সারা মুখটা যে আবরণে ঢাকা পড়ে তাকে বলি মুখোশ। গোয়েন্দা গল্প, রহস্যরোমাঞ্চ সিরিজ, দীপক চ্যাটার্জী-রতনলাল খ্যাত ড্রাগনের অভিযান থেকে ফেলু মিত্তিরের দার্জিলিং জমজমাটে নানা ধরনের ভয় দেখানো মুখোশের মৌরসীপাট্টা।
মুখোশ শুধু বাস্তবে নয়, কল্পনার জগতেও। দুদিন আগে পর্যন্ত “অমুক বাবু ভালোমানুষীর মুখোশ পরে ঘোরেন” বলতে বুঝতাম সেই বাবু দ্বিচারী। বেশ অনেক বছর আগে বর্তমান কেন্দ্রীয় শাসক দলের পূর্বতন অবতারের প্রখ্যাত নেতা শ্রী গোবিন্দাচার্য তদানীন্ডন প্রধানমন্ত্রীকে দলের মুখোশ ও উপ প্রধানমন্ত্রীকে প্রকৃত মুখ বলে হৈচৈ ফেলে দিয়েছিলেন। বর্তমান অবতারে অবশ্য যিনি মুখ তিনিই মুখোশ, কোনো জটিলতা নেই।
আবার সেই “ধান ভানতে মহিপালের গীত”! ‘ডক্টরস ডায়ালগে’ কোভিড ভ্যাকসিন সংক্রান্ত মদীয় প্রবন্ধের তলায় ভক্তকূলের স-টিক মন্তব্যগুলি সঠিকই ছিল। কেউ লিখেছিলেন লেখকের বদ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে দিনের আলোর মত স্পষ্ট। কেউ লিখেছিলেন বিজ্ঞানচর্চার ‘মুখোশ’-এর আড়ালে রাজনীতির কারবার ফেঁদেছি। বটেই তো। রাজনীতির নামে কদর্য্য জাতিদ্বেষ, মেকি জাতীয়তাবাদের মোড়কে সাম্প্রদায়িক বীভৎসতা, বহিরাগত বলে মাটির মানুষদের বহিস্কার তাঁদের একচেটিয়া অরাজনৈতিক অধিকার। তাঁদের চারটি পায়ের চারটি খুরেই দন্ডব্ত।
যাই হোক সম্পূর্ণ মুখের আচ্ছাদন যদি মুখোশ হয় তাহলে মুখের নিম্নভাগ নাসিকা ও মুখবিবরের ছিদ্রের আবরণকে নাকোশ বলা যেতে পারে। বর্তমান করোনারী (অর্থাৎ করোনার অতিমারীর) কালে তা প্রায় সার্বজনীন।
আর বৈচিত্রই বা কি! সাতরঙা রামধনু রঙের কাপড়ের নাকোশ, চিত্র বিচিত্র ছবি আঁকা নাকোশ, রাজনৈতিক দলের জোড়াফুল, কোকোনদ বা কাস্তে হাতুড়ি লাঞ্ছিত নাকোশ এমনকি দেব দেবীর মূর্তি আঁকা নাকোশ গড়িয়াহাট থেকে হাতিবাগান সমাকীর্ন। যারা আরও সতর্ক ও বিদগ্ধ মানুষ, তারা ব্যবহার করছেন সার্জিকাল মাস্ক (যা এতদিন চিকিৎসক বা স্বাস্থ্যকর্মীদেরই একচেটিয়া ছিল), এমনকি বিগত ডিসেম্বর থেকে বিখ্যাত হওয়া ‘এন-৯৫’ (N95) মাস্ক- তা যত মহার্ঘ্যই হোক না কেন! এই জন সচেতনতা বা অতিমারীর অতি উদ্বেগকে পুঁজি করে মাস্ক-এর কালোবাজারি এবং নকল নাকোশের কারবার দারুণ ফুলে ফেঁপে উঠেছে এই দুঃসময়ে। বহু মানুষের কপালে বা থুতনির তলায় মাস্ক বিরাজমান—মাদুলি বা তাবিজের মত। তাঁদের বোধ হয় দৃঢ় বিশ্বাস যে শরীরের সঙ্গে লেগে থাকলেই ভাইরাস পর্যুদস্ত হবে। সন্ধ্যা হলেই গলায় তাবিজের মত মাস্ক ঝুলিয়ে চায়ের দোকানের আলো-আঁধারিতে বাজারী পত্রিকার এবং বৈদ্যুতিন মাধ্যমে প্রাপ্ত জ্ঞানের আদানপ্রদান কি ধরনের জনসচেতনতা ভেবে অবাক হতে হয়। যাকগে সে কথা। আজকের সংক্ষিপ্ত প্রবন্ধের আলোচ্য বিষয় হল মাস্ক বা নাকোশের প্রকারভেদ ও প্রয়োজনীয়তা।
