মাথাটা একটু উঁচু করলেই ত্যারচা ভাবে নজরে পড়ছে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল হলের মস্তকে বসানো ডানা মেলে দেয়া লম্বা ফ্লুট বাঁশি হাতে কালো পরীটি। গতকালও সে দেখেছিল, আজও খেয়াল করল মুখটা ঈশান কোণের দিকে তাক করা। হয়তো মুখটা পরশুদিনও ছিল ওদিকে। সে খেয়াল করেনি।
কোমরের কাছে লোহার নলটা সমানে খুঁচিয়ে যাচ্ছে। যন্ত্রটা খুব এমন কিছু বড় নয়। খুব বাহারি ও কিছু নয়। তবে কাজের জিনিস। একটা লাইসেন্সড পিস্তল। অবশ্য তার কাছে এটা থাকা বেআইনি। কারণ এটার লাইসেন্সি তার বাবা। মিঃ অনুপম নন্দী, ডায়মন্ড হারবার আর আগড়পাড়ার দিকে যার নামে একটা একটা মাঝারি ইনস্ট্রুমেন্ট টুলস বানানোর কারখানা আছে। পৈতৃক নয়, নিজে হাতে গড়ে তোলা সম্পত্তি।
সে বিহান নন্দী, এবার এগারো ক্লাসে ভর্তি হয়েছে। আজ তিন দিন সে স্কুলে যায়নি। আর হয়তো যাবেও না কোন দিন । কারণ সে বেঁচে থাকতে চাইছে না।
সে স্কুলে অ্যাবসেন্ট করে না সচরাচর, প্রয়োজন ও হয় না। এক দু বার কোন বিশেষ কারণে স্কুলে যেতে পারেনি। মা ডাক্তার আঙ্কেলকে বলে মেডিকেল সার্টিফিকেট জোগাড় করে দিয়েছিল।
এবার সে ইচ্ছে করেই যাচ্ছে না। কারণ তিতিবিরক্ত হয়ে এই যে জীবনটা তার হাতের মুঠোয়, সে শেষ করে দিতে চাইছে।
ছ’টা বুলেটের মধ্যে মাত্র একটাই সে খরচ করবে। এটাকে বলে পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জ-এ ফায়ার। গুলির উৎস আর লক্ষবস্তুর দূরত্ব যেখানে শূন্য। সে নেট ঘেঁটে দেখেছে। ব্যাপারটা জলের মতো সহজ। শুধু চাই মানসিক দৃঢ়তা। এই ক’দিনে সে ঐ বস্তুটা রপ্ত করেছে।
সে ভেবে দেখেছে। এখানে তার নিজের কোন দোষ নেই। কিন্তু অশান্তির চাপটা তাকে পুরোপুরি নিতে হচ্ছে।
কাঠের বেঞ্চে হেলান দিয়ে এই উজ্জ্বল দুপুরে কৃষ্ণচূড়ার ছায়ায় চোখ দুটো সে বোজাল। টুপ টাপ করে একটা দুটো ঝরা ফুল আর গাছের শুখনো ডালের টুকরো মাথায় এসে পড়ছে।
তার মনে পড়লো ঘটনাটার শুরুটা। সেদিন সপ্তাহের প্রথমদিন। সময় সকাল আটটা। তার বাবা ব্যস্ত মানুষ। অনেকে তাকে বলে ইন্ডাস্ট্রিয়ালিস্ট, আবার অনেকে বল এন্টারপ্রেনিওর। সে দেখেছে আর্থিক প্রাচুর্যের সাথে সাথে তার বাবার আছে চূড়ান্ত ব্যস্ততা।
আজ ডায়মন্ড হারবার যাবেন তিনি। ওয়াশরুমে আছে ন। বাবার মোবাইলটা তৃতীয়বারের জন্য বেজে উঠল। মা কিচেনে ছিল। কোন কারণে বাইরে এসে ফোনটার দিকে তাকাল এবং কলটা রিসিভ করল। কোন কথা বললো না, শুধু শুনলো। আবার ফোনটা রেখে দিয়ে নিজের কাজে চলে গেলো।
তাকে তৈরি হতে হবে। স্কুলের বাস আসবে সাড়ে নটায় আবাসনের গেটের সামনে। বি ব্লক থেকে অনমিত্র সেনও ওই গাড়িতে যায়।
বাবা রেডি হয়ে বাথরুম থেকে বেরলে মা প্রথম কথা বলল, – তুমি বোলপুরে যাচ্ছ ?
