(এক বছর আগের লেখা … এখনো আমি শোকসন্তপ্ত হৃদয়ে স্মরণ করি এই মহান বাঙালিকে)
প্রথমেই বলে রাখি যে কোন মৃত্যু, ভীষণ বেদনাদায়ক। তবু মৃত্যু আসে। এই ঢ্যামনার হাত থেকে কেউ রেহাই পায়নি, পাবে ও না।অন্ততঃ এখনো অব্দি কাউকে রেহাই দেয়নি বা দেবে বলে কোন মেমোরেণ্ডামে সাক্ষরও দেয়নি!!!
মৃত্যুকে এই বিষয়ে একশো পার্সেন্ট বিশ্বাস করা যায়- এই হারামি, ওর নিজের পথ থেকে একচুলও সরে আসবে না!!!
রাজা উজির প্রজা নেতা মন্ত্রী আমলা গামলা পুলিশ ছুরি কাঁচি লাঠি বোমা করোনা চিকেন পক্স কলেরা টিবি ক্যান্সার- কোন কিছুর ভয় পেয়েছে বলে প্রমাণ নেই।
প্রসঙ্গতঃ মাইকেল জ্যাকসনের কথা বলা যাক। না মরার জন্য তিনি করেননি এহেন কিছু পৃথিবীতে নেই। তিনি মরতে চাননি!! যে কোন মূল্যে বেঁচে থাকতে চেয়েছিলেন। এরকম আরো বহু মানুষই চেয়েছিলেন বা চান।
কিন্ত মৃত্যু যে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে বসে আছে- সেটি বোধহয় নজর এড়িয়ে গেছে!!! শালা পুরো কুত্তার লেজের মতো! বাঁকা তো বাঁকা!!
এবার এই মৃত্যু যদি আসে অকালে (যদিও আমাদের হিসেবে অকাল !) বা মৃত্যুর কারণ যদি হয় ভয়াবহ কোন দুর্ঘটনা বা খুন , তাহলে আমাদের বায়ু পিত্ত কফ মেশা জৈবিক চাহিদা ভরা মগজে, শরীরে, মনে সে বড় ধাক্কা দেয়। একদম ওলটপালট করে দেয় সবকিছু।
আসলে আমরা সবাই কোন না কোন ভাবে গণৎকার ।
আমাদের জীবনের সব কিছু যেমন সাজানো গোছানো, আমরাও সেটা মেনে নিয়ে গুনে গুনে জীবন কাটাই। জন্ম থেকে শুরু করে ক্লাসের পড়া, ডিগ্রী, টাকা পয়সা ঘুষ ট্যাক্স জামা প্যান্টুল জাঙিয়া জায়গা জমি কিল ঘুষি চুরি ডাকাতি ধর্ষণ খুন ফুল ফল পূর্ণিমা অমাবস্যা চুম্মাচাটি লাভ লোকসান ভ্যালেন্টাইন – সব গুনে গুনে আমাদের জীবন শেষ হয়।
এবার এই গোনা ব্যাপারে সামান্য একচুল হলেই – কি যেন একটা হয়ে যায়! কি যে হয়ে যায় – তাল কেটে যায়। তার কেটে যায়!আরো ওলটপালট হয়ে যায় – যখন আপাতদৃষ্টিতে কোন আপনজন মৃত্যুর হাতে শিকার হয়! মাইরি বলছি, পুরো শর্ট সার্কিট হয়ে শক লাগে যেন!!
ভ্যানতাড়া না করে বলে ফেলি – এরকম একজন বড্ড, বড্ড আপনজনের মৃত্যুতে যারপরনাই আঘাত পেয়েছি । সে বেদনা শেলের আঘাতের তীব্রতা এতোটা বেশি ছিল যে, প্রায় লক্ষণের মতো অজ্ঞান হয়ে পড়ে ছিলাম খানিকক্ষণ।
তারপর আর কি করি! আমার তো আর হনুমান নেই যে বিশল্যাকরণী আনতে পাঠাবো, আর লাফ দিয়ে একহাতে পর্বত তুলে নিয়ে হাজির হবে! খানিক বাদে পাছার পকেট থেকে গাঁজার কল্কে বের করে দিলাম কয়েক টান!
আমি কোন লেভেলের মাতাল – এই ভেবে গালি দেবেন ভাবছেন তো?
