সুশ্রুত-সংহিতা – সূত্রস্থান (৩য় অধ্যায়)
৩য় অধ্যায়ের শিরোনাম “অধ্যয়ন-সম্প্রদানীয়” অধ্যায়। এরপরে সূত্রস্থানে যেসমস্ত বিষয় নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে তার (মোট অধ্যায় সংখ্যা ৪৬টি) বিবরণ দেওয়া হয়েছে। নিদানস্থান-এর মোট অধ্যায় সংখ্যা ১৬টি। শারীরস্থান-এর ১০টি। চিকিৎসাস্থান-এর ৪০টি। কল্পস্থান-এর ৮টি। উত্তরতন্ত্র-র অন্তর্ভুক্ত “ঔপদ্রবিক”-সংক্রান্ত (dealing with complications) অধ্যায় সংখ্যা ২৬টি। এই ২৬টি অধ্যায় আবার পূর্বোক্ত শালাক্যতন্ত্র-র (supraclavicular diseases) অন্তর্ভুক্ত। কুমারতন্ত্র বা কৌমারভৃত্য-র (the treatment of women during pregnancy, delivery and the puerperium, coupled with pediatrics) অধ্যায়ের সংখ্যা ২৭ থেকে ৩৮, অর্থাৎ মোট ১২টি। কায়চিকিৎসা-র অধ্যায় সংখ্যা ৩৯ থেকে ৫৯, অর্থাৎ মোট ২১টি। ভূতবিদ্যা-র (demonology) অধ্যায় সংখ্যা ৬০ থেকে ৬২, অর্থাৎ মোট ৩টি। অধ্যায় ৬৩ থেকে ৬৬ – মোট ৪টি – এই অধ্যায়ের অলঙ্করণ বলা যেতে পারে। বহুধরনের সন্নিবেশের দরুন উত্তরতন্ত্রের শ্রেষ্ঠত্ব আছে বলে ঋষিরা একে উত্তরতন্ত্র বলা হয়েছে, এবং এই অংশ সংহিতার পরিশিষ্ট বলেও একে উত্তর শব্দে অভিহিত করা যায় (উত্তর শব্দে শ্রেষ্ঠ ও পরিশিষ্ট)। (৩.৪-৪৬)[1]
যা বলা হল এসমস্ত বিষয় “অবশ্যপাঠ্য। এবং এগুলো অধ্যয়ন করার পরে চিকিৎসা অভ্যাস করা উচিত। শাস্ত্র ও চিকিৎসা উভয় বিষয়ে জ্ঞান থাকলে চিকিৎসক রাজযোগ্য (fit to serve the king) হয়ে থাকেন।” (৩.৪৭)
“যে ব্যক্তি কেবল শাস্ত্রজ্ঞ এবং ক্রিয়াকুশলী নন, ভীরু ব্যক্তি যুদ্ধে গমন করে যেরকম ইতিকর্তব্যবিমূঢ় হয়, সে ব্যক্তিও সেরকম রোগীর কাছে গিয়ে মুগ্ধ (confused) হয়ে থাকে।
যে ব্যক্তি কেবল ক্রিয়াকুশল এবং ধৃষ্টতাবশতঃ শাস্ত্রজ্ঞান উপার্জন করেনা, সে সাধুদের কাছ থেকে সমাদর পায়না, এমন কি রাজার বধযোগ্য হতে পারে।
উক্ত দুধরনের চিকিৎসকই অনিপুণ ও নিজের কাজে অক্ষম হয়ে থাকে। এদের উভয়কেই অর্দ্ধশিক্ষিত বলা যায়। উভয়েই একটি পাখা-বিশিষ্ট পাখীর মতো উড়তে অসমর্থ হয়।” (৩.৪৮-৫০)
এরপরে বিশেষ জোর দিয়ে বলা হয়েছে – “যে কুবৈদ্য ছেদন (excision) ও স্নেহন (unction) ইত্যাদি কাজে অনভিজ্ঞ, সে লোভবশতঃ মানুষ হত্যা করে থাকে। এরকম ক্ষেত্রে রাজা দোষী (কেননা তাঁর অনবধানতবশতই এরকম লোকে চিকিৎসা করতে পারে।” (৩.৫২)
এটুকু পাঠের পরে আমরা ৪টি বিষয় ভেবে দেখবো – (১) আজ থেকে অন্তত ২০০০ বছর আগেও কুবৈদ্যের চিকিৎসক হিসেবে একটি বাস্তব অস্তিত্ব ছিল, (২) এদের সঙ্গে উপযুক্ত প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত বৈদ্যদের বিরোধ খুব প্রকটভাবে প্রকাশিত, (৩) রাজার অনুমোদন তথা বর্তমান সময়ের রেজিস্ট্রেশন তথা লাইসেন্স-এর একটি আদিরূপ (যেকোন চেহারায়) পেশাগতভাবে চিকিৎসকদের অবশ্যই দেওয়া হত, এবং (৪) কুবৈদ্য (তথা আজকের পরিভাষায় quacks) সমাজে বিদ্যমান ছিল রাজার দোষে – রাজার উপযুক্ত নজরদারির অভাবে।
এ প্রসঙ্গে ১৯ শতকের ইংল্যান্ডের তুলনীয় চিত্র উল্লেখ করা যায়। সুখ্যাত আধুনিক ইংরেজ কবি রবার্ট সাদি ১৮১৪ সালে লিখছেন – “quackery is carried to greater perfections of villainy here than in any other part of the world. Sickness humbles the pride of man; it forces upon him a sense of his own weakness, and teaches him to feel his dependence upon unseen Powers: that therefore which makes wise men devout, makes the ignorant superstitious.”[2] পরে বলছেন – “The abracadabra of the old heretics was lately in use as a charm for the ague, and probably still is where ague is to be found, for that disease has almost wholly disappeared within the last generation. For warts there are manifold charms.”[3]
পুর্বোক্ত সুশ্রুত-সংহিতা-য় আলোচিত রাজার “অনবধানবশতঃ”-র তুল্য ইংল্যান্ডের সরকারের তীক্ষ্ণ সমালোচনা করছেন সাদি – “Government gives an indirect sort of sanction to these worst of all impostors. They enter the receipt of their medicines as a discovery, and for the payment of about 100/. sterling, take out a privilege, which is here called a patent, prohibiting all other persons from compounding the same…”[4]
এখানে আরেকটি প্রসঙ্গের অবতারণা করা যায়। প্রাচীন গ্রিক মেডিসিন বিশেষজ্ঞ লুডভিগ এডেলস্টাইন তাঁর গবেষণাসমৃদ্ধ গ্রন্থে দেখিয়েছেন যে, হিপোক্রেটিসের সময়েও গ্রিসে ছাত্ররা “take an oath before they are allowed to participate in the course of studies.”[5]
এমন কি ডাক্তারদের ফিজ-এর ব্যাপারেও এডেলস্টাইন-এর মন্তব্য – “The physician’s fee is, therefore, a source of worry for the patient because he may leave if he does not receive sufficient remuneration. The physician should learn not to charge very much when the patient is unable to pay; he should see his reward in his patient’s gratitude and in the reputation he gains for also treating the poor.”[6]
ফিজ-এর ক্ষেত্রে না হলেও এর সঙ্গে কিছু সাদৃশ্য আমরা চরক এবং সুশ্রুতেও দেখতে পাব। আরেকটি বিষয় হল, যেভাবে চিকিৎসকের ফিজের কথা বিবৃত হয়েছে প্রাচীন গ্রিসে, স্পষ্ট করে বলা না হলেও এ থেকে অনুমান করা যায়, সম্ভবত ফিজ-এর ব্যাপারটি “in cash”-এ ছিল, প্রাচীন সমাজে সচরাচর চালু “in kind”-এর পরিবর্তে।
আমরা আবার আলোচিতব্য ৩য় অধ্যায়ে ফিরে আসি। এ অধ্যায় থেকে বোজাহ যায় যে, শিক্ষার ব্যাপারে যথেষ্ট কঠোর এবং rigorous একটি শিক্ষাক্রম অনুসরণ করা হত – “ছাত্র শুচি হয়ে, উত্তরীয় ধারণ করে, অধ্যয়নকালে অনাকুল (unagitated) চিত্তে উপস্থিত হলে গুরু তাকে ছাত্রের ক্ষমতা অনুযায়ী একপদ বা এক শ্লোক করে ক্রমে করমে পড়িয়ে যাবেন। সেইসব পদ ও শ্লোক ক্রমে যোজনা করতে হবে। এভাবে শিষ্যদেরকে একে একে পাঠ করাতে হবে এবং গুরুকে নিজেও শিষ্যের পেছন পেছন পাঠ করে যেতে হবে। অদ্রুত, অবিলম্বিত (unhesitated), অশঙ্কিত ও অননুনাসিক স্বরে (without nasal pronunciation) অক্ষরগুলি স্পষ্ট স্পষ্ট করে, বর্ণগুলি ব্যক্ত করে, চোখ, ভ্রূ, ওষ্ঠ ও হাত দিয়ে অভিনয় না করে সাধুভাষায় অনতি উচ্চ ও অনতি নীচ স্বরে পাঠ করবে। অধ্যয়নকালে গুরু-শিষ্যের মধ্য দিয়ে কেউ গমন করবেন না।” (৩.৫৪)
যখন লিপির ব্যবহার নেই, লেখ্য কোন রূপ নেই, সেসময়ে সম্পূর্ণ শ্রুতি-নির্ভর এরকম শিক্ষাদানের পদ্ধতি oral transmission-এর ক্ষেত্রে প্রায়-সম্পূর্ণ foolproof ছিল, একথা আজ মেনে নিতে কোন অসুবিধে হবার কথা নয়।