– না, আমি তো ডায়মন্ড হারবার যাচ্ছি।
– তুমি মিথ্যে বলছো।
– আমি কেন মিথ্যে কথা বলতে যাব?
-সেটাও তো আমার প্রশ্ন, মিথ্যে বলার কি দরকার ছিল?
কথা কাটাকাটি শুরু এবং কিছুক্ষণের মধ্যে তান্ডবের চূড়ান্ত। সে প্রায় কিছু না খেয়ে এবং টিফিন না নিয়ে স্কুল বাসে উঠে পড়ে। তখনও চলছে পরস্পরের প্রতি দোষারোপ আর বিষ ওগরানো।
সে পালিয়ে বাঁচলো।
মাঝে মাঝে এ সমস্যা হয় না তা নয়। তবে এতোটা বাড়াবাড়ি বিহান মনে করতে পারে না কবে শেষবার হয়েছে এই বিলাসবহুল যথেষ্ট বড় সড় ফ্ল্যাটে । হয়তো হয়েছে সে ছিলো না তখন।
বিক্ষিপ্ত মানসিক অবস্থায় সে স্কুলে ঢুকলো। ক্লাসে সে যথেষ্ট ভালো ছেলে। প্রথম সারির ছাত্র। গত বোর্ডের পরীক্ষাতেও যথেষ্ট ভালো রেজাল্ট করে বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হয়েছে।
আজ মাথায় কিছু ঢুকছে না। পকেটে অল্প কিছু টাকা ছিল। ক্যান্টিনে গিয়ে অল্প কিছু খেয়ে এসেছে। কোন রকমে ক্লাসগুলো শেষ করলো।
বাড়িতে এসে ভিতরে ঢোকার পরে দেখলো মায়ের ঘর বন্ধ। বুলা মাসি দরজা খুলে দিয়েছিলো।
– মা একটু বেরিয়েছে, তুমি খেয়ে নাও, বাবু।
– মাসি, মা কোথায় গেছে জানো?
– কিছু তো বলে যায় নি। তবে তার আসার সময় হয়ে গেছে। দু ঘন্টা বাদে আসবে বলেছিল। তোমাকে খেয়ে ঘুমিয়ে নিতে বলেছে।
এরপর রাতের ঘটনা।
বাবা একটু আগেই ফিরেছে। মা’কেও দেখতে পেল নিজের ঘরে কিছু করছে। সে চেষ্টা করেছিল কথা বলার কিন্তু বিশেষ সুবিধা হয়নি। তাই সে ও ধারে আর এগোয় নি। তাদের পরিবারে এই ধরনের যোগাযোগহীনতা খুব নতুন কিছু নয়। অভিজাত এলাকায় বেশ বড়সড় ফ্ল্যাট এবং জমি থেকে অনেকটা ওপরে যেখানে শব্দের অনুপ্রবেশ কম।
বাবার অনুপস্থিতিতে সাময়িক যুদ্ধ বিরতির পর প্রবল বিক্রমে আবার শুরু হলো, বাবা যখন বাড়ি ফিরলো। কাজের লোকজন বিদায় নিয়েছে।
– তুমি কি চা বানাবে, না আমাকে যেতে হবে রান্নাঘরে?
– এটুকুই বা বাড়ির জন্য বাকি রাখলে কেন? ওটাও তো সেরে আসতে পারতে?