দাঁড়াবেন না। আপাতত পাছায় ভর দিয়ে থাকুন।
আপনজন বললাম বলে খুব খারাপ লাগলো, তাইতো? আসলে ডাক্তারি পড়ার পর থেকে, নিজের পরিবার পরিজন আত্মীয় স্বজনদের বাইরে – একটা পরিবারের অংশ হয়ে যাই আমরা। সেই বৃহত্তর পরিবারের সদস্য হলো সব স্বাস্থ্যকর্মীরা। মানে ডাক্তার, নার্স এবং অন্যান্যরা। এবং সেই পরিবারের কোন একজন সদস্যের কিছু হয়ে গেলে, মনে হয় নিজের পরিবারের কেউ চলে গেল! আরো বলে রাখি – এক্ষেত্রে ডাক্তার বলতে আমি শুধুমাত্র মডার্ন মেডিসিন পড়া ডাক্তারদের কথা বলছি না!যাঁরাই রোগীদের জন্য কাজ করেন, তাঁদের উপকার করতে চেষ্টা করেন, সত্যি সত্যি উপকার করে ফেলেন, তাঁরা সবাইই ডাক্তার!
আপনজন এই কারণেই যে – এর জন্য আমি বহু রাত জেগেছি !
শুধুমাত্র এই লোকটির কথা শোনার জন্য , সারাদিনের কাজকর্ম শেষে , অনেক কষ্ট করে , চোখের ঘুম মুছে দিয়ে হা করে তাকিয়ে থেকেছি ।
কি অবিশ্বাস্য ক্ষমতা ছিল এই লোকটির। চারপাশের পৃথিবী তখন নিদ্রামগ্ন। খবরের চ্যানেলে চ্যানেলে সব খবর শেষ। পেটের খাবার হজম হবার জন্য এদিক ওদিক গড়িয়ে যাচ্ছে পাকস্থলীতে। মাঝে মাঝে ঢেঁকুর উঠছে । ঠিক এইরকম সময়ে তিনি তাঁর শ্রীমুখ নিয়ে আসতেন টিভির পর্দায়!
তিনি একা আসতেন বললে ভুল হবে, তাঁর সঙ্গে থাকতেন কোন একজন বিখ্যাত ব্যক্তি! চামচা বলে অপমান করা উচিত নয় তাঁদের! তিনি হতে পারেন বিখ্যাত নাট্যকার, হতে পারেন বিখ্যাত এডিটর!
তারপর শুরু হতো ডাক্তারি!.মাইরি বলছি – এরকম ডাক্তারি আমি কোনকালে দেখিনি, শুনিনি। আবার শুধুমাত্র ডাক্তারি বললে হবে কেন?সে ই অমিত শক্তিধর, গোল্ড মেডেলিস্ট, বিশ্ববিখ্যাত বাক্যসেদ্ধ, রত্নসেদ্ধ রাশি গ্রহ নক্ষত্র বাস্তুবিশেষজ্ঞ সহস্রাব্দের সেরা বাঙালি, এই ছিরিছাঁদহীন ভুঁড়িওয়ালা আপামর বাঙালির জন্য হাসিমুখে একের পর এক রোগের (হ্যাঁ রোগই বলবো) নিদান বলে যেতেন!
বেশ্ববিখ্যাত এই কারণেই যে – টিভির পর্দার নিচের দিকে লেখা দেখতাম – এই ভদ্রলোক, শুক্কুর বা কলকাতা, শনিবার দুবাই, রবিবার আমেরিকা, মঙ্গলবার ফের হাওড়ার অখ্যাত গলিতে,
বুধবার কেষ্টপুরে, বেস্পতি বার সিঙ্গাপুর করে বেড়ান!!!
এবং প্রত্যেক জায়গায়ই তিনি যে অসংখ্য মানুষের রাশি গ্রহ নক্ষত্রের পাছায় থাপ্পড় মেরে ছ্যাবলামি ছুটিয়ে দিতেন, এ বিষয়ে আমার সন্দেহ নেই!!
খবর নিয়ে জেনেছিলাম – এনার দক্ষিনা খুবই সামান্য। ওই দশ মিনিটের জন্য তিন হাজার থেকে শুরু। পঞ্চাশ হাজার টাকা অব্দি আছে পরিষেবা ভেদে।
নিন্দুকেরা বলে – মার্সিডিজ অডি বিএমডব্লিউ রেঞ্জ রোভার ছাড়া আতিপাতি গাড়িতে পাছা ঠেকানোর মতো পাপ উনি করতেন না।
শোনা যায়, এই কারণেই নাকি এখনো অব্দি মারুতি হুণ্ডাই টয়োটার মতো গাড়ি মধ্যবিত্তের গাড়ি হয়ে থেকে গেছে!!
আর সিগারেট খাওয়া নিয়ে তো প্রায় মিথ আছে। এ বিষয়ে মোটেই দেশভক্তির তোয়াক্কা করেননি!! বিদেশী এবং দামী – এই ছিল এনার ট্রেডমার্ক!!