চতুর্থ ও ৫ম অধ্যায়
চতুর্থ অধ্যায়ের শিরোনাম “প্রভাষণীয় অধ্যায়”।
মিউলেনবেল্ডের কথায় – “is about the importance of correctly understanding the text of the treatise and its terminology. The textbook called Aupadhenava (ঔপধেনব), Aurabhra (উরভ্র), Sauśruta (সুশ্রুত) and Pauṣkalāvata (পুষ্কলাবত) are mentioned as the basic surgical treatises.”[7]
বলা হয়েছে – “অধীত শাস্ত্রের অর্থ ধারণ করতে না পারলে গর্দ্দভের চন্দনকাষ্ঠের ভার ধারণের মতো অনর্থক পরিশ্রমকর হয়।” (৪.৪)
আরও গুরুত্বপূর্ণ উপদেশ হল – “একটি শাস্ত্র পাঠ করলেই শাস্ত্রের অর্থ নির্ণয় করা যায় না। এজন্য বহুবিদ্য চিকিৎসকই শাস্ত্রজ্ঞানে সমর্থ হয়ে থাকেন।
যে বৈদ্য গুরুমুখোচ্চারিত (পূর্ব্বকালে শাস্ত্রসমূহ ‘লিখিত’ না থাকাতে গুরুমুখোচ্চারিত বলা হয়েছে[8]) শাস্ত্র বার বার উপাসনা করে কাজে প্রবৃত্ত হন, তিনিই বৈদ্য। অন্যপ্রকারের বৈদ্যকে তস্কর বলা যায়।” (৪.৭-৮)
৫ম অধ্যায়ের শিরোনাম “অগ্রোপহরণীয় অধ্যায়” – “সর্ব্বকর্ম্মের আগে যন্ত্রাদির আহরণ করতে হয় বলে যন্ত্রাদিকে অগ্র-উপহরণ বলা যায়। এই অধ্যায়ে যন্ত্রাদি সম্পর্কে উপদেশ দেওয়া হচ্ছে”[9] মিউলেনবেল্ড বলছেন এই অধ্যায় “is concerned with the arrangements preliminary to surgical interventions.”[10]
“কর্ম্ম অর্থাৎ চিকিৎসা তিনপ্রকার (৩টি ধাপ) – পূর্ব্বকর্ম্ম (preliminary measures), প্রধানকর্ম্ম (principal measures) এবং পশ্চাৎকর্ম্ম (after-treatments)।” (৫.৩)
“শস্ত্রকর্ম্ম ৮ প্রকার – ছেদন (excision), ভেদন (incision), লেখন (scarification or scraping), বেধন (puncturing), এষণ (probing), আহরণ (extraction), বিস্রাবণ (drainage) এবং সীবন (uturing)। (৫.৫)
এই ৮ প্রকার কর্ম্মের মধ্যে যে কোন কর্ম্ম করতে হলেই এই সব আয়োজন আবশ্যক হয় – যন্ত্র (blunt instruments), শস্ত্র (sharp instruments), ক্ষার (caustic alkali), অগ্নি (cautery), শলাকা (rod/probe), শৃঙ্গ (specific bloodletting technique using a horn), জলৌকা (leeches), অলাবু (gourd), জাম্ববৌষ্ঠ (a pencil rod made of black stone and having a tip like rose apple or water apple•[11]), পিচু (তুলা), প্রোত (বস্ত্রখণ্ড বা bandage), সূত্র (সুতো), পত্র (পাতা), পট্ট (পটী বা পট্টবস্ত্র), মধু, ঘৃত, বসা (muscle fat), দুগ্ধ, তৈল, তর্পণ (saturating liquid), কষায় (ক্কাথ বা decoction), আলেপন (প্রলেপ), কল্ক (a herbal paste or bolus, prepared by grinding fresh or dried herbs into a paste with water), ব্যজন (পাখা), শীতলজল, উষ্ণজল, ও কটাহ (frying pan) এবং স্নিগ্ধ, স্থির ও বলবান পরিচারকগণও কাছে থাকা আবশ্যক।” (৫.৬)
(জাম্বু ফল)
“চিকিৎসকগণ পশ্চিমমুখে বসবেন, পরে শস্ত্রচালনা করবেন। মর্ম্ম, শিরা, স্নায়ু, সন্ধি, অস্থি ও ধমনীতে যেন না লাগে, যেন শস্ত্র অনুলোমভাবে (signifies a direction that promotes movement or action along the natural flow) প্রয়োগ করা হয়। যে পর্যন্ত পূষ (pus) দর্শন না হয় সে পর্যন্ত শস্ত্র প্রবেশ করাবে। শস্ত্র তুলবার সময় একেবারে টেনে তুলবে এবং দ্রুত তুলে নেবে। ব্রণের পাক গভীর হলেও রোগীর আঙ্গুলের দুই আঙ্গুল বা তিন আঙ্গুলের বেশি গভীরে যাওয়া যাবেনা।” (৫.৭)
এরপরে সঠিক ও উপযুক্ত ভেদন-এর বর্ণনা করা হয়েছে। (৫.৮-৯) “শৌর্য্য, আশুক্রিয়া (ক্ষিপ্রতা), শস্ত্রের তীক্ষ্ণতা, অস্বেদ (না ঘামা), অবেপথু (না কাঁপা), অসম্মোহ (ইতিকর্তব্য বিমূঢ় না হওয়া) – এই কয়েকটি গুণ শস্ত্রকর্ম্মকালে বৈদ্যের আবশ্যক।” (৫.১০)
মিউলেনবেল্ডের সারানুবাদে – “the proper way of making a counter-incision (in order to assure complete drainage) (5.11) or multiple incisions (5.12)”-এর কথা বলা হয়েছে।[12] এবং “Pre- and post-operative measures are discussed (5.16-17), followed by fumigation (ধূপন: ৫.১৮), and protective mantras to be used in a ritual called rakṣākarman (রক্ষাকর্ম) (5.19-33). The remaining part of the chapter is devoted to after-treatment, in particular wound dressing and the change of dressings (5.3-42).”[13]
পরবর্তী নির্বাচিত অধ্যায়সমূহ
৬ষ্ঠ অধ্যায়ের শিরোনাম “ঋতুচর্যা” – (যে ঋতুতে যেরকম আচরণ করতে হয়, সে বিষয়ে)। (৬.১)
এই অধ্যায়ের উল্লেখযোগ্য হল, অধ্যায়ের শুরুতেই সময়ের বিভিন্ন পরিমাপ দেওয়া – অক্ষিনিমেষ (একটি লঘু অক্ষর, যেমন ‘ক’, উচ্চারণ করতে যতটুকু সময় লাগে), ১৫ নিমেষে ১ কাষ্ঠা হয়, ৩০ কাষ্ঠায় ১ কলা হয়, ২০ কলা এবং ৩ কাষ্ঠায় ১ মুহূর্ত হয়, ৩০ মুহূর্তে ১ অহোরাত্র হয়, ১৫ অহোরাত্রে ১ পক্ষ হয়। পক্ষ ২ রকমের – শুক্ল ও কৃষ্ণ। ২ পক্ষে ১ মাস হয়। (৬.৪-৫)[14]
১২ মাসের তথা ১ সংবৎসরের সূচনা হয় মাঘ মাস দিয়ে। ২ মাসে ১ ঋতু হয়, সেজন্য ৬ ঋতু। মাঘ (তাপস) এবং ফাল্গুন (তপস্যা) – এই ২ মাস শিশির। চৈত্র (মধু) এবং বৈশাখ (মাধব) মিলে বসন্ত। জ্যেষ্ঠ (শুচি) এবং আষাঢ় (শুক্র) – ২ মাস মিলে গ্রীষ্ম। শ্রাবণ (নভঃ) ও ভাদ্র (নভস্য) মিলে বর্ষা। আশ্বিন (ইষ) ও কার্তিক (ঊর্জ্জ) মিলে শরৎ। অগ্রহায়ন (সহঃ) এবং পৌষ (সহস্য) – এই ২ মাস মিলে হেমন্ত। (৬.৬)
মিউলেনবেল্ডের সারানুবাদে – “the moon and the corresponding tastes are strong during during the dakṣināyaṇa, the sun and the corresponding tastes during the uttarāyaṇa (6.7-8). The two ayanyas together make one year; five years make one yuga. Some refer to this whole series of division of time as the kālacakra (wheel of time) (6.9).”[15]
শেষে বলা হয়েছে – “ঋতুসমূহ স্ব স্ব গুণে অতিযুক্ত হলে (aggravated) বা বিষম হলে (perverted) প্রাণীদের বাত, পিত্ত, কফ কুপিত হয়।
রোগ উৎপন্ন হবার আগেই সংশোধনের সাহায্যে বসন্তে শ্লেষ্মা ও শরৎকালে পিত্ত হরণ করবে। আর বর্ষাকালে বায়ু হরণ করবে।” (৬.৩৬-৩৭)
৭ম অধ্যায় “যন্ত্রবিধি অধ্যায়”। এখানে যন্ত্রের (blunt instruments) বিভিন্ন প্রকরণ, যন্ত্রের সঠিক ব্যবহার, শরীর থেকে শল্যকে (1. A spear, javelin, dart. 2. An arrow, a shaft. 3. A thorn, splinter. 4. Any extraneous substance lodged in the body and giving it very great pain[16]) সুচারুভাবে আহরণ (extraction) করার পদ্ধতি বিস্তৃতভাবে বিবৃত হয়েছে।
গোড়াতেই একটি গুরুত্বপূর্ণ উপদেশ দেওয়া হয়েছে এই অধ্যায়ে – “যন্ত্র ১০৮টি। এর মধ্যে হাত-ই প্রধানতম যন্ত্র বলে জানবে, কারণ অন্যান্য যন্ত্রের কাজ হাতেরই অধীন।” (৭.৩) একথা আজও সমানভাবে সত্যি, এমনকি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা AI আসার পরেও।
