তখন বুড়ো হাতুড়ে বাজারে বাজারের উঁচু সান বাঁধানো বেদীতে বসে জিজ্ঞেস করলেন “কাটতে কতো নেবেন গো পিসিমা?”
মাছকুটুনি বালিকা মাছ কুটতে কুটতে উত্তর দিলো “ছোটো মাছ দশ ট্যাকা, বড়ো মাছ পাঁচ”
হাতুড়ে বুড়ো থলিটা এগিয়ে দিলেন। ওতে আছে তিনশো গ্রাম কচুর লতি। ওনার কোমরে বড্ড ব্যথা। নিচু হতে পারছেন না তাই মাছকুটুনির সাহায্যপ্রার্থী। কচু দেখে বালিকা ভয়ানক আপত্তি করবে কিনা ভাবছিলেন। কেননা লতি কুটোনোর কথা ওনাকে কেউ বলেনি। তবে অবশেষে কেটে দেবেন বললেন, এরপর আছে লতি সেদ্ধ করা, তারপর রান্না। ব্যথার কথা খেয়াল থাকলে ওনার লতি কেনার মতি থাকতো না।
এমন সময় হীরুডাকাত এসে এক প্যাকেট কুচো চিংড়ি দিয়ে চলে গেলো “চিংড়ি দিয়ে কচুর লতি ভালো হবে, হাতুড়েবাবু।” হীরু হলেন বিখ্যাত মাছওয়ালা । তিনি সোচ্চারে হীরুডাকাত বলেই নিজের পরিচয় জানান দেন। কিন্তু হঠাৎ চিংড়িমাছ কেনো?
তাহলে গপ্পোটা প্রথম থেকেই শুরু করা যাক সিনেমার ভাষায় যাকে বলে ফ্ল্যাশ ব্যাক।
দিন কয়েক আগের কথা। হাতুড়েবুড়ো ভোলার চায়ের দোকানে বসে কাগজের কাপে চা পীচ্ছেন। এমন সময়ে ভুঁড়ির ওপরে দুহাত জোড় করে হীরুডাকাত এসে হাজির। ওনার নব্বুই উত্তীর্ণা মাতৃদেবী ভয়ানক অসুস্থ। ভুলভাল কথাবার্তা বলছেন, মানুষজন চিনতে পারছেন না, বাথরুম পায়খানার কোনও কন্ট্রোল নেই। এবং তিনদিন ধরে খাওয়া দাওয়াও বন্ধ। এখন যদি হাতুড়েবাবু কিছু……
হাতুড়ে প্রচুর ভাবলেন। কি কি ওষুধ খাচ্ছেন সেটা জানতে প্রচুর ফোনাফুনি হলো। প্রচুর তাম্রকূট, কৃষ্ণ কৃষ্ণ চা পান সবই হলো, ইতিমধ্যে চিন্তাণ্বিত হাতুড়ের চারপাশে বাজাড়ু জনগণ ভীড় জমিয়েছেন। ভোলা পরোটা ছেড়ে ভিড়ভাট্টায় চা বিক্রিতে ব্যস্ত। পরোটাখোররা বলা বাহুল্য বিশেষ উত্তেজিত। অবশেষে হাতুড়ে বললেন “হুম।”
হীরুডাকাত ওমনি ওনার ঠোঁটের সামনে একটা সিগারেট এগিয়ে দিলেন, ভোলার পুত্র তাপসকুমার দিয়াশলাইয়ের কাঠিতে আগুন ধরিয়ে ওনার মুখাগ্নি করে দিলো।
হাতুড়ে বললেন “সোডিয়াম পটাশিয়াম”
হীরুডাকাত বললেন “সেটা কি জিনিস হাতুড়েবাবু?”
“ল্যাবরেটরিতে ফোন করুন”
ফোন হলো। হাতুড়ে সোডিয়াম পটাশিয়াম, রুটিন রক্ত আর ইউরিনের রুটিন টেস্ট করতে হুকুম দিলেন।
সমবেত মানুষদের মধ্যে খুঁৎখুঁতে চট্টরাজবাবু বললেন “এগুলো কেনো?”
হাতুড়ে ধূমুদগীরণ করে বললেন “প্রয়োজন আছে”
“আরে জটপ্যাঁচানী হাতুড়েবাবু, একটু তো বুঝিয়ে বলুন” চট্টরাজের চটজলদি উত্তর।
ভোলা একটা বিস্কুট এগিয়ে দিলো। হাতুড়ে প্রশ্ন করলেন “আমাদের মাসল, হার্ট এসব কোন শক্তিতে চলে?”