প্রথমেই বলে নেওয়া ভালো মাস্ক হচ্ছে প্রতিরোধ মূলক নয়, বিবর্তন মূলক। অর্থাৎ মাস্ক আপনাকে অন্য মানুষের নিক্ষিপ্ত হাঁচি কাশির মধ্যে উপস্থিত ড্রপলেট বা ভাইরাস থেকে খুব একটা নিরাপত্তা দেয় না। করোনা বা অন্যান্য ভাইরাসের যা আয়তন (০.৩-০.৫ মাইক্রন) তাতে কোন ধরনের মাস্কের দ্বারাই তার চলাচল বন্ধ হওয়ার কথা নয়। অবশ্য বড় আকারের জলবিন্দু বা ড্রপলেটকে তা রুখতে পারে। মাস্কের মূল উদ্দেশ্য হল আপনার থেকে যাতে জীবাণু অন্য মানুষের শরীরে ছড়িয়ে না যায়, তা প্রতিহত করা। তাও মানুষ মূলতঃ সংবাদমাধ্যমের দ্বারা বিভ্রান্ত হয়ে এবং সরকারী রং বেরং এর বিশেষজ্ঞ দ্বারা প্রাণিত হয়ে প্রাণমনে নানা ধরনের মাস্ক ধারণ করছেন যার অধিকাংশই চুড়ান্ত অস্বাস্থ্যকর ও ঝুঁকিপূর্ণ। নিরাপত্তার ছদ্ম প্রতিশ্রুতি ছাড়া এগুলো কিছুই দেয় না।
করোনা ভাইরাস বায়ুবাহিত কিনা সে নিয়ে বিতন্ডা চলছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ৩ বার নিজেদের মত পরিবর্তন করেছেন। ৪০টি দেশের প্রায় ২৫০ বিজ্ঞানী WHO-কে চিঠি দিয়ে জানিয়েছেন যে করোনা ভাইরাস বায়ু মাধ্যমে ছড়াতেই পারে। এ তথ্য যদি সত্য হয়, তবে মাস্ক পরে তাকে আটকানো অসম্ভব।
রং বেরং-এর মাস্ক
আমাদের দেশে আমদানী করা ও উৎপাদিত মাস্কের সিংহভাগ তৈরি হয় বুননহীন (non-woven) থার্মোপ্লাস্টিক বাজারের থলির কাপড় দিয়ে যা বাজারের সবচেয়ে শস্তা প্লাস্টিক। এই জাতীয় প্লাস্টিককে বলা হয় PP fabrics বা Propylane Polymer ফাব্রিচস, এই ধরনের কাপড়ের (?) মাস্কের সবচেয়ে বড় বিপদ হল, ওপরের ও নীচের আলগা আঁশ আঁশ তন্তু থাকে যার অতিক্ষুদ্র কণা ফুসফুসে ঢুকে যায় ও দীর্ঘ ব্যবহারে ফুসফুসের অসুখ, ক্যানসার, স্নায়ু রোগ প্রভৃতি হতে পারে। তাছাড়া এই ধরনের কাপড়ে নানা ধরনের ভারী ধাতু যেমন থ্যালিয়াম, সীসা, ক্যাডমিয়াম, পারদ প্রভৃতি থাকে, যা শরীরের প্রবেশ করলে নানা অসুখ বিসুখ হতে পারে। যেমন ফুসফুসের অসুখ, যকৃতের অসুখ, চর্মরোগ, হরমোনের তারতম্য, নানা ধরনের ক্যানসার, বন্ধ্যাত্ব ইত্যাদি। উন্নত বিশ্বের সব দেশে এই ধরনের মাস্ক তৈরী করা এবং বাজারজাত করার আগে তার গুণমান নির্ণয় করার নির্দিষ্ট নিয়ম আছে যা আমাদের দেশে অনুপস্থিত। বিদেশে সমস্ত ধরনের মাস্কে তন্তু এবং জীবাণু প্রতিরোধ সংক্রান্ত পরীক্ষা হয় আন্তর্জাতিক গুণমানের ভিত্তিতে। এসব আমাদের দেশে প্রেতের অট্টহাসির মত শোনায়।
নাকোশের প্রকারভেদ
মাস্ক মূলতঃ তিন প্রকার।