“শরীরের ও মনের বাধাজনক (আবাধ) দ্রব্যসমূহকে শল্য বলা হয়। ঐ সকল শল্য উদ্ধার করার যে উপায় তাদেরকে যন্ত্র বলে।” (৭.৪)
মিউলেনবেল্ডের কথায় – “The yantras are of six types: svastimukh (স্বস্তিমুখ – cruciform), saṃdaśayantra (সংদংশজাতীয় – pincer-like), tālayantra (তালযন্ত্র – picklock-like or spoon-shaped), nāḍīyantra (নাড়ীযন্ত্র – tubular), śalākāyantra (শলাকাযন্ত্র – rod-like), and upayantra (উপযন্ত্র – accessory instruments) (7.5)”[17]
এই ৬ রকমের যন্ত্রের আবার ভাগ আছে। স্বস্তিকযন্ত্র ২৪ রকমের। সংদংশযন্ত্র ২ রকমের, তালযন্ত্র ২ রকমের, নাড়ীযন্ত্র ২০ ধরনের, শলাকাযন্ত্র ২৮ রকমের এবং উপযন্ত্র ২৫ রকমের। (৭.৬)
সাধারণভাবে এই যন্ত্রগুলি লোহার তৈরি। যদি লোহার অভাব ঘটে তাহলে লোহার মতো চরিত্রের ও রূপের অন্যান্য দ্রব্য দিয়ে নির্মিত হতে পারে। (৭.৭।)
“যন্ত্রগুলির মুখ সিংহের মতো নানারকম হিংস্র জন্তু ও মৃগ-পক্ষীর মুখের মতো কল্পনা করা হয়। এজন্য ঐসব জন্তুর মুখ বললেই যন্ত্রগুলো নির্মাণ করা যেতে পারে। এছাড়া শাস্ত্র, উপদেশ, অন্য যন্ত্র দেখে ও যুক্তির সাহায্যেও তৈরি করা হয়।” (৭.৮)
“যন্ত্রসমূহ সম্যকভাবে তৈরি হওয়া এবং অবস্থা অনুযায়ী খরমুখ (rough) বা মসৃণমুখ (smooth) হওয়া আবশ্যক। যন্ত্ররা যেন সুদৃঢ় হয়, দেখতে সুন্দর হয়, এবং যেন ভালোভাবে ধরতে (grip) পারা যায়।” (৭.৯)
এরপরে যন্ত্রগুলোর বিস্তারিত বিবরণ রয়েছে, যা, আমার বিচারে, আজকের পাঠককুলের জন্য যথেষ্ট প্রয়োজনীয় নয়। তবে কিছু প্রাসঙ্গিক অংশ উদ্ধৃত করছি।
“২ রকমের তালযন্ত্রই ১২ আঙ্গুল। একরকমের তালযন্ত্র দ্বিতালক (two blades), অন্যপ্রকার একতালক (one blade)। এরা কান, নাক ও নাড়ীর ভেতর থেকে শল্য উদ্ধার করে।” (৭.১২)
এছাড়া অন্য যন্ত্রগুলোর এবং উপযন্ত্রগুলোর বিবরণ রয়েছে। এরপরে ব্যাখ্যা করা হয়েছে যন্ত্রের কাজ ২৪ প্রকারঃ নির্ঘাতন (wrenching out), পূরণ (filling, with oil, et.), বন্ধন (bandaging), ব্যূহন (retraction), বর্ত্তন (approximation), চালন (displacement), বিবর্ত্তন (turning around), বিবরণ (dilatation), পীড়ন (squeezing), মার্গশোধন (cleaning passages), বিকর্ষণ (loosening), আহরণ (extraction), আঞ্ছন (traction), উন্নমন (elevation), বিনমন (depression), ভঞ্জন (breaking), উন্মথন (stirring with a probe), আচূষণ (suction), এষণ (probing), ঋজুকরণ (straightening), বিদারণ (splitting), প্রক্ষালন (irrigation), প্রধমন (insufflations), এবং প্রমার্জন (mopping up)। (৭.১৭)
যন্ত্রের বিভিন্ন ত্রুটি নিয়েও আলোচনা করা হয়েছে – “যন্ত্রদোষ ১২ প্রকার – অতিস্থূল (too thick), অতিদীর্ঘ, অতিহ্রস্ব, অগ্রাহী (শল্যকে ধরতে পারে না), বিষমগ্রাহী (শল্যের একদিক মাত্র ধরতে পারে), বক্র, শিথিল (আলগা), অত্যুন্নত (too elevated), মৃদুকীল (যার খিল নরম বা আল্গা হয়েছে), মৃদুমুখ (যার মুখ দৃঢ় নয়), ও মৃদুপাশ (যার দাঁড় নরম বা আলগা)।” (৭.১৯) কঙ্কমুখ (স্বস্তিকযন্ত্রের একটি) যন্ত্রকে যন্ত্রের মধ্যে শ্রেষ্ঠ বলা হয়েছে।(৭.২১)
৮ম অধ্যায়ের শিরোনাম “শস্ত্রাবচরণীয় অধ্যায়” – যেভাবে শস্ত্র (sharp instruments) চালনা করতে হয় সে সম্বন্ধীয়।
২০ প্রকার শস্ত্র রয়েছে – মণ্ডলাগ্র (circular head), করপত্র (saw), বৃদ্ধিপত্র (scalpel), নখশস্ত্র (nail-parer), মুদ্রিকা (ring knife), উৎপলপত্র (lancet), অর্ধধার (single-edged knife), সূচী (suturing needle), কুশপত্র (bistoury), আটীমুখ[18] (আটী-bill scissors), শরারিমুখ (শরারি[19]-bill scissors), অন্তর্মুখ (curved bistoury), ত্রিকুর্চক (three-edged knife), কুঠারিকা (chisel), ব্রীহিমুখ (trocar), আরা (awl – একটি ছোট, ধারালো যন্ত্র যা চামড়া বা কাপড়ে ছিদ্র করার জন্য ব্যবহৃত হয়। এছাড়াও, এটিকে “সূচি”, “কাঁটা”, বা “বেধনিকা” ও বলা যেতে পারে), বেতসপত্রক (a kind of scalpel), বড়িশ (a sharp hook), দন্তশঙ্কু (tooth-scaler) এবং এষণী (a sharp probe)। (৮.৩)
(আটী ও শরারি পাখির ছবি)
মণ্ডলাগ্র এবং করপত্র ব্যবহৃত হয় ছেদন (excision) এবং লেখন (scarification, scraping)-এর জন্য, বৃদ্ধিপত্র, নখশস্ত্র, মুদ্রিকা, উৎপলপত্র এবং অর্ধধার ব্যবহৃত হয় ছেদন এবং ভেদন (incision)-এর জন্য, সূচী, কুশপত্র, আটীমুখ, শরারিমুখ, অন্তর্মুখ এবং ত্রিকুর্চক ব্যবহৃত হয় বিস্রাবণ (drainage)-এর জন্য, কুঠারিকা, ব্রীহিমুখ, আরা, বেতসপত্রক এবং সূচী ব্যবহৃত হয় ব্যধন (puncturing)-এর জন্য, বড়িশ এবং দন্তশঙ্কু ব্যবহৃত হয় আহরণ (extraction)-এর জন্য, এষণী ব্যবহৃত হয় এষণ (probing)-এর জন্য, এবং আনুলোম্য (In the direction of the hair, produced in natural or direct order[20]) এবং সূচী ব্যবহৃত হয় সীবন (suturing)-এর জন্য। এভাবে ৮ রকমের কাজে শস্ত্রসমূহের ব্যবহার ব্যাখ্যাত হয়েছে। (৮.৪)
এরপরে শেখানো হয়েছে কীভাবে শস্ত্র ধরতে এবং চালনা করতে হয় (৮.৫), এদের নামকরণ যেভাবে করা হয়েছে (৮.৬), এদের আয়তন ও মাপ (৮.৭), এবং এদের গুণাগুণ বলা হয়েছে (৮.৮)।
শস্ত্রের ৮ প্রকার দোষ বলা হয়েছে – বক্র, কুণ্ঠ (ভোতা), খণ্ড (ভাঙ্গা), খরধার (যার ধার খরখরে), অতিস্থুল, অতিসূক্ষ্ম, অতিদীর্ঘ এবং অতিক্ষদ্র। বলা হয়েছে করপত্র (saw) খরধার হওয়া উচিত কারণ এর সাহায্যে অস্থি ছেদন করতে হয়। (৮.৯)
শস্ত্রসমূহের পায়না (পান – tempering) ৩ প্রকার – ক্ষারদ্বারা (caustics), জলদ্বারা এবং তেলদ্বারা। যেসব শস্ত্র দিয়ে মাংস ছেদন, ভেদন ও উৎপাটন করতে হয়, তাদের পান (tempering) জলে হওয়া উচিত। শিরাব্যধন ও স্নায়ু ছেদন শস্ত্রসমূহের পান তেলে হওয়া উচিত। (৮.১২)
মিউলেনবেল্ড জানাচ্ছেন – “Ṥastras should be sharpened with a smooth stone (ślakśṇaśila – শ্লক্ষ্ণশিলা), their edges should be smoothened with a piece (phalaka) of śālmalī (শিমূল) wood (8.13).”[21] শ্লক্ষ্ণশিলা-র[22] বর্ণ মাষকলায়ের মতো।
এই অধ্যায়ের শেষে বলা হচ্ছে – “বৈদ্য নিজের বুদ্ধি প্রয়োগ করে প্রয়োজন্মতো শস্ত্রসমূহ বিশুদ্ধ লোহা (আয়স) দিয়ে উপকরণসম্পন্ন কাজে নিপুণ কর্মকারকে দিয়ে তৈরি করাবেন।” (৮.১৯খ-ছ)
“যে বৈদ্য শস্ত্র প্রয়োগ করতে জানেন, তাহার সিদ্ধিলাভ হয়। সেজন্য শস্ত্র প্রয়োগে সবসময় অভ্যাস থাকা প্রয়োজন।” (৮.২০)
