পল্টুর দাদু মিলিটারিতে ব্রিগেডিয়ার ছিলেন। রিটায়ার করে পাহাড়ি কোন জায়গায় বাড়ি করেছেন। দেরাদুন থেকে অনেক দূর গাড়ি করে যেতে হয়। দেরাদুন যেতেই তো কত সময় লাগে। সেবার পল্টুর বন্ধু ঝাপান তার বাবা-মার সঙ্গে দেরাদুন, মুসৌরি, এসব কত জায়গা বেড়িয়ে এল। পল্টুকে গল্প করল — কেমন ট্রেনে করে প্রথমে দিল্লি, তারপরে আবার আর একটা ট্রেনে দেরাদুন… পল্টু যায়ইনি। পল্টুর বাবার অফিসে নাকি ছুটি-টুটি পাওয়া যায় না, তাই ওদের কোথাও বেড়াতেও যাওয়া হয় না। শুধুুুু পুজোর সময় মামাবাড়িতে বর্ধমানের গ্রামের পুজো, সে-ও বাবার সঙ্গে নয়, মার সঙ্গে। তাই সে বারে বাবা যখন এসে বলল, “গরমে চলো, বাবার কাছ থেকে ঘুরে আসি। কী রে পল্টু, যাবি নাকি দাদুর বাড়ি?” তখন পল্টুর যে কী আনন্দ হলো, সে আর বলে বোঝানোর নয়। এক ছুটে ঝাপানের বাড়ি গিয়ে তাকে খবরটা দিয়ে তবেে শান্তি।
সে বছর গরমটাও পরল জব্বর। গরমের ছুটি শুরু হবার দু সপ্তাহ আগেই পল্টুর ইসকুল ছুটি দেবে বলল। সবার খুব আনন্দ! কিন্তু নতুন ছুটির দিনের দু-তিন দিন আগেই প্রিন্সিপাল বললেন, “যদি এমনই গরম চলে তাহলে দেড় মাস পরেই স্কুল খুলবে। কিন্তু যদি বর্ষা এসে যায়, গরম কমে যায়, তাহলে তাড়াতাড়ি স্কুল খুলবে। ভয় নেই, আমরা সব বাবা-মাকে হোয়াটসঅ্যাপ করে জানিয়ে দেবো। আপনাদের সব্বার নম্বর স্কুলে আছে তো?”
খবর শুনে পল্টুর বাবা তো রেগে কাঁই! “কোনও মানে হয়? ওদিকে দু সপ্তাহ পরে আমাদের টিকিট কাটা হয়েছে! এবারে সেই টিকিট ক্যানসেল করো রে, নতুন টিকিট কাটো রে…” সেদিন অনেক রাত অবধি ইন্টারনেটে বসে বসে বাবা পরদিন সকালে গোমড়া মুখে বলল, “যাবার টিকিট ক্যানসেল করে দিয়েছি, কিন্তু নতুন টিকিট তো ট্রেনে পাইনি, তাই দিল্লীর টিকিট কেটেছি ফ্লাইটেই। ফেরার টিকিট এখনও ক্যানসেল করিনি, দেখা যাক কি হয়…”
কবে স্কুল খোলে সে নিয়ে অবশ্য পল্টুর মাথা ব্যথা নেই। স্কুল যেতে দু দিন দেরি হলে ওর ভালোই। বরং অচেনা দাদু-দিদার সঙ্গে আরও বেশি দিন কাটানো যাবে, সেটাই বেশি মজা। মা অবশ্য বলে যে দাদু-দিদা ওর অচেনা মোটেই নয়। ওর যখন ছ’ মাস বয়স, আর তারপরে আবার যখন দেড় বছর, দাদু দিদা দুজনেই এসে অনেকদিন ছিলেন। অ্যালবাম খুলে ছবি দেখায় — “এই দেখ, দাদুর কোলে উঠেছিস তুই।” “এই দেখ, দাদু তোকে কাঁধে করে নিয়ে পিকনিকে ছুটোছুটি করছে!” ছবিগুলো দেখে দেখে দাদু দিদার চেহারাটা পল্টুর চেনা হয়ে গেছে।
