এতটুকু বাসা
.
মা নিষাদ প্রতিষ্ঠাং ত্বমগমঃ শাশ্বতীঃ সমাঃ।
যৎ ক্রৌঞ্চমিথুনাদেকমবধীঃ কামমোহিতম্।।
.
দস্যু রত্নাকর বাল্মীকি-রূপে নবজন্ম নিলেন, আর প্রথম শ্লোক বেরোল পাখির একনিষ্ঠ প্রেমের ডিফেন্সে। ‘নিষাদ, তুই চিরকাল পতিত থাকবি। কারণ, তুই ক্রৌঞ্চমিথুনের একটিকে কামমোহিত অবস্থায় বধ করেছিস।’
পুরুষ পাখি তীরবিদ্ধ হবার পরে স্ত্রীর কাতর বিলাপ দেখে বাল্মীকির বিরহকাতর নারীর কথা মনে এল। গ্রিক ট্র্যাজেডির ধারায় এ হল ক্লাসিকাল সীতাহরণের প্রিমনিশন, তবে তখনও গ্রিক নাটক জন্মায়নি। ক্রৌঞ্চ-ক্রৌঞ্চিকে যে চিরায়ত প্রেমিক-যুগল ভাবা হয়েছে, সে নিয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই। স্ত্রী কোঁচ বকের বিলাপ দিয়ে বাল্মিকীর প্রথম ছক্কাটি পাঠকের হৃদ-গ্যালারির এক্কেবারে ভিআইপি এনক্লেভে গিয়ে পড়েছে।
.
ক্রৌঞ্চমিথুন হল একনিষ্ঠ প্রেমের প্রতীক। আমাদের তো বটেই, সব প্রাচীন ঐতিহ্যে পাখিদের প্রেমের কূজন মানুষ ফেস ভ্যালুতে নিয়েছে। বাল্মিকী থেকে ব্যোমকেশে তার প্রমাণ আছে; সত্যবতীর সঙ্গে গা ঘেঁষাঘেঁষি বসার জন্য অজিত ব্যোমকেশকে আওয়াজ দিয়েছে, আহা, কপোত-কপোতী, বুড়ো বয়সে লজ্জা করে না? অ্যারিস্টটল অবশ্য বেসুরে গেয়ে বলেছিলেন, মুরগীরা একাধিক মোরগের সঙ্গে নির্বিচার সঙ্গম করে। তবে তাঁকে নিরপেক্ষ ভাবা মুশকিল, দন্তরুচি কৌমুদী ভেরিফাই না করেই তিনি বলেছিলেন মেয়েদের দাঁতের সংখ্যা পুরুষদের চাইতে কম। আধুনিক বিজ্ঞান এইসব হৃদকমলে ধূম লাগানোর মধ্যিখানে নিজেকে অনাসক্ত অবজার্ভার করে রাখতে পারেনি, পাখিদের আদর্শ দম্পতি ভাবমূর্তিতে নিজের রাবার স্ট্যাম্প পট করে লাগিয়ে দিয়েছিল। অবশ্য তার কারণ এক্কেরে ছিল না, এমন বললে বিজ্ঞানীদের রোষে ভস্ম না-হোক হাফ-বয়েল হতে হবে। অধিকাংশ গায়ক পাখিদের জুড়ি একটা ঋতুতে একসাথে থাকে, বাসা বাঁধে, বাচ্চার যত্ন নেয়। তাদের ছোট বাচ্চারা মানুষেরই মত যেন, অনেকদিন অসহায় থাকে, বাপ-মায়ের যত্ন ছাড়া বাঁচে না। তাই বিজ্ঞানীরা ভাবতেন, একসাথে জুড়ি বেঁধে বাসার পাখিরা অন্তত একটি প্রজনন ঋতুতে একগামী থাকে।
.
.