– দেখ,সারাদিনের ঝামেলার পর এসব ন্যাকামি আমার ভালো লাগছে না। যা বলার সরাসরি বল।
– তুমি সহজ ভাবে সত্যিটা বললে এই সমস্যাটা হত না।
– আমি তো কিছু বুঝতে পারছি না। আমার মাথায় কিছু ঢুকছে না।
– মেয়েছেলে নিয়ে রিসোর্টে ফুর্তি করতে যেতে পারো। সেটা বলতে অসুবিধা কেন?
-স্টপ, স্টপ ইট। বাড়িতে ছেলে আছে। সেটা ভুলে যেও না।
– ও, বউ ছেলে বাড়িতে থাকতে তুমি হোটেলে মেয়েছেলে নিয়ে থাকবে, ফুর্তি করবে। সেটাতে লজ্জা নেই, ছেলে জানলেই দোষ? আমি তো তাকে ডেকে সেটাই বলবো।
– তোমার মাথায় এটা আসে কি করে?
– কেন? প্রান্তিকের সোনাঝুরি রিসোর্ট মনে করতে পারছো না?
বিহানের কানে টুকরো টুকরো শব্দগুলো আসছিল। আর সে অনুভব করছিল একটা যন্ত্রণা। তার মাথার ভিতরে। আস্তে আস্তে বাড়ছে। প্রবল থেকে প্রবলতর হচ্ছে।
একবার তাকে ডাঃ দেব, সাইকিয়াট্রিস্ট-এর কাছে নিয়ে যেতে হয়েছিল তার ক্লাস নাইন ফাইনাল পরীক্ষার আগে। সে টার্গেট হারিয়ে ফেলছিল। সামান্যই কারণ। তার দাদু এবং ঠাকুমা তখন এইখানেই কয়েকদিনের জন্য এসেছিলেন তমলুকের দেশের বাড়ি থেকে।
ঠাকুমা কি প্রসঙ্গে মাকে বলেছিল, – বউমা বিহান তো ভালো ছেলে। ওকে চাপ দিও না।
তিনি দেশ গাঁয়ের মানুষ। নাতিকে ভালোবেসে বলছিলেন। কোন কারণে সেটা ঘৃতাহুতির সমতূল্য হয়। তাকে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ শুনতে হয় মায়ের কাছে। বিহান ও জানতো এর পরিনাম কি হতে পারে। সেই রাতে বাবা ফিরলে ঠাকুমা তাকে মানে তার একমাত্র সন্তানকে জড়িয়ে ধরে হাউ হাউ করে কাঁদতে থাকেন। অসহায়,কিছুটা অসুস্থ বৃদ্ধ দাদু শুধু ঠক ঠক করে কাঁপছিলেন।
বাবা গাড়ি করে সেই রাতেই তাদেরকে তমলুকে দিয়ে এসেছিলেন ।
যাওয়ার সময় বিহানকে বুকে চেপে ধরেছিলেন দুজনে। সেই রাত থেকেই বিহান খাওয়া ছেড়ে দিয়েছিল। খেতে পারত না। মনে হত তার জন্য দুজন নিরপরাধী মানুষ অপমানিত হলেন এবং তাদের অসময়ে বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে হল।
সে নিজেকে অপরাধী ভাবতো এবং গভীর অবসাদের মধ্যে তলিয়ে যাচ্ছিল। ঘুমতে পারছিল না, খেতে পারছিল না, পড়ায় মনযোগ দিতে পারছিল না।
একটা ক্রিটিকাল সময়ে পারিবারিক চিকিৎসক ডাঃ রায়ের রেফারেন্সে তাকে সায়কিয়াট্রিষ্টের পরামর্শ ও মনস্তাত্ত্বিক কাউন্সেলিং করান হয় এবং সে আস্তে আস্তে বিপদ মুক্ত হয়।
দাম্পত্যের এই বাগযুদ্ধে মার কথাগুলো তার যুক্তিসঙ্গত মনে হয়নি। অনেক সময় তার মনে হয় তার মায়ের মানসিক গঠন পুরোপুরি ঠিক নেই।