সুশ্রুত-সংহিতা-য় (এবং চরক-সংহিতা-য়, আমি বাগভটের আলোচনা করছিনা) ধাপে ধাপে একজন শিক্ষার্থীকে সহজ থেকে কঠিনতর এবং শাস্ত্রের তত্ত্বকথা থেকে চিকিৎসার জগতে ব্যবহারিক প্রয়োগে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। এখানে আমরা অধ্যায়গুলো অনুসরণ করলে দেখতে পাবো, যন্ত্র, শস্ত্র ইত্যাদি বিভিন্ন সার্জারির “ইন্সট্রুমেন্ট” এবং পদ্ধতির কথা তাত্ত্বিকভাবে বলা হয়েছে। তার পরবর্তীতে বলা হয়েছে কীভাবে এবং কোথায় ও কখন এদের ব্যবহার করতে হবে। এভাবে শিক্ষাদানেরর প্রতিটি ধাপ গুরুত্বপূর্ণ।
প্রতিটি ধাপেই বলা হয়েছে – (১) গুরুশিক্ষা এবং ব্যবহারিক প্রয়োগের মধ্যে সামঞ্জস্যবিধান করতে হবে, (২) প্রতিক্ষেত্রে রোগীর অবস্থান, দেহের শক্তি ও গঠন, রোগী কীভাবে দিনচর্যা এবং ঋতুচর্যা করে, ইত্যাদি বিষয়গুলোকে সম্যকভাবে অনুধাবন করতে হবে, (৩) “নিজের বুদ্ধি চালনা”-র ওপরে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে, (৪) সমস্ত পরিমাপ এবং ওষুধ ও চিকিৎসার ক্ষেত্রে একটি বিশেষ সময়ে এবং প্রেক্ষিতে সর্বোত্তম ও সর্বোচ্চ যেভাবে ব্যবহার করা যায় তাকে পরিপূর্ণভাবে সদ্ব্যবহার করা হয়েছে, এবং, সর্বোপরি, (৫) নিজের জ্ঞান ও বোধের পরিধি বৃদ্ধির জন্য চোখ-কান খোলা রেখে যেকোন জ্ঞানী মানুষের কাছ থেকে বিদ্যা ও যুক্তির অভ্যাস আহরণের কথা বলা হয়েছে। এগুলো কোনটাই হেলাফেলার বিষয় নয়। আধুনিক জ্ঞানতত্ত্বের epistemological এবং ontological অবস্থানেও এগুলো সাধারণভাবে মূল বনিয়াদ হিসেবে গৃহীত।
এরকম প্রেক্ষাপটে আমরা পরের অধ্যায়কে বোঝার চেষ্টা করব। ৯ম অধ্যায়ের শিরোনাম “যোগ্যাসূত্রীয় অধ্যায়”। যশোদাননন্দন সরকার এর ব্যাখ্যা করেছেন এভাবে – “যোগ্যা অর্থাৎ সম্যক কর্মাভ্যাস। যার দ্বারা কর্মাভ্যাসের জ্ঞান হয়, তাকে যোগ্যসূত্রীয় বলে”[23]।
“শিষ্য সমস্ত শাস্ত্রে অবগত হলেও তাকে কর্মাভ্যাস (practical work) করাবে। ছেদন (excision) প্রভৃতি কাজে এবং স্নেহ (oleation) ইত্যাদি[24] প্রয়োগের (oleation) কাজেও তাকে উপদেশ দেবে। বহুবিদ্যা উপার্জন করেও যদি কর্মাভ্যাস করা না যায় তাহলে কর্মের অযোগ্য হতে হয়।” (৯.৩)
“ছেদনাদি (excision) কাজ শিখতে হলে পুষ্প, ফল, অলাবু (লাউ), কালিন্দক (তরমুজ), শসা, কাঁকুড় ও কর্কারু (কুমড়ো) প্রভৃতিতে ভিন্ন ভিন্ন প্রকার ছেদন, উৎকর্তন (উর্ধদিকে ছেদন) ও পরিকর্তন (অধশ্ছেদ) শিক্ষা দেবে। দৃতি (ভিস্তি – A leathern bag for holding water[25]), বস্তি ও প্রসেবক (চামড়ার থলি) জল বা কাদায় পূর্ণ করে তাতে শস্ত্র প্রয়োগ করে ভেদনকর্ম (incision) শিখবে। এভাবে লোমযুক্ত প্রসারিত চামড়ার খণ্ডে লেখনকর্ম (scraping) শিখবে; মৃত পশুর শিরা বা পদ্মের ডাঁটিতে শস্ত্রপ্রয়োগ করে বেধনক্রিয়া (pncturing) শিখবে; ঘুণেখাওয়া কাঠ, বেণু (tube of bamboo) নলের নালীতে বা শুকনো লাউয়ের মুখে এষণী (probe) প্রয়োগ করে এষণকর্ম (probing) শিখবে; পনস (কাঁঠাল), বিম্বী (Coccinia grandis or Ivy Gourd), তেলাকুচা ও বিম্বফলের (বেল) মজ্জা এবং মৃত পশুর দাঁত আকর্ষণ করে আহরণকর্ম (extraction) শিখবে; মোম লাগানো শিমূলতক্তায় সূচী প্রভৃতি প্রয়োগ করে বিস্রাবণকর্ম (drainage) শিখবে; সূক্ষ্মবস্ত্র ও ঘনবস্ত্রের অন্তর্ভাগে অর্থাৎ সম্মিলনস্থানে অথবা মৃদু চর্মদ্বয়ের অন্তর্ভাগে (thin and thick ends of fine cloth) সূচী প্রয়োগ করে সীবনকর্ম (suturing) শিখবে; বস্ত্রনির্মিত পুরুষের (human model) ভিন্ন ভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গে বন্ধন প্রয়োগ করে বন্ধনকর্ম (bandaging) শিক্ষা দেবে। অগ্নি (cautery) ও ক্ষার (caustic alkali) যেভাবে প্রয়োগ করতে হয় তা নরম মাংসখণ্ডসমূহে প্রয়োগ করে দেখাবে। কর্ণ সন্ধি থেকে ছিন্ন হলে যেভাবে বন্ধন করতে হয় তা নরম চামড়া বা মাংস এবং পদ্মের ডাঁটিতে সংহিত করে (unification) করে দেখাবে। কীভাবে বস্তিনল প্রবেশ করাতে হয় (introducing nozzle), কীভাবে বস্তিপীড়ন করতে হয় (compression of enema pouch), কীভাবে ব্রণবস্তি পীড়ন করতে হয় তা জলপূর্ণ ঘটের পাশের ছিদ্রে অথবা লাউ ইত্যাদির মুখে প্রয়োগ করে দেখাবে।” (৯.৪)
“অতএব যিনি শস্ত্র, ক্ষার ও অগ্নিকর্মে নৈপুণ্য অর্জন করতে চান, তিনি ভিন্ন ভিন্ন শারীরিক দ্রব্যের অনুরূপ বাহ্য-বস্তুতে (human models) সেই সেই কর্ম অভ্যাস করবেন।” (৯.৬)
আমরা এমন একটি সময়ের চিকিৎসাশাস্ত্র নিয়ে আলোচনা করছি যখন কেবলমাত্র মস্তিষ্কের ব্যবহার, যুক্তির প্রয়োগ, হাতের ব্যবহার এবং বিভিন্ন ইন্দ্রিয়-সঞ্জাত বোধের তুল্যমূল্য বিচার করে রোগ এবং তার থেকে মুক্তি সম্পর্কে সিদ্ধান্তে পৌঁছনোই ছিল একমাত্র উপায়। তখন শবব্যবচ্ছেদ নিষিদ্ধ (এ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা পরে করব), ত্রি-দোষ তত্ত্বের বাইরে আর কোন পদ্ধতিতে রোগের pathology এবং organ localization of disease বোঝার জন্য ভিন্নতর কোন পথ উন্মুক্ত হয়নি, সেরকম এক সময়ে চিকিৎসাবিদ্যার শিক্ষার্থীরা যে যত্ন, মনোযোগ, এবং প্রায়-প্রতিটি খুঁটিনাটি বিষয়ে সম্যক জ্ঞানলাভ করছে, এবং প্রাথমিকভাবে human models বা চারপাশের প্রকৃতিতে লভ্য ফল ও উদ্ভিদের বিভিন্ন অংশ এবং পশুদেহের বিভিন্নাংশের ওপরে যেভাবে হাতেকলমে শিক্ষা বা practical training দেওয়া হচ্ছে, তা সত্যিই আমাদের গভীর মনোযোগ এবং অনুধাবন দাবী করে। কেন এই রকম ধারা ব্রাহ্মণ্যতন্ত্রের চাপে নতিস্বীকার করে কেবলমাত্র একটি scholastic medicine-এ পর্যবসিত হল, কীভাবে সর্বশক্তিমান বাজারের উপযোগী করে সুবিশাল আয়ুর্বেদশাস্ত্রকে পঞ্চকর্ম-নির্ভর কিছু বাছাই করা চিকিৎসায় হ্রস্ব করে ফেলা হল, তার অনুসন্ধানও গভীর মনোযোগের দাবী রাখে। আয়ুর্বেদকে ভাসাভাসা, তরলভাবে দেখে এ কাজটি করা সম্ভব নয়।
জিমারম্যান দেখিয়েছেন, ২০শ শতাব্দীতেও তাঁর আয়ুর্বেদের শিক্ষক Vyaskaran N. S. Moos-কে দেখেছেন “never touched the patient … The disciples were trained in selecting, quoting and applying versified and lengthy recipes taken Vāhaṭa’s (Vāgbhaṭa) Astāngahridayasamhitā.” পরে আরও বলছেন – “To describe the parts of the body and their functions, the Sanskrit texts make use of the most unmarked words: to go, to say, to nourish, to support … There is no map nor topography of the body but only an economy (an “animal economy”…), that is to say, fluids going in or coming out , residing in some āsraya, “recipient” or flowing through some some “srotas”, “channel” … only had a physiology of saps and metamorphoses, but no real concept of organ.”[26]
তাঁর পর্যবেক্ষণে – “we have Pathology without anatomy”[27].