সন্তানের যত্নে বাবা ও মা, দুজনের অংশগ্রহণের ফলে পাখিদের মধ্যে ‘দাম্পত্য সম্পর্ক’ বা ‘সামাজিক একগামিতা’ দেখা যায়। তবে সেটাকে হাসিমুখ দম্পতির ফেসবুক স্ট্যাটাস আপডেটের চাইতে বেশি গুরুত্ব দেওয়া যায় না। পোড়-খাওয়া বিজ্ঞানীরাও সেটা বুঝতে বড্ড সময় নিয়েছেন। সম্প্রতি ডিএনএ ফিঙ্গারপ্রিন্টিং প্রযুক্তি দিয়ে পাখির ছানাদের পিতৃপরিচয় নির্ণয় করা হয়েছে। ওমা, দেখ কাণ্ডো, এক বাবা-মায়ের বানানো বাসার ডিম আর ছানার মা একটাই বটে, কিন্তু বাপের ঠিক নাইকো! বাল্মিকী বেঁচে থাকলে নিষাদ আদালতে ফলস এভিডেন্স প্রোডিউস করার মামলা করত। তবে বাল্মিকীর কেসটা একেবারে হোপলেস নয়, অনেকগুলো বাসার পুরুষ পাখি সত্যিই সব ছানাদের জৈবিক পিতা। উনি সাধু মানুষ, সংসারের এত প্যাঁচ-পয়জার জানবেন কেমনে? তবু নিষাদ বলতেই পারে, আরে সাধু বলে কি চোখের মাথা খেয়েছেন? দেখছেন না, যতরকম বাসাতে ডিএনএ আঙ্গুলছাপ করা হয়েছে তাদের নাইন্টি পার্সেন্ট ঘুটিং কেস?
.
নিষাদের প্রাকৃত ভাষার জোর আমরা হুতোম ও কস্যচিৎ উপযুক্ত ভাইপোস্য-র সঙ্গে সঙ্গে হারিয়েছি, আর হ্যারি বেলাফন্তের মেলেচ্ছ ভাষায় সাঁটে বলা ‘ম্যান স্মার্ট, উইমেন স্মার্টার’ বললে সাতদিনের ফাঁসি অবধারিত। সে-বেদনা বুকে চেপে আসুন আপাতত প্রমিত ও প্রতুল বাংলায় গান গাই।
.
.
স্ত্রী আর পুরুষে মৌলিক ফারাক কোথায় বলুন দিকি? আজ্ঞে না, এক্স ক্রোমোজোম আর ওয়াই ক্রোমোজমে নয়। যেমন ধরুন পাখিদের মধ্যেই স্ত্রীরা সেক্স ক্রোমোজোম বাবদে হেটারোমর্ফিক (ZW). আর পুরুষরা হোমোমর্ফিক (ZZ), অর্থাৎ মানুষের ঠিক উলটো। আফটার অল, পাখিরা ডাইনোদের বংশ, আমাদের সঙ্গে তাদের ঢের দূরত্ব। আসল স্ত্রী-পুরুষ ফারাক হল প্রাথমিক বিনিয়োগে। সন্তান হল স্ত্রী-পুরুষের যৌথ উদ্যোগ, তাতে স্ত্রীর প্রাথমিক বিনিয়োগ হল এই এত্তোবড় একখান ডিম্বাণু (সাতসকালে একখান ডাবল ডিমের মামলেট খেয়েছি, ডিমহারামি করতে পারব না), আর পুরুষের প্রাথমিক বিনিয়োগ হল স্রেফ আণুবীক্ষণিক-ব্যাঙ্গাচি-পানা একখান শুক্রাণু। সিংহ থেকে ছারপোকা, সব পুরুষই কোটি কোটি ব্যাঙ্গাচি অবতার বানিয়েই চলছে অবিরত, তাতে একখান ডিম্বাণু বানানোর খরচও লাগে না যে!
.
.