কি অবলীলায় একজন মানুষ সামনে রাখা ল্যাপটপের কি টিপে, এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের তথাকথিত আধপাগলা বেওয়ারিশ গ্রহ নক্ষত্র কে এক চুটকিতে ঘাড় ধরে পথ চিনিয়ে দিতেন, তাঁদের পাছায় থাপ্পড় মেরে গাধা থেকে মানুষ করে দিতেন, সেই অলৌকিক ক্ষমতা বহুবার চাক্ষুষ করে করে আমার বিশ্বাস জন্মেছিল – ইনি অবতার!!
কার অবতার – সেটা অবশ্য জানতে পারিনি !
তো এই ভদ্রলোকের কথা আমি সময় পেলেই শোনার চেষ্টা করতাম। কারো শনি মদ খেয়ে উল্টো ঘুরছে, কারো বেস্পতি লুঙ্গি পরে শীর্ষাসন করছে, কারো পাইলসের রক্তে জাঙ্গিয়া ভিজছে, কারো ছেলে প্রেমাসক্ত অতএব পড়ালেখা ও সংসারে নিরাসক্ত, কারো মেয়ে সারাদিন ফোন ঘাঁটে, কারো চাই বশীকরণ, কারো চাই ধনসম্পত্তি, কারো প্রোমোশন, কারো চাকরি, কারো রাশিচক্রে হাঁ করে আছে রাহু, কারো আবার কর্কটরাশির বিরুপ প্রভাবে ক্যান্সার, কারো সূর্যের চক্কান্তে দিনে কাজ আর রাতে ঘুম – এরকম হাজারো সমস্যার সমাধান এক চুটকিতে করার মতো এলেম এই লোকটির মধ্যে দেখেছি!!!
অন্ধকার থেকে আলোর পথে নিয়ে এসেছেন কত মানুষকে!!
আমাদের মতো যাঁরা ছোটবেলা থেকে হাফপ্যান্ট গুটিয়ে, মাথার পাছার বগলের পেটের চুল ছিঁড়ে, স্কুল কলেজে পড়াশোনা করে শেষে শুধুমাত্র পেটের ভাতের জোগাড় করতে হিমশিম খাচ্ছি, তাঁদের এরকম অবতারকে হিংসে হয়। বিশ্বাস করুন, হিংসে হয়!
হবে না কেন বলুন তো??
আরে বাবা আমরাও মানুষ তো!
এতো পড়াশোনা করে একটা গ্রহ নক্ষত্র নাড়ানো তো দূরের কথা ,
একখণ্ড পাথর নড়াতে গেলে ক্রেন ভাড়া করি!! টেপা টেপি সেজে প্রেমে খাবি খেতে খেতে গোলাপ ফুল খোঁজ করি, ভ্যালেন্টাইন ডে-তে ছুকছুক করি, ফ্ল্যাট কিনতে গিয়ে সারাজীবন কিস্তি শোধ করি, একটা কাজ পেতে গিয়ে লোকের হাত পা থেকে শুরু করে যেখানে খুশি তেল মালিশ করি, শেষে একদিন ব্লাড প্রেসার স্ট্রোক হার্ট এ্যাটাক ক্যান্সারে টুপ করে ঝরে পড়ি!!!
আর এই ভদ্রলোক – যাকগে।
তো এনার মৃত্যু হয়েছে বলে একটি বিখ্যাত খবরের কাগজ চ্যানেল বড়সড় হেডলাইন দিয়েছেন। দেখে তো আমার মতো মানুষের আত্মারাম খাঁচাছাড়া হয়ে গেছিল।
সেইজন্যই গাঁজা খেয়েছিলাম!
আমি এই মৃত্যু মানতে পারিনি! এটা মৃত্যু নয়, হতে পারে না!!
যেহেতু খুন বলার মতো নয়, তাই এটাকে সুইসাইড বলতে চাই।
এই অবতার, কেন জানি না কোন ভুলে, পার্থিব জীবনের সব কাজ কর্ম অকালে শেষ করে দিয়ে, ন্যালাখ্যাপা বাঙালি সহ সমগ্র পৃথিবীর অসংখ্য মানুষ কে, ইতর অসভ্য রাশি গ্রহ নক্ষত্র বাস্তুদোষ অসুখের ছ্যাবলামির অকাল সমুদ্রে ভাসিয়ে দিয়ে , জাস্ট নিজেকে শেষ করে দিলেন!!
তাও, কি ভাবে??
