সবাই লক্ষ্য করেছেন কিনা জানি না, যে কোন সিনেমায় মুখ্য অথবা পার্শ্ব চরিত্রেরা যখন অভিনয় করেন তখন কিছু কিছু দৃশ্যে, সে মাঠে ময়দানে যেখানেই হোক না কেন, ভিড়ের মাঝে অনেক নাম না জানা ছোটখাটো অভিনেতা বেশ মুন্সিয়ানার সাথে একটা দুটো ডায়ালগ বলে চলে যান। নজরে না পড়লেও সামগ্রিক ভাবে সেই সিনটাকে উৎরে দেওয়ার জন্য তাদের অভিনয়টিও কিন্ত ফেলে দেওয়ার মতো নয়। নায়ক কিম্বা খলনায়ক দুই চরিত্রকে ফুটিয়ে তুলে কাহিনীকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার পিছনে সামান্য হলেও তাদের অবদান রয়ে যায়।
ঠিক তেমনি ভাবেই আমাদের রোজকার জীবনেও এমন কিছু মানুষের সান্নিধ্যে আমরা আসি, যারা হয়তো এলাকায় তেমন নজরকাড়া নন; জীবনে প্রতিষ্ঠাও সেই অর্থে তেমন লাভ করে উঠতে পারেন নি, কিন্তু যাদের উপস্থিতির গুরুত্ব ওজনে অনেক কম হলেও, সমাজের প্রয়োজনে কোথাও তাদের ভূমিকা পালন করে যায়।
বয়সে সামান্য ছোট হলেও আমার বন্ধু বাবু ছিল ঠিক সেই ধরনের চরিত্র। ছিল বলছি এই জন্যেই, কারণ আজ থেকে সে আর আমাদের মধ্যে নেই।
সত্তরের দশকে যখন আমাদের পরিবার পাকাপাকিভাবে কলকাতায় ফিরে আসে তখন থেকেই দেখতাম আমাদের পাড়ার ক্লাবে যে কোন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে পৌরহিত্য করতেন এক বৃদ্ধ ভদ্রলোক। উনি ছিলেন প্রবীণ স্বাধীনতা সংগ্রামী শ্রী হিরন্ময় দত্ত। আমাদের সকলের ‘দাদু’। আসলে ঠিক আমাদের নয়, বাবু আর তার ভাইদের এবং সেই সূত্রেই আমাদের সকলেরও।
আর সেই পরিবারটির ইতিহাসও বড় অবাক করা। আমি অনেক পরে জেনেছি, এক ছাদের তলায় দীর্ঘদিন বসবাসকারী বাবু এবং তার বাবা, কাকারা সকলেই কিন্তু এক পরিবারের মানুষ নন। বাংলাদেশ থেকে উদ্বাস্তু হয়ে ভেসে আসা দুটি পরিবারের এক ছাদের তলায় একত্রিত হয়ে জোট বেধে বেঁচে থাকার এক অসাধারণ উদাহরণ ওঁরা। যা হয়তো কোন অর্থনৈতিক কারণে শুরু হলেও আজ দীর্ঘ পঞ্চাশ বছর পরেও এক সূত্রে গাঁথা। কোন সঙ্কটই উনাদের আলাদা করতে পারেনি।
এক সৎ বামপন্থী গৃহকর্তার চলে যাওয়ার পরেও সেই ট্র্যাডিশনকে বজায় রাখতে পেরেছে তাঁদের পরবর্তী প্রজন্ম। শত অসুবিধাতেও হাত ছাড়েন নি একে অপরের। এযুগের আধুনিক সমাজে যেখানে কথায় কথায় হেঁশেল আলাদা হয় সেখানে এই পরিবার এক অলীক দৃষ্টান্তস্বরূপ।
বাবু সেই অর্থে জীবনে ‘বিশেষ’ কিছু করতে পারেনি। পড়াশোনাতেও নেহাৎ সাদামাটা হওয়ায় অনেক জায়গা ঘুরে শেষমেশ একটা সামান্য চাকরি করতো এক বন্ধুর দোকানে। বাবা, কাকারা চলে যাওয়ার পর মা, ভাই আর কাকিমাকে নিয়েই চলতো তাঁদের সংসার। চিকিৎসার দরকারে যাঁরা সকলেই আমার কাছে আসতেন।
দীর্ঘদিন এই মানুষগুলোর সান্নিধ্যে এসে যেটা আমি লক্ষ্য করেছি, সেটা হলো এদের সততা। এক প্রবীণ স্বাধীনতা সংগ্রামী গৃহকর্তার উত্তরাধিকার যেন এঁরা সকলেই বয়ে চলেছেন।
শঠতার এই সময়ে যখন মিথ্যার মুখোশে ডুবে আছে সমগ্র সমাজ, ঠিক তখন এই মানুষগুলোকে কেমন যেন বিরল প্রজাতির মনে হয়। শত প্রলোভনেও এরা মাথা নোয়ান নি। রাজনৈতিক পট পরিবর্তন হয়েছে, প্রচুর মানুষ রঙ বদলেছে সুবিধা নেওয়ার নিমিত্তে। এঁদের পরিবর্তন ঘটেনি। বাম আমলেও যা ছিলেন এই আমলেও তাই। খুব সাধারণ।
তবে সবাই এলেও বাবু কিন্তু কোনদিন নিজের চিকিৎসার জন্য আমার কাছে আসেনি। কোথাও এক ধরনের, নিজের প্রতি অবহেলার একটা মনোভাব হয়তো কাজ করতো ওর মধ্যে।সেটা জীবনের প্রতি হতাশা থেকেই এসেছিল বলেই আমার ধারণা।
কয়েকদিন আগে এক সকালে ওর ভাই এর অসহায় ডাকে আমি ওর বাড়ি গিয়ে পৌঁছাই। ওকে পরীক্ষা করে বুঝতে পারি, মস্তিষ্কে একটা স্ট্রোক ওকে প্যারালাইজ করে দিয়েছে আর কেড়ে নিয়েছে বাকশক্তি।
সব বন্ধুরা মিলে টাকাপয়সা জোগাড় করে হাসপাতালে ভর্তি এবং অপারেশন করিয়েও আমরা ফিরিয়ে আনতে পারলাম না বাবুকে। জীবনের প্রতি হয়তো অনেক ক্ষোভ রেখে, হতাশাগুলিকে বুকে জড়িয়ে ধরে আজ সবাইকে ছেড়ে পরপারে চলে গেল বাবু।
তাই, ভিড়ে দাঁড়িয়ে থেকে সিন উৎরে দেওয়া কোন এক্সট্রার অভাবে যেমন সিনেমা অপেক্ষা করে থাকবে না, ঠিক সে ভাবেই কোন সৎ মানুষের অভাবে দাঁড়িয়ে থাকবে না জীবন। আঁকাবাঁকা পথে সে এগিয়ে যাবে নতুন কোন কাহিনী অথবা পরিণতির দিকে।
শুধু আমাদের মতো কিছু স্বজন হারানো মানুষের হৃদয়ে অব্যক্ত যন্ত্রণার মতো রয়ে যাবে স্মৃতির মিছিল। জীবনভর।