১০ম অধ্যায়ের শিরোনাম “বিশিখানুপ্রবেশনীয় অধ্যায়”। বিশিখ শব্দের অর্থ কর্তব্যকর্ম পেশাগত তথা ব্যবসার জগতে অনুপ্রবেশন। “বৈদ্য চিকিৎসাশাস্ত্রে ব্যুৎপত্তি লাভ করবেন, শাস্ত্রার্থ সমস্ত অবগত হবেন (a fully qualified physician) … রাজার অনুমতি নেবেন, নখ ও লোম কামাবেন, শুচি হবেন, শুক্লবস্ত্র পরিধান করবেন, ছত্র ধারণ করবেন … পরে পেশাগত জগতে/ব্যবসায় প্রবেশ করবেন (বিশিখাঃনুপ্রবেষ্টব্যা)।” (১০.৩)
“রোগীর দূত শুভসূচক হলে, শুভলক্ষণ দেখতে পাওয়া গেলে … চিকিৎসক রোগীর গৃহে নিশঃঙ্কে প্রবেশ করতে পারেন। রোগীর গৃহে প্রবেশ করে, রোগীর পাশে বসে রোগীকে দর্শন (inspection), স্পর্শন (palpation) ও প্রশ্ন (interrogation) করবেন। কেউ কেউ বলেন যে, এই ৩ রকমের উপায়েই প্রায় সমস্ত রোগ জানা যায়। কিন্তু তা সঠিক নয়। রোগের সম্পর্কে জ্ঞান অর্জনের উপায় (বিজ্ঞানোপায়) ৬ রকমের – ৫ রকমের ইন্দ্রিয়জ্ঞান (চক্ষু, শ্রোত্র তথা কান, ঘ্রাণ তথা নাক, রসনা তথা জিহ্বা এবং স্পর্শন তথা ত্বক বা চামড়া) এবং প্রশ্ন।” (১০.৪)
এরপরে প্রতিটি ইন্দ্রিয় দিয়ে কীভাবে রোগ সম্পর্কে সম্যক জ্ঞানলাভ করা যায় সেকথা বলা আছে। বলা হয়েছে – “প্রশ্ন দ্বারা দেশ (location), কাল, জাতি, সাত্ম্য রোগের নিদান (suitability and etiology of disease), প্রভৃতি জানা যায় … যেসব ব্যাধির নাম আয়ুর্বেদে নির্দিষ্ট নেই, সেগুলোও বাত-পিত্ত-কফের লক্ষণ দ্বারা নির্ণয় করা যেতে পারে।” (১০.৫)
সহজ কথা হল, বিভিন্ন ধরনের পরীক্ষার মধ্যে নতুন রোগের আবিষ্কার ও নথিবদ্ধকরণ খুব স্পষ্টত স্বীকৃত হল। একটি মুক্তমনা চিকিৎসাশাস্ত্রের এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান ও লক্ষণ।
১২শ অধ্যায়ে বলা হল – “চিকিৎসাকার্যে ক্ষার (caustic alkali) অপেক্ষা অগ্নিকর্ম (cauterization) বেশি গুরুত্বপূর্ণ বলা হয়। কেননা অগ্নিদগ্ধ রোগীদের রোগের পুনরুদ্ভব (recurrence) হয় না। রোগসমূহ ওষুধ, শস্ত্র ও ক্ষারের অসাধ্য হলেও অগ্নিসাধ্য হয়ে থাকে।” (১২.৩)
“রোগের স্থান এবং রোগীর মর্মসমূহ এবং বল (strength) ভালোভাবে পরীক্ষা করে এবং রোগী ও ঋতু ভালোভাবে বিচার করে চিকিৎসক অগ্নিকর্ম করবে।” (১২.১২)
২১তম অধ্যায়ের শিরোনাম “ব্রণপ্রশ্ন অধ্যায়”। একটি শ্লোকে বলা হয়েছে – “যেমন চন্দ্র, সূর্য্য ও অনিল (air) বিসর্গ (relasing), আদান (receiving) ও বিক্ষেপ (dispersing) – এই তিন ক্রিয়ার সাহায্যে জগৎকে ধারণ করে, কফ পিত্ত ও বায়ুও সেরকম তিন ধরনের ক্রিয়ার সাহায্যে শরীরকে ধারণ করে।” (২১.৫)
এর মধ্য দিয়ে অণুবিশ্ব (microcosm) এবং মহাবিশ্ব-র (macrocosm) মধ্যেকার ভারসাম্য রক্ষা করার যে দার্শনিক ধারণা আয়ুর্বেদ ধারণ করে তা আরেকবার পরিস্ফুট হয়।
২২তম অধ্যায় “is about sores (ব্রণ), their discharges (স্রাব) and some other subjects.”[28] মিউলেনবেল্ড এই অধায়ের মূল বিষয়টি এভাবে বলছেন – “Subjects dealt with are: the sbstrates (বস্তু) of sores: skin, muscular tissue, sirās, snāyus, osseous tissue (অস্থি), junctures (সন্ধি), viscera (কোষ্ঠ), and vital spots (মর্মন) (22.3).”[29]
“ব্রণের বর্ণ ভস্ম, কপোত বা অস্থির মতো হলে এবং রুক্ষ (rugged), অরুণ বা কৃষ্ণবর্ণ হলে বায়ুজ (caused by বায়ু) বলা যায়। নীল, পীত, হরিত, শ্যাব (blackish or brownish discoloration), কৃষ্ণ, কপিল (pale-brown or tawny), বা পিঙ্গল (orange or golden/yellow) হলে রক্তপিত্তজনিত বলা যায়, এবং শ্বেত, স্নিগ্ধ (unctuous) বা পাণ্ডু (yellowish-whitish or pallid) হলে শ্লেষ্মজ (caused by শ্লেষ্মা) বলা যায়। আর সবরকমের বর্ণযুক্ত হলে সান্নিপাতিক (conglomeration of vitiated tridoṣa) বলা যায়।
২৪তম অধ্যায়ের শিরোনাম “ব্যাধিসমুদ্দেশীয় ব্যাধিবিবরণ সম্বন্ধীয়) অধায়”। “ব্যাধিসমূহ ২ রকমের – একপ্রকার শস্ত্রসাধ্য (curable by surgical means), অন্যপ্রকার স্নেহ ইত্যাদি পদ্ধতিতে (by means of oleation and related procedures) চিকিৎসাসাধ্য। কিন্তু শস্ত্রসাধ্য রোগেও স্নেহ ইত্যাদি পদ্ধতিতে চিকিৎসার নিষেধ নেই। অথচ যেসব রোগ স্নেহাদি চিকিৎসাসাধ্য তাতে শস্ত্রচিকিৎসা করা যায় না।” (২৪.৩)
২৫তম অধ্যায়ের শিরোনাম “শস্ত্রকর্মণ্য অধ্যায়”। “Chapter twenty-five is devoted to the eight surgical procedures (শস্ত্রকর্মন).”[30]
মিউলেনবেল্ডের সারানুবাদে – “The subjects are: disorders to be treated by means of excision (ছেদ্য), incision (ভেদ্য), scarification (লেখ্য), puncturing (বেধ্য), probing (এষ্য), extraction (আহরণ), drainage (স্রাব্য), and suturing (শিব্য) (25.3-17ab), contra-indications for suturing (25.17cd-18ab), wound toilet before suturing (25.18cd-19), the technique of suturing and materials to be used (25.20-21)…”[31]
একটি শ্লোকে বলা হয়েছে – “যে জঘন্য অস্ত্রচিকিৎসক অস্ত্র প্রয়োগের সময়ে আপনার শরীরে আঘাত করে ফেলে, সেই আত্মঘাতী কু-বৈদ্যকে আয়ুঃপ্রার্থী ধীর ব্যক্তি (wise) পরিত্যাগ করবেন।” (২৫.৪২)
এরপরে বলা হয়েছে – “রোগী মাতা, পিতা, পুত্রগণ ও বন্ধুদেরকেও সন্দেহ করতে পারে, অথচ বৈদ্যে বিশ্বাস রাখে। সে বরং আপনি আপনাকে পরিয়াগ করতে পারে, বৈদ্যকে শঙ্কা করে না। এজন্য বৈদ্য তাকে পুত্রের মতো রক্ষা করবে।” (২৫.৪৩-৪৪)
চিকিৎসকদের ক্ষেত্রে বোধহয় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল, সেসময়ের সমাজে চিকিৎসকদের ethics তথা নৈতিকতার একটি প্রধান ভিত্তি উপরের শ্লোকের মধ্য দিয়ে প্রোথিত হয়েছিল।
২৬তম অধ্যায়ের শিরোনাম “প্রনষ্টশল্যবিজ্ঞানীয় অধ্যায়”। শরীরের কোন স্থানে শল্য গুপ্ত অবস্থায় আছে তা এই অধ্যায় পাঠ করলে জানা যায়।
“শ্বল এবং শল ধাতুর অর্থ আশুগমন (moving fast), এই শব্দদুটির ২য়টি থেকে শল্য শব্দের ব্যুৎপত্তি হয়েছে। শল্য দুই রকমের – শারীর (endogenous) ও আগন্তু (exogenous)। শল্য হচ্ছে সেই বস্তু যা সমগ্র শরীরে ব্যথার সৃষ্টি করে। যেহেতু এর বিবরণ এই শাস্ত্রে লেখা হয়েছে এজন্য একে শল্যশাস্ত্র বলে।” (২৬.৩-৪)
“The śārīra type of śalya consists of teeth, hairs, nails etc., as well as corrupted bodily elements (ধাতু), foods (অন্ন), impurities (মল), and doṣas; all the other ones belong to āgantuka types (26.6); the āgantuka śalyas may be (piece of) metal (লোহা), bamboo (বেণু), wood (বৃক্ষ), grass, horn or bone; out of these, the metallic ones, and among the metallic ones, arrow (শর), should be taken into consideration primarily; arrows are of two types: barbed (কর্ণিন) and smooth (শ্লক্ষ্ণ), and of various shapes (26.7); the five directions from which a śalya may enter the body (26.8); the sites where it may lodge (26.9) … exploration of the track with a probe (এষণী) (26.16-17); sequelae of unextracted śalyas (26.18-22).[32]
শল্য-সংক্রান্ত এই আলোচনা আমাদের পরবর্তী সময়ে যে আলোচনা হবে সে ব্যাপারে সবিশেষ গুরুত্বপূর্ণ হবে, কারণ এই সংহিতা অনুযায়ী শল্যহর্তর (যাকে ইংরেজিতে surgeon বলা যেতে পারে) হচ্ছেন প্রধান ব্যক্তি যিনি সুশ্রুত-সংহিতা-য় পুরোটা জুড়েই সমধিক গুরুত্বপূর্ণ। আমরা সুশ্রুত-সংহিতা নিয়ে আলোচনার শুরুতেই শল্য নিয়ে আলোচনা করেছি। আমরা একবার সূত্রস্থানের ১ম অধ্যায়ের শ্লোকটি স্মরণ করে নিই – “শল্যতন্ত্র আয়ুর্বেদের প্রথম অঙ্গ, কেননা জ্বর বা সমধর্মী রোগ তৈরি হবার আগে আঘাতের জন্য ব্রণসমূহ (ক্ষত বা ঘা) তৈরি হত এবং এই তন্ত্রের উপদেশ মতেই সেসব ব্রণের চিকিৎসা হত … অষ্টাঙ্গ আয়ুর্বেদের মতে শল্যতন্ত্রই অধিক … এই তন্ত্র নিত্য পুণ্যকারক, স্বর্গলাভের উপায়, যশস্কর, আয়ুষ্কর ও অর্থোপার্জনের উপায়।” (সূঃ ১.১৭-১৮)
মিউলেনবেল্ডের সারানুবাদে – “Ṥalya is declared to hold the foremost place among the branches of āyurveda … It is pre-eminent too on account of its quick action, owing to the use of sharp and blunt instruments (শস্ত্র ও যন্ত্রসমূহ), caustics (ক্ষার), and cautery (অগ্নি) (1.17-18).”[33]
এরকম এক প্রেক্ষাপটে আমরা আরও কিছু শিক্ষা আহরণ করতে পারি। ২৭তম অধ্যায়ের শিরোনাম “শল্যাপনীয় অধ্যায়”। “শল্য ২ রকমের – অবদ্ধ (fixed, অস্থি প্রভৃতিতে আটকানো) এবং অনবদ্ধ (loose)।” (২৭.৩)
১৫ রকমের উপায়ে অনবদ্ধ (loose) শল্য অপসারণের (উদ্ধারণ) বর্ণনা করা হয়েছে – স্বভাব (natural bodily functions), পাচন (maturation), ভেদন (incision), দারণ (causing a burst), পীড়ন (squeezing), প্রমার্জন (cleansing), নির্ধ্মাপন (blowing), বমন (emesis), বিরেচন (purgation), প্রক্ষালন (irrigation), প্রতিমর্ষ (a kind of powder used as a strenutatory – sneezing[34]), প্রবাহন (straining), আচূষণ (sucking), অয়স্কান্ত (a magnet), এবং হর্ষ (cheering)।” (২৭.৪)
“বৃহৎ ও ক্ষুদ্র উভয়প্রকার শল্যের ২ উপায়ে আহরণ (removing) হয় – প্রতিলোম (in the opposite direction) এবং অনুলোম (in the direction of entry).। প্রতিলোম উপায়ে অর্বাচীন (proximate) ও অনুলোম উপায়ে পরাচীন (remote) শল্য আহরণ করতে হবে।” (২৭.৪-৫)
“শল্য আহরণের সময়ে বা আহরণের পরে রোগী মূর্ছা গেলে মুখ ও মাথায় শীতল জল সেচন (sprinkle) করবে। রোগীর মর্মস্থানসমূহ রক্ষা করবে এবং রোগীকে দুধ জাতীয় তরল দিয়ে তর্পণ (rehydration) করবে ও মুহুর্মুহুঃ আশ্বস্ত করবে।” (২৭.১১)
৩৫তম অধায়ের নাম “আতুরোপক্রমণীয় অধ্যায়”। “রোগীর চিকিৎসা করতে হলে বৈদ্যকে প্রথমে রোগীর আয়ু পরীক্ষা করতে হবে। আবার রোগীর আয়ু থাকলেও ব্যাধি, ঋতু, অগ্নি, বয়স, দেহ, বল, সাত্ম্য (suitability, wholesomeness), প্রকৃতি (constitution), ভেষজ ও দেশ (type of country) পরীক্ষা করতে হয়।”
মনোযোগী পাঠে নজরে আসবে, আয়ু থাকলেও সব রোগীর চিকিৎসা করা যাবে এমনটা নয়। আমরা এর আগে ১০ম অধ্যায়ে দেখেছি, “অসাধ্য রোগের চিকিৎসা করবেন না। যেসব রোগ সংবৎসর পার করেছে সেসকল প্রায়ই পরিহার্য (pathological conditions that have persisted for more than a year should, as a rule, be avoided) (10.6).”
