ভদ্রলোক মাঝে মাঝেই আসেন। আজও এসেছেন। চেয়ারে ধপাস করে বসেই বললেন, ‘ডাক্তারবাবু, আমাকে বাঁচান?
বললাম, ‘বেঁচেই তো রয়েছেন। মরমর না হলে বাঁচাব কী করে?’
ভদ্রলোক ঘোঁত করে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। বললেন, ‘একে কি বেঁচে থাকা বলে! রোগে একেবারে জর্জরিত হয়ে গেলাম। এর চেয়ে মরে যাওয়া ভালো।’
কথা বাড়িয়ে লাভ নেই। বাইরে অধৈর্য রোগীদের ভিড়। সরাসরি বিষয়ে চলে এলাম, ‘বলুন, এবারে কী সমস্যা হলো।’
ভদ্রলোকের হাত বিশাল ভুঁড়ির উপর ঘোরাঘুরি করল, ‘পেটের সমস্যায় জেরবার হয়ে গেলাম ডাক্তারবাবু।’
‘কী হয়েছে? পেটে ব্যথা? বমি? গা গুলানো?’ আমি সারসংক্ষেপে মনোযোগী হই।
‘ওসব কিছু নয় ডাক্তারবাবু।‘ ভদ্রলোক প্রতিবাদ জানালেন।
‘তাহলে কি পাতলা পায়খানা? খানাপিনা ঠিক আছে? সমস্যাটা কী?’
ভদ্রলোক ‘ঘ্রাত’ করে একটি বিচ্ছিরি ঢেকুর তুলে বললেন, ‘সমস্যাটা এই।‘ তারপর তিনি ঢেকুর তুলে চললেন। চলতেই লাগলেন- যেন অনন্ত কামরার ঢিকির ঢিকির মালগাড়ি।
এরকম উদার উদগারের কবল থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য বললাম, ‘কবে থেকে এমন হচ্ছে?’
‘ঘ্রাত’ ভদ্রলোক থমকালেন। তারপর বললেন, ‘অনেকদিন। কিছু খেলেও হচ্ছে, না খেলেও হচ্ছে। খাওয়ার সাথে সম্পর্ক নেই মোটে।‘
বললাম, ‘ঘাবড়াবেন না। ব্যাপারটা মারাত্মক কিছু নয়। ঢেকুর জিনিসটা আসলে…’
ভদ্রলোকের হাহাকারে মুখ হা করেও থামতে বাধ্য হলাম। তিনি বললেন, ‘কিছু লুকাবেন না, আমার কী হয়েছে সত্যি করে বলুন। প্যানক্রিয়াটাইটিস হয় নি তো?’
ভদ্রলোক প্যান্টের হুক খোলার চেষ্টা করতে করতে বললেন, ‘আপনি একবার চেপে দেখুন ডাক্তারবাবু। ভালো করে দেখুন।‘
ভুঁড়ির জন্য সহজে হুক খুলতে পারছেন না। আমি ভদ্রলোকের প্যান্ট ক্রিয়া দেখতে দেখতে বললাম, ‘প্যানক্রিয়াটাইটিস মোটেই এরকম হয়না। ব্যথা হয়, বমি হয়।‘
‘বমি হয়নি তো।‘ আত্মবিশ্বাসের সম্ভবামিতে ভদ্রলোক স্বস্তির শ্বাস ফেললেন। পরক্ষণেই আবার নিদারুণ দুশ্চিন্তায় কাঁদো কাঁদো হয়ে গেলেন। বললেন, ‘তাহলে আমার হয়েছেটা কী? গুরুতর কিছু যে হয়েছে সে বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই।‘ বলেই ‘ঘ্রাত’ করে আবার ঢেকুর তুললেন।
সেই অবকাশে আমি বললাম, ‘এভাবে এ প্রশ্নের অ্যানসার দেওয়া…’
‘আচ্ছা, ক্যানসার হয়নি তো আমার?’ ভদ্রলোকের হাহাকারে আবার থমকাতে বাধ্য হই।
‘না না, ক্যানসার নয়। ক্যানসারে তনু ক্ষীণ হয়। আপনি তো বর্ধমান।‘
‘না না, বর্ধমান নই। নদীয়া, শান্তিপুর। শান্তিপুরের কাঁচাগোল্লা খেয়েছেন?’ ভদ্রলোকের চোখ ঝকমক করে ওঠে। উত্তেজনায় ঢেকুর তুলতে ভুলে যান।
বাইরে থেকে একজন মুখ বাড়িয়ে বলেন, ‘ডাক্তারবাবু, তাড়াতাড়ি। আর চাপতে পারছি না। এবারে কাপড়ে চোপড়ে হয়ে যাবে।’
বললাম, ‘চেপে রাখবেন কেন। পায়খানা পেলে করে আসুন। চেম্বারের পাশ দিয়ে ঠিক পেছনেই।’
‘গেছি তো, এখানে এসে চারবার গেছি। মুশকিল হচ্ছে উঠে এলেই আবার পেয়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে আদি অন্ত বসে থাকি। ডান পায়ের হাঁটুতে আবার বাত। পায়খানায় বসে বসে পা খানাও যেতে বসেছে। দয়া করে তাড়াতাড়ি করুন।‘
ভদ্রলোককে বললাম, ‘ঢেকুর ছাড়া তো আপনার কোনো সমস্যা নেই? আমি ওষুধ লিখে দিচ্ছি। আপনি দুইদিন ওষুধ খেয়ে না কমলে এসে বলুন। ‘
ভদ্রলোক বিরস বদনে বললেন, ‘এতো হাতুড়ে চিকিৎসা হলো। ঢেকুরটাকে চেপে দিলে কারণটা আর কোনো দিন জানা যাবে?’
‘কারণ নিয়ে অবসেসিভ হওয়ার কারণ নেই। অনেকক্ষেত্রেই পেটের গণ্ডগোল আর মন…’
‘গল-স্টোন হতে পারে? অন্তত একটা ছবি করান তাহলেই বোঝা যাবে।’
ইউএসজি পরে করবেন, আগে পাঁচদিন ওষুধ খান? এভাবে অন্তঃসার শূন্য বিষয় নিয়ে আলোচনা করে লাভ নেই।
‘আলসার হয়নি তো? হলে অবশ্য ছবিতে ধরা যাবেনা।’
দরজা ঠেলে বাইরের লোকটি ঢুকেই পড়লেন, রেগে মেগে বললেন ‘অনেকক্ষণ পেট কামড়ানো সহ্য করে আপনার প্যাঁচাল শুনছি। নিজের ডাক্তারি বন্ধ করে বাড়ি গিয়ে ওষুধ খান।‘
মারমুখো রোগীকে সকলেই ভয় পায়। নাছোড় ভদ্রলোক মনঃক্ষুণ্ণ হয়ে চেয়ার ছাড়লেন। তাঁর এখন আরো ঘন ঘন ঢেকুর উঠছে।