১। কাপড়ের মাস্ক; যা এখন বহুল পরিমাণে ব্যবহৃত হচ্ছে। আমেরিকার সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল বা CDC সাধারণ মানুষের জন্য বিশেষত যেখানে জীবাণু দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে, সেই সব জায়গায় এই মাস্ক ব্যবহার করতে বলেছে, যাতে ভাইরাস দ্রুত গতিতে না ছড়াতে পারে। কিন্তু স্বাস্থ্যকর্মী, হাসপাতাল কর্মী বা রোগীর এই ধরনের মাস্ক ব্যবহার করে কোন লাভ নেই।
২। ত্রিস্তর (Triple layer) সার্জিকাল মাস্কঃ এই মাস্ক মুখে আলগাভাবে লাগানো থাকে এবং একবার ব্যবহারের পরেই ফেলে দেওয়া উচিৎ। কেচে বা পরিষ্কার করে এই মাস্ক ব্যবহার করা যায় না। কোন অবস্থাতেই এই সার্জিকাল মাস্ক জীবাণু থেকে পুরো নিরাপত্তা দেয় না। ছিঁড়ে গেলে বা ভিজে গেলে এই মাস্ক সঙ্গে সঙ্গে পালটে নিতে হবে।
৩। এন ৯৫ মাস্কঃ ডিসেম্বর মাসের আগে এই মাস্কের নামও আমজনতার অজানা ছিল। আর আজ প্রায় সমস্ত মানুষ এই মাস্ককেই করোনার বিরুদ্ধে রক্ষাকবচ বলে ধরে নিয়েছেন। সেই সুযোগে হাজার হাজার জাল নাকোশ কেবল এন ৯৫ ছাপ্পা মেরে বিক্রি করছে। প্রকৃত দামের ৪-৫ গুণ বেশি দাম দিয়ে মানুষ তা কিনছেন এবং বিপুল আত্মতৃপ্তি বোধ করছেন। এন ৯৫ কথাটির অর্থ হল ৯৫ শতাংশ বায়ুর মধ্যে ভেসে থাকা কণাকে (Suspended Particle) এই মাস্ক আটকে দিতে পারে। N95 মাস্ককে পরিভাষায় N95 রেসপিরেটরও বলা হয়। এর বৈজ্ঞানিক নাম হল N95 filtering face piece Respirator (FFR) এগুলি এমন ভাবে তৈরী, যা তরল পদার্থ রোধী।
ব্যাকটেরিয়া প্রতিরোধী (কিন্তু ভাইরাস নয়) আমাদের শরীরের পক্ষে উপযোগী (biocomfortable) ও দাহ্য নয়। বিশেষভাবে ল্যাবরেটরীতে নানা পরীক্ষা করে তবেই এই মাস্ক বাণিজ্যিক ভাবে বিক্রি করা যায়। আগেই বলা হয়েছে আমাদের দেশে গুণমান পরীক্ষা না করেই বহু সংস্থা নকল N95 মাস্ক বিক্রি করছে। সাধারণভাবে এন ৯৫ মাস্ক পুনর্ব্যবহারযোগ্য নয়। এবং যে সব ডাক্তার ও স্বাস্থ্যকর্মী সরাসরি কোভিড রোগীর চিকিৎসার সঙ্গে যুক্ত এবং যেখানে রোগীর হাঁচি কাশির মারফৎ এরোসল ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা আছে তাদেরই এন৯৫ মাস্ক ব্যবহার করা উচিৎ। ICMR (ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অফ মেডিক্যাল রিসার্চ) এবং CDC (Center for disease Control USA) র নির্দেশিকায় স্পষ্ট বলা হয়েছে যে সাধারণ মানুষের এই ধরনের মাস্ক ব্যবহার করার কোন যুক্তি নেই। তবে তা শুনছে কে?
এন ৯৫ মাস্ক নাক ও মুখমন্ডল আবরণ করে এবং মুখের ওপর গোল হয়ে চেপে থাকে। ফু দিলে ফুলে ওঠে এবং বাতাস এর থেকে বেরোনোর কথা নয় (Blowing Test)। অপরপক্ষে সাধারণ ত্রিস্তর সার্জিকাল মাস্ক মুখের ওপর আলগাভাবে বসে থাকে (Loose fitting) যাতে ব্যবহারকারীর মুখ ও নাক থেকে কোন সংক্রমণ পরিবেশে ছড়িয়ে না পড়ে।
N95 ,মাস্ক ব্যবহার সম্পর্কে কিছু সতর্কতা
ক) কারা এই নাকোশ ব্যবহার করবেন না?