ইংরেজ বিজ্ঞানী অ্যাঙ্গাস জন বেটম্যান ১৯৪৮ সালে বললেন, ডিম্বাণু তৈরি করলে তা নিষেকের জন্য শুক্রাণুর অভাব হবার কথা নয়। স্ত্রী-জীব বেশি ডিম্বাণু তৈরি করতে পারলে তার ছেলেমেয়ে বেশি হয়, কিন্তু সে সারা জীবনে বেশি সংখ্যক ডিম্বাণু তৈরির ব্যয় জোটাতে পারে না। তার সন্তান সংখ্যা নির্ভর করে তার ডিম্বাণু তৈরির ক্ষমতার ওপর। অন্যদিকে, শুক্রাণু তৈরি করা সোজা বলে পুরুষ লক্ষ কোটি শুক্রাণু তৈরি করে। একখান বিশাল সাইজের ডিম্বাণুর সঙ্গে মিলে বাচ্চা তৈরি করার জন্য একখান খুদে শুক্রাণুই যথেষ্ট। বেশি সংখ্যক স্ত্রীর সঙ্গে মিলিত হতে পারলেই হল, পুরুষের বাচ্চা তৈরির শুক্রাণুর অভাব হবে না। যে পুরুষ বেশি সংখ্যক স্ত্রীর সঙ্গে সঙ্গম করতে পারবে, তার বাচ্চাকাচ্চা বেশি হবে, ও পরের প্রজন্মে তার জিনের প্রতিলিপির সংখ্যা বাড়বে। এই হল বেটম্যানের নীতি। হুতোমি বাংলায় বেটম্যানের নীতি হল পুরুষ চাদ্দিকে ছোঁকছোঁক কব্বে, আর স্ত্রীরা পতির পা ধরে সগগে যাবে।
.
.
এই নীতি থেকে বড় বড় জীববিজ্ঞানী ও সমাজবিজ্ঞানীরা ভেবেই ফেললেন, মানুষের মধ্যে এইটেই হল ‘স্বাভাবিক’, ‘জীববিজ্ঞান সম্মত’ ও ‘জিনগত’ (হুতোমে কুলোচ্ছে না মশাই)। নারীবাদীরা বললেন, জিন গুণতি করে মানুষের গুণবিচার, এয়ার্কি হচ্ছে? আরে চোখটা পুরো খুলুন মশাই, চাদ্দিকে যে ঢের পশু আর পাখিদের স্ত্রীরা বহুগামী আর পুরুষ একগামী, সে বেলা? পুরুষের একগামিতা অবশ্য তেমন বেশি নেই, সে তো ওরা মল্লেও শুধরোয় না, তা বলে কিনা ‘জিনগত প্রবণতা’ দিয়ে নারীকে স্বভাবতই একগামী ও পুরুষমানুষকে বহুগামী বলে দাগিয়ে দিচ্ছেন? আস্পদ্দার কথা!
.
.
বেটম্যান, ম্যান ও উওম্যান ছেড়ে পাখিদের কথায় আসি। জুড়ি পক্ষিণী ছাড়াও পাঁচ-সাতটা স্ত্রী পাখির সঙ্গে সঙ্গম করলে পুরুষ পাখির বংশধর বাড়ে, আর সেই বংশধরের মাধ্যমে বহুগামিতার জিনগত প্রবণতা পরের প্রজন্মে ছড়িয়ে পড়ে, এটা বোঝা সহজ। কিন্তু এইসব ফ্লিং করে স্ত্রী পাখির লাভ কী? তার ওপর পুরুষ পাখিরা সতীত্বের ওপর গুরুত্ব দেয়। অনেক প্রজাতির পুরুষ পাখি সঙ্গিনীকে পাহারা দেয় যাতে সে অন্য পুরুষের সঙ্গে মিলিত হতে না পারে। তবুও স্ত্রী পাখি জুটির বাইরে সঙ্গম করে। এর নানা ব্যাখ্যা বের করার চেষ্টা হয়েছে।
.
.
প্রথম ব্যাখ্যা হল দেখতে জোয়ান লম্বা আসল কাজে অষ্টরম্ভা কেস। একটি পুরুষের বীর্যে শুক্রাণু স্ত্রী পাখির সমস্ত ডিম্বাণুকে নিষিক্ত করার জন্য যথেষ্ট হবার কথা, কিন্তু কয়েকটা পুরুষের শুক্রাণু কমও তো হতে পারে? স্টেপনি হিসেবে একখান কলির কেষ্ট থাকলে স্ত্রী পাখির রক্ত জল করে বানানো ডিম্বাণুর সবগুলোই কাজে লাগে। দ্বিতীয়ত, স্থায়ী সঙ্গী হিসেবে স্ত্রী পাখির দরকার ভাল গেরস্ত (বা ভাল রেস্ত) পুরুষ যে বাচ্চা ও বাসার যত্ন নেবার কাজে ওস্তাদ। তা বলে আশেপাশে দু-চারটে ম্যাচো পাখি শিস দিলে, বাঁশির শবদে মোর আঁওলাইলো রান্ধন হবে, এ তো বেসিক হরমোনের খেল।
.