এবারও তাই মনে হলো । কিন্তু সেটা বলার সাহস এবং ধৃষ্টতা তার নেই। আর নানা কারণে বাবার সাথে তার খুব কাছাকাছি-সম্পর্ক নয়। মানে যেটাকে ইন্টিমেসি বলে। তার ক্লাসের অনেক বন্ধুরাই তাদের বাবাকে বন্ধুর মতো ভাবে। সে পারে না। হয়তো সেটা সে শেখেনি, শেখান হয়নি ।
সেই সাইকিয়াট্রিস্ট যার পরামর্শে কাউন্সেলিং টা করা হয়েছিল। তিনি বলেছিলেন পেরেন্টাল কাউন্সেলিং করাতে। মানে বাবা মা উভয়কে মনস্তাত্ত্বিক কাউন্সেলিং।
করান হয়নি কারণ অশান্তির ভয়ে বাবা সেটা মাকে বলতে পারেনি।
এবার অশান্তির পারদ চড়তেই থাকল। বিহান কানে আঙুল চেপে নিজের ঘরে কি করবে সেটাই বুঝতে পারছিল না। তার হৃৎস্পন্দনের গতি বেড়ে যাচ্ছে। ঈশ্বরের কাছে প্রার্থণা করা ছাড়া এই মুহুর্তে তার কিছু করার নেই।
– তুমি একটা বাস্টার্ড, বে….।
– প্লিজ স্টপ, বিহান সব শুনছে।
– তুমি চেন না ওই মেয়েটাকে? ফোন করেই খুবই চেনা লোককে বলার মতো সে বলে গেল। তুমি থাকবে আর ও থাকবে, মিট করবে ঐ রিসোর্টে। আমি শুধু শুনে গেছি।
– তুমি কেন রিসিভ করলে ওই ফোনটা। ও নাম বলেনি? ও তো কুহেলি।
– হয়তো বলেছে আমি শুনিনি, শোনার দরকার মনে করিনি।
– আমাদের একটা ইন্ডাস্ট্রিয়াল প্লটের ব্যাপারে পার্টির সাথে কথা হবে।
– নাটক করো না, গল্প সাজাতে যেয়ো না।
– ও তো আবার আমাকে ফোন করেছিল। প্রোগামটা এগিয়ে এসেছে।
– আমি ঘেন্না করি তোমাকে..।
– তোমার ফোন কি কখনও আমি ধরেছি ?
– আমার ঐ সব আনসোসাল কারণে কখনও ফোন আসে না।
– কেন তোমার তো এই দাদা ওই দাদা, কম তো আসে না? তাদের সাথে তোমার কিসের রিলেশন আমি কি দেখতে যাই, না জানতে চাই ?
– তোমার নোংরা মেন্টালিটি, তাই তোমার মনে এগুলো আসে।
ঝগড়া চলতে চলতে একটা সময় দুজনে ক্লান্ত হয়ে পড়ে। মা তারপর নিজের ঘরের দরজা বন্ধ করে দেয়। বাবাও চুপ চাপ হয়ে যায়।
অনেকটা রাত হলে সে ডাইনিং এসে জ্বলে থাকা লাইটটা নিভিয়ে দেয় ।
বাবার ঘরে আলো জ্বলছে। সে উঁকি দিয়ে দেখল তার বাবা একটা মদের বোতল নিয়ে বসেছে। বাবা মদ খায়। কিন্তু এভাবে একা একা ঘরে বসে খাচ্ছে, এটা ভাবতে পারছিল না। পাশে অ্যাটাচি কেস খোলা। কিছু গোছ গাছ করার চেষ্টা করছিলো বোধ হয়।
ফিরে এসে নিজের ঘরে আলো নিভিয়ে দু’হাতে মাথা ধরে বসে থাকল বিহান ।