এই পাঠ থেকে সম্ভবত আমরা এটা বুঝতে পারি যে, আয়ুর্বেদের চিকিৎসার মূল জোর আধুনিক মেডিসিনের পরিভাষায় prognosis-এর ওপরে। যে রোগের ক্ষেত্রে prognosis ইতিবাচক নয় সেসব রোগের চিকিৎসা মূলত পরিহার করার উপদেশ দেওয়া হয়েছে। ৯ম শতাব্দীর বিখ্যাত টীকাকার মাধব-এর পর্যবেক্ষণ এক্ষেত্রে দেখে নেওয়া সাহায্যকারী হবে –
“শুরুতেই এটা জোর দেওয়া কার্যকরী হবে যে ভারতীয় মেডিসিনে একটি রোগের গতিধারা হল বিকাশের একটি বিরামহীন প্রক্রিয়া। একটি রোগ হল এমন কিছু যা ধীরে ধীরে উন্মোচিত হয়। প্রাথমিক লক্ষ্মণ বা পূর্বরূপ বিকশিত হয় পূর্ণাঙ্গ লক্ষ্মণসমূহে বা রূপ-এ। আনুষঙ্গিক প্রকোপ বা উপদ্রব হল একটি মৌলিক রোগগ্রস্ত প্রক্রিয়ার ফলাফল। এই প্রক্রিয়ার শেষে হয় সুস্থ হয়ে ওঠে কিংবা মৃত্যুকালীন চিহ্ন বা অরিষ্ট ফুটে ওঠে … বহুক্ষেত্রেই এই সমগ্র প্রক্রিয়াটিকে কাব্য ছন্দে রাখা হয়, গদ্যে বিবরণের চাইতে পদ্য স্মরণে রাখা সহজ … It is repeatedly observed by commentators that one or more of the symptoms of a particular disease does not fit into the theoretical frame, but is nevertheless present. Such a symptom s called vikṛtiviṣamasamavāyārabdha … This type of symptoms may be considerd to have been really observed.”[35]
আমরা আবার “আতুরোপক্রমণীয় অধ্যায়”-এ ফিরে আসি। বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গের পরিমাপ সম্পর্কে মুলেনবেল্ড স্বল্প কথায় জানাচ্ছেন – “The standard measurements (প্রমাণ) of the various parts of the human body; the major parts (অঙ্গ) are the trunk (অন্তরাধি), lower extremities (সক্থি), upper extremities (বাহু), and head; the subdivisions are the minor parts (প্রত্যঙ্গ); the yardstick is the breadth of the patient’s own finger (অঙ্গুল), the toal length of the (male human body) is 120 fingers (অঙ্গুল) (35.12) …”[36] প্রভৃতি। এই অধ্যায়ে স্ত্রীলোকের অঙ্গপ্রত্যঙ্গেরও বিবরণ দেওয়া হয়েছে।
বলা হয়েছে – “স্ত্রীলোকের শ্রোণি (pelvis – এখানে শ্রোণি শব্দে উরুসন্ধি থেকে স্ত্রীলিঙ্গের উপরিতন ভাগ বোঝাবে) ও পুরুষের উরঃ (হৃদয়ের ঊর্ধ এবং কণ্ঠের অধঃ এই দুয়ের মধ্যভাগকে এখানে উরঃ বলা হয়েছে) ১২ আঙ্গুল। স্ত্রীলোকের ঊরঃ (chest) ১৮ আঙ্গুল বিস্তৃত, পুরুষের কটিও (waist) ১৮ আঙ্গুল।” (৩৫.১৫)
“২৫ বছরে পুরুষের বীর্য্য পরিপূর্ণ হয় (adulthood) আর ১৬ বছরে নারীর বীর্য্য পরিপূর্ণ হয় (adulthood)। কুশলী চিকিৎসক এটা হিসেবে রাখবেন।” (৩৫.১৬)
একটি গুরুত্বপূর্ণ শ্লোক হচ্ছে – “ভিন্ন ভিন্ন ব্যাধি সমস্তই ত্রিবিধ – সাধ্য (curable), যাপ্য (palliable ones), এবং প্রত্যাখ্যেয় (to be rejected by treatment)।” (৩৫.১৭)
“দেশ ৩ প্রকার – আনূপ (marshy), জাঙ্গল (arid) ও সাধারণ (medium)। যে দেশে বহু জল, বহু নিম্নোন্নত ভূমি (ditches and mounds); বহু নদী ও বহু বর্ষা, যে দেশের বায়ু মৃদু ও শীতল; যে দেশের স্থানে স্থানে বহু মহাপর্বত (যেমন চট্টগ্রাম) এবং স্থানে স্থানে বহু মহা বৃক্ষ (যেমন সুন্দরবন); যে দেশের মানষের শরীর প্রায়ই মৃদু (sof), সুকুমার (delicate) ও পুষ্ট (corpulent) এবং যে দেশে বাতিক (বায়ুপ্রধান), শ্লেষ্মিক (কফপ্রধান) ও বাতশ্লৈষ্মিক রোগই বেশি, তাকে আনূপ দেশ বলে (যেমন সেময়ের বাঙ্গালা দেশ)। যে দেশ আকাশ সম, যে দেশের ভূমি অনাবৃত ও সমতল; যে দেশে বৃক্ষ বেশি বিরল বা যেখানে অল্প কাঁটাঝোপ দেখা যায়; যে দেশে প্রধানতঃ অল্প বর্ষা, অল্প প্রস্রবণ এবং অল্প জল অথচ তা কৃষ্ণজল; যে দেশের বায়ু উষ্ণ ও প্রখর; যে দেশে বিরল ও অল্প শৈল (sparse and few mountains), যে দেশের মানুষের শরীর দৃঢ় ও কৃশ (firm and lean physique) এবং যে দেশে বাতপিত্ত রোগই বেশি, তাকে জাঙ্গল দেশ (যেমন রাজপুতানা) বলে। যে দেশে আনূপ ও জাঙ্গল উভয় লক্ষণই আছে, তাকে সাধারণ দেশ বলে (যেমন বিহার অঞ্চল)।” (৩৫.৪২-৪৩)
এখানে ৩টি বিষয় লক্ষ্যণীয় – (১) সময়ের সাথে সাথে আর্য্যরা উত্তর-পশ্চিম ভারত থেকে ক্রমাগত পূর্বদিকে যাত্রা করেছে – অর্থাৎ ঋগ্ থেকে অথর্ববেদ রচনার সময়কাল (মোটামুটি ১৫০০-৫০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ) পর্যন্ত। এরপরে আয়ুর্বেদের উৎপত্তিকাল এবং এরপরেই আয়ুর্বেদের প্রধান দুটি সংহিতা সূত্রবদ্ধ হবে। (২) জাঙ্গল দেশ মুলত উত্তর-পশ্চিম দিকে, এবং আনূপ দেশ পূর্বদিকে। মধ্যবর্তী অঞ্চল, যেমন বিহার ও উড়িষ্যা, হল সাধারণ অঞ্চল। (৩) এই অঞ্চল ভাগের সঙ্গে সঙ্গে দেহের মধ্যে বায়ু, পিত্ত ও কফের তুলনামূলক প্রাধান্যকারী অবস্থান পরিবর্তিত হচ্ছে বলে সে সময়ের চিকিৎসকদের নিবিড় পর্যবেক্ষণে ধরা পড়েছে।
“আনূপদেশে জাত শ্লীপদ (Filariasis or Elephantiasis) প্রভৃতি রোগ জাঙ্গলদেশে নিয়ে আসলে এর শক্তি হ্রাস পায়। আবার নিজের দেশের সঞ্চিত রোগ স্থানান্তরিত হলে কূপিত (aggravated) হতে পারে না।
যে দেশে যে দোষ প্রবল, সে দেশে সেই দোষের বিপরীত আহার, নিদ্রা ও চেষ্টা ইত্যাদি পালন করতে থাকলে সে দোষ কূপিত হয় না।” (৩৫.৪৪-৪৫)
“Chapter thirty-six (ভূমিপ্রবিভাগীয়) is about the classification of soils and some other subjects.”[37] এখানে একটি লক্ষ্যণীয় শ্লোক হল – “গোপাল (cow-herds), তাপস (hermits), ব্যাধ ও অন্যান্য বনচারীদেরকে এবং যারা মূল ভোজন করে – এরকম লোকদেরকে ওষুধের সংবাদ জিজ্ঞাসা করতে হয়।” (৩৬.১০)
আমাদেরকে যা আকৃষ্ট করবে তাহল, প্রাচীনকালের চিকিৎসকদের একটি সর্বদা জ্ঞানোন্মুখ এবং জিজ্ঞাসু মুক্ত মন ছিল – নিজেদেরকে সমৃদ্ধ করার লক্ষ্যে জ্ঞান আহরণের ক্ষেত্রে কোন জাত বা বর্ণের প্রতিবন্ধকতা ছিলনা, সর্বদা শিক্ষার্থী। এবং ব্রাহ্মণ্যতন্ত্রের সঙ্গে আয়ুর্বেদের বিরোধের মূল ভিত্তি তৈরি হল কার্যত বর্ণভেদ প্রথাকে অস্বীকার করার মধ্য দিয়ে।
সমগ্র অধ্যায় জুড়ে কীভবে এবং কখন ও কোন পরিস্থিতিতে বিভিন্ন ওষধি সংগ্রহ করতে হবে বিস্তারিত বিবরণ রয়েছে। সেরকম মাটির চরিত্র এখন দুর্লভ এবং যেসব আপাত কঠোর বিধি শাস্ত্রে বলা আছে সে বিধি অনুসরণ করা সম্ববত আরও কঠিন। এসব সত্ত্বেও অতি সহজে তথাকথিত আয়ুর্বেদীয় ওষুধ বিপুল পরিমাণে কারখানায় তৈরি হচ্ছে এবং আমরা প্রাচীন ওষুধের মহত্ব আরোপ করে প্রচুর পরিমাণে ক্রয়ও করছি। এমনকি আধুনিক চিকৎসকেরাও এসব ওষুধ লিখে থাকেন।
৩৮তম অধ্যায়ের শিরোনাম “দ্রব্যসংগ্রহণীয় অধ্যায়”। এই অধ্যায়ের শেষে বলা হয়েছে – “দোষভেদে ভিন্ন ভিন্ন গণ (groups) প্রয়োগ করতে হয়। কোন ক্ষেত্রে পৃথক, কোন ক্ষেত্রে মিশ্রিত, কোন ক্ষেত্রে সমস্ত এবং কোথাও বা ব্যস্ত সমস্ত করে প্রয়োগ করতে হয়।” (৩৮.৮২)