গরমের ছুটি পড়ল ভাগ্যিস! এমন গরম পড়েছে, যে রাস্তায় ছায়ায় দাঁড়িয়েও মানুষ ঘেমে নেয়ে অস্থির। পল্টুর বাড়িতে যে কুকুরটা খেতে আসত তিন বেলা, সে তো সকালে দুপুরে আর আসেই না। মা একদিন দেখতে পেল সে কোন নর্দমার জলে শুয়ে আছে। বলল, “বেচারা,” বলে সে যখন রাতে খেতে এসেছে, একটা পুরোনো কাঁথা ভিজিয়ে দরজার সামনে দিয়ে বলেছে, “এখানে শুয়ে থাক।”
কুকুর কি আর থাকে? সে কোথায় চলে গেছে — কিন্তু পরদিন বাড়ির অন্য বাসিন্দারা চেঁচামেচি লাগিয়েছে, সিঁড়িতে কে নোংরা কাপড় ফেলেছে? বাধ্য হয়ে পল্টুর মা কাপড়টা সরিয়ে নিল। বাবা বলল, “জানোই তো ওরা কুকুর-টুকুর পছন্দ করে না। তুমি খাওয়াও বলে রাগ করে। আর তাছাড়া, দু-দিন পরে তো এক মাসের জন্য চলেই যাব। না-ই বা বেচারাকে বিছানায় ঘুমোনো অভ্যেস করালে?”
ঠিক কথা, বাক্স বিছানা গোছানো শেষ। একমাসের জন্য পাহাড়ি জায়গায় যাওয়া। পল্টুর দিদা রোজই ফোন করছেন। বলছেন, “বৌমা, এখানে পাহাড়ের তুলনায় গরম, কিন্তু তোমরা তো শুনছি ফার্নেস থেকে আসছ। সুতরাং পল্টুসোনার জন্য মনে করে সোয়েটার, মাফলার, উলের টুপি, দস্তানা আর গরম মোজা এনো। তোমাদের জন্য চিন্তা নেই। আমার আর বাবার অনেক গরম কাপড় আছে। দরকার হলে নিতে পারবে…”
এদিকে বাবা গুগ্ল্ খুলে বলছে, “আরে দিনে বাইশ থেকে পঁচিশ ডিগ্রি বলছে। অত গরম জামা লাগবে না। সূর্য ডুবলে একটু ঠাণ্ডা হবে, তাই একটা সোয়েটার নাও… আর রাতে তো লেপ কম্বল থাকবেই… বেশি ওজন হলে এক্সেস ব্যাগেজ দিতে হবে।” আর মা বলছে, “থামো তো! একটা দুটো না, তিন-তিনটে টিকিট… এক্সেস ব্যাগেজ হবে!… হুঁঃ! আর বৃষ্টি হয়ে যদি হঠাৎ ঠাণ্ডা হয়ে যায়? তখন কে দেখবে?”
উত্তেজনায় আর গরমে পল্টুর ঘুমই হচ্ছে না। শেষে এল সেই দিন। সকালবেলায় বাবা ফোন থেকে উবার ট্যাক্সি ডেকে আনল, দুটো সুটকেস আর তিনটে ব্যাগ তাতে ভরে ওরা রওয়ানা দিল এয়ারপোর্ট।
দিদা যতই ভয় পাক, পাহাড়ে অত ঠাণ্ডা না। অবশ্য, বাবা বলল, এটা তেমন পাহাড়ি জায়গাও না। শীতে বরফ পরে বটে, তবে বরফে রাস্তাঘাট বন্ধ হয়ে যায় না। তবু দিদার ভয় যায় না। খালি, “দাদুভাই, সোয়েটার পরো, মাফলার পরো…” বলেই চলেছে। শেষে পল্টু কাছে এসে বলল, “দিদা, দেখো, ঘামছি। শেষে ঘাম বসে সর্দি লাগবে।” তখন আবার শুরু করল, “ওরে দাদুভাই, রোদে বেরিয়ো না, ঘাম বসে যাবে…”
দাদু বলল, “আহ্ অপর্ণা, ওকে অত পুতু পুতু কোরো না। এসেছে পাহাড়ে, একটু শরীরটা পাকিয়ে যাক। শহুরে ছেলে, দেখো, একদম মাস্ল্ নেই। এই ক’ দিনে আমি ওকে একেবারে চৌকস করে দেব… কী বলো দাদুভাই? চৌকস হবে তো?”
