টিভির পর্দায় ফর্সা হবার বাজারি ক্রিমের বিজ্ঞাপন দেখতে দেখতে আমার পাড়ার এক কাকিমার ভীষণ সখ হয়েছিলো ফর্সা হবার ক্রিম কিনে মুখে লাগাবে। আমি ঠাট্টা করে বলেছিলাম তোমার ওই কালো রঙের সুন্দর মুখখানা দেখেই তো কাকু তোমাকে জীবনসঙ্গী করে এনেছে এই বয়েসে এসে কেনও অকারণে তোমার সুন্দর মুখখানা পোড়াবে কাকিমা। কাকিমা অবাক নয়নে আমার দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে বললো কেনো রে অনেকেই তো মাখে! কাকিমা আজ আর বেঁচে নেই। বেঁচে থাকলে নিশ্চিত ভাবে এই মেয়েটির মুখের ছবি দেখিয়ে অন্তত বলতে পারতাম, দেখো কাকিমা ফর্সা হবার ক্রিম মুখে লাগিয়ে এই মেয়েটির বর্তমান কি মুখের অবস্থা।
হ্যাঁ জানি শুধু এই মেয়েটির একারই ইচ্ছা নয়। এই ইচ্ছে গুলো লুকিয়ে আছে এ অভাগা দেশের বহু সংখ্যক কালো মেয়ের মধ্যে। এ সমাজে কালো ছেলের যদি বা দাম থাকে কিন্তু কালো মেয়ের কোনও দাম নেই। আমরা কবিগুরুর গান শুনি এবং আপন মনে অনেক সময় গুনগুন করে গেয়েও উঠি ‘কৃষ্ণ কলি আমি তারেই বলি, কালো তারে বলে গাঁয়ের লোক’ -হ্যাঁ এইটুকুই, তারপর আমরা পুরুষেরা নিজের পছন্দের পাত্রীর খোঁজে পত্রিকার পাতায় বিজ্ঞাপনে ভরিয়ে তুলি, সুন্দরী সুশ্রী, গৃহকর্মে নিপুণা কর্মঠ পাত্রী চাই। আর এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় কালো মেয়েরাও নিজেদেরকে সুশ্রী ও ফর্সা করে তুলতে বিজ্ঞাপনের প্ররোচনায় ফাঁদে পা দিয়ে ব্যবহার করে ফেলেন একের পর এক ফর্সা হবার স্টেরয়েড জাতীয় ক্রিম। পরিশেষে এর ফল হয় ভয়ানক। ফর্সা হবার বিষয়টিই হলো একটি সামাজিক কুপ্রথা অথচ এই কুপ্রথার চক্করেই প্রতিনিয়ত ঘুরপাক খাচ্ছে পুরুষতান্ত্রিক ব্যবস্থাপনায় আবদ্ধ এই নারীরা। ফর্সা হবার পরিণতি কি ভয়ঙ্কর হতে পারে আসুন তার বাস্তব এক উদাহরণ আপনাদের সামনে তুলে ধরি।
সাপ্তাহিক দু’দিন আমাদের বারাসাত সিটিজেন ফোরামে নিয়মিত ভাবে অনেকেই আসেন নিজের চিকিৎসার জন্য তেমনই নিজের চিকিৎসার জন্য ডা.পুণ্যব্রত গুণের কাছে এসছিলেন এই মেয়েটি। নিজেকে ফর্সা এবং সুশ্রী করে তুলতে একইভাবে বিজ্ঞাপনের প্ররোচনায় ফাঁদে পড়ে নিজের মুখে দিনের পর দিন লাগিয়েছেন ফর্সা হবার স্টেরয়েড জাতীয় ক্রিম। ফর্সা একটু হয়েছেন কিন্তু তার বিনিময়ে মুখের বেশ কিছু জায়গায় দেখা গিয়েছে ছুলির মতো সাদা ছোপ ছোপ। শুধু তাই নয় ছুলির দাগ গুলো আরও ক্রমশ সাদা হয়ে যাচ্ছে সারা মুখে। অজস্র ব্রণ দেখা দিচ্ছে এমনকি রোদের আলো মুখে লাগলে মুখ জ্বালা করছে। কে জানতো বলুন ফর্সা হবার এত ঝঞ্জাট। মেয়েটি একটি বিউটি পার্লারে কাজ করতো বর্তমান লকডাউন পরিস্থিতিতে তাও বন্ধ। বর্তমানে নিরুপায় হয়েই লোকের বাড়ি বাড়ি গিয়ে একাজ করতে বাধ্য হচ্ছেন। বিজ্ঞাপনের বিজ্ঞাপন নিজেকে দেখাতে গিয়ে অজান্তেই ফর্সা হবার স্টেরয়েড ক্রিম মেখে আজ তার এই বিপত্তি।
সত্যিই কি এভাবে স্টেরয়েড ক্রিম মেখে ফর্সা হওয়া যায়! আসুন এবার সেই বিষয় নিয়েই একটু আলোকপাত করি।
প্রথমেই বলি আমরা কালো হব না ফর্সা হব তা নির্ভর করে আমাদের ত্বকে মেলানোসাইট কোষগুলো কতটা মেলানিন তৈরি করছে তার উপর। মেলালিন হলো বাদামি-কালো রঙের একটি পদার্থ। ত্বকে মেলানোসাইট কোষগুলো কতটা মেলানিন তৈরি করবে তা নির্ভর করে দুটো জিনিসের উপর।
এক – জেনেটিক বা বংশগত কারণ। যা পরিবর্তন করার কোনো উপায় নেই।