ম্যাচোবাবু অন্য বাসার বাচ্চাদের যত্ন-আত্তিতে ব্যাস্ত, তার সাথে ঘর বাঁধার উপায় নেই। তবে কিনা, ইয়ে তো করাই যায়, তাই না? কথাটা পেজ থ্রি-র গুলতানি নয়, বিজ্ঞানীরা দেখেছেন, স্ত্রী পাখি পুরুষের জিনগত গুণ শনাক্ত করতে পারে। তারা স্বামী বাছার সময় যেসব গুণ বিচার করে, প্রেমিক খোঁজার সময় অন্য গুণ বিচার করে। সেই সুযোগে ম্যাচো জিন এট্টু বেশি চান্স পায় আর কি।
.
.
ভাল জিন ছাড়াও অন্য পার্কস অ্যান্ড বেনেফিটস আছে। নগদ Loveএর ব্যবস্থা থাকলে একটা পুরুষের চাইতে দুটো ভাল, দুটোর চাইতে তিনটে। সঙ্গমের আগে-পরে বাসার পুরুষ স্ত্রীকে খাদ্য গিফট করে, বা সন্তান পালনে সাহায্য করে। ভেতরে ভাতার মিনসেরা, বাইরে প্রেমিক জিন-সেরা, আহা, এমন হলে স্ত্রী-পাখির পোয়া-বারো। কিন্তু কোন বাসার রেসিডেন্ট পুরুষ এত বোকা হয়?
.
হয়, Zানতি পারো না। ব্লু টিট পাখি বাসা বাঁধার আগে কোর্টশিপের সময় পুরুষ ব্লু টিট-এর কাছ থেকে খাদ্য উপহার পায়। বাসা বাঁধার পরে ডিম পাড়ার সময়ে স্ত্রীর প্রায় অর্ধেক খাবার পুরুষ জুগিয়ে দেয়। ব্লু টিট স্ত্রীরা মাঝে মধ্যে নিজের এলাকা ছেড়ে অন্যত্র বেরোয়। তা বেরোতেই পারে, খাদ্য জোটাতে হবে। তবে কিনা তারা যতবার বেরোয় তার অর্ধেক সময়ে অন্য কোনও পুরুষ ব্লু টিটের সঙ্গে তাদের মোলাকাত হয়, নতুন কোর্টশিপ হয় মাঝেমধ্যে, আর দু-একবার যৌনমিলনও হয়! অন্য পুরুষের সঙ্গে দেখা হবার সময়গুলোতে স্ত্রী পাখি খাবার জোগাড় মোটে করে না, সুতরাং কেন বেরনো, তা বুঝতে অসুবিধা হয় না। তাদের বাসা পরীক্ষা করে দেখা গেছে, এক-তৃতীয়াংশেরও বেশি পাখির বাসায় প্রেমিকের বাচ্চা আছে। প্রেমিক পুরুষটি থাকে কাছাকাছি, অন্য কোনও স্ত্রীর ঘরে। মেল স্মার্ট, ফিমেল স্মার্টার!
.
.
চিত্র
১) বাল্মিকী-নিষাদ-ক্রৌঞ্চ বধ কথা (যেমন খুশি আঁকো প্রতিযোগিতায় অথেনটিক প্রথম স্থানাধিকারী, কঠোরভাবে অপ্রাপ্তবয়স্কতদের জন্য)
২) নীড় ছোট, তাই কাছে কাছে
৩) ইউরেশিয়ান ব্লু টিট—দুষ্টু ও মিষ্টি
.
তথ্যসূত্র
Marlene Zuk, Leigh W Simmons. Sexual Selection a very Short Introduction. Oxford University Press, 2018 page 25-33