চোদ্দ তলার এই ফ্ল্যাটের বারন্দায় একটা বেতের চেয়ার পাতা আছে । বিহান বারান্দায় এসে দাঁড়াল কিন্তু বসলো না। অনেক নিচে রাস্তাটা প্রায় জনহীন। ছোট গাড়ি দু একটা যাচ্ছে। ল্যাম্প পোস্টের ছায়াগুলো অদ্ভুত ভূতুড়ে লাগছে এখান থেকে । মাতাল একটা লোক, রাস্তা পেরোচ্ছে। দু’টো কুকুর তাকে বিরক্ত করছে। আকাশে ইতস্ততঃ কিছু তারা চোখে পড়ছে।
বারান্দার গাছগুলো নিস্প্রভ হয়ে গেছে। জল দেয়া হয়নি। ওটা মা দেয়। পাগলির মাথা ঠিক নেই। ও সেটা বুঝতে পারছে। কিন্তু এখানে ওর কিছু করারও নেই।
বারান্দায় দাঁড়িয়ে ভিতরের দিকে তাকালো বিহান । মায়ের ঘরের দরজা বন্ধ।
বাবার ঘর থেকে দরজার ফাঁক দিয়ে আলো এসে পড়ছে ড্রয়িং রুমে।
রাত এগারোটা বাজে। বাবা নীচু চেয়ারটায় মাথাটা হেলিয়ে দিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। সেন্টার টেবলে একটা কাঁচের গ্লাসে তখনও খানিকটা মদ রয়ে গেছে। চুরি করে বাবাকে বিহান দেখলো। নাক ডাকছে ক্লান্তি আর গভীর ঘুমে। তার আওয়াজ আসছে।
সে বাবার পিছনে, যেখানে অ্যাটাচিটা রাখা আছে সেদিকে গেলো। চেনা অ্যামেরিকান ট্যুরিস্টার কোম্পানির দামি হাত বাক্স। বাদামি চামড়ার হোলস্টার থেকে চেনা যন্ত্রটা বার করে নিলো বিহান ।
বিপজ্জনক অস্ত্র। বাইরে গেলে বাবা এটা সঙ্গে রাখে আত্মরক্ষার জন্য।
নিজের স্কুল-ব্যাগে রেখে দিলো আগ্নেয়াস্ত্রটি।
আসবার সময় বাবার ঘরের আলোটা নিভিয়ে দিয়ে দরজাটা টেনে দিল। হয়তো কাল সকালে বেরোতে হবে। একটু ঘুমিয়ে নিক।
মা কি করছে জানে না। হয়তো না খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। তার কাছে ঘুমের বড়ি থাকে। পাড়ার ফার্মেসি থেকে সে এক আধ বার এনে দিয়েছে। চেনা দোকানদার।
দরজা ঠেলে দেখলো মায়ের ঘরের দরজা খোলাই আছে। টেবল ল্যাম্প জ্বলছে।
অসহায়ের মতো মুখ গুঁজে শুয়ে আছে মা । একটা পাতলা চাদর টেনে দিলো তার গায়ে।
নিজের ঘরে এসে জলের বোতল থেকে এক ঢোক জল খেয়ে আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়ল। আগামীকাল সকালেও কি এই যুদ্ধের অবসান হবে? মনে তো হয় না।
পাড় বাঁধানো জলাটায় কয়েকটা শালুক ফুল ফুটেছে। স্বচ্ছ জলে ছোট ছোট কিছু মাছ খেলে বেড়াচ্ছে। একটা লাল ফড়িং উড়ে উড়ে ফুটন্ত ফুলের মেলে দেয়া পাপড়িতে বসছে, আবার উড়ে যাচ্ছে।
বাদাম,পপকর্ণ, লজেন্স নিয়ে হিন্দুস্থানি ফেরিওয়ালারা আশপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
সে ঠিক কখন থেকে বসে আছে খেয়াল নেই। পরশু ভোরবেলা বাবা গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে গেছে। অটোম্যাাটিক লক ডোর তাই কাউকে উঠে গিয়ে বন্ধ করতে হয়নি।
