(বহুকাল আগে। কতোকাল আগে জানতে চাইছেন? সে ধরুন ঊনিশশো আটষট্টি বা ঊনসত্তর সালে বা সত্তর সালে। তখন প্রথম কিশোর ভারতী বেরিয়েছে। একদিকে দীনেশ চন্দ্র চট্টোপাধ্যায় লিখছেন ধারাবাহিক ‘দুরন্ত ঈগল’- জুরা নামের এক যুবক আর তার কুকুর টীকের দুর্গম কারাকোরাম পাহাড়ে অভিযানের গল্প, সঙ্গে চলছে নানা প্রবন্ধ, গল্প। তখন হাতের লেখা নিয়ে ‘হাঁসদা’ নামে একটা ধারাবাহিক প্রবন্ধ বেরিয়েছিল। একটা বাচ্চা খারাপ হাতের লেখার জন্য খুব বকা খেয়ে বসে আছে, এমন সময়ে পুকুরের হাঁস অর্থাৎ সরস্বতীর বাহন তাকে হাতের লেখা ভালো করার কিছু কায়দা বলে’ দ্যায়।
মা বাবার বদলির চাকরি, নানা জায়গায় বদলি হ’তে হ’তে সেই সব পত্রিকা আমি কোথায় হারিয়ে ফেলেছি। পরে দুরন্ত ঈগল বইটা বইমেলায় খুঁজে পেয়েছি। কিন্তু গোগোলবাবুও ঐ বিশেষ লেখাটার সন্ধান দিতে পারলেন না। লেখকের নামও মনে নেই। তবুও লেখা ও লেখকের কাছে কৃতজ্ঞতা স্বীকার করছি। সেটাই আজকের লেখার উৎস বিশেষ।)
রবিঠাকুরের হাতের লেখাটা বেশ শৈল্পিক। প্রতিভাবান, শিল্পী মানুষ-এটা তো হবেই। কিন্তু সেই সময়ের বহু মানুষের হাতের লেখাই বেশ সুন্দর ছিলো- বাবা, কাকাদের কথা বাদই দিলাম, এমনকি আমার তথাকথিত অশিক্ষিত ঠাকুমার হাতের লেখাও খুব ভালো ছিলো। সে তুলনায় এখনকার মানুষজনের (ডাক্তারদের কথা আর বলবোই না) হাতের লেখা অতি অখাদ্য। কিন্তু কেন এমন হয়? আমাদের ত্রুটিটা ঠিক কোথায়? আমার বাচ্চার হাতের লেখা কি শেষমেশ কাগের ঠ্যাং, বগের ঠ্যাংই হবে?
আসুন বিষয়টাতে একটু লেখনীপাত করা যাক।
তখন ছোটোবেলায় সবাইকার লেখা শুরু হতো শ্লেট আর শ্লেট পেন্সিল (শ্লেট পাথরের এক টুকরো কাঠি) দিয়ে। এখন লেখা শুরু হয় কাগজ কলমে। পেন্সিলের কথাও আসেই না। আসলে গন্ডগোলটা এখানেই রয়েছে। আপনি শ্লেট আর কোথায় পাবেন? কাল্পনিক একটা কাঠি দিয়ে হাওয়ায় নাম লেখার চেষ্টা করুন, দেখবেন আপনার পুরো হাতটাই নড়ছে। সেই কাঁধ থেকেই, কিন্তু আঙ্গুলের বিশেষ কোনও নড়চড় হচ্ছে না। এখানেই রয়েছে রহস্যের উৎস।
এবার আমরা রবীন্দ্রনাথের হাতের লেখায় আসি- সুন্দর কিন্তু টানা লেখা, দেখলেই চোখ জুড়িয়ে যায়। উনি দীর্ঘদিন শ্লেটে লিখেছেন, না কোথাও কোনও উদ্ধৃতি নেই। কিন্তু এটাই ছিলো তখনকার রীতি। এবার নিজের হাতের লেখার কথা ভাবুন, সেটা কিন্তু সে রকম নয়।
কেন এমন হয়?জানতে গেলে, আমাদের নিম্নলিখিত হাতের লেখার বিভিন্ন পদ্ধতি বোঝা যাক।হাতের লেখা মূলতঃ চার রকম।
(১) ফিঙ্গার মুভমেন্ট
(২) ঋস্ট (কবজি) মুভমেন্ট
(৩) এলবো (কনুই) বা ফোর আর্ম মুভমেন্ট
