রমজান মাসে ডায়াবেটিসের রোগীরা পড়েন বিপদে। তার সাথে সাথে আমাদের চিকিৎসকদের বিপদও কম নয়।
রোগীরা ভোর রাতে সেহেরির খাওয়ার আগে ইনসুলিন নিয়ে নেন বা সুগারের ওষুধ খেয়ে নেন। আবার খাবার খাবেন প্রায় ১৪ ঘণ্টা বাদে, যেখানে ডায়াবেটিসের রোগীদের প্রতি তিন বা চার ঘণ্টা অন্তর কিছু খাওয়া উচিৎ। ফলে নিয়মিত গণ্ডগোল ঘটে।
চিকিৎসা শাস্ত্রে নিত্যনতুন প্রটোকল বার হয়। কিভাবে ডায়াবেটিস নিয়ে রোজা পালন করা যায় তাই নিয়েও অনেকগুলি প্রটোকল তৈরী হয়েছে। সেখানে বলা আছে রোজা চলাকালীন দিনের মধ্যে পাঁচবার রক্তের গ্লুকোজ পরীক্ষা করতে এবং গ্লুকোজ ৭০মিগ্রা/ডেসি-লির নীচে নামলে বা অত্যাধিক বেড়ে গেলে রোজা ভেঙে ফেলতে হবে। এবং আরও বলা হয়েছে রোজা চলাকালীন রক্ত পরীক্ষা করলে রোজা ভাঙে না।
কিন্তু দুঃখের ব্যাপার হলো আমার অধিকাংশ রোগীর দিনে পাঁচবার রক্ত পরীক্ষা করার সামর্থ্য নেই। তাঁরা পাঁচ মাসেও একবার রক্ত পরীক্ষা করান না।
ফলে এসময় রোজই দুচারটি হাইপোগ্লাইসেমিয়ার কেস পাই। আজও এসেছিলেন এক শুকনো চেহারার মহিলা। সুগার মাপা হলো। ৪২মিগ্রা/ডেসি-লি তে নেমে গেছে। একেবারে নেতিয়ে পড়েছেন। তাড়াতাড়ি গ্লুকোজ এনে খাওয়াতে বললাম। সাথে আপাদমস্তক ঢাকা তার মেয়ে এসেছিল। বলল, ‘তাহলে তো মায়ের রোজা ভেঙে যাবে। আর ঘণ্টা খানেক পরে খাওয়ালে হতো না?’
খুব ইচ্ছা করছিল অকাল পক্ক মেয়েটির কানের তলায় বিরাশি সিক্কার একটা চড় বসাই। কিন্তু আমি চিকিৎসক। মারধোর করা খারাপ দেখায়।
ভদ্রমহিলা গ্লুকোজের গোটা প্যাকেট খেয়ে আধ ঘণ্টা বাদে উঠে বসলেন। বললাম, ‘জোর বাঁচা বেঁচে গেছেন। এই অসুস্থ শরীরে আর রোজা রেখেন না। আরেকটু হলেই মারা পড়তেন।‘
ভদ্রমহিলা দেখি মেয়ের এক কাঠি উপরে। বললেন, ‘সবই আল্লার ইচ্ছা বাবা। মরলে তাঁর হাতেই মরতুম। রোজা রেখে মরা তো সৌভাগ্য।‘
এটুকু বুঝলাম, এনাকে বোঝানোও আমার কর্ম নয়। বস্তুত এই উপোষ ব্যাপারটা বাঙালিদের একেবারে মজ্জায় মজ্জায় ঢুকে গেছে। কিছু মানুষ বাধ্য হয়ে উপোষ করে। আর বাকিরা যেকোনো ছুতো নাতায় উপোষ করে। বিশেষ করে বাঙালি মেয়েদের উপোষের ব্যাপারে আপোস নেই। শিব রাত্রি, একাদশী, রটন্তী কালী পুজো- ছুতো একটা পেলেই হোলো।
শিবরাত্রির পরদিন পেটে ব্যথা আর বমির রোগীর ভিড়। এমনিতেই সকলেই প্রায় ক্রনিক অ্যানিমিয়া আর গ্যাস্ট্রিকের রোগী। একদিন উপোষ করে প্রায় যায় যায় অবস্থা। এদিকে মুখে বড় বড় বুলির অভাব নেই, “মরে গেলেই ভালো ডাক্তারবাবু। পুণ্য কাজে মৃত্যু হলে স্বর্গ বাস।‘
বললাম, ‘স্বর্গ লাভের এমন সুযোগ হাতছাড়া করছেন কেন? ডাক্তারের কাছে এলেন কেন?’
