কয়েকদিন আগে আমার এক রোগিনীকে ক্যালসিয়াম ও ভিটামিন-ডি খেতে লিখেছিলাম। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, এসবের বদলে উওমেন হরলিক্স খেলে হবে কি না।
আমি বললাম, হরলিক্স তো লোকে ‘এমনি এমনি খায়’। ‘এপাং ওপাং ঝপাং’। সবই বিজ্ঞাপনের মোড়ক। বিজ্ঞাপনে সবই ঢেকে যায়, মুখ তো বটেই। কিন্তু শুধু মোড়ক খেলেই তো হবে না, ওষুধটাও খাওয়া চাই। সুতরাং বিজ্ঞাপন ছেড়ে আসল ক্যালসিয়াম খেতে হবে।
রোগিনী বললেন, ‘কিন্তু সবাই তো বলে উওমেন হরলিক্স খেতে।’
‘সবাই মানে?’
‘এই তো, ফেসবুক- হোয়াটসঅ্যাপে আমার বন্ধুবান্ধবরা সবাই খায়।’
‘সবাই খায়? আপনি সিওর?’
উনি অবাক হয়ে বললেন, ‘হ্যাঁ।’
‘যারা যারা বলে, সবাইকে আপনি উওমেন হরলিক্স খেতে দেখেছেন? আর খাওয়ার পরে তাদের উন্নতি হতে দেখেছেন?’
‘খেতে কি করে দেখব? ফেসবুকের বন্ধুদের বেশীরভাগকে তো চিনিই না।’
‘চেনেন না, শুধু তারা লিখছে যে তারা উওমেন হরলিক্স খায়। তারা সত্যিই খেয়েছে কি না এটার কোনো যুক্তিগ্রাহ্য প্রমাণ নেই। অথচ তারা, মানে আপনার সোস্যাল মিডিয়ার বন্ধুরা, যা বলছে, তা আপনি সত্যযুগের সরলতায় বিশ্বাস করবেন? যাচাই করে নেবেন না?’
এইবার ভদ্রমহিলা মনে হল বাস্তবে ফিরলেন। ‘তাহলে ডাক্তারবাবু, কোন ক্যালসিয়ামটা খাবো?’
লিখে দিলাম সেটা।
এটা একটা উদাহরণ। ইনি একা নন। লক্ষ লক্ষ- হয়ত বা তার চেয়েও বেশী মানুষ- এই রোগে ভোগেন।
রোগটা হল, ‘পিছিয়ে পড়ার ভয়’। ইংরেজিতে যাকে বলে ‘Fear Of Missing Out’ বা ‘FOMO’। তথাকথিত বন্ধুরা সবাই উওমেন হরলিক্স খাচ্ছে এবং ফেসবুকে ষ্ট্যাটাস আপডেট দিচ্ছে। সুতরাং ওনাকেও খেতে হবে। না খেলেই ব্যাকডেটেড।
সোস্যাল মিডিয়াতে বন্ধুবৃত্তে যারা আছে (যদিও তাদের ৯০% কে হয়ত আসলে কোনোদিন চিনি না, চাক্ষুষ দেখিই নি), তারা যা যা করছে তার চেয়ে কিছু বেশী অথবা নিদেনপক্ষে সমান সমান না করলে সমাজে মানসন্মান থাকে না যে! তবে, এইক্ষেত্রে ‘সমাজ’ মানে হল, ভার্চুয়াল সমাজ। মুষ্টিমেয় সংখ্যক প্রতিবেশী, বন্ধু, সহকর্মী, আত্মীয়রা তার অন্তর্গত হতেও পারে। তবে তার বাইরে, বাস্তবে অপরিচিত মানুষের সংখ্যা অনেক বেশী।
সবাই যদি ‘ম্যাজিক ফ্রেমে’ উদ্ভট অবাস্তব ছবি পোষ্ট করে- তাহলে আমাকেও সঙ্গে সঙ্গে সেটা করতে হবে। কাল্পনিক বৃদ্ধবয়সের চেহারার ছবি (হয়ত ওই বয়স পর্যন্ত পৌঁছনোর সুযোগই আসবে না) পোষ্ট করার ট্রেন্ড শুরু হলে, আমি যদি তা না করতে পারি- তাহলে রাতে ঘুম হবে না, মাথায় যন্ত্রণা শুরু হবে, কাজে মন দিতে পারব না। মোদ্দা কথা হল, ফেসবুকের আঙিনায় পিছিয়ে পড়ার আতঙ্ক আমায় গ্রাস করবে।
এছাড়া, বন্ধুরা তাদের রান্না করা বা বড় বড় নামীদামী রেস্তোরাঁয় পরিবেশিত খাবারের ছবি তাদের ফেসবুক দেওয়ালে পোষ্টালে, আমাকে অন্ততপক্ষে বিরিয়ানি ইত্যাদি রান্না করে স্মার্টফোনে ছবি তুলে তার জ্যান্ত ছবি দিতে হবে। অন্যের কাছে যতই সেগুলো অসংবেদনশীল মনে হোক না কেন, অথবা যতই বহু গরীব মানুষ আজকে না খেয়ে থাকুক, অথবা কারো দয়ায় শ্রমজীবী ক্যান্টিন বা কমিউনিটি কিচেনে খেয়ে কোনোমতে বেঁচে থাকুক না কেন।
বন্ধুরা গুলমার্গের ছবি দিলে আমাকে সুইজারল্যান্ড, নরওয়ে বা ওইরকম কোথাওকার ছবি দিতেই হবে। না পারলেই সাংসারিক অশান্তি, মানসিক বিপর্যয়। প্রবল মানসিক সমস্যা। ওর ছবি পাঁচশো ছত্তিরিশটা লাইক পেল আর আমার এত সুন্দর লেখায় মাত্র দুশো বারোটা লাইক!