দাদুর হাবভাবে পল্টু মাঝে মাঝে একটু নার্ভাস লাগছে। তাছাড়া দাদুর চেহারাটাও নার্ভাস হবার মতো। বিরাট বুকের ছাতি, হাতের গুলিগুলো ইয়াব্বড়ো। আর নাকের নিচে গোঁফটা — বাপরে, সে একেবারে দুই গাল ছেয়ে বড়ো হয়েছে দু-দিকে। তাই চৌকস কথাটার মানে ঠিকমত না জানলেও ঘাড় নেড়ে বলল, “হ্যাঁ!”
দাদু খুশি হয়ে হেসে বলল, “ঠিক। দিদা তোমার খাওয়াদাওয়া দেখবে, আর আমি তোমার শরীরের দিকে নজর দেব। কাল থেকে সকালে আমার সঙ্গে মর্নিং ওয়াকে যাবে। ফিরে এসে বাগান করবে। আর তারপরে ব্রেকফাস্টের আগে, এক চক্কর সাইকেল… সাইকেল চালাতে পারো?”
না। ভয়ে ভয়ে মাথা নাড়ল পল্টু।
“পারো না। সে-কী! কুছ পরোয়া নেহি। সাইকেল চালানো খুব সোজা। শিখে যাবে। তারপরে ব্রেকফাস্ট — সকালের পড়াশোনা শেষ করে, চান করে, খেয়ে, বিকেলে আবার আমরা জগিং করতে যাব। এখানকার জিমনেশিয়ামে নিয়ে যাব তোমাকে — আমার তৈরি করা জিম। দেখবে কতরকম এক্সারসাইজ করার ব্যবস্থা। তারপরে ফিরে এসে পড়াশোনা করে, খেয়েদেয়ে আবার ঘুম। দেখবে কেমন ক’ দিনে চেহারাই পালটে যাবে… হা হা হা হা হা।”
মনে মনে পল্টুর চোখ ছানাবড়া! এত রুটিন? তাহলে স্কুল ছুটি হয়ে লাভ কী হলো? ভেবেছিল দাদু দিদার বাড়ি এসে একটু গল্পের বই পড়বে, একটু পাহাড়ে বেড়াবে, ঝরনার পাশে মা, বাবার, দাদু, দিদার সঙ্গে পিকনিক যাবে…
বাবা বলল, “মর্নিং ওয়াক! ওরে বাবা! পল্টু, তুই মর্নিং ওয়াক যাবি? তুই তো মর্নিং কাকে বলে জানিসই না।”
দাদু ভুরু কুঁচকে বলল, “কেন? জানে না কেন? তুই ওকে ঘুম থেকে ভোরে ওঠা অভ্যেস করাসনি?”
বাবা আমতা আমতা করতে থাকল, মা বলল, “ও কী অভ্যেস করাবে? ও তো অফিস থেকে ফেরেই রাত করে, তারপরে নিজেই শুতে শুতে রাত সাড়ে বারোটা একটা। তবে পল্টুর স্কুল তো মর্নিং। বাস আসে সাড়ে ছটায়। তাই ওকে পৌনে ছটায় রোজ উঠতেই হয়…”
কপাল ভালো, আলোচনাটা ঘুরে গেল বাবা কেন দেরি করে শোয়, দেরি করে ওঠে, সেদিকে। সেই ফাঁকে পল্টু চট করে পালাল বাগানে। ওখানে মালী কাজ করছে। ওর সঙ্গে কিছুক্ষণ গল্প করতে না করতেই দিদা ডাকল, “দাদুভাই এসো। পকোড়া খেয়ে যাও…”
দিদা প্রথমে পল্টু আর মা-বাবার থাকার ব্যবস্থা একটাই ঘরে করেছিল। কিন্তু যখন জানতে পারল যে বাড়িতে পল্টু একাই শোয়, তখন খুশি হয়ে আর একটা ছোটো ঘর খুলে দিয়ে বলল, “এটা তোমার ঘর এই ক’দিনের জন্য।”
ঘরটা ছোট্ট। একটা ছোটো খাট, আর একটা আলমারি। দিদা কাজের লোককে দিয়ে একটা টেবিল আর ছোটো চেয়ার দিয়ে গেল, যাতে পল্টু বসে পড়তে পারে। দিদা আর মা স্যুটকেস থেকে পল্টুর সব জামা কাপড় নিয়ে এল আলমারিতে রাখতে। পল্টু ওর বইগুলো বের করে টেবিলে রাখল। দিদা হেসে বাঁচে না! তিনটে পড়ার খাতা, আর ছটা গল্পের বই? পড়ার বই একটাও নেই?