শুনলাম – গভীর রাতে, যখন তিনি সবে গ্রহ নক্ষত্রকে এক রাতের মতো ঘুমানোর আদেশ দিয়ে একের পর এক দামী সিগারেটের ধোঁয়াসুখ নিচ্ছিলেন, নিদ্রা দেবী কখন এসে চোখে ঘুম ঢেলে দিয়েছেন, তারপর সেই সিগারেটের আগুন, মতান্তরে আরেক ঢ্যামনা, উচ্ছন্নে যাওয়া, দেবতা নামের কলঙ্ক, ঝাঁট জ্বালানোর মাস্টার অগ্নিদেব, কয়েকবার নোবেল পুরস্কারের দাবীদার এই সুমহান বাঙালির শরীরের পঞ্চাশ শতাংশ পুড়িয়ে দিয়েছে!!!
আমি জাস্ট ভাবতে পারছি না – এই ভদ্রলোকের এরকম পরিণতি হতে পারে। বিশ্বাস হচ্ছে না!! আমার দৃঢ় বিশ্বাস – ইনি ও অন্যান্য অবতারের মতোই ইহলোক ত্যাগ করেছেন স্বেচ্ছায়। শিখণ্ডী হিসেবে ব্যবহার করেছেন অগ্নিকে।
আমি তো অবাক হলাম – রাষ্ট্রীয় শোক পালন হলো না কেন??
গান স্যালুট হলো না কেন?? ম্যাদামারা বাঙালি কি করছে??মরণোত্তর নোবেল পুরস্কারের দাবি তোলা কি খুব অসঙ্গত??
নিন্দুকেরা বলে – সব গ্রহ নক্ষত্রের পাছা লাল করা এই বাঙালির সঙ্গে ব্যাটা অগ্নির খানিকটা শত্রুতা ছিল!! কারণ, ইনি যে লেভেলে ঝাঁট পোড়াতে পারতেন, অগ্নিদেব সেটা পারতেন না!!বোঝাই যায় – এরকম শত্রুতা অবতার বা দেবতা লেভেলে চলতেই থাকে। একজন আরেকজনকে মানতে পারে না। তাই কন্ট্রোল ও করতে পারেন না।
যাইহোক, শোকসন্তপ্ত হৃদয়ে, আমি এই মহান বাঙালি অবতারের অকাল মৃত্যুতে একটি যুগের অবসান দেখছি। সেই যুগ – যাতে লোকের মাথায় টুপি পড়িয়ে যতই নিজেকে বড়সড় ভবিষ্যৎবক্তা ডাক্তার প্রমাণ করার চেষ্টা করুন না কেন, যতই যাঁর পাছায় থাপ্পড় মেরে নিজেকে মহান পণ্ডিত দেখানোর চেষ্টা করুন না কেন, নিজের বেলায় কোন রকম ধাপ্পাবাজি কাজে লাগবে না!!
আগুন লাগলে পুড়ে যাবেন। মৃত্যু এলে মরে যাবেন। সমস্যায় পড়লে নিজের চেষ্টায় বা অন্য কারো সাহায্যেই সমাধান পাবেন!
গ্রহ নক্ষত্র রাশিফল এই যুগে অচল ।
আপনি দেখছেন কিনা জানি না। চোখ মেলে দেখুন।
জয়ন্ত শাস্ত্রীর অকাল মৃত্যুতে আমি শোকাহত। উপকার পাওয়া (?) অসংখ্য মানুষের জন্য আমার করুণা রইলো ।
অবতাররা এভাবেই আমাদের ফাঁকি দিয়ে চলে যায়, তবু অমর হবার জন্য ইনি নিজের আঙ্গুলে একটা মাত্র জেম অফ ডেথ কেন পরলেন না – এই দুঃখ নিয়ে আপাতত সাতসকালে সাত কলকে গাঁজা খাবো আমি!!
শেষে বলে রাখি- জ্যোতিষ শাস্ত্রে আমার অগাধ আস্থা। সেই কবে অঙ্কের জ্যোতিষ স্যার বলেছিলেন – তুই গুনতে পারিস না, অতএব হবি একটা কলুর বলদ! অক্ষরে অক্ষরে সে কথা মিলে গেছে। ডাক্তার হবার পর থেকে সে কথা আমি মনে রেখেছি!!
অ্যাস্ট্রোফিজিক্স পড়তে গিয়ে অ্যাস্ট্রোলজির সাথে মিল খুঁজে না পেয়ে হেব্বি রাগ ধরেছিল।
যাকগে । একটি মৃত্যু নিয়ে লেখা। দয়া করে কেউ ন্যাকা ন্যাকা বক্তব্য রাখবেন না যে কেন মৃত্যু নিয়ে এরকম লেখা লিখবো।
লিখতে হয় – প্রতিটি মৃত্যু একটি শিক্ষা!!