জোড়া যমজ ও জিন-পরিবেশ মিথস্ক্রিয়া
কয়েকটি জোড়া যমজ বেশ বিখ্যাত। যেমন পশ্চিমবঙ্গেরই বসিরহাটের গঙ্গা মণ্ডল ও যমুনা মণ্ডল। এরা ড্রিমল্যান্ড সার্কাসের স্পাইডার গার্ল হিসেবে খ্যাত। ওড়িশার গঙ্গা যমুনাও জোড়া-বোন, তাদের হৃদপিণ্ড ও লিভার জোড়া-লাগা। এই দুই গঙ্গা-যমুনাকে আলাদা করা যায়নি, বা তারাও আলাদা হতে খুব উৎসাহী ছিল না (তথ্যসূত্র ৪)। স্পাইডার গার্লেরা বিয়ে করেছিল, তবে তাদের স্বামী ছিল একজন। তাদের একটি বাচ্চা হয়, কিন্তু বাচ্চাটি বাঁচেনি।
.
যুক্ত যমজদের কেবল দেহ যুক্ত, তাই নয়। তারা সবাই একটিমাত্র ভ্রূণকোষ থেকে উৎপন্ন বলে তাদের ডিএনএ ও জিন হুবহু এক। তাদের পরিবেশ প্রায় এক। আমরা জানি, জিন ও পরিবেশ, এ-দুয়ের মিথস্ক্রিয়ায় তৈরি হয় মানুষের ব্যক্তিত্ব, তার চরিত্র, তার বুদ্ধিমত্তা।
জোড়া যমজ তৈরি হয় কেমন করে?
মায়ের পেটে শুক্রাণু ও ডিম্বাণু মিলে প্রথমে একটি ভ্রূণকোষ বা জাইগোট তৈরি করে। জাইগোট বারংবার বিভাজিত হয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ শিশু তৈরি হয়। কিন্তু বিরল ক্ষেত্রে এই জাইগোটটি বিভাজিত হবার কোনও একটি পর্যায়ে দুভাগে ভাগ হয়ে যায়। যদি একেবারে প্রথম দিকে তারা আলাদা হয়ে যায় তো দুটি সদৃশ যমজ শিশু জন্মায়। এরা জোড়া নয়, কিন্তু দেখতে একরকম। যদি ভ্রূণ তৈরির মাঝপথে এরকম দুভাগে ভাগ হবার ঘটনা ঘটে, তখন তারা জোড়া যমজ হিসেবে জন্মায়। এদের একটা বড় অংশ গর্ভাবস্থায় মারা যায়, বা জন্মের সময়ে মারা যায়। বিশেষ করে সিজারিয়ান সেকশন অপারেশন করে বাচ্চা বের করা যখন তেমন চালু ছিল না, তখন এদের জ্যান্ত জন্মানো বেশ অবাক কাণ্ডই ছিল। যুক্ত যমজ মাত্রেই সদৃশ যমজ, তারা জিনগতভাবে হুবহু এক, তবে তারা মায়ের পেটে পুরো আলাদা হতে পারেনি।
.
জোড়া নয়, এমন সদৃশ যমজদের একজনকে যদি অন্য পরিবারে দত্তক নেওয়া হয়, তাহলে দুজনের পরিবেশ আলাদা হবে। সে ক্ষেত্রে দেখা গেছে, আলাদা পরিবারে মানুষ হওয়া সত্ত্বেও নানা মানসিক ক্ষমতা ও প্রবণতা এই যমজদের অনেকটা একরকম হচ্ছে। এরকম দুজনের মধ্যে তুলনা করে দেখা গেছে, বুদ্ধিমত্তা (আই কিউ দিয়ে মাপা), ব্যক্তিত্বের ধরণ (অন্তর্মুখী নাকি বহির্মুখী) এবং আগ্রাসী হবার প্রবণতা—এই তিনটে জিনিস জিনগত প্রবণতা ও পরিবেশ—উভয়ের দ্বারা সমভাবে নিয়ন্ত্রিত হয়। (তথ্যসূত্র ৫) কিন্তু জিন ও পরিবেশ এ-দুয়ের প্রভাব আলাদা করে দেখা সম্ভব নয়।
.