পল্টু বলল, “এগুলো প্রোজেক্ট। এর জন্য বই লাগবে না, দিদা। বাবার মোবাইলেই সব পাব।”
দিদা অবাক হয়ে বলল, “প্রোজেক্ট? সে আবার কী?”
পল্টুর মা বলল, “আগে আমরা যেটা হলিডে হোম-ওয়ার্ক বলতাম, সেটাকেই আজকাল স্কুলে প্রোজেক্ট ওয়ার্ক বলছে…”
মা’র কথা শেষ হবার আগেই দিদা রেগে বলল, “প্রোজেক্ট ছিল ছাত্ররা একসঙ্গে কাজ করতে শেখার উপায়। আজকাল স্কুলে সব ভুলভাল শেখায়… টিচাররা নিজেদের কাজ কমানোর জন্য…” তারপরে মনে হল পল্টুর সামনে এসব কথা বলা উচিত না। থমকে গিয়ে বলল, “বেশ দাদুভাই। তুমি পড়ো। আমি দুপুরের খাবার ব্যবস্থা দেখি-গে…”
দুপুরে খাবার পরে দাদু-দিদা গেল বিশ্রাম করতে। মা বাবাও চুপচাপ শুয়ে পড়ল। পল্টু কিছুক্ষণ বাড়ির ভেতর ঘুরঘুর করে দেখল ওর ঘরের একটা দরজা দিয়ে বাগানে যাওয়া যায়। বাইরে গিয়ে দেখল কাজের লোক আর মালী বাগানে বসে কথা বলছে। মালী ওর পুঁটলি খুলে খাবার বের করে খাচ্ছে। পল্টুকে দেখে দুজনে ডাকল। “খোখাবাবু, ইধার আও…”
পল্টু হিন্দি ভালোই জানে। ওর ক্লাসে অনেক হিন্দি-বলা ছেলে মেয়ে আছে। অনেকে বাঙালি হয়েও হিন্দি পড়ে। কিন্তু দাদুর কাজের লোক আর মালীর হিন্দি ওদের মতো না। সব কথা বোঝা যায় না। পল্টু বার বার “কেয়া? কেয়া?” করতে লাগল, আর ওর হিন্দি শুনে মালী হেসে বাঁচে না। ফোকলা দাঁতে গড়াগড়ি দিয়ে হাসে।
হাসিতে গল্পে কখন বিকেল হয়েছে পল্টু খেয়াল করেনি। হঠাৎ দাদুর গলা পেল, “দাদুভাই, তুমি কোথায়? আমাদের জগিঙের সময় হয়েছে। চলো, বেরিয়ে পড়ি।”
দাদু বাড়ি থেকে বারান্দায় বেরোবার আগেই পল্টু ছুট্টে ঘরে ফিরে গিয়ে জুতো পরে নিয়েছে। দাদু যতক্ষণে ওর ঘরের দরজায় এসে দাঁড়িয়েছে, ততক্ষণে পল্টু রেডি। দাদু খুশি হয়ে বলল, “চলো, জগিং করতে যাই…”
দুজনে বেরিয়ে পড়ল। দাদু বুড়ো মানুষ, পল্টুর চেয়ে আস্তেই দৌড়য়। বলল, “তুমি দৌড়ে আমার চেয়ে এগিয়ে যাও, কিন্তু বেশি এগিয়ো না।”
দুজনে চলল দৌড়ে।
সন্ধেবেলা অসুবিধে না হলেও, পরদিন সক্কালে দাদুর ডাকাডাকিতে আর ঘুম ভাঙে না পল্টুর। কোনও রকমে উঠে চোখেমুখে জল দিয়ে মর্নিং ওয়াক করতে বেরোল। তখনও সূর্য ওঠেনি। চারিদিকে কুয়াশা। দাদুর উৎসাহ ভোরে আর পল্টুকে চাঙা করতে পারল না। যতক্ষণে দুজনে হেঁটে ফিরেছে, ততক্ষণে মা-বাবা-দিদা ঘুম ভেঙে বারান্দায় বসে চা খাচ্ছে। দাদু গিয়ে বসল চা খেতে — পল্টু ঘরে গিয়ে জুতো মোজা খোলার আগেই ঘুমিয়ে কাদা।
দাদু ছাড়ার পাত্র না। বলল, “ওতে কিচ্ছু হবে না। দু-দিনে অভ্যেস হয়ে যাবে। চিন্তা নেই। দাদুভাই, এখান থেকে যাবার আগে তুমি ভোরে ঘুম থেকে ওঠা, আর এক্সার্সাইজ করায় মাস্টার হয়ে যাবে।”
ওরে বাবারে!
