দুটো পরীক্ষার পরেই লকডাউন। অঙ্ক আর কেমিষ্ট্রি পরীক্ষা আর হলই না। অথচ ও দুটো তার পড়া ছিল ভালো