পৃথিবীর বিখ্যাততম জোড়া যমজ ছিল চ্যাং আর ইং। তারা শ্যামদেশে জন্মেছিল, আর তাই এখন যে কোনও দেশের জোড়া যমজের আরেক নাম হল শ্যামদেশীয় যমজ বা সিয়ামিজ টুইন। চ্যাং ছিল ভারি আবেগপ্রবণ, আর টাকাপয়সা হাতে আসার পরে সে খুব মদ খাওয়া শুরু করে। ইং চট করে আবেগপ্রবণ হত না আর সে মদ খেত না, মদ খাওয়া তেমন পছন্দও করত না। কিন্তু চ্যাং মদ খেলে ইং-এরও খানিক নেশা হত। (তথ্যসূত্র ৬)
চ্যাং আর ইং। লালেহ ও লাদান। এদের কেবল ডিএনএ আর জিন এক ছিল তা নয়, তাদের পরিবেশ অন্য যে কোনও একজোড়া মানুষের চাইতে বেশি একরকম ছিল। কিন্তু তা কি পুরো একরকম ছিল? মাতৃগর্ভের পরিবেশের কথা ধরা যাক। মাতৃগর্ভে ভ্রূণ দুটির অবস্থান আলাদা হয়, ফলে তাদের ওপর সমান চাপ পড়ে না। রক্ত সরবরাহ থেকে দুজনেই একই পরিমাণে পুষ্টি না পেতে পারে। জন্মানোর পরেও দুজনের মধ্যে কিছু না কিছু পরিবেশগত তফাৎ থাকে। কিছু তফাৎ সহজেই বোঝা যায়—কেউ মায়ের প্রিয়, কেউ-বা বাবার ফেভারিট। আবার ছোটখাট কিছু পরিবেশগত ফারাক বোঝাই দুষ্কর, কিন্তু সেগুলো চরিত্র ও ব্যক্তিত্বও গঠনে বিরাট অভিঘাত ফেলে। হয়তো ছোটবেলায় কাউকে কুকুর কামড়ে দিয়েছিল, সে কুকুরকে ভয় পেত। হয়তো অন্যজন কুকুরের সঙ্গে খেলা করতে ভালবাসত, আর প্রথমজন কুকুরকে মেনে নিতে বাধ্য হত। তার ভয় বাড়ত, একই সঙ্গে তার মনে হত কুকুরকে তাড়ানো তার পক্ষে অসম্ভব, কুকুর তাড়াতে গেলে অন্যজন কুকুরকে আরও বেশি গায়ের ওপর তুলে নেবে। সে গুটিয়ে যেত, আর অন্যজন সব সময়ে প্রাধান্য পেতে অভ্যস্ত হয়ে উঠত। এইধরণের আপাত-তুচ্ছ পার্থক্য ক্রমে চরিত্র ও ব্যক্তিত্ব গঠনে বিরাট প্রভাব ফেলে। কিন্তু চরিত্রের পার্থক্য থেকে এরকম কারণ ধরা অসম্ভব।
.
অন্য ভাষায় বলতে গেলে, জিন-পরিবেশ মিথস্ক্রিয়া সরল নয়। তা সহজ পাটিগাণিতের ছক মেনে চলে না। আমরা কেওটিক সিস্টেমের কথা জানি। মানুষের ব্যক্তিত্ব ও চরিত্র গঠন হল পরিবেশের সঙ্গে তার কেওটিক মিথস্ক্রিয়া। কিন্তু সে নিয়ে তাত্ত্বিক আলোচনার স্থান এখানে নয়। এখানে শুধু এই কথাটুকু বলে রাখা যে, জিনগত ভাবে দুজন হুবহু এক হলে, তারা একরকম মানুষ হয় না। তাদের পরিবেশের মধ্যে যথাসম্ভব মিল থাকলেও তারা একরকম হয় না। শুধু তাই নয়, কোথায় কতটা মিলবে বা মিলবে না, সেটা পরিবেশের উপাদান বিশ্লেষণ করে আমরা পূর্বানুমান করতে পারি না। ফলে আমরা পরিবেশ নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে তাদের চরিত্র একরকম বা ভিন্নরকম ‘তৈরি’ করতেও পারি না।
.
এই সিদ্ধান্তটি কেবল জোড়া-লাগা যমজ বা সদৃশ যমজের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য, এমন নয়। এটা সবার জন্যই প্রযোজ্য। ব্যক্তিচরিত্র গঠন কোনও নির্ধারিত/নির্ধারণবাদী (deterministic) বিষয় নয়, তা অনেক এলোমেলো ঘটনা দ্বারা প্রভাবিত (stochastic)।
(সমাপ্ত)
চিত্র পরিচিতি
১) চ্যাং আর ইং (চিত্রঋণ উইকিপিডিয়া)
২) লালেহ ও লাদান
তথ্যসূত্র
৪) The Times of India, December 4, 2017
৫) Turkheimer, E., Haley, A., Waldron, M., D’Onofrio, B., and Gottesman, I. I. Socioeconomic status modifies the heritability of IQ in young children. Psychol. Sci. 14, (2003). 623–628.
৬) https://www.britannica.com/biography/Chang-and-Eng