(৪) পুরোপুরি আর্ম (রবীন্দ্রনাথের হাতের লেখা) মুভমেন্ট। এটায় পুরো হাত নড়ে।
ফিঙ্গার মুভমেন্টে লিখলে খুব মন দিয়ে না লিখলেই হাতের লেখা খারাপ হবে।
আপনি ভূর্জপত্রে (তালপাতার পুঁথি) যে সব সংস্কৃত লেখা হতো, এমনকি পুরোনো কুষ্ঠিতেও, সেগুলো দেখুন- অদ্ভুত সুন্দর লম্বা লম্বা ছবির মতো লেখা হতো (তারও আগে পাথরে বা ধাতব জিনিসে খোদাই করে’ লেখা হতো-ইন্দাস ভ্যালি, জুলিয়াস সিজারের সময় রোমান পত্রাবলী-তাতে গোটা শরীরটাই নড়তো)। ভূর্জপত্রগুলো খাগের কলমে লেখা হতো। খাগ মানে উলুখাগড়ার গাছ, তার একটা দিক সরু করে নিয়ে কালিতে (রঙিন তরলে) ডুবিয়ে তালপাতার পুঁথিতে লেখা হতো। এটা আপনি সরস্বতী পুজোর উপাচারে দেখেছেন। দুধের দোয়াতে এই কলম ডোবানো থাকে।
তারপর এলো দোয়াতে কলম ডুবিয়ে লেখার কলম। তখন থেকেই পেন্সিল রয়েছে। এর প্রত্যেকটাতেই পুরো হাত নাড়িয়ে লিখতে হতো। না হলে লেখাই সম্ভব নয়। কারণ তখন কাগজ ছিলো খড়খড়ে এবং কলমের আগাও অমসৃণ। এটাতে এমন ভাবে লিখতে হতো যে চাপ এ্যাতো বেশী পড়বে না, যাতে কলমের নিব ভেঙে যায় অথবা কাগজটা ছিঁড়ে যায়।
আমার হাতের লেখা? সেটা তো বলবে গাঁয়ের পাঁচজনা, কিন্তু আমি বহুদিন শ্লেটে লিখেছি।তারপর এলো পেন্সিল। তখনও পেন্সিল কাটা কল আসে নি। কতোবার দাড়ি কাটার ব্লেডে আঙ্গুল কেটেছি। বাজারে কিন্তু তখনই কালি ভরা ঝর্ণা কলম পাওয়া যায়। সুলেখা কালিও। তখন বোধহয় আমি থ্রি বা ক্লাস ফোরে পড়ি। তখনও আমি পেন্সিল নিয়ে বসে আছি। আমার জীবনে ক্লাস ফাইভে এলো কালি ভরা কলম। সব শেষে এলো আর্টেক্স কলম। তখন আমি চেলপার্ক (কালির কোম্পানি)-এর টার্কিশ ব্লু দিয়ে লিখতাম। লাল কালিতে দাগানোর জন্য আরেকটা কলম, কালির দোয়াত। সব দোয়াতেই একটা করে ড্রপার ফ্রি থাকতো। প্রথমে কালো মুন্ডু ওয়ালা ড্রপার, তারপর স্বচ্ছ প্ল্যাস্টিক ড্রপার। মাধ্যমিক পরীক্ষার সময় অবধি এই চলেছিলো।
দেখুন কান্ড, ধান ভানতে নিজের গাজন গাইছি।
এখন প্রথম থেকেই শিশুর হাতে বল পয়েন্ট পেন, ভালো পেন্সিল। তখনকার খাতার থেকে এখনকার খাতার কাগজ অনেক মসৃণ। প্রথম আনাড়ি হাতে এই সব পিছলে যেতে চায়। যেহেতু আঙুলের ওপর আমাদের নিয়ন্ত্রণ অনেক বেশী, তাই ছোটো শিশুরা এই সব মসৃণ লেখার জিনিসপত্র প্রথম থেকেই আঙুল দিয়ে সামলাতে চেষ্টা করে। ফলতঃ প্রথম থেকেই চলে আসে ফিঙ্গার মুভমেন্টে লেখা।
