কাহিনি
– উপন্যাস কিম্বা ভূতের গল্পের প্লট পাওয়া যাবে? আছে তোমার কাছে?
ছোকরা মাথা নাড়ল। মাথা নাড়া দেখে হ্যাঁ নাকি না বোঝা গেল না। শুনেছি আমরা যেমনটি মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলি, দক্ষিণের দেশে সেই ভাবে মাথা নাড়লে হয় না। এ আবার দু রকম ভাবেই নাড়ল। কী বুঝবে বোঝো!
আমি কাঁধের ঝোলা ব্যাগটা খুলে ডাইরি আর পেনটা বার করে বললাম,
– তা হ্যাঁ হে, রেট কী রকম?
ছোকরা, হ্যাঁ ছোকরাই বলি… চকচকে মুখে বলল, সে আপনি প্লট শুনে যা বলবেন, তেমনটি দেবেন। তবে এখানে বসে তো হবে না। একটু একলাটি হতে হবে। যেখানে যেখানে আপনার আপত্তি, সামান্য মোচড় দিয়ে দেব।
যত শুনছি, অবাক হচ্ছি। এই রকমও হয়? এই রকম প্লটওয়ালা, গল্পের প্লট বেচার লোক? আজব জায়গা এই কলকাতা।
– কোথায় বসে গল্পটা বলবে? এই খানে, এই কলেজ স্কোয়ারেই?
– এই তো, সামনেই আমার বাসা। চলুন ওখানে। বসে বলি। সময় লাগবে। উপন্যাস তো। ছোটোগল্প চাইলে তাও দেবখন। আর ওই যা বললেন, ভূতের গল্প।
বলল বটে বাসাটা সামনেই। কিন্তু খুব কাছে নয়। এ গলি সে গলি পেরিয়ে, আরপুলি লেনের ভেতর দিয়ে কিছুটা এগিয়ে এক সরু গলির পর তস্য গলির ভেতরে ঢোকাল আমায়।
একটু ভয় ভয় করছিল। রাস্তা তত নির্জন নয় যদিও। কলকাতার কোন রাস্তাই বা নির্জন আছে? কিন্তু বলা যায় না, এখানের লোকজনেরা ওর হয় তো চেনা। আমার তো আর চেনা নয়। মেরে ধরে লুটপাট ছিনতাই করলেই বা আটকাবো কী করে?
এই অবধি ভেবেই বেজায় হাসি পেয়ে গেল। ছিনতাই, তাও আবার আমাকে? হাঃ…
ঘোস্ট রাইটার, যাকে পেট চালাতে হয় অন্যের নামে লিখে, তার পকেটে যে বিকেলের চা বিস্কুটের পয়সাটাও থাকে কী থাকে না।
আমার কাঁধের ঝোলায় এই মুহূর্তে রয়েছে প্রকাশকের ফেরত দেওয়া পাণ্ডুলিপিটা।
এপার বাংলা ও’পার বাংলা কাঁপানো লেখক চন্দ্রশেখর মুখার্জির ঘোস্ট রাইটার আমি। ঘোস্ট রাইটার কাকে বলে বোঝেন তো? ভৌতিক লেখক নয় কিন্তু।
দাঁড়ান, বুঝিয়ে বলি।
চন্দ্রশেখরের বয়স হয়েছে। ওঁর লেখা গল্প উপন্যাসের বিরাট কাটতি। কিন্তু ওই বয়সের কারণেই লিখে উঠতে পারেন না। ছোটদের লেখা বড়দের লেখা কিছুই পেরে ওঠেন না।
পেরে ওঠেন না, তবু কিন্তু ওঁর সেই লেখা রেগুলার বেরোয়। ছোটদের জন্য আনন্দভারতী বা কিশোরমেলা কিম্বা বড়দের জন্যও, গল্প উপন্যাস সবই বেরোচ্ছে। উনি লিখতে পারছেন না। তাহলে লিখছেটা কে?