রোজ সকালে টেনে টেনে তোলে দাদু, রোজ সকালে পল্টুর ঘুম ভাঙতে আরও দেরি হয়, রোজ যেন আরও অনিচ্ছুক শরীরটা টেনে টেনে হাঁটতে যায়, আর ফিরে এসেই আবার ঘুমিয়ে পড়ে।
দিদা বললেও শোনে না দাদু, বলে, “আরে, ভাবছ কেন? দেখবে, কেমন কদিনেই তাগড়া হয়ে যাবে তোমার নাতি!”
পল্টু ভেবে পায় না, কী করে রেহাই পাবে।
এক দিন গেল, দু’দিন গেল, তিন দিন… চার… পাঁচ দিনের দিন দুপুরে দিদা পল্টুকে ডাকল শোবার ঘরে। বলল, “দেখে যাও, তোমার বাবার ছোটোবেলার ছবি।”
খাটের ওপর বাবু হয়ে বসে পুরোনো দিনের অ্যালবাম খুলে দিদা দেখাল কাগজে ছাপা ছবি। মোবাইলের স্ক্রিনে না, ট্যাবে না, ল্যাপটপে না। বাবা যখন বাচ্চা, বাবা যখন হামা দিচ্ছে, বাবা স্কুলে যাচ্ছে, বাবা চিড়িয়াখানায়…
দিদা দেখাচ্ছে, আর পল্টু দেখছে দাদুর বালিশের পাশে একটা টেবিল, তাতে একটা ঘড়ি। এরকম ঘড়ি আগে দেখেছে পল্টু। মিঃ বিন-এর কার্টুনে। ভোর বেলায় মিঃ বিনের ঘরে ঘড়িটা তারস্বরে ঝনঝন করে বেজে ওঠে, আর মিঃ বিন চাপড় মেরে, কিংবা লাথি মেরে, অথবা লাঠি দিয়ে মেরে ঘড়িটা ভেঙে ফেলে।
জিজ্ঞেস করল, “দিদা, ওটা কি দাদুর ঘড়ি?”
দিদা বলল, “ওটা অ্যালার্ম ঘড়ি। ওটাই তো সকালে বাজে, আর দাদু ঘুম থেকে উঠে মর্নিং ওয়াকে যায়।”
পল্টু বলল, “রোজ বাজে? নিজে নিজে? মোবাইলের অ্যালার্মের মতো?”
দিদা বলল, “না। দম দিতে হয় রোজ। নইলে বাজে না। দাদু শোবার সময় অ্যালার্ম দিয়ে শোয়। নইলে ঘুম ভাঙে না। দাদু বলে মোবাইলের অ্যালার্ম নাকি শুনতেই পায় না।”
সে দিন রাতে পল্টু খেয়েদেয়ে ঘুমোতে গেল। খাটে শুয়ে বই পড়া অভ্যেস। একটু পরে দাদু বসার ঘরে সবাইকে “গুডনাইট” বলে শুতে গেল। তারপরে মা-বাবা আর দিদা। মা-বাবা ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করল। দিদা গেল খাবার ঘরের পেছনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে বাহাদুরকে বলতে কাল ব্রেকফাস্টে কী বানান’ হবে। রোজের মতো।
দশ মিনিট পরে যখন দিদা আবার ফিরে এসে শুতে যাবার আগে পল্টুর ঘরে উঁকি মেরে দেখল, পল্টু ঘুমিয়ে কাদা।
পরদিন সকালে দাদুর ঘড়ি তারস্বরে ক্রিইইইইইইইইইইইইইইইইং শব্দে দাদু-দিদার ঘুম ভাঙিয়ে দিয়েছে। দাদু উঠে অ্যালার্ম বন্ধ করে চুপি চুপি জুতো জামা পরে বেরিয়ে দেখে পল্টুর মা-বাবা বাইরের ঘরে বসে আছে। দাদুর পেছনে উঠে এসেছে দিদাও। পল্টুর মা-বাবাকে দেখে দুজনেই অবাক। “তোরা এত ভোরে উঠে গেছিস?”