এরপরে শর্মা একটি লাইন যোগ করেছেন – “Some do not read this verse.”[38] একটু গভীরে ভাবলে এই সংযোজনীটুকুর অসীম গুরুত্ব রয়েছে। যদি কেউ কেউ এগুলো না পাঠ করে তাহলে ওষুধ তৈরির প্রক্রিয়া, এবং পরবর্তীতে তার ক্রিয়া করার ক্ষমতা, ব্যাহত হবে। ঠিক এই সমস্যাগুলোই “আধুনিক আয়ুর্বেদ” বহন করছে।
৪৫তম অধ্যায়ের শিরোনাম “দ্রব্যদ্রব্যবিধি” – “devoted to the description of liquid substances, their properties, and their actions.”[39] যেসমস্ত বিষয় আলোচিত হয়েছে – জল (৪৫.৩-৪৬); দুগ্ধ (৪৫.৪৭-৬৪); দধি (৪৫.৬৫-৮৩); তক্র (buttermilk mixed (with a third part of) water) (৪৫.৮৪-৮৯) তক্রকুর্চিকা (inspissated তক্র) এবং এর তরল অংশ মণ্ড (৪৫.৯০), কিলাট (ক্ষীর), পীযূষ (colostrums), মোরট (নবপ্রসূত গাভীর ৭ম দিনের দুগ্ধ) (৪৫.৯১); নবনীত (টাটকা ঘি) (৪৫.৯২-৯৩); সন্তানিকা (দুধের সর) (৪৫.৯৪); বিভিন্ন ধরনের ঘি (৪৫.৯৬-১০৫); পুরাণঘৃত (৪৫.১০৭-১০৮); কুম্ভসর্পি (দীর্ঘদিন ধরে রাখা ঘি), মহাঘৃত (৪৫.১০৯-১১১); তৈল (৪৫.১১২-১১৩) ইত্যাদি।
এই অধ্যায়ে দুধের বিস্তারিত বর্ণনা রয়েছে – গোদুগ্ধ, মহিষদুগ্ধ, ছাগদুগ্ধ, উটের দুধ, হস্তিনীর দুধ, ঘোড়ার দুধ ইত্যাদি (৪৫.৪৭-৬৪)। কিন্তু এখানে ২টি উল্লেখযোগ্য শ্লোক আছে – “নারীদুগ্ধ মধুর, কষায়নুরস (slightly astringent), শীতল, নস্য (snuffing) ও আশ্চ্যোতনে (a procedure where medicated drops are instilled into the eyes from a specific height) পথ্য, জীবন, লঘু ও দীপন (a stimulant of digestion or a substance that improves the digestive fire)।” (৪৫.৫৬)
প্রথম বিষয় হল, শিশুদের ক্ষেত্রে মাতৃদুগ্ধ প্রাণদায়ী হলেও, চিকিৎসার ক্ষেত্রে নারীদুগ্ধ আলাদা করে একটি দ্রব্য হিসেবে এখানে বিবেচিত হচ্ছে। পরের প্রশ্ন হল, নারীদুগ্ধ সংগ্রহ হত কীভাবে? কোন ধরনের নারীর কাছ থেকে আয়ুর্বেদজ্ঞ চিকিৎসকেরা এই দুধ সংগ্রহ করতেন?
এরপরের আরেকটি শ্লোকে বলা হয়েছে – “নারীদুগ্ধের ঘৃত অতিশয় চক্ষুষ্য (promoting or beneficial for eye health or good for the eyes), অমৃতের মতো, দেহ ও অগ্নির বৃদ্ধি করে, লঘুপাকী (light in digestion) এবং বিষনাশক।” (৪৫.১০৩) এখানেও এই একই প্রশ্ন আসে – কোন ধরনের নারীদের কাছ থেকে সংগৃহীত দুধের ঘি কীভাবে সংগৃহীত হত? এমনটা কি হতে পারে যে, যেহেতু আয়ুর্বেদজ্ঞ চিকিৎসকেরা চিকিৎসার ক্ষেত্রে বর্ণভেদ প্রথা বিশেষ মান্য করতেন না, এজন্য নীচু বর্ণের নারীদের কাছ থেকে দুধ সংগ্রহ করা হত? আজ ২ হাজার বছর পরে এ প্রশ্নের উত্তর পাবার কোন রাস্তা নেই। কিন্তু প্রশ্নটি থেকেই যায়।
৪৬তম অধ্যায়ের শিরোনাম “অন্নপানবিধি অধ্যায়”। এই অধ্যায়টি সূত্রস্থানের বৃহত্তম অধ্যায়, মোট ৫৬২টি শ্লোক।
মিউলেনবেল্ডের ভাষায় এই অধ্যায়টি “is devoted to the articles of diet and medical substances.”[40] এটি সূত্রস্থানের শেষ অধ্যায়ও বটে। মিউলেনবেল্ডের সারানুবাদে – “The subjects are: the properties and actions of śāli (শালি) rice (46.4-7); saṣtika (ষষ্টিক) rice (46.8-11); vrīhi (ব্রীহি) rice; śāli grown on burnt fields (46.15); rice growing in a dry type of soil (স্থলজ) and on irrigated fields (কৈদারা) (46.16-17); rice which has been transplanted once (রোপ্য) or several times (অতিরোপ্য) (46.18-19); inferior cereals (কুধান্য) (46.20-26); pulses (বৈদল) (46,27-38); sesamum (তিল) (46.39-40); barley (যব) and অতিযব (46.41-43ab) … ইত্যাদি।”[41]
৬টি মাংসবর্গের বিবরণ দেওয়া হয়েছে – জলেশয় (A fish[42]), আনূপ (Any animal frequenting marshy or watery places (as a buffalo[43]), গ্রাম্য (domestic), ক্রব্যাদ (মাংসভুক), একশফ (not cloven-hoofed), ও জঙ্ঘাল (1. Bunning swiftly, rapid, 2. A deer, an antelope[44])। এই সকল বর্গের পর পরটি পূর্ব পূর্বটির অপেক্ষা প্রধান। জাঙ্গলবর্গ ৮ রকমের – জঙ্ঘাল (swift runners), বিষ্কির (scatterers), প্রতুদ (peckers), প্রসহ (snatchers), পর্ণমৃগ (tree-dwellers), বিলেষয় (living in burrows in the earth), এবং গ্রাম্য (domestic)। এদের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল জঙ্ঘাল ও বিষ্কির। (৪৬.৫৩)
এরপরে প্রায় সমস্ত রকমের পশু, পাখি (যার মধ্যে কাক, শকুন ইত্যাদিও আছে) ও মাছের বিবরণ দেওয়া আছে এবং আলাদা আলাদা গুণ বর্ণনা করা আছে। কোন ধরনের রোগে কোন ধরনের বা কিসের মাংস সুপ্রযোজ্য এবং বায়ু, পিত্ত ও কফের প্রশমনকারী বিভিন্ন প্রাণীর মাংস ভিন্ন ভিন্ন ক্ষেত্রে কীভাবে কাজ করে, তার বিস্তারিত বর্ণনা আছে।
গুহাশয় প্রাণীদের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত – সিংহ, ব্যাঘ্র, তরক্ষু (নেকড়ে), ঋক্ষ (ভালুক), দ্বীপি (চিতাবাঘ), মার্জার (বনবেড়াল), শৃগাল ও মৃগের্বারু (deer-eater, known as হরিণদ্রব)। এদের মাংস মধুর, গুরু (heavy), স্নিগ্ধ (unctuous), বলদায়ক, বায়ুনাশক, উষ্ণবীর্য (refers to the hot potency or heating property of a substance) এবং নেত্ররোগীদের ও গুহ্যরোগীদের (suffering from diseases of private parts) নিত্য হিতকর (৪৬.৭২-৭৩)।
বিভিন্ন ধরনের সাপের ব্যাপারে বলা আছে – এরা অর্শ রোগ ও বায়ু-র প্রকোপ প্রশমিত করে, চোখের জন্য উপকারী, বিপাক ক্রিয়ার ক্ষেত্রে মধুর এবং মেধা ও হজমের শক্তি (digestive power) বৃদ্ধি করে (মেধাঅগ্নিবর্ধনাঃ)। দর্বীকর সাপের (hooded snakes – কেউটে, গোখরা প্রভৃতি) মাংস এবং রাজিমান (streaked – বোড়া প্রভৃতি রাজিযুক্ত) সাপের মাংস কটুপাকী (pungent), মধুর, অতিশয় চক্ষুষ্য (wholesome for eyes), এবং বিষ্ঠা, মূত্র ও অধোবায়ুর প্রবর্তক (eliminates flatus) (৪৬.৮৩-৮৪)।
গ্রাম্য (domestic) বর্গের মাংসের বিবরণ। গ্রাম্য বর্গের মাংসের মধ্যে পড়ে – অশ্ব, অশ্বতর (খচ্চর), গো (গরু), গর্দভ, উষ্ট্র (উট), ছাগ, মেষ, মেদঃপুচ্ছক (দুম্বা) প্রভৃতি। গ্রাম্য জন্তুর মাংস বায়ুনাশক, বৃহংণ (a therapeutic approach focused on nourishing and strengthening the body, particularly for individuals who are underweight or depleted), কফপিত্তকারক, রসে ও পাকে মধুর, দীপন ও বলবর্ধক (৪৬.৮৫-৮৬) গোমাংস শ্বাস, কাস, প্রতিশ্যায় (coryza), এবং বিষমজ্বর (irregular fever) নাশ করে। বায়ু-কে প্রশমিত করে। (৪৬.৮৯)
আনূপবর্গ-এর প্রাণীদের ৫টি ভাগ – (১) কুলচর (living banks), (২) প্লব (divers and swimmers), (৩) কোশহ (living within shells), (৪) পাদী (reptiles, crustaceans etc.), এবং (৫) মৎস্য। কুলচর গোত্রের মধ্যে পড়ে – হাতি, মোষ, বরাহ (শূয়র), গণ্ডার ইত্যাদি।