লিখছে এই আমার মত ক’জন। ওঁর স্টাইলে পটাপট লিখে দিচ্ছি পাতার পরে পাতা। নিজের নামে লিখি না কেন? আমি লিখলে ছাপবেই বা কে? পড়বেই বা কে? ওনার নামে বই লিখলে বাজারে পড়তে পাবে না। বিনিময়ে আমি পাব, রয়ালটির ভাগ। এই হল ঘোস্ট রাইটারের গপ্পো!
কিন্তু মুশকিল হয়েছে আমার। পাঠক নাকি ইদানিং পড়েই নাক সিঁটকোচ্ছে। বলাবলি করছে, চন্দ্রশেখরের ধার কমে গেছে।
আসলে হয়েছে কী। ওঁর লেখার স্টাইলটা রয়েছে কলমে কিন্তু আমার প্লটের জোর নেই। সেই প্লটের খোঁজ করতে গিয়ে এই ছোকরার সঙ্গে আলাপ।
বোস পাবলিশার্সএর হরিবাবু দেখা করতেই গত হপ্তায় দেওয়া পাণ্ডুলিপিটা ফিরিয়ে দিয়ে বললেন, – না হে বিবর্তন, লিখেছ চন্দ্রবাবুর মতন হুবহু, কিন্তু দু’পাতা পড়লেই বোঝা যাচ্ছে ভেতরটা ফাঁপা। প্লটে বিস্তর ফাঁকি। ভসভসে। চন্দ্রবাবুও আপত্তি করবেন, এমন খেলো লেখা ওনার নামে ছাপলে। আর রেগে যাবেন নাই বা কেন? রয়ালটির থার্টি পার্সেন্ট অবধি নিচ্ছো ওনার গুডউইলে। ঠিক মত না লিখলে চলবে কেন?
ছোকরা কোথাও ছিল আশেপাশে। ঘর থেকে বেরোতেই কাছে এসে বলল,
– প্লট বিক্রি করি আমি। নেবেন?
এদের কথা আমাকে বলেছিল বিজয়। সে টিভি সিরিয়ালের স্ক্রিপ্ট লেখে। এই রকমের কারও কাছ থেকে নাকি প্লট কেনে। ভাবলাম, দেখিই না চান্স নিয়ে।
★
সেই তার সঙ্গেই প্লট কিনতে আসা।
তো যাই হোক, একটা বাড়ির সামনে এসে, সদর দরজাটা খোলাই, ডানহাতি একটা ঘরে বসালো আমায়। বলল, – শুনুন, আমি মোড়ের মাথার দোকান থেকে এট্টু চা পাতা নিয়ে আসি। যাব আর আসব। চা খেতে খেতে কথা হবে।
সে গেছে তো গেছেই। দশ পনেরো মিনিট হয়ে গেল। ফেরে আর না। বসে থাকতে থাকতে বিরক্তি এসে গেল। বলেছে গল্পের প্লট শুনে দর ঠিক হবে। কত নেয় কে জানে।
কী রকম কী রেট, এই সব সাত পাঁচ ভাবছি। এমন সময় ঘরে ঢুকল সে। মানে সেই ছোকরা নয়, একটা বছর বাইশ পঁচিশের মেয়ে। দেখতে কেমন সে বর্ণনায় যাচ্ছিনে। বঙ্কিমের গল্পের মত হে পাঠক কল্পনা করো, কিম্বা হাল আমলের গল্পের ধাঁচে, না থাক সেই দেখার বর্ণনা।
মেয়েটা কিন্তু আমায় দেখে বেশ অবাক। আর বিরক্তও। আমার মাথায় যে কথা ঘুরছিল, নার্ভাস হয়ে সেই জিজ্ঞাসাটাই করে ফেললাম, – আচ্ছা রেট কত?
বলতেই মেয়ের চোখে আগুন জ্বলে উঠল। – কে পাঠিয়েছে? মালতী মাসি না নুলো সাধন? ওদের বলেছি তো আমি দু’দিনের মধ্যে ঘর ছেড়ে চলে যাব। বাবা নেই মানেই কি আমি ওদের হাতে চলে গেলাম? ভদ্রবাড়িতে লোক ঢুকিয়ে দিচ্ছে!
