কোকিল কথা
মাসি গো মাসি, পাচ্ছে হাসি/নিম গাছেতে হচ্ছে শিম্/হাতির মাথায় ব্যাঙের ছাতা/
কাগের বাসায় বগের ডিম (সুকুমার রায়)
প্রথম ছবিতে দেখুন, মা পাখি বাচ্চাকে খাবার দিচ্ছে। ওপরের পাখি মা-পাখি, আর নীচের পাখি তার ছানা।
এমন মায়ের এমন ছানা! হবেই তো, কাগের বাসায় বগের ডিম যে। মা পাখি হল রিড ওয়ার্বলার, আর ছানা পাখি হল ইউরোপের সাধারণ কোকিল। কোকিল মা চুপি চুপি এসে ওয়ার্বলারের বাসার একটা ডিম খেয়ে নেয়। কাজটা খারাপ সন্দেহ নেই, কিন্তু ডিম খাওয়া হল কোকিল মায়ের পরের কাজের ভূমিকা মাত্র। সে একটা ডিম পাড়ে, এবং রিড ওয়ার্বলারের বাসায় সেই ডিমটা রেখে দেয়। ওয়ার্বলার মা নিজের ডিমের সঙ্গে কোকিলের ডিম তা দিয়ে ফোটায়। কোকিলের ছানা আগে জন্মায়, আর জন্মেই সে অন্য সব ওয়ার্বলার ডিম আর ছানাকে ঠেলে ফেলে দেয় বাসার নীচে, তাদের শিয়াল-কুকুরে খায়। আর কোকিলছানা বিরাট হাঁ করে খাবারের আবদারে চিল-চিৎকার জুড়ে দেয়।। অবশ্য চিলের মতো গলা নয় তার, এমনকি কোকিলের মতোও নয়। তার গলা ওয়ার্বলার বাচ্চার মতো, কিন্তু বেশি জোরদার। মা-ওয়ার্বলার তাকে সাধ্যমতো খাইয়ে যায়, আহা, একটিই ‘সন্তান’ তার, সাত রাজার ধন এক মানিক। এক সময়ে ছানা বড় হয়, ‘মায়ের’ চাইতে দু-গুণ তিন-গুণ ছয়-গুণ বড়। মা খাইয়ে যায়। তারপর ছানা বাসা ছাড়ে। কিছুদিন পরে সে ওয়ার্বলারের ডাক ভুলে কোকিলের গলায় ডাকে, কুহু, কুহু!
কাক-কোকিলের পরজীবিতার ক্লাসিক গল্প আমাদের বহুদিন জানা। সংস্কৃতে কোকিলের নামই হল ‘পরভৃত’ অর্থাৎ অন্যের আশ্রিত, আর কাকের নাম ‘পরভৃৎ’, অন্যের আশ্রয়দাতা। ছোটবেলায় এ-দুটো গুলিয়ে ফেলে মাস্টারমশাইয়ের কানমলা খেয়েছি। বহুকাল থেকে মানুষ দেখেছে, কাকের না-ফোটা ডিম ও সদ্যোজাত শাবকেরা বাসা থেকে পড়ে মরে যায়। লোকে এর জন্য মা-কোকিলকেই দায়ী করত।
এডোয়ার্ড জেনার বলে এক ব্রিটিশ ‘ভদ্রলোক প্রকৃতিবিদ’ ১৭৮৮ সালে ইংল্যান্ডের রয়াল সোসাইটির জার্নালে সদ্যোজাত কোকিলছানার আচরণ নিয়ে একটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন। কাকের ডিম বা বাচ্চাকে কে ফেলে দেয়? সকলের ধারণা ছিল, মা-কোকিল ডিম পাড়ার সময়ে এদের ফেলে দেয়। এদেশে স্কুলের অনেক বিজ্ঞান বইতে এখনও তেমনই লেখা আছে। কিন্তু জেনার দেখলেন, মা-কোকিল সব ডিম বা বাচ্চা ফেলে না। ডিম থেকে বেরনো সদ্যোজাত কোকিলছানা বাসা থেকে অন্য ডিম আর বাচ্চাদের ফেলে দেয়। জন্মের পর চোখ ফোটার আগেই অন্ধ কোকিল বাচ্চা তার পিঠ দিয়ে একটি ডিম বা বাচ্চাকে ঠেলতে ঠেলতে বাসার কিনারায় নিয়ে যায়, তারপর তাকে ফেলে দেয়। কোকিল ছানাদের পিঠ দেহের তুলনায় চওড়া, আর সেখানে একটু গর্তের মত আছে। সেই গর্ত থাকায় ঠেলার সময় ডিম বা বাচ্চা ফসকে যায় না। বড় হবার সঙ্গে সঙ্গে কোকিলছানার এই গর্ত মিলিয়ে যায়। জেনার বহুবার কোকিলের কীর্তি পর্যবেক্ষণ করেন।
সেকালের ইংল্যান্ডে বিজ্ঞানের সঙ্গে সামাজিক মূল্যবোধ গুলিয়ে ফেলার প্রবণতা কাটেনি (এখনও কেটেছে কি?)। তাই রয়াল সোসাইটির অধিকাংশ বিজ্ঞানীর কাছে শিশু-কোকিলের হত্যাকাণ্ড এক অসম্ভব ব্যাপার বলে মনে হয়েছিল। তারা জেনারের গবেষণাকে হতবুদ্ধিকর ও কুৎসিত ভেবেছিলেন। জেনার সম্পর্কে ‘ভদ্রলোক’ প্রকৃতিবিদদের বিরাগ বেশ স্থায়ী হয়েছিল।
ও হ্যাঁ, এই এডোয়ার্ড জেনার ভদ্রলোকই ক’দিন পরেই গুটিবসন্তের টিকা নিয়ে গবেষণাপত্র পাঠাবেন, ও রয়াল সোসাইটি সেটি জার্নালে ছাপাবে না।
বসন্তের কোকিল, তুমি গুটিবসন্তের কেহ নহ!
চিত্রতালিকা
১) ওপরে রিড ওয়ার্বলার মা-পাখি ও নীচে কোকিল ছানা (চিত্রঋণ Wikimedia Commons)
২) এডোয়ার্ড জেনার (চিত্রঋণ Wikimedia Commons)
তথ্যসূত্র
১) Croston, R. & Hauber, M. E. The Ecology of Avian Brood Parasitism. Nature Education Knowledge. 2010; 3(10):56
২) BardelI D. Biology in History Nestling cuckoos to vaccination—a commemoration of Edward Jenner. BioScience. 1996; 46(11)