এ সবই ‘ফোমো’ (FOMO) অর্থ্যাৎ ‘ফিয়ার অফ মিসিং আউট’ এর উপসর্গ। ভয়ংকর দুশ্চিন্তা- সমকালীন সময় থেকে পিছিয়ে পড়ার। এই দুশ্চিন্তা মানুষের মনকে কুরে কুরে খায়। উৎস দেয় না। এমনকি, যে মানুষ নোনা ধরা দেওয়ালের ঘরে, অ্যাসবেস্টসের চালের নীচে ঘুমায়, তাকেও। আবার যে তিন কোটি টাকার ডুপ্লে ফ্ল্যাটে ঘুমায়, তাকেও।
অবাক কান্ড এই যে- লাইক, শেয়ার, কমেন্টে এগিয়ে-পিছিয়ে থাকার এই যে প্রতিযোগিতা- এর মাঝেই কোনো কোনো প্রতিযোগী যে হঠাৎ হঠাৎ ভ্যানিশ হয়ে যায়, সেটা আগে সোস্যাল মিডিয়ার ভীড়ের মাঝে সকলের ঠিক সহজে চোখে পড়ত না। আজকাল, একটা ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অদৃশ্য ভাইরাস এই ব্যাপারটা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে।
দু সপ্তাহ আগে সমকালীন বিতর্কিত বিষয় নিয়ে সবসময় তেজী এবং তার্কিক পোষ্ট দেওয়া একজনের ছবি হঠাৎ ভেসে উঠল ফেসবুকের দেওয়ালে। নীচে সাতশো তিরিশ জনের কান্নাভেজা ইমোজি-র সাথে লেখা আরাইপি! সত্যি, এতটাই ঠুনকো এ জীবন।
তাই বলে ভাববেন না ফোমো (FOMO) বা এই ‘পিছিয়ে পড়ার ভয়’ শুধুমাত্র সোস্যাল মিডিয়ার লেজুড় হয়ে মানুষের জীবনে প্রবেশ করেছে। একদমই নয়। ১৯৯৬ সালেও এ জিনিস ছিল। ডান হেরম্যানের লেখায় তার হাতে গরম প্রমাণ আছে। হার্ভার্ড বিজনেস স্কুলের ম্যাগাজিনে ২০০০ সালে এ নিয়ে লেখালেখি হচ্ছে। সোস্যাল মিডিয়ার দাপাদাপি তখন কোথায়? সোস্যাল মিডিয়ার দাপটে বিষয়টা কয়েক হাজার গুণ বেড়ে গিয়ে ঢুকে পড়েছে প্রায় প্রত্যেক অন্দর মহলে।
আসলে আমরা বেশীরভাগ মানুষই হারতে চাই না, হারাতেও চাই না। কিন্তু, সেটা তো বাস্তবে সম্ভব নয়। হারতে হবে, এ জীবনের সবকিছু হারাতেও হবেই একদিন। এটা আমরা কিছুতেই মেনে নিতে পারি না। বেশীরভাগ আমরা কিন্তু জানি যে, কোনো জীবন্ত মানুষের পক্ষে পৃথিবীর প্রতিমূহুর্তের গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সম্পর্কে ‘আপ টু ডেট’ থাকা সম্ভব না। কিন্তু জানলে কি হবে, মানছে কে?