তারপর এক এক করে কাজের মাসিরা ঢুকে পড়ে। সেটা মা সামলে নিয়েছে। ও স্কুলের সময়ে ব্যাগ পত্র নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। মা তার ঐ মানসিক অবস্থায় কথাবার্তা বিশেষ বলেনি।
স্কুলের গেটে নেমে ও আর স্কুলে ঢোকে নি। একটা বাসে করে চলে এসেছে ভিক্টোরিয়ার কাছে। উদ্দেশ্যহীন ভাবে এখান ওখানে ঘুরে খানিকটা সময় পার করে ও এই চত্ত্বরে ঢুকে পড়ে।
এই ভাবে ঘুরে বেড়ানোতে সময় নষ্টই হচ্ছে। কাজের কাজ কিছু হচ্ছে না। তাকে এক জায়গায় বসে সঠিক সিদ্ধান্তটা নিতে হবে। তবে তার আগে চুল চেরা বিচার করেই কাজটা তাকে করতে হবে।
এটা ভাবনার আদর্শ জায়গা। তার স্কুলের পোশাকটা অনেকের সন্দেহের উৎপত্তি করছে ঠিকই। তবে কেউই গভীর ভাবে মনোযোগ দিচ্ছে না।
সেদিনই ভোর রাতে ঘুম ভেঙে গেলে সে মারণ যন্ত্রটায় হাত বুলিয়ে দেখেছিল। একটু নাড়াচাড়া করেছিল। মনে হয়েছিলো বাবা অ্যাটাচিটা নিয়েই বেরিয়ে যাবে সেটা চেক করার কথা তার মনে আসবে না।
আর মা ? সে যে কি করবে সেটাই ভাবনার? ছেলে স্কুলে গেছে এটা ভেবেই নিশ্চিন্তে থাকবে। বাকিটুকু বিহানের চিন্তার বাইরে। মাকে সে ঠিক কিভাবে দেখে? সেটা সে নিজেও বুঝতে পারে না। মায়ের জটিল মনস্তাত্ত্বিক অবস্থানের কাটা-ছেঁড়া করার মতো দক্ষতা তার নেই। তার থলকুল সে পায় না।
মা তাকে সব চেয়ে বেশি সময় দিয়েছে। এই জীবনের এতোটা পথ আসতে মা- ই বেশি নিজেকে নিংড়ে দিয়েছে । তার খাওয়ানো, পরানো, স্কুলে ভর্ত্তি করানো সবই মা।
অথচ তার সব গুণ ও ত্যাগ ছাড়িয়ে সে একজন অসম্ভব জেদি মহিলা। সেখানে সে যুক্তিতর্কের বাইরে। নিজে যেটা বুঝবে তার বাইরে তাকে কিছু বোঝানো যাবে না।
বাবা ঠিক বলছে কিনা সেটা নিরপেক্ষ ভাবে তার ভাবা উচিৎ ছিল।
সে যখন বেশ ছোট তখন ডায়মন্ড হারবারের কারখানার কোন এক ঝামেলার পরিপ্রেক্ষিতে এই পিস্তলটা কেনা হয়। বাবা বলে , সৌভাগ্যক্রমে অন্য সব মানুষের মতো এটার ব্যবহারের প্রয়োজন তারও হয়নি। গুপ্ত লকারে পড়ে থাকা এবং নির্দিষ্ট সময়ে লাইসেন্স নবীকরণ ছাড়া এর কোন কাজ নেই।
এবার প্রথম কাজে লাগবে।
একটা ফুল ফুল টুপি পরা লোক তার পাশে এসে বসলো। সে পছন্দ করলো না।
– তুমি ম্যাজিক ভালোবাসো ?
– একবারই দেখেছি। পি সি সরকার, মহাজাতি সদনে।
– জুনিয়র, প্রদীপ চন্দ্র সরকার? তেমন কিছু নয়। আমি তার বাবা প্রতুল চন্দ্র সরকার, সিনিয়রের শিষ্য।
– আপনি ম্যাজিক জানেন?
