চার মাসের বাচ্চাটার জন্মগত নার্ভের রোগ। বুকের ছবিতে বড় সাদা ছোপ। নিউমোনিয়া। জন্ম থেকেই বুক আর পেটের মাঝে বড় ছাতার মতো পেশিটা বাদে শ্বাস নেওয়ার অন্য পেশিগুলো কাজ করে না। হাত পা ভালোভাবে নড়ে না। কিন্তু চোখমুখ বেশ তীক্ষ্ণ আর সজাগ। শ্বাসকষ্ট বাড়তে থাকায় ভেন্টিলেটরে দিতে হলো। এসব বাচ্চাকে একবার ভেন্টিলেটরে দিলে সাধারণত সেখানেই বন্দী হয়ে যায়। এক্ষেত্রেও অন্যথা হয়নি স্বাভাবিকভাবেই। প্রায় দু’সপ্তাহ ভেন্টিলেটরে যুদ্ধ করার পর ক্রমশ নেতিয়ে পড়ছিল। তবু কাল সকাল অব্দিও এক দুবার চোখ খুলে পিটপিট করে দেখছিল। সারাদিনের পরিশ্রম ব্যর্থ করে ভোররাতের দিকে সব শেষ।
দুটো বেড পরেই সেরিব্রাল পলসির বাচ্চা। পায়ে বড় ইনফেকশন। ভর্তির সময় হিমোগ্লোবিন মাত্র দুই। ধীরে ধীরে কিডনিতেও থাবা বসিয়েছে জীবাণু। তিন বছর বয়স। এখনো ঘাড়ই সোজা হয়নি ভালোভাবে। বসতে শেখা, দাঁড়ানো, কথা বলা তো অনেক দূরের ব্যাপার। শুধু আকারে-ইঙ্গিতে কিছু নির্বাক অভিব্যক্তি। নাকি বাদবাকি পৃথিবীর দিকে আঙুল উঁচিয়ে অবোধ্য প্রতিবাদ? সেও তো তিনদিন ভেন্টিলেটরে থেকে ঝুপ করে ঝরে গেল। বাড়ির লোকজনও শেষমেষ আর পেরে উঠছিল না। প্রথম প্রথম আবেগের তীব্র টান থাকে। তারপর রোজ রোজ স্নান করিয়ে দেওয়া, খাইয়ে দেওয়া, পায়খানা-পেচ্ছাব করিয়ে দেওয়া, আরো খুঁটিনাটি যাবতীয় কাজ করিয়ে দিতে দিতে একসময় বাবা-মা’ও হাঁফিয়ে ওঠেন। কোনও কাজই ও নিজে পারে না যে! জীবিকার টান, পেটের খিদে আর সময়ের প্রলেপ; সব মিলিয়ে আবেগগুলো কমতে থাকে। আমি অন্তত এর মধ্যে অস্বাভাবিক কিছু দেখি না।
মৃত্যু আসে। ঘনঘনই আসে। মৃত্যু ঘিরে রহস্যময়তা বিদায় নিয়েছে কবেই। তবুও নিজের থেকে আরেকটা ‘আমি’কে আলাদা করে সামনে দাঁড় করিয়ে ভাবতে বসলে দেখি; এই তো এক্ষুনি ছিল জলজ্যান্ত একটা প্রাণ! হৃদপিণ্ডটা ধুকপুক করছিলো তালে তালে। আমি মৃত্যুসংবাদ ঘোষণা করার আগে অব্দিও সে ছিল একটা জীবন্ত প্রাণ, একটা জীবন্ত সত্ত্বা। ঠিক ঘোষণা করার পরেই সে খাতায়-কলমে মৃত হয়ে গেল। খাতায় কলমে লিখে দিলাম এই শরীরের আর পৃথিবীর জল হাওয়ায় কোনও অধিকার নেই। কী এক অদ্ভুত শূন্য শূন্য সে অনুভূতি! আমারই কলমের তলায় তার হৃদপিন্ডের স্পন্দন থেমে যাচ্ছে। একটা দু’টাকার পেন আরেকটা এক টাকার কাগজ। ব্যাস! জীবনের মূল্য শুধু এইটুকু…
এদিকে তার পাশের বেডের বাচ্চাটা আশঙ্কাজনক অবস্থা থেকে ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠছে। প্রথম দু’দিন ছিল ভেন্টিলেটরে। পরের দিন শুধু মাস্কে অক্সিজেন। এখন তো বেশ ভালো কথা বলছে, সবকিছু খেতে পাচ্ছে। একটু ভালো হতেই বায়না ধরেছে, “কবে বাড়ি যাব ডাক্তার বাবু?” সত্যিই তো, কেই বা থাকতে চায় এই মৃত্যুপুরীতে? একই সাথে, একই দিনে কাঁচে ঘেরা আইসিইউর ভেতরে জীবনের রং বদল। সবুজ চাদরে বিছানাগুলো ঢাকা। সবুজ চাদরের ক্যানভাসে কোথাও ফুটে ওঠে জীবনের উষ্ণতা, কোথাও মৃত্যুর শীতলতা।
নাইট ডিউটি করে ফিরে আসার পর আরাধ্যা ফোন করেছিল। সেই আরাধ্যা! যাকে জঙ্গলমহলের শালবনি সুপারস্পেশালিটি হাসপাতালে গলায় নল পরিয়ে হাওয়া ভরা ব্যাগ চেপে চেপে সবাই মিলে বাঁচিয়ে তুলেছিলাম। একটানা ব্যাগ পাম্প করা হয়েছিল চব্বিশ ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে। তখন হাতে ভেন্টিলেটার ছিল না। ভেন্টিলেটরের নব ঘুরিয়ে হাওয়ার বেগ আর মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করার কোনও উপায় ছিল না। যে কোনো সময়ই দুর্ঘটনা হতে পারত। তবু ঝুঁকিটা নিয়েছিলাম কারণ রেফার করলে রাস্তাতেই অবধারিত মৃত্যু। আরাধ্যা বেঁচে যায়। এখন সম্পূর্ণ সুস্থ। কে জানে, হয়তো এক প্রকার হঠকারিতাই ছিল। এভিডেন্স বেজড মেডিসিন, কনজিউমার প্রটেকশন অ্যাক্ট, আইন আদালত আর চিকিৎসক নিগ্রহের জাঁতাকল যেভাবে চেপে বসছে তাতে দ্বিতীয়বার এরকম দুঃসাহসিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে আমিই একশোবার ভাববো। জানি না, চিকিৎসক আর রোগীর মধ্যে সন্দেহের বাতাবরণ সৃষ্টি হ’লে আসলে লাভটা কার? আরাধ্যা বলেছে, “কাকু, তুমি ইদিকে আর আসব নি? বাবা বলছ্যা তুমি এলে তমার জন্য আলু-পিঁয়াজ দিবে। মোদের মাঠে অনেক হছ্যা।” কোনোমতেই যাওয়া হবে না জেনেও মিথ্যে প্রবোধ দিই, “হ্যা, যাবো বাবা। তুমি ভালো থেকো। কেমন?”
এসব কথোপকথন ক্রমেই বিরল হয়ে আসছে। এখন শুধু যন্ত্রচালিতের মত কাজ করে যাওয়া। তারই মধ্যে কিছু কিছু মৃত্যু বুদবুদের মত উঠে রক্তাক্ত করে যায়। মারীর দেশে রক্তাক্ত হওয়াই ভবিতব্য…
ছবিঃ গুগল
Sir where is your clinic? Are you available in Kolkata?