ক) ২বছরের নীচে শিশু, যাদের দীর্ঘকালীন শ্বাসকষ্ট, হার্টের অসুখ বা অন্যান্য নিশ্বাস প্রশ্বাসের সমস্যা আছে, তাদের এই মাস্ক ব্যবহার করা বারণ।
খ) দৌড়ানো, জিম করা বা অন্য শারীরিক পরিশ্রমের সময় কোনো ধরনের মাস্কই ব্যবহার করা উচিৎ নয়।
গ) যে সব ছেলেদের মুখে প্রচুর দাড়িগোঁফ আছে, তারা এই ধরনের মাস্ক ব্যবহার করতে পারবে না, কারণ তাতে এই ধরনের মাস্ক মুখের ওপর সঠিকভাবে চেপে বসতে পারবে না।
ঘ) অনেক বাজারজাত এন৯৫ মাস্কে দেখা যাচ্ছে প্লাস্টিকের বড়ো বোতামের মত একটি জিনিস থাকে, নিশ্বাস ছাড়ার সুবিধার জন্য, যাকে বলা হয় Exhaler .
ICMR কিন্তু তাদের সর্বশেষ নির্দেশিকায় জানিয়েছে covid রোগীর চিকিৎসার সঙ্গে যুক্ত চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের পক্ষে এই নিশ্বাস-পথযুক্ত এন৯৫ মাস্ক ব্যবহার করা বিপজ্জনক ও অসুরক্ষিত।
আর একটা কথা মনে করিয়ে দিই, বাজারে যে সব মাস্ক বিক্রী হচ্ছে, তাতে অনেক সময় দাম বাড়াবার জন্য প্রকৃত এক্সহালের-এর বদলে মাস্কের উপরে একটা প্লাস্টিকের ছিপি বসিয়ে দেওয়া হচ্ছে, যার আদৌ কোন কাজ নেই।
তাহলে ভালো মাস্ক চিনবো কি করে?
সাধারণ জনগণের উদ্দেশ্যে বলি দামী এবং ভালো মাস্ক পরার প্রয়োজন নেই, কারণ তা আপনাকে করোনা থেকে নিরাপত্তা দিতে পারবে না। আর হাসপাতাল বা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে মাস্ক ব্যবহারের জন্য আপনাকে অনুমোদিত সংস্থার শংসাপত্র দেখতে হবে, যেমন, National Personal Protective Technology Laboratory (NPPTL), National Institute for Occupational Safety And Health (NIOSH), Center for Disease Control and Prevention (CDC), Centre for International Regulatory Assistance (CITRA)
মাস্কের পুনর্ব্যবহার
১) সাধারণ সুস্থ মানুষ কাপড়ের নাকোশ ধুয়ে নিয়ে রোদে শুকিয়ে পুনর্ব্যবহার করতে পারেন। কিন্তু একজনের ব্যবহৃত জিনিস অন্যজন ব্যবহার করবেন না (অবিনিময় যোগ্য)
২) সার্জিকাল মাস্ক ব্যবহারের পর ফেলে দেওয়া উচিত (Disposable)
৩) N95 মাস্ক সাধারণ ভাবে পুনর্ব্যবহার না করাই ভালো কিন্তু বিশেষ পরিস্থিতিতে জীবাণুমুক্ত করে তা ব্যবহার করা যায়। একদিন ব্যবহার করার পর আপনার N95 মাস্কটি (যদি ছিঁড়ে ফেটে না যায়), শুকনো খবরের কাগজের মধ্যে রেখে দেবেন বা রোদে দড়িতে ঝুলিয়ে রাখতে পারবেন এবং ৪-৫ দিন বাদে তা আবার ব্যবহার করতে পারবেন। অর্থাৎ আপনি যদি ৪-৫ টি মাস্ক কেনেন, এবং একদিন করে ব্যবহার করেন, তাহলে এই ধরণের পুনর্ব্যবহার সম্ভব। একে বলে ‘মাস্ক রোটেশন’।
আশাকরি নাকোশ সম্পর্কে কিছু আলোকপাত করা গেল।
ছবিসূত্র : পিয়ালী দে বিশ্বাস
নাকোস পড়ে কেমন যেন নাক্কোস নাক্কোস লাগলো। নাক্কোস খোক্কোস দত্যি দানো।
যার হৃদরোগের সুত্রপাত হচ্ছে, সে যদি একসঙ্গে দুটি করে এন৯৫ নাকোস নিয়মিত ব্যবহার করে, তাহলে তার হৃদরোগ কি ত্বরান্বিত হতে পারে? সুস্থ মানুষ এভাবে দুটো করে এন৯৫ একসঙ্গে দীর্ঘক্ষণ দীর্ঘদিন ব্যবহার করতে থাকলে কি হৃদরোগের সম্ভাবনা বাড়তে পারে?
বর্তমান সময়ের জন্য এক অনবদ্য লেখা । মানুষ বর্তমানে এই কোভিড কালে ভীষণ ভাবে ভীত ও সন্ত্রস্ত । তাই প্রকৃত জ্ঞানের জন্য এই লেখা এক দলিল স্বরূপ ।