‘সেও ভগবানের লীলা। তিনিই আপনার কাছে পাঠিয়েছেন।‘
অনেক কিছু বলার ছিল। কিন্তু যিনি সাধারণ লজিকের ধার ধারেন না, তাকে লজিক্যাল ফ্যালাসি বোঝানো আমার কম্ম নয়।
তবে সকলেই যে এমন ধর্ম নিষ্ঠ, তা নয়। অনেকেই দিব্যি খাবারদাবার খেয়েও উপোষ করে। আমি যখন গ্রামে চাকরি করতাম তখন গ্রামের সমবয়সী কয়েকজন মুসলিম ছেলে বন্ধু হয়ে গেছিল। একটি ছেলে রোজার সময় প্রায় প্রতিদিনই দুপুরে আমার কোয়ার্টারে এসে খেয়ে যেত। একদিন বলল, ‘বাবার শরীরটা ভালো যাচ্ছে না। আপনার কাছে আসতে পারে। আপনি কিন্তু ঘুণাক্ষরেও বলবেন না আমি আপনার কাছে খেয়ে যাই। বাবা জানে আমি রোজ রোজা রাখি।‘
আমার কোয়ার্টারে তখন পিকনিক লেগেই থাকতো। পিকনিক মানেই ভাত আর মুরগির মাংস। যে ধাপধরা গোবিন্দপুরে থাকতাম সেখানে খাসির মাংস খেতে হলে গোটা খাসিই কিনতে হতো। যেহেতু গোটা খাসি থেকে গোটা মুরগি কেনা অনেক যুক্তি যুক্ত, তাই আমাদের পিকনিকের মেনু পালটাতো না।
একদিন আমি ও ওই ছেলেটি মুরগি আনতে গেছি, ছেলেটি বলল, ‘মুরগী ঘরে নিয়ে চলেন। এখানে কেউ হালাল পদ্ধতিতে কাটে না। সাচ্চা মুসলিম কখনো হালাল মাংস ছাড়া খায় না।‘
জিজ্ঞাসা করলাম, ‘হালাল পদ্ধতি কি বটে?’
ছেলেটি বলল, ‘এ পদ্ধতিতে মুরগিটিকে জবাই করার আগে বিসমিল্লাহ নাম নিতে হবে। তার মাথাটি কাবার দিকে ঘোরানো থাকবে। একটা ধারালো ছুরি দিয়ে গলার সামনের দিকটা কাটতে হবে, এবং শিরা কেটে সব রক্ত বেরিয়ে যাওয়ার জন্য অপেক্ষা করতে হবে।‘
তারপর বলল, ‘আপনার হালাল মাংস খেতে আপত্তি নেই তো?’
বললাম, ‘আমার কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু এভাবে মুরগীটাকে কাটবে কে?’
ছেলেটি গর্বিত মুখে বলল, ‘কেন আমিই কাটব। আমি একজন সাচ্চা মুসলমান।‘
বললাম, ‘হ্যাঁ, সেতো রোজার সময়েই টের পেয়েছি।’
ছেলেটি চুপ হয়ে গেল। সম্ভবত তাঁর ধর্মবিশ্বাসে নিয়ে প্রশ্ন তোলায় সে অত্যধিক মনঃক্ষুণ্ণ হয়েছে। বাজার সেরে যখন কোয়ার্টারে ঢুকলাম, সুচিত্রাদি ভাত বসিয়ে দিয়েছে। জ্যান্ত মুরগি দেখে বলল, ‘মুরগি কাটিয়ে আনেন নি কেন? আমি কিন্তু মারতে পারব না। আহা, কেষ্টার জীব।‘
ছেলেটি বলল, ‘আমিই কাটব। দিদি, আমাকে একটা ধারাল ছুরি দেন তো।‘
‘ছুরি তো নাই।‘
‘তাহলে বটি-খান দেন।‘
আমরা মুরগি নিয়ে কোয়ার্টারের পেছনে এলাম। ধুধু ধানক্ষেত। সূর্য ঢুবে গেছে। সামান্য লাল আভা দিগন্ত রেখায় লেগে রয়েছে। আসতে আসতে অন্ধকারে চরাচর ঢুবে যাচ্ছে।
ছেলেটি মুরগি ধরে বিড়বিড় করে কিছু বলছে। বিড়বিড় করেই চলেছে। আমি অন্যদিকে তাকালাম। মুরগির মাংস অত্যন্ত উপাদেয়। কিন্তু মুরগি মারা দেখাটা কষ্টকর।
হঠাত ঝটপট করে আওয়াজ। তারপর ছেলেটির আত্মচিৎকার। পরক্ষণেই অতবড় চেহারার ছেলেটি ঝুপ করে মাটিতে পরে গোঁ গোঁ করতে লাগল। মুরগিটি ডানা ঝাপটিয়ে ধানক্ষেতে ঢুকে গেল।
চোখে জল ছিটিয়ে ছেলেটির জ্ঞান ফেরানো হলো। চোখ খুলেই সে প্রথম কথা বলল, ‘মুরগিটা কোথায়?’
সুচিত্রাদি মুখে আঁচল চাপা দিয়ে হাসছে। বললাম, ‘ও মুরগির আর খোঁজ করে লাভ নেই। ধানক্ষেত কেউটেতে ভর্তি। অন্ধকারে ধানক্ষেতে জলের মধ্যে নেমে মুরগি খুঁজলে সাপের কামড় খেতে হবে।‘
সুচিত্রাদি বলল, ‘একটা বাঁধাকপি আছে দেখছিলেম। ওইটাই রেঁধে দি। ওই দিয়েই পিকনিক করে নিয়েন।’