এক ছোকরা ভীড় দেখে উৎসুকভাবে উঁকিঝুঁকি দিচ্ছিল, বললো “খাবারের শক্তিতে”
হাতুড়ে ঘাড় নেড়ে বললেন “হয়নি হয়নি ফেল”
ছোকরা বোধহয় বিখ্যাত কেউ হবে তাই এবার বাকিরা বললো “তাহলে কিসে? তাহলে কিসে?”
হাতুড়েবাবু বিস্কুট মুখে পুরে বললেন “বিদ্যুৎ শক্তিতে”
জনগণ পুরো ত থ দ ধ ন হয়ে গেলো। “বিদ্যুৎ? বলো কি হে তুমি, হাতুড়ে? সিইএসসি না এসইবি? এসি না ডিসি?” বিষ্মিত তারিণীখুড়োর বিষাক্ত প্রশ্ন।
হাতুড়ে হাসে। এ হাসি আগে কেবলমাত্র বনমালী নস্কর লেনে পাওয়া যেতো। “আজ্ঞে না ঐ ইলেকট্রোলাইটস– ওরা চার্জড পার্টিকল বা বিদ্যুতাণ্বিত পদার্থ। এদের কিছু কোষের বাইরে রক্তে মিশে ঘুরে বেড়ায়– আবার কিছু থাকে কোষের মধ্যে। এমনভাবে থাকে যাতে একটা বিশেষ মাত্রায় বিদ্যুৎ দেহকোষে সবসময় বজায় থাকে। যেই মাত্র নার্ভ গিয়ে হার্ট বা মাসলকে কাজ শুরু করতে বলে সেই খন্ড মুহূর্তে (স্প্লিট সেকেন্ড বা মিলি সেকেন্ডে) ঐ সব বিদ্যুতাণ্বিত পদার্থগুলো সব জায়গা বদল করে। বাইরের গুলো ভেতরে চলে যায় এবং ভেতরের গুলো বাইরে, ফলে দেহকোষের ভেতরে প্রয়োজনীয় বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু হয়ে যায়। ব্যস শুরু হয়ে যায় হার্ট ফুসফুস মাসলের কাজকর্ম। ধুকধুক ফুসফুস মাসলের কাজ”
হে সুন্দরী পাঠিকা বিশ্বাস করুন এই অবধি বলতেই ভোলাবাবু হাতুড়ের সামনে একটা প্লেটে করে দুটো পরোটা, একটা ডিম সেদ্ধ আর আলুর তরকারি নামিয়ে দিয়ে গেছিলেন। এ্যাকেবারে ফ্রি মানে মিনি মাগনা ।
তারিণীখুড়ো কিন্তু সন্তুষ্ট নন। “মানলাম আমাদের শরীরের ভেতরে সবসময় এ্যাতো জটিল ব্যাপার স্যাপার চলছে। সত্যিই না বুঝলে এসব বোঝা যায় না। তবে সোডিয়াম পটাশিয়ামের সঙ্গে রক্ত আর পেচ্ছাপ পরীক্ষা কেনো করতে দিলে হে তুমি? কমিশন টমিশন আছে নাকি?”
হাতুড়ে নির্মল আনন্দে হাসেন। “হা হা হা হা হা হা হা হা হা হা হা হা হা হা হা হা হা হা হা হা …. বয়সকালে সামান্য ইনফেকশন হলেই এইসব সোডিয়াম টোডিয়াম হুশ হুশ করে কমে যায় বিশেষতঃ ইউরিন ইনফেকশন হলে, সেটা না জানলে তো ঐসব সোডিয়ামরা কমতেই থাকবে তারপর এক সময় হার্ট বন্ধ হয়ে বুড়ি যদি পটল তোলে হীরুডাকাত আমায় মেরে পাটপাট করে দেবে না?”
ভোলাবাবু হাতুড়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন “হাতুড়েদা আপনি পরে হাসবেন, এখন পরোটা খান”
ও হ্যাঁ, হীরুডাকাতের মা ভালো আছেন, তাই আজ কুচো চিংড়ির ভোজ। এটা আবার কোমরে ব্যথা নিয়ে আগে ভাজতে হবে। হাতুড়ে গজগজ করতে করতে বাড়ি ফেরেন।
এর জন্য কি ওষুধ সেবন করা উচিত?
ওটা হাতুড়ের কম্ম নয় । আপনার ডাক্তারবাবু বলবেন ।
Darun likhechhen. Moja pelam.
এতো ভালো করে বোঝানো অনেকদিন পরে দেখলাম। চমৎকার লাগলো। কিছু ছিল, কিছু তো বাড়ল।
অনেক অনেক ধন্যবাদ
মমতাদেবী উৎসাহ পেলাম । চেষ্টা থাকবে এই রকম লেখার ।