তর্জনী তুলে সদর দরজা দেখিয়ে হিস্ হিস্ করে বলল, – বেরোও, বেরোও এক্ষুনি। নইলে চেঁচিয়ে লোক ডাকব কিন্তু। ঢোকবার সময় গেটে দ্যাখোনি, লেখা আছে, সাবধান গৃহস্থ বাড়ি?
সর্বনাশ করেছে। গলি তস্য গলি ঘুরে এ কোথায় ঢুকেছি আমি। হাড়কাটা গলির কাছাকাছি বাই লেনগুলোয় কোনও কোনও বাড়িতে এরম লেখা থাকে শুনেছিলাম ওই লাইনে ওস্তাদ বন্ধুদের কাছে। সেই রকম গৃহস্থ বাড়িতে রসিকজন যাতে ভুল করে না ঢুকে পড়ে তার জন্য ওই সাবধানবাণী লেখা থাকে। ঢুকে পড়লে মারধোর অপমানিতও হয়েছে ওরা কেউ।
আমি প্রাণ বাঁচাবার জন্য আকুলিবিকুলি করছি, এমন সময় চোখ পড়ল দেওয়ালে। ফ্রেমে আটকানো ওই ছোকরার ছবি। দেখিয়ে হাঁসফাঁস করতে করতে বললাম, – ওই তো, ওই ছেলেটাই তো আমাকে গল্পের প্লট বিক্রি করবে বলে ফুঁসলে নিয়ে এলো।
এই কথা শুনে, বললে প্রত্যয় হবে না, মেয়েটা কেমন থমকে গেল। ছবিটার দিকে তাকিয়ে বলল, – বাবা, তুমি, তুমিই শেষ অবধি?
★
ছবিটা ওই মেয়েটার বাবার। যুবক বেলার ছবি। গত সপ্তাহে তিনি মারা গেছেন মেডিকেল কলেজে। মা নেই বহু দিন। বাপ বেটিতে শহরের ভদ্র পাড়ায় আস্তানা না পেয়ে এ’খানে দিন গুজরান করত। বাবা মারা গিয়ে অবধি আশেপাশের শকুনি গৃধিনীরা ওকে তাক করেছে।
এরকম নাকি এ দিগড়ে হরদম ঘটে। গৃহস্থবাড়ির গার্জিয়ান না থাকলে পাড়ার মাংসবেচা দালালেরা এগিয়ে আসে। সামনে থাকে মাসিপিসিরা। ক্যান্সার ছড়িয়ে পড়ার মতই হাড়কাটার বাতাস ছড়িয়ে পড়ে। নিঃশব্দে খসে পড়ে দরজায় লাগানো বোর্ড।
★
কিনতে এসেছিলাম ভূতের গল্পের প্লট। তা একরকম সেই রকমই প্লট পেলাম বই কি! সেই সাথে ভালোবাসার গল্পের প্লটও। মেয়ের নাম একটু আজব রেখেছিল সেই লোক। মেয়ের নাম কাহিনি। ওর বাবা সত্যিই প্লট বিক্রি করতেন। বড় বড় লেখকেরা কাস্টমার ছিল। কিন্তু যা হয়। দারিদ্র ছিল ভূষণ।
★
কাহিনি এখন আর কলকাতার গলিতে থাকে না। আগড়পাড়ার ইলিয়াস রোডে আমাদের বাড়িতে আমরা তিনজন থাকি। আমি, আমার মা আর কাহিনি। আজ্ঞে হ্যাঁ, বিয়ে হয়েছে এই ঘোস্ট রাইটারের। তার বউ কাহিনি পাড়ার একটা কিন্ডারগার্টেন স্কুলে পড়ায়।
আর আমি বিবর্তন মিত্র, এখন পুরোপুরি হোলটাইমার লেখক। ঘোস্ট রাইটার না। নিজের নামেই লিখি।
বিয়েতে যৌতুক পেয়েছি। যৌতুকও পেয়েছি কাহিনি। এক সুটকেস ভরা পাণ্ডুলিপি। অজস্র প্লট। প্লট দেবে বলেছিল তো! সেই যৌতুকেরই ভরসায় পুরোনো বাড়িতে একটা নতুন ঘর তুলছি