ফিঙ্গার মুভমেন্ট:-এটাতে আপনার ঋস্ট তালুর কড়ি আঙুলের দিকটা কাগজে চেপে থাকে। ভালো নিয়ন্ত্রণ রাখার জন্য দুটো আঙুল (সাধারণতঃ তর্জনী আর বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ) শক্ত করে’ কলমটা চেপে’ ধরে’ থাকে, তাতে রাইটার্স ক্র্যাম্প হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। আঙ্গুলের এই পেশীগুলো সূক্ষ্ম কাজ করার জন্য তৈরি, বেশীক্ষণ জোরে চেপে কলম ধরা এবং একটানা লেখার জন্য নয়।খেয়াল করে’ দেখুন যে লাইন ধরে লিখেছেন, কবজি, তার খুব কাছে চেপে বসে থাকে। ফলে আপনার আঙুলের ঘোরার পরিধি খুব ছোটো হয়ে যায়। অক্ষরগুলো ছোটো ছোটো হয়। এবং যাদের নিয়মিত লিখতে হয় তাদের রাইটার’স ক্র্যাম্প হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। খুব তাড়াহুড়ো করে লিখলে হাতের লেখা খারাপ হতে পারে। বোঝানো ভারি মুশকিল। নিজের হাতের তালুর কড়ি আঙুলের দিকটা আর কবজি, কোনও একটা শক্ত জিনিসে চেপে লেখার চেষ্টা করুন, বুঝতে পারবেন।
অনেক শিল্পী ফিঙ্গার মুভমেন্টে ছবি আঁকেন। এতে আঁকা ,ছোটো আর অনেক বেশী নিখুঁত হয় কিন্তু যেই মুহূর্তে আপনি বড়ো কিছু আঁকতে যাবেন, তখন আর ফিঙ্গার মুভমেন্ট কাজে দেবে না। ছয় ইঞ্চির বেশী পরিধি এই ধরণের লিখনভঙ্গীতে হয় না। ছবি আঁকার সময় পেন্সিল কাগজে চেপে ধরাও মুশকিল (অনেকেই এটা করেন), তাতে পরে মুছতে অসুবিধে হবে, আঁকা গতিময় এবং জোরালো হবে না এবং রং করার পরেও পেন্সিলের গাঢ় দাগগুলো দেখা যাবে।
ঋস্ট মুভমেন্ট:-স্বাভাবিকভাবেই এটাতে মূলতঃ ঋস্ট মুভমেন্টে লেখা হয়। অর্থাৎ আঙুল নয়, এক্ষেত্রে কবজি থেকেই নাড়িয়ে লেখা হচ্ছে। ফলে আঙুল নড়ছে না, কলমটা কেবল ধরে রাখছে। এতে রাইটার্স ক্র্যাম্প হওয়ার সম্ভবনা তুলনায় কম এবং আঙুল অনেকখানি জায়গায় নড়াচড়া করার সুযোগ পাচ্ছে।
ফোর আর্ম মুভমেন্ট এবং ফুল আর্ম মুভমেন্ট:- এতে কবজি আলতো করে কাগজের ওপর ভারসাম্য ঠিক রাখার জন্য রাখা থাকে। নাহলে এভাবে লেখাই সম্ভব নয়। এক্ষেত্রেও আঙুলের কাজ শুধুমাত্র কলমটা ধরে’ রাখা। হাত কনুই থেকে পুরো সোজা থাকবে। শিশু বা লেখক পেন্সিলের তীক্ষ্ণ ডগাটা অবধি দেখতে পাবে, এতে কী লিখছি, কেমন লিখছি এটা বোঝা যায়। এ দুটোতে গোটা হাত নড়ে লেখা হবে। ফুল আর্ম রাইটিংয়ের সময় কাঁধও নড়ে। এতে শুধু হাতের লেখা ভালো হবে তা নয়, অক্ষরগুলো গোটা গোটা বড় হবে। কেন না আপনার আঙুল বৃত্তাকারে ঘোরার জন্য অনেক বড়ো জায়গা পাচ্ছে। ছবি আঁকার সময় এটা বাধ্যতামূলক।
সুতরাং যদি ছোটোবেলা থেকেই এটা প্র্যাকটিস করা যায়, তাহলে হাতের লেখা দ্রুত, শৈল্পিক, বড়ো বড়ো এবং চমৎকার হবে। দুঃখ করবেন না- যদি আপনি এখনও ফিঙ্গার মুভমেন্টে লেখেন তাহলে এখনও পারবেন। প্রয়াস করুন, অবশ্যই সম্ভব।চেষ্টা কৃতে যদি ন সিদ্ধ্যতে, কোঅত্র দোষঃ?
