অবাক কাণ্ড! মেরুদণ্ড?
– এরকম একটি কথা শুনলে প্রথমেই যেটা মনে আসে, সেটি হলো- আপাদমস্তক ভণ্ড, ভীতু, নির্লজ্জ তোষামোদকারী, ন্যায় নীতির তোয়াক্কাহীন বেমক্কা একটি মানুষ! না, এই লেখায় অমন কারো কথা নেই।
কিন্তু প্রশ্নটাকে যদি অন্যভাবে ভাবি- অবাক কাণ্ড! মেরুদণ্ড? – তাহলে কিন্তু জানা জরুরি আসলেই মেরুদণ্ড বা শিরদাঁড়া আদৌ দণ্ডাকৃতি কিনা।
হ্যাঁ, এই প্রশ্নটা কেউ তুললে, আক্ষরিক অর্থ বিচার করতে বসলে আপনি ঠকে যাবেন নিশ্চিত। তখন শিরদাঁড়া বললে যদি বা মেনে নেওয়া যায়, মেরুদণ্ড বললে কেউ নাও মানতে পারেন।
মেরুদণ্ড কি আসলেই দণ্ডাকৃতি?
নাকি সে আমাদের শরীরের দুই মেরুকে যুক্ত করে? মোটেই না। এটি শুরু হয় আমাদের সারভাইকাল রিজিয়নে, শেষ হয় লেজের দিকটায় মানে স্যাক্রামের নিচে কক্সিসে।
লেজ নিয়ে অন্য একদিন লেজুড়বৃত্তি করা যাবে। এবং সবচেয়ে বড় কথা হলো- শিরদাঁড়ার সামনে পিছে চারটে বাঁক ছাড়াও ডান বা বাম – যে কোন দিকে বাঁক থাকতে পারে। সেটা অল্প হলে নর্মালও হতে পারে, কিন্তু বেশির ভাগ সময় হয় কোন অসুখের কারণে।
না, আজ আর বাঁকে বাঁকে ঘুরতে যাবো না। বিস্ময়সূচক প্রশ্নটির উত্তর খুঁজি এমব্রায়োলজি থেকে।
আগে বলেছিলাম – আমাদের তিন চাকতি থেকে কিভাবে ব্যাঙাচি দশা শুরু হয়। বলেছিলাম – চাকতির ভেতর নোটোকর্ড নামক একটি অক্ষ তৈরি হয়। যার পেছনে তৈরি হবে নিউরাল টিউব বা ভবিষ্যতের স্পাইনাল কর্ড। তারপর চাকতি চারদিক থেকে ভাঁজ হয়। মানে তিন লেয়ারের চাকতি পুরোটাই ভাঁজ হবে সামনের দিকে।
এবার অক্ষের কাছাকাছি থাকা মেসোডার্ম লেয়ারকে আমরা বলি – প্যারাঅ্যাক্সিয়াল মেসোডার্ম। ছবিতে দেখা যাবে আরো দুটি ভাগ আছে মেসোডার্মের। একটি ইন্টারমিডিয়েট প্লেট একটি ল্যাটারাল প্লেট। এই দুটো পরে আলোচনা করা যাবে।
এই প্যারাঅ্যাক্সিয়াল প্রথমে কোনাকুনি দুই ভাগে ভাগ হবে। একটি হবে সামনের দিকে sclerotome এবং অন্যটি পেছনের দিকে dermatomyotome। রেসপেক্টিভ Dermatomyotome থেকে তৈরি হবে মাংসপেশী ও চামড়া। এই sclerotome থেকেই তৈরি হবে সোমাইট।
কতগুলো? ৪২-৪৪ জোড়া। অন্য প্রাণীর ক্ষেত্রে, যেমন সাপ, এটি সংখ্যায় ৫০০ ও হতে পারে।
এবার এই সোমাইটগুলোই হলো ভবিষ্যতের কশেরুকা। পাশাপাশি দুটো করে সোমাইট মিলে একটি করে কশেরুকা তৈরি করবে। একমাত্র দ্বিতীয় সারভাইকাল কশেরুকার ক্ষেত্রে চারটি সোমাইটের অবদান থাকবে।
এই কারণেই, বড় বয়সেও দুটি সোমাইটের সংযোগস্থলে মানে কশেরুকার পেছন দিকে একটি ছোট খাঁজ থাকে, যেখান দিয়ে কশেরুকায় শিরা ও ধমনী যাতায়াত করে ।
এই কারণে, কখনো কোন একটি বা দুটি সোমাইটের কোন সমস্যা হলে শিশু কশেরুকার জন্মগত ত্রুটি নিয়ে জন্মাবে।
ছবিতে কশেরুকার বডি দেখুন। ওটার নানারকম শেপ হতে পারে। যেমন – অর্ধেক কশেরুকা। কখনো তিন চারটি একসাথে জুড়ে ব্লক ভার্টিব্রা।
আর নোটোকর্ডের কি হবে? বেশিরভাগই বিলুপ্ত হবে। সামান্য অংশ সোমাইটগুলোর মাঝে মানে কশেরুকার মাঝে আটকে পড়ে আমাদের ইন্টারভার্টিব্রাল ডিস্কের সেন্ট্রাল অংশ বা nucleus pulposus তৈরি করবে।
কখনো এই সোমাইটের অংশ পেছন দিকের নিউরাল টিউবকে পুরোপুরি ঘিরে ধরতে না পারলে তৈরি হবে spinal dysraphism।
এই কদিন আগেই যে হাইকোর্ট রায় দিয়েছিল বাচ্চার lepto-meningomyelocele আছে বলে অ্যাবরশন করানো যাবে, সেটিও এই একই কারণে।
এছাড়াও বহু মানুষের ক্ষেত্রে কশেরুকার স্পাইন এ দুদিকের সোমাইট না মিললে গ্যাপ থাকে। স্পাইনা বাইফিডা বলি আমরা।
যেটা বলে শুরু করেছিলাম- মেরুদণ্ড মোটেই দণ্ডাকৃতি নয়। এমনিতে বাঁকা, তার উপর খণ্ড খণ্ড।
অতএব, কাউকে মেরুদণ্ডহীন বলার আগে দু’বার ভাবুন! আপনার কশেরুকার একখানা এক্স-রে এনে যদি দেখিয়ে দেয় যে – আপনারও আসলে খণ্ড খণ্ড … কেলোর কীর্তি হয়ে যাবে!!