চেম্বারের ফাঁকা সময়ে ডাক্তারবাবুর পড়াশুনো মাথায় উঠেছে। এলাকায় করোনা ছড়িয়ে যাওয়ার পর থেকেই রোগীর সংখ্যা অত্যাধিক বেড়ে গেছে। সবই প্রায় জ্বরের রোগী। সারাদিন ধরেই তিনি রোগী দেখছেন।
জ্বর-কাশির সব রোগীকেই করোনা পরীক্ষা করতে বলছেন। কাছেই একটি সরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্রে বিনামূল্যে করোনা পরীক্ষা হচ্ছে। ডাক্তারবাবুর প্রেসক্রিপশন নিয়ে গেলেও সেখানে দিব্যি পরীক্ষা হয়ে যাচ্ছে। অনেকেই পরীক্ষা করাচ্ছেন এবং অধিকাংশেরই করোনা ধরা পড়ছে।
ডাক্তারবাবুর বয়স ষাট পেরিয়েছে। তাঁর স্ত্রী, পুত্র বারবার বলছেন রোগী দেখা বন্ধ করার জন্য। রোজই একাধিক চিকিৎসকের মৃত্যুর খবর পাওয়া যাচ্ছে। পশ্চিমবঙ্গেই চিকিৎসকের মৃত্যু পঞ্চাশ ছাড়িয়েছে। তার মধ্যে ৪৭ জনই প্রাইভেট প্রাক্টিশনার। যে চিকিৎসকরা সরকারি বা কর্পোরেট হাসপাতালে রোগী দেখেন তাঁদের মধ্যে মৃত্যুহার অনেক কম।
ডাক্তারবাবু স্ত্রীর কথার অবাধ্য হন না। তবে এক্ষেত্রে মানতে পারেননি। মহামারীর মতো জনস্বাস্থ্যের এক বিপর্যয়ের সময়ে চুপচাপ ঘরে বসে থাকা অসম্ভব। তিনি দুটি ‘তিন লেয়ারের মাস্ক’ পরে রোগী দেখছেন। চেম্বারের পেছনে একটি ছোট্ট ঘরে একলা থাকছেন। গত দুই মাস ধরে সেই ঘরে স্ত্রী, পুত্র বা অন্য কাউকে ঢুকতে দিচ্ছেন না। আজকাল শুধু খাবার নেওয়ার সময়ে তাঁর স্ত্রীর সাথে দেখা হয়।
মাঝে মাঝে যখন ক্লান্তি লাগে তিনি মোবাইলে শ্যামনগরের ডাঃ প্রদীপ ভট্টাচার্যের শেষ যাত্রার ভিডিওটা দেখেন। চোখের জলে ক্লান্তি ধুয়ে যায়।
আজও সকাল সকাল ডাক্তারবাবু চেম্বার খুলে বসেছিলেন। একটি বছর ত্রিশের যুবক ঢুকল। যুবকটি অত্যন্ত অন্যমনস্ক। তার মাস্ক চোয়াল থেকে ঝুলছে।
ডাক্তারবাবু বললেন, ‘বাবা… মাস্কটা নাকের উপরে উঠিয়ে নাও। না হলে তুমিও মরবে, আমিও মরব।’
যুবকটি মাস্ক টেনে নাক, মুখ ঢাকল। তারপর বলল, ‘ডাক্তারবাবু, আমার যা অবস্থা তাতে মরে যাওয়াই ভালো।’
ডাক্তারবাবু বললেন, ‘সবাই এই মহামারীর মধ্যে বেঁচে থাকার জন্য মরিয়া লড়াই চালাচ্ছে। লোকে বাঁচার জন্য পায়ে হেঁটে কয়েকশো কিলোমিটার পথ পেরোচ্ছে। আর তুমি এই বয়সে মরার চিন্তা ভাবনা করছো কেন?’