(সব শেষে আবার বলি, সেই পুরোনো কিশোর ভারতীর কাছে আমি ঋণী।তখনই এটা পড়েছিলাম।)
আজকের মতো বুড়ো হাতুড়েকে বিদায় দিন। বিদায় বন্ধু, অশ্রুজল ইত্যাদি ইত্যাদি…
হাতের লেখার জন্য আঙুল কব্জি পেশির দরকার হয় ঠিক কিন্তু আমার মনে হয় সব থেকে বেশি দরকার মা বাবা গুরুজনদের ধৈর্যের,যেটা এখন আর কারুর নেই।বাচ্চা ইস্কুল যায় 2 বছর বয়স থেকে,তারপর শুরু হয় পড়াশোনার নামে অত্যাচার,শুরু হয় আস্বাস্থ্যকর প্রতিযোগিতা,কে প্রথম কে দ্বিতীয় বা তৃতীয় হবে তার টানাপোড়েন।সময় কোথায় হাতের লেখা শেখার? আর একাকী পরিবারে কর্মরত মাবাবার সময় কোথায় বাচ্চাকে দেবার মতো? প্রণম্য রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পাঠশালায় গেছিলেন অনেক বেশি বয়সে তাঁর মূল শিক্ষা শুরু বাড়ি থেকে।আমরা ইস্কুল গেছি সারে পাঁচ বছর বয়সে।বাড়িতে মার কাছে শিখেছি স্লেটে হাতের লেখা,আর ঘরের লাল মেঝেতে চক দিয়ে আঁক কষা।আমার মা তিন ভাই বোন কে পড়তে বসিয়ে সংসারের যাবতীয় কাজ করতেন।কি সব দিন ছিল সে সব আমাদের।আমার আজকের শিশুদের জন্য কষ্ট হয়,ভাবি এই নিদারুণ সভ্যাতার যুগে ওরা কি কি পেল না।শুধু হাতের লেখা নয় ভাই ওরা একটা সুস্থ মানসিকতার মধ্যে বড়ো হলো না।এখন আর কিছু করার নেই,এর মধ্যে থেকে যারা সুন্দর করে ভাবতে শিখছে,বলতে শিখছে,লিখতে শিখছে আমাদের আশার আলো তারাই।
দিদি, ওদের এক অস্বাস্থ্যকর,অর্থহীন প্রতিযোগিতার মধ্যে ফেলে ওদের মানুষ হতে দিচ্ছি না।
পরে আমরাই হাহাকার করছি-সন্তান আমাকে দেখে না।
এক যান্ত্রিক যাপনে ওরা অভ্যস্থ হয়ে যাচ্ছে।
বিরল বিষয় । অসাধারণ লেখা
ধন্যবাদ দি’।চমৎকার থাকো।
অসাধারণ !
ধন্যবাদ দাদা
আমার হাতের লেখা পড়ার মত ছিল না। কিন্তু সেটা আত্মরক্ষার তাগিদে। ডাক্তারি বানানগুলো মনে রাখা অসম্ভব।
এখন অফ্ স্পিনার থেকে লেগ স্পিনারের গ্রিপ? দেখি হয় কিনা।
ধন্যবাদ দাদা।অকপট সহজ স্বীকারোক্তি আমায় স্তম্ভিৎ করলো।
ধন্যবাদ দি’।চমৎকার থাকো।