– অনেক।
– থট রিডিং পারেন?
– ওটাই তো আমার অস্ত্র। বলতে হবে তুমি এই মুহুর্তে কি ভাবছো?
– না থাক। তার দরকার হবে না।
-কেন, পরীক্ষা করবে, আমি সত্যি ম্যাজিশিয়ান কি না?
– কিছু লাভ নেই।
– কিন্তু আমি সত্যি জাদুকর কি না সেটা তো আমাকে জানাতেই হবে? কিছু একটা বলি, যেটা প্রমাণ করবে আমি প্রতুল সরকারের শিষ্য?
– বেশ বলুন, তাড়াতাড়ি। আমার হাতে সময় নেই।
– কেন তোমার তো বিকেল চারটের পর ক্লাস শেষ। সে অবধি তুমি এখানে কাটিয়ে দিয়ে যেতেই পারো?
– আপনি কি করে জানলেন, আমি স্কুল থেকে এখানে এসেছি?
– তুমি বিহান নন্দী, সাউথ পয়েন্টের এগারো ক্লাসের সাইন্স স্ট্রীমের ছাত্র। ক্লাস কেটে এখানে বসে কাব্য চর্চা করছো।
– ও আর এমন কি কথা, আমার ব্যাগের গায়ে ওটা লেখা আছে।
– তাই, খেয়াল করিনি তো। না হলেও আমি বলতে পারতাম।
– আচ্ছা তবে বলুন আমার বাবার নাম কি?
– এটা একটু জটিল হয়ে গেল,বেশ জটিল তবুও চেষ্টা করে দেখছি, হতে পারে, মিঃ অনুপম নন্দী, হ্যাঁ ঠিক তাই। বালিগঞ্জ সার্কুলার রোড, আর আর..।
– আচ্ছা আমি কি আপনাকে আগে দেখেছি? গলাটা চেনা চেনা লাগছে কেন?
– সেটা মনের ভুল হতে পারে। তবে একটা কথা বলি। তুমি ব্যাগটা আমাকে দাও। এখানে একজন ভি ভি আই পি আসছেন কিছুক্ষণের মধ্যে। মেটাল ডিটেকশান স্ক্যানারে কিছু খারাপ পেলে হুজ্জুতি হবে।
– তুমি নিরঞ্জন কাকা না? ডায়মন্ড হারবার..।
– ঠিকই ধরেছো, বিহান বাবু। উফ্ আর কত অভিনয় করবো? সকালে বড়বাবু ফোন করেছিলেন বোলপুর থেকে। স্কুল থেকে বাড়িতে ফোন, সেখানে পায়নি বলে অফিসে ফোন। বার বার রিং হওয়াতে আমি ধরি। তারপর বড়বাবুকে বলি স্কুলে যোগাযোগ করতে। তুমি দু দিন স্কুলে যাচ্ছো না। তোমার একটা কিছু প্রোজেক্ট আছে। সেটা নাকি জরুরী।
– তুমি এখানে কি করে এলে ?
– তোমার বাবাই বললেন খোঁজ করতে। স্কুলে গেট ম্যানকে জিজ্ঞেস করাতে বললো। এসেছিল তার পর একটা বাসে চড়ে আবার কোথায় চলে গেলো। বাসের নাম্বারটাও ভাগ্যক্রমে বলতে পারলো। তারপর এদিক ওদিক হন্যে হয়ে খানিক ঘুরে বেড়ালাম। বড়বাবু আজ ফিরবে। তার আগেই নিষ্পত্তি করতে হবে। আমাকে দেখে যাতে পালিয়ে যেতে না পারো তাই পি সি সরকারের শিষ্য সাজলাম।
– নিরঞ্জন কাকা, সেটাই তো আমাকে সন্দেহে ফেলেছিল। তোমার গলা।
– আচ্ছা, সেই ‘বিপদ’টা কি ব্যাগে রেখেছো না বাড়িতে?