দুই – দেহের অংশবিশেষর ধর্ম। যেমন যৌনাঙ্গ বুকের চাইতে কালো হয়। এছাড়াও আর একটি বিষয় পরিবেশ বা মুলত সূর্যের আলো বা রোদ। রোদ লাগলে আমাদের চামড়া কালো হয়ে যায় তাই দেহের ঢাকা অংশ গুলো খোলা অংশের চাইতে সাধারণভাবে ফর্সা হয়।
ফর্সা হওয়ার ক্রিম নয় কিন্তু বিজ্ঞাপনের প্ররোচনায় ফর্সা হবার জন্য প্রতিনিয়ত এই ক্রিম ব্যবহার করে চলেছেন আমাদের দেশের মেয়েরা জানিনা ছেলেরাও চুপিচুপি এই ক্রিম মাখেন কিনা। একধরনের ক্রিম ইদানীং বেশ প্রচলিত অথচ কোনো কোম্পানিই ‘ ফর্সা হবার ক্রিম ‘ হিসেবে কিন্তু বাজারে পাঠায়না। এই নিয়ে বিজ্ঞাপনও দেন না। কিছু ওষুধ দোকানের দোকানদার, বিউটি পার্লার, কিছু হাতুড়ে এবং অসাধু ডাক্তারের সৌজন্যে এগুলো বাজারে ফর্সা হবার ক্রিম হিসেবে দারুণ চলছে। অথচ কারর মাথায় থাকে না যে স্টেরয়েড ক্রিম গুলো ফর্সা হবার জন্য নয়। বেশ কিছু ক্রিম আছে তা বিভিন্ন চর্মরোগের চিকিৎসার জন্য ব্যবহার করা হয় এবং সেই সব স্টেরয়েড ক্রিম গুলো চর্মরোগের চিকিৎসায় ভীষণ কাজের। জেনে রাখা অত্যন্ত জরুরি এই স্টেরয়েড ক্রিম গুলো ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া এই সব ক্রিম বিক্রি করা আইনত দণ্ডনীয়। কিন্তু অদ্ভুত ভাবে আমাদের দেশে আইনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে বেটনোভেট, প্যানডার্ম প্লাস ইত্যাদি নানা নামের ক্রিম বিক্রি হচ্ছে চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া। পাড়ার দিদি-দাদা, মাসি – পিসি থেকে শুরু করে অনেকেই বাতলে দিচ্ছেন কালো মেয়ের ফর্সা হওয়ার উপকারের জন্য। আর এই পরামর্শ অনুযায়ী মেয়েরা প্রথম দিকে একটু ফর্সা হয়েই কিছুদিন পর থেকে মুখ লাল হয়ে যাচ্ছে, কারও সাদা ছোপ ছোপ মতো হ্য়ে যাচ্ছে এছাড়াও ব্রণ, মুখের চামড়া পাতলা হয়ে সব সময় জ্বালা আর চুলকানি।
তাহলে কি সত্যিই কিছু ব্যবহার করবো না এ প্রশ্ন অনেকের মাথায় হয়তো উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে। চিকিৎসক বন্ধুদের ভাষায় সবচেয়ে সহজবোধ্য হল সানস্ক্রিন হিসেবে কাজ করা। আমরা জানি সূর্যের রোদের নানা অংশ আছে। তার মধ্যে থেকে সব অংশ কিন্তু সমান কালো করে না। সূর্যের আল্ট্রাভায়োলেট অংশ যা আমাদের চোখে অদৃশ্য। অর্থাৎ আল্ট্রাভায়োলেট – এ এবং আল্ট্রাভায়োলেট – বি, সংক্ষেপে যাদের ইউভি-এ এবং ইউভি- বি বলা হয় – এরাই কিন্তু আমাদের রং কালো করে বেশি। সানস্ক্রিনের নানা কেমিক্যালে নানা ভাবে সূর্যের রোদের এই ইউভি- এ ইউভি -বি অংশ আটকে যায়।
এছাড়াও অন্য কিছু কেমিক্যাল আছে যা চামড়ার কালো রং কমাতে সাহায্য করে যেমন মনোবেঞ্জাইল ইথার অফ হাইড্রোকুইনোন (২০%) কিন্তু চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া এই রাসায়নিকটির ব্যবহার- এই কর্মটি একদমই করতে যাবেন না৷ চর্ম রোগ হয়েছে নিশ্চই ডাক্তার দেখাবো এতে লজ্জা পাবার তো কিছুই নেই কিন্তু হঠাৎ করে ফর্সা হবার বাসনায় কসমেটিকের দোকান থেকে স্টেরয়েড ক্রিম কিনে মুখে লাগিয়ে অবশেষে মুখ পুড়িয়ে- এটা কি কম লজ্জার। কি প্রয়োজন আছে বলুন কৃত্রিমভাবে নিজেকে সৌন্দর্য করে তোলার। রবীন্দ্রনাথের সেই সুরে আমরা কি গাইতে পারি না –
আমার পানে দেখলে কিনা চেয়ে
আমি জানি আর জানে সেই মেয়ে।
কালো ? তা সে যতই কালো হোক,
দেখেছি তার কালো হরিণ – চোখ।
কৃষকলি আমি তারেই বলি…
কৃতজ্ঞতা স্বীকার – স্বাস্থ্যের বৃত্তে (স্বাস্থ্য ও বিজ্ঞান বিষয়ক সাময়িকী)