এখানেও কয়েকটি বিষয় বিশেষভাবে নজর করার মতো – (১) গরু, মেষ যেমন আনূপ, জাঙ্গল ও সাধারণ সবজায়গাতেই পাওয়া যায়, তেমনি উট জাঙ্গল অঞ্চলের বৈশিষ্ট্য, আবার দুম্বা, খচ্চর প্রভৃতি প্রাণী শীতলতর পাহাড়ি অঞ্চলের বৈশিষ্ট্য। (২) মাংসের মধ্যে কাক, শকুন, সাপ যেমন আছে, তেমনি আছে গরু, বরাহ তথা শূয়র, ঘোড়ার মাংস ইত্যাদি। (৩) ব্রাহ্মণ্যবাদে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ মাংস দ্বিধাহীনভাবে রোগীর পথ্য হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। (৪) মুক্তমনা আয়ুর্বেদেজ্ঞ চিকিৎসকেরা চিকিৎসার স্বার্থে প্রকারান্তরে ব্রাহ্মণ্যবাদী বিধানকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করছেন, subversion-ও ঘটিয়েছেন বলা যায় – এ এক ঐতিহাসিক দলিল। (৫) “আধুনিক আয়ুর্বেদ”-এ আয়ুর্বেদের অন্তর্বস্তুর এসবকিছু সম্পূর্ণ ছেঁটে ফেলে নিষ্প্রাণ, কিছু ব্যবহারিক প্রয়োগ-নির্ভর (যেমন পঞ্চকর্ম ইত্যাদি) তথাকথিত “আয়ুর্বেদীয় চিকিৎসা” হচ্ছে এবং বিপুল পরিমাণে বাণিজ্যিকীকরণ হচ্ছে – প্রাচীন শাস্ত্রের মহত্ত্বের নাম করে।
আমাদের স্মরণে রাখতে হবে – আয়ুর্বেদে কোন ব্যক্তি রোগীর চিকিৎসার বিবরণ লিপিবদ্ধ নেই, যদিও চিকিৎসার ক্ষেত্রে প্রতিটি ব্যক্তির প্রকৃতি বিচার করে আলাদা আলাদা (individualized) চিকিৎসার কথা বলা আছে, এবং, এমনকি আয়ুর্বেদ লিপিবদ্ধ হবার সমসাময়িক কালের গ্যালেন-ও যেভাবে রোগীর ইতিহাস রাখতেন, আয়ুর্বেদে সেটা (case history) সম্পূর্ণ অনুপস্থিত। নীচে গ্যালেনের রোগীর কেস হিস্টরি দিচ্ছি।
(H.F.J. Horstmanshoff – “Galen and his patients”, in Ancient Medicine in its Socio-Cultural Context, p. 91)
যাহোক, এরপরে সম্ভবত রাজানুগ্রহ পাওয়ার জন্য এবং শাস্ত্রকারদের সন্তুষ্ট করার লক্ষ্যে খাদ্যপ্রস্তুতবিধিতে একটি সমঝোতা করতে হয়েছে – “rules for the (royal) kitchen (মহানাস) (46.446-448); rules for serving the food; the material for for the vessels, plates etc., dependent on the ype of food and drink (46.449-459ab)”[45] ইত্যাদি রচনা করতে হয়েছে। P. V. Sharma শ্লোকটি বিস্তারে বলেছেন – “Cooked food should be presented after it is contacted with anti-poison formulations, sprinkled with incanted water and de-poisoned by mantras.”[46]
এই শ্লোকটি থেকে অষ্টাঙ্গ আয়ুর্বেদের “অগদতন্ত্র তথা toxicology”-র গুরুত্বের আভাসও প্রত্যক্ষ করা যায়।
এই অধ্যায়ের শেষ শ্লোকটি হচ্ছে – “মহামুনি রাজর্ষিপ্রধান ধন্বন্তরির অনুমোদিত এই আহারবিধি যত্ন নিয়ে পাঠ করলে বৈদ্য সুপণ্ডিত হয়ে রাজা ও মহাত্মাদের নিযুক্ত হবার যোগ্য হবেন।” (৪৬.৫৬২)
শেষ কথা
আমরা পরের অধ্যায়ে “শারীরস্থান” এবং শবব্যবচ্ছেদ তথা ডিসেকশন (?) নিয়ে চালু ধারণার আলোচনায় প্রবৃত্ত হব।
______________________________________________________________________
[1] P. V. Sharma, Suśruta-Saṃhitā: With English translation of text and Ḍalhaṇa’s commentary along with critical note, vol. 1, 2004, pp. 36-48.
[2] Robert Southey, Letters from England, 3 vols, II, 3rd edn., 1814, p. 284.
[3] Ibid, p. 282.
[4] Ibid, pp. 300-301.
[5] Ludwig Edelstein, Ancient Medicine, ed. by Owsei Temkin and C. Lilian Temkin, 1994, p. 48.
[6] Ibid, p. 99. যদিও “injunction on fees”-ও আরোপিত হয়েছিল।
[7] Meulenbeld, HIML, IA, p. 204.
[8] যশোদাননন্দন সরকারের সংযোজন – সুশ্রুত সংহিতা, ২য় খণ্ড, পৃঃ ১২।
[9] যশোদানন্দন সরকারের সংযোজন – সুশ্রুত সংহিতা, ২য় খণ্ড, পৃঃ ১৩।
[10] Meulenbeld, HIML, IA, p. 204.
[11] P. V. Sharma, ibid, p. 61.
[12] মিউলেনবেল্ড, প্রাগুক্ত, পৃঃ ২০৪।
[13] Meulenbeld, ibid, pp. 204-205.
[14] এখানে উল্লেখযোগ্য, পরিমাপের আরেকধরনের পদ্ধতি শার্ঙ্গধর চিকিৎসা সংগ্রহ-তে (কালীকিঙ্কর সেনশর্মা এবং সত্যশেখর ভট্টাচার্য সম্পাদিত, ১৯৯৮) বর্ণিত আছে। যদিও সেটা সময় সংক্রান্ত নয়, পরিমাপ সংক্রান্ত – পৃঃ ৪।
[15] Meulenbeld, ibid, p. 205.
[16] Vaman Shivram Apte, The Practical Sanskrit-English Dictionary, 1890, p. 1037.
[17] Meulenbeld, ibid, p. 206.
[18] আপ্তের-র পূর্বোক্ত অভিধানে আটীমুখ-এর অর্থ হিসেবে বলা আছে – “surgical instrument used in bloodbtting (so called from its being like the beak of the bird āṭi’)” – পৃঃ ২৩১। একে শরারি পাখিও বলা হয়। A kind of bird (śarāri) (also written āṭi) – https://www.wisdomlib.org/definition/ati#sanskrit।
[19] “Śarāri (शरारि) is a Sanskrit word referring to “a kind of heron” (“skimmer”)” – Wisdom Library – https://www.wisdomlib.org/definition/sharari#ayurveda.
[20] আপ্তে, প্রাগুক্ত, পৃঃ ২৪২।
[21] Meulenbeld, ibid, p. 207.
[22] আপ্তের পূর্বোক্ত অভিধান অনুযায়ী শ্লক্ষ্ণ শব্দার্থের ২য় এন্ট্রি হচ্ছে “Smooth, polished” – পৃঃ ১০৬২।
[23] যশোদানন্দন সরকার, প্রাগুক্ত, পৃঃ ২৯।
[24] পিভি শর্মা এই অংশটুকুর ব্যাখ্যা করেছেন এভাবে – “Snehādiṣu – ādi includes sudation, emesis, purgation, non-unctuous and unctuous enema etc.; chdyādiṣu – ādi includes incision etc. and other seven surgical operations. Though in this discipline excision etc. are the chief ones, unction etc. are employed as preparatory measures and as such mentioned first; others however read ‘chdyādiṣu snehādiṣu ca’. – Sushruta saṃhitā, vol. 1, p.107.
[25] আপ্তে, প্রাগুক্ত, পৃঃ ৫৭৬।
[26] Francis Zimmermann, The Conception of the body in Ayurvedic Medicine: Humoral Theory and Perception, pp. 1-11, revised and published on the ewb in November 2005 – reference: http://www.ehess.fr/centres/pri-al/nature/body.html.
[27] Ibid, p.4.
[28] Meulenbeld, ibid, p. 215.
[29] Ibid.
[30] Muelenbeld, ibid, p. 217.
[31] Ibid, p. 207.
[32] Meulenbeld, ibid, p. 218.
[33] Meulenbeld, ibid, p. 203.
[34] Monier-Williamms, ibid, p. 669.
[35] Meulenbeld, The Mādhavanidāna: With ‘Madhukośa’, the Commentary by Vijayarakṣita and Ṥrikaṇṭhadatta (Chapters 1-10), 2008, pp. 612-613.
[36] Meulenbeld, HIML, IA, p. 221-222.
[37] Meulenbeld, ibid, p. 223.
[38] P. V. Sharma, ibid, p. 367.
[39] Meulenbeld, HIML, IA, p. 227.
[40] Ibid, p. 228.
[41] Ibid, p. 228.
[42] Apte, ibid, p. 509.
[43] Ibid, p.242.
[44] Apte, ibid, 504.
[45] Meulenbeld, HIML, IA, p. 232.
[46] P. V. Sharma, ibid, p. 547.
খুব কৌতুহল জাগায় লেখাটি। প্রসঙ্গ গুলো সমসাময়িক দৃষ্টিভঙ্গীতেও কি সুন্দর আলোচনা করা হয়েছে।
বিস্তারিত আলোচনা। সুন্দর ব্যাখ্যা। মনের শুদ্ধিকরণ প্রয়োজন, সঙ্গে সমাজেরও।