বাবা বলল, “ভোর কোথায়? আমরা তো এরকম সকালেই উঠি। এর আগেই উঠি — বাহাদুর যখন চা করে আনে, মা টেবিলে আসে। কিন্তু তুমি আজ এর মধ্যেই মর্নিং ওয়াক করে ফিরে এলে? পল্টু যায়নি?”
দাদু বলল, “আরে আমি তো এখনই বেরোব। সবে তো ছটা বাজে!”
মা বলল, “কই, এখন তো সাতটা বাজছে। সাতটা পাঁচ!”
দাদু বলল, “আরে! তাই তো! বসার ঘরের ঘড়ি আর খাবার ঘরের ঘড়িতে সাতটা বেজে গেছে!”
দিদা বলল, “কাল তুমি ঠিক অ্যালার্ম দাওনি?”
দাদু বলল, “আরে অ্যালার্ম কি রোজ আলাদা সময়ে দিই? সাড়ে পাঁচটায় দেওয়া থাকে। রোজ আমি শুধু দম দিয়ে দিই।”
তাই তো!
দাদু ঘরে ফিরে গিয়ে অ্যালার্ম ক্লকটা হাতে করে নিয়ে এল। “কী আশ্চর্য! এতে যে এখন ছটা সাত মিনিট! ব্যাপারটা কী হল? সব ঘড়িতে সাতটা বেজে গেছে, আর আমার ঘড়িতে ছটা?”
সবাই উঠে গিয়ে দাদুর ঘড়ি দেখল। ঘড়িটা মোটেই খারাপ হয়ে যায়নি — থেমেও নেই। টিকটিক করে চলেই চলেছে! ওদিকে পাহাড়ের আড়াল থেকে সূর্য উঠে গেছে। কুয়াশা কমে আসছে। দাদুর মর্নিং ওয়াক যাওয়া হয়নি।
দাদু বসার ঘরের টেবিলের ওপরে ঘড়িটা রেখে বলল, “আমি মর্নিং ওয়াকটা সেরে এসে দেখছি কী হল। পল্টুর ঘুম ভেঙেছে? যাই, ওকে গিয়ে তুলি।”
আজ পল্টুর ঘুম ভাঙতে অত দেরি হল না। জুতো পরে বেরিয়ে এসে মা-বাবাকে বসার ঘরে বসে থাকতে দেখে থমকে গেল। তারপরে টেবিলের ওপরে দাদুর ঘড়িটা দেখে ওর মুখের যা ভাব হল, তা দেখে মা জিজ্ঞেস করল, “পল্টু, দাদুর ঘড়িটায় আজ সকাল সাতটায় কেন ছটা বাজে তুই জানিস?”
এর পরে আর কারও কিছু বুঝতে বাকি রইল না। সবার মুখের দিকে তাকিয়ে পল্টুর একবার মনে হয়েছিল, হল বুঝি এইবার। কিন্তু দিদা হেসে কুটিপাটি। বলল, “বেশ হয়েছে। যেমন ওইটুকু বাচ্চার সঙ্গে জবরদস্তি… বেশ করেছে ঘড়ি এক ঘণ্টা স্লো করে দিয়েছে।”
ছুটির বাকি ক’দিন দাদু আর পল্টুকে মর্নিং ওয়াকের জন্য ডাকেনি। তবে ফিরে এসে সঙ্গে নিয়ে বাগানে ঘোরা, আর বিকেলের জগিং আর জিম অবশ্য থামেনি।