সিকিউরিটি চেকিং হলে সমস্যা।
বিহান তার কোমরের কাছে গুঁজে রাখা যন্ত্রটা হস্তান্তর করে দিল তাদের কারখানার বিশ্বস্ত সিকিউরিটি অফিসার নিরঞ্জন হাজরার হাতে।
-বাঃ, এবার নিশ্চিন্ত। চল এবার বাইরে বেরই।
গড়ের মাঠে তখনও বিকেল নামেনি। দূরের উচ্চতম টাটা সেন্টার বিল্ডিং-টা উজ্জ্বল আলোকে চক চক করছে। রাস্তা পেরিয়ে ছায়া ছায়া গাছ তলাতে বিহানের মনে হলো তাদের সাদা রঙের হন্ডা সিটি গাড়িটা দাঁড়িয়ে আছে।
গেট খুলে উদ্বিগ্ন বিহানের মা এদিকে তাকিয়ে আছেন। হাওয়ায় চুলের রাশি বাতাসে উড়ছে।
মা ছেলের দৃষ্টি বিনিময় হলো। কোন কথা হলো না।
– নিরঞ্জন, ঐ কোয়ালিটি আইসক্রিমের লোকটার কাছ থেকে চারটি February নিয়ে এসো ।
– ও মা। আমি কিন্তু কর্ণেটো নেবো।
– তুই যা, নিজেই নিয়ে নে।
নিরঞ্জন এই পরিবারের বেশ নির্ভরযোগ্য লোক ও একজন বেতনভুক কর্মচারী। তা সত্ত্বেও তার অবদান এই পরিবারের জন্য আরো একটু বেশি কারণ সে ব্যবসা এবং সাংসারিক জীবনের কঠিন সময়ে নন্দী পরিবারের পাশে এসে দাঁড়ায়। কারখানা তৈরির সময় থেকে সে এদের সাথে আছে। বিহানের মা একটু বিশেষ স্নেহের চোখে দেখেন নিরঞ্জনকে।
– বৌদি তোমার প্যান কার্ড আর আধার টা একটু গুছিয়ে রেখো। পরশু এ ডি এস আর – এ একটু যেতে হবে। প্রান্তিকের প্লটটার রেজিষ্ট্রেশন হবে।
– মা, একটু ফুচকা খাবো ?
– খাবে বৌদি ফুচকা, কতদিন খাইনি ? নিরঞ্জন বললো।
– ঠিক আছে।
ড্রাইভারের পাশে নিরঞ্জন আর পিছনে মা এর সাথে বিহান। ওয়ান ওয়ে বলে গড়ের মাঠটা পেরিয়ে আবার ডান দিক ধরে জহরলাল নেহেরু রোড ধরে এক্সাইড মোড়ের কাছে এসে বিহানের মা বললো, – নিরঞ্জন, একবার গাড়িটা হার্লেম পয়েন্টে ঢোকাও তো, মোড়ের একটু আগে বাঁদিকে।
মা দেখলো বিহান ব্যাকসিটে হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে।
– একবার রিসেপশনিস্টকে গিয়ে বলবে ডাঃ অনিরুদ্ধ দেবের আর্লিয়েষ্ট অ্যাপয়েন্টমেন্ট কবে পাওয়া যাবে? একটা নাম বুক করবে, আমার নামে।
– ঠিক আছে বৌদি।
– আর শোন। একেবারে হলদিরামে ঢুকে দাদার জন্য কয়েকটা ধোকলা আর বেসন লাড্ডু নেবে। তোমার দাদা পছন্দ করে।
বিশ্বস্ত নিরঞ্জন মাথা নেড়ে ভিতরে এগিয়ে গেল। অনন্যা নন্দী ড্রাইভারকে এ সি বাড়িয়ে দিতে বললেন। ছেলের দিকে তাকালেন। তার চশমাটা সন্তর্পণে খুলে নিয়ে বললেন, – বাবা একটু সোজা হয়ে শো, ঘাড়ে লাগবে।