এটা এখন একটা বিরাট মানসিক এবং সামাজিক সমস্যা, যেটা মনোবিদদের অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করতে হচ্ছে।
আগেই বলেছি, সোস্যাল মিডিয়াই ফোমো (FOMO)-র একমাত্র কারণ, আধার এবং অবলম্বন নয়। বস্তুতঃ, সোস্যাল মিডিয়ার জন্মের আগে থেকেই ফোমো সমাজের এবং মনোবিদ দের একটা মাথাব্যথার কারণ। তবু, এই যে মুহুর্তে মুহুর্তে সেল্ফি তোলা এবং পোষ্টানো, ঘন্টায় ঘন্টায় ষ্ট্যাটাস আপডেট, আর সেটা না করতে না পারলেই- হয়ত ইন্টারনেট বন্ধের কারণে, অভিভাবকদের চাপে বা কর্মস্থলে দায়িত্ব বা পরিস্থিতির কারণে- শুরু হয় মানসিক অস্থিরতা। মানসিক চাপ, পিছিয়ে পড়ার প্রবল ভয়, মানসিক ও শারীরিক অসুস্থতা আমাদের গ্রাস করে। শুধু তাই নয়, এই ভয়ানক মানসিক সমস্যা ব্যাক্তি মানুষের সৃষ্টিশীলতাকে সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দেয়। ডেকে আনে অকারণ অসন্তুষ্টি, ঈর্ষা, হিংসা, হতাশা ও একাকীত্ব। শুধু তাই নয়, ফোমো আক্রান্ত মানুষ তার সোস্যাল মিডিয়ার বন্ধুদের কাছ থেকে আগ্রাসীভাবে তাদের তাৎক্ষনিক এবং টাটকা সংবাদ এবং তথ্য দাবী করতে থাকে, যেটা সম্পূর্ণ অযৌক্তিক।
মনোবিদ্যার অনেক আন্তর্জাতিক গবেষণা দেখাচ্ছে, বিশেষতঃ যুবসমাজের মধ্যে, সর্বক্ষণ সামাজিক মাধ্যমে সক্রিয় থাকার সামাজিক এবং বন্ধুস্থানীয়দের চাপ ক্রমশঃ বেড়েই চলেছে।
এই ব্যপারে দুটো প্রচলিত গল্প দিয়ে লেখা শেষ করব।
প্রথম গল্প, একটি তরুণীর এক বয়ফ্রেন্ড জুটেছে, যে খুব ভালমানুষ, সৎচরিত্র এবং প্রতিষ্ঠিত। তরুণীকে সে ভালবাসে ও সন্মান করে। সে সংস্কৃতিমনস্ক এবং রসবোধের অধিকারীও বটে। তবে তার দোষের মধ্যে বড় দোষ এই যে, সে কোনো সোস্যাল মিডিয়া- যেমন ফেসবুক, টুইটার, ইন্স্টাগ্রাম, হোয়াটস্অ্যাপ, সিগন্যাল, টেলিগ্রাম কোনো কিছুতেই নেই। এমনকি, সে স্মার্টফোনও ব্যবহার করে না। তখন, তরুণীটির বন্ধু ও আত্মীয়দের ধারণা হল- একটা স্মার্ট ফোন অবধি নেই, তা কি করে হয়? তরুণটি কোনো অপরাধী নয় তো? আদৌ তার সত্যিকারের অস্তিত্ব আছে তো? এ ছেলে কোনো ঠকবাজ নয় তো?
শেষ পর্যন্ত বন্ধু ও অন্যদের সন্দেহ এবং ভুল বোঝানোর ফলে তরুণীটি ছেলেটির সঙ্গে এই সুন্দর সম্পর্কটা ভেঙে দেয়। তার মানে, সোস্যাল মিডিয়ায় অস্তিত্ব না থাকলে একটা জলজ্যান্ত মানুষের জাগতিক অস্তিত্বই আজকাল প্রশ্নের মুখে।
দ্বিতীয় গল্পটি আরো করুণ। মাঝবয়সী এক ভদ্রলোকের স্মরণসভা, যিনি সোস্যাল মিডিয়াতে খুবই সক্রিয় ছিলেন। কিন্তু, তাঁর ভাই, দিদি, স্ত্রী ও পুত্র বাদে স্মরণ সভায় উপস্থিত মাত্র দুইজন। তখন, সেই সদ্যপ্রয়াত ভদ্রলোকের দিদি ওনার স্ত্রী কে অবাক হয়ে বললেন, ‘ভাইয়ের ফেসবুকের বন্ধুর লিষ্টে তো দেখি দু’হাজার জন বন্ধু। স্মরণ সভায় মাত্র দুজন?’
এটাই এখন বাস্তব।
বি.দ্র. ১– ছবিগুলো এবং বেশ কিছু তথ্য ইন্টারনেট থেকে প্রাপ্ত।
বি.দ্র. ২– এই লেখা পোষ্টানোর পরেই আবার বেশ কয়েকদিনের জন্য FB এর দরজা বন্ধ করে রাখবো। সুতরাং, এই লেখা কারো অপছন্দ হলে আমায় বকাঝকা করে লাভ নেই। আমার পঞ্চেন্দ্রিয়তে পৌঁছবে না।