‘ডাক্তারবাবু, সাতদিন বাদে আমার বিয়ে।’
‘হ্যাঁ, বিয়ে জিনিসটা একটা জটিল সমস্যা বটে। কিন্তু তার জন্য মরার চিন্তাটা বাড়াবাড়ি। তুমি চোখ কান বুজে বিয়েটা করেই ফেল। আমিও ভয়ে ভয়েই করেছিলাম। তারপর দেখলাম যতটা খারাপ ভাবছিলাম, বিয়ে জিনিসটা ততটা খারাপ নয়।’
যুবকটি ক্লান্ত চোখ দুটি মেলে বলল, ‘বিয়ে করতে আমি মোটেই ভয় পাই না। বরঞ্চ যে পাত্রী তার সাথে বিয়ে না হলে আমার বেঁচে থাকাই অর্থহীন। আমার সমস্যাটা অন্য। আমার একটা রোগ ধরা পড়েছে। সেই রোগ লুকিয়ে কি বিয়ে করা উচিৎ হবে? আর যদি রোগের কথা বলি, তাহলে কি পাত্রীর বাড়ির লোকজন আমার সাথে মেয়েটির বিয়ে দেবে?’
ডাক্তারবাবু চিন্তিত ভাবে বললেন, ‘তোমার কি রোগ ধরা পড়েছে বাবা? এইচআইভি, থ্যালাসেমিয়া, নাকি ক্যান্সার?’
যুবকটি বলল, ‘ওসব কিছু নয়। তবে আমার প্রায় ওরমকই একটি খারাপ রোগ ধরা পড়েছে। চোরা জন্ডিস।’
‘চোরা জন্ডিস? সেটা আবার কি রোগ? চোরাবালির কথা শুনেছি। কিন্তু চোরা জন্ডিসের কথাতো শুনিনি।’
‘ঠিকই বলেছেন… চোরাবালি…। আমি আস্তে আস্তে যেন চোরাবালিতে ডুবে যাচ্ছি। বারবার রক্ত পরীক্ষা করছি, আর রিপোর্ট দেখে আরও চোরাবালিতে ঢুবে যাচ্ছি। এই দেখুন আমার লিভার ফাংশান টেস্টের একগাদা রিপোর্ট। প্রায় সব রিপোর্টেই বিলিরুবিন বেশি।’
ডাক্তারবাবু হাত বাড়িয়ে রিপোর্টের গোছা নিলেন। পর পর রিপোর্ট গুলো দেখলেন। দেখতে দেখতে তার মুখে হাসি ফুটে উঠল। যদিও মাস্কের আড়ালে সেই হাসি চাপা থাকল। তিনি বললেন, ‘তুমি কোনও চোরা জন্ডিসে ভুগছো না। তুমি যে রোগে ভুগছো তার নাম গিলবার্ট সিন্ড্রোম।’
‘কি নাম বললেন? এটা কি খুব জটিল রোগ? এই অসুখে কি অল্প দিনের মধ্যেই লিভার ফেলিওর হয়ে যায়? পেটে জল জমে?’
‘গিলবার্ট সিন্ড্রোম আদৌ কোনো জটিল রোগ নয়। শরীরে লোহিত রক্ত কণিকা নষ্ট হয়ে যাওয়ার পর কণিকার ভেতরের হিমোগ্লোবিন থেকে বিলিরুবিন তৈরি হয়। এই বিলিরুবিন রক্তের মাধ্যমে লিভারে পৌঁছায়। এখন লিভারে পৌছানোর পর বিলিরুবিন উৎসেচকের মাধ্যমে গ্লুকোনিউরিক অ্যাসিডের সাথে যুক্ত হয়। তারপর পিত্তের মাধ্যমে সেটি পরিপাক নালীতে নির্গত হয়। গ্লুকোনিউরিক অ্যাসিডের সাথে যুক্ত এই বিলিরুবিনকে বলে কনজুগেটেড বিলিরুবিন। আর তার আগের বিলিরুবিনকে বলে আন-কনজুগেটেড বিলিরুবিন।’
যুবকটি কাঁচুমাচু মুখে বলল, ‘এসব জেনে আমি কি করব?’
ডাক্তারবাবু বললেন, ‘বাবা… অজ্ঞানতাই সবচেয়ে বড় অসুখ। তোমার ভয় কাটানোর জন্য বিস্তারিত জানা অত্যন্ত জরুরী।’
‘বলুন…’
‘যে কোনও লিভারের অসুখে সাধারণত বিলিরুবিনের কনজুগেশনের প্রক্রিয়াটি স্বাভাবিক থাকে। তাই সেক্ষেত্রে কনজুগেটেড বিলিরুবিন বাড়ে। যেমন ধরো হেপাটাইটিস, সিরোসিস, অবস্ট্রাক্টেড জন্ডিস ইত্যাদি। তাছাড়া সেক্ষেত্রে লিভার ফাংশান টেস্টের অন্যান্য জিনিস গুলোর পরিবর্তন হয়। যেমন এসজিপিটি, এসজিওটি ইত্যদি লিভার এনজাইম বাড়ে। অ্যালবুমিন কমে।’
‘হ্যাঁ, আমি সেটা খেয়াল করেছি। আমার বাকি লিভার ফাংশান টেস্ট ভালো আছে।’
ডাক্তারবাবু বললেন, ‘গিলবার্ট সিন্ড্রোমে বিলিরুবিন কনজুগেশনের জন্য প্রয়োজনীয় উৎসেচকটির অভাব থাকে। যার ফলে কনজুগেটেড বিলিরুবিন ঠিক বা কম থাকলেও আন-কনজুগেটেড বিলিরুবিন পরিমানে অনেকটাই বাড়ে। এটা একধরণের জিন ঘটিত অসুখ। ফলে সারাজীবন ধরেই গিলবার্ট সিন্ড্রোমে আন-কনজুগেটেড বিলিরুবিন বেড়ে থাকে। তোমার যদি বেশ কয়েক বছর আগের লিভার ফাংশান টেস্টের রিপোর্ট থাকে, তাতেও দেখবে বিলিরুবিন ২ থেকে ৪ মিগ্রা/ডেসিলির মধ্যে। এবং তার মধ্যে আন-কনজুগেটেড বিলিরুবিন ৮০% এর বেশি।’
‘এটা ঠিক বলেছেন। পাঁচ বছর আগেও আমার লিভার ফাংশান টেস্টে বিলিরুবিন তিন এসেছিল। আচ্ছা ডাক্তারবাবু এই আন-কনজুগেটেড বিলিরুবিন আর কোনো জটিল অসুখে বাড়তে পারে না?’
‘হ্যাঁ পারে। যেমন হিমোলাইটিক অ্যানিমিয়া। কিন্তু তুমি নিশ্চিন্তে থাকতে পারো তোমার সেসব হয়নি। আমি ইতিমধ্যে তোমার চোখের পাতা টেনে দেখেছি, রক্ত যথেষ্ট আছে। পেটে খোঁচা মেরে দেখে নিয়েছি পিলে বাড়েনি। তাছাড়া জটিল রোগ হলে পাঁচ বছর ধরে তুমি নিশ্চয়ই সুস্থ থাকতে না।’
‘তাহলে আমি এখন কি করব?’
‘বিয়েটা করে ফেলবে। তাহলেই দেখবে এই সব অসুখ বিসুখের ভূত তোমার মাথা থেকে বেড়িয়ে গেছে।’
‘কিন্তু আমি যে আরসো-ডিঅক্সি-কোলিকঅ্যাসিড বলে একটা দামী ওষুধ এক আত্মীয়ের কথা মতো অনেক দিন ধরে খাচ্ছি?’
‘সে তুমি ডাক্তারের কথা বিশ্বাস করবে না আত্মীয়ের কথা বিশ্বাস করবে সেটা তোমার ব্যক্তিগত ব্যপার। আমার কথা বিশ্বাস করলে এখুনি ওই ওষুধ বন্ধ করো। প্রাইমারি বিলিয়ারি সিরোসিস বলে একটি জটিল রোগ ছাড়া অন্য কোনও অসুখে ঐ দামি ওষুধটির কোনো ভূমিকা নেই। একটা কথা মনে রেখো, ৫% এর বেশি মানুষের গিলবার্ট সিন্ড্রোম থাকে। বেশীরভাগ মানুষই না জেনে সারাজীবন দিব্যি কাটিয়ে দেয়। তোমার কোনো চিকিৎসার দরকার নেই। শুধু দরকার মাথা থেকে এই রোগের ভূত তাড়ানো।’
‘তাহলে ডাক্তারবাবু, বিয়ে করতে কোনো সমস্যা নেই তো?’
‘নিশ্চিন্তে বিয়ে করো। আগে হলে বলতাম বিয়ের পরে মামনিকে নিয়ে একবার ঘুরে যেও। যা দিনকাল পড়েছে, এখন কাউকে আসতেও বলতে পারছি না।’ বয়স্ক ডাক্তারবাবু মাস্কের আড়ালে একটা বড়সড় দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন।
আমার আছে। জানতে পেরে প্রথমে ভয় পেয়েছি, তারপর এডজাস্ট হয়ে গেছে সঙ্গী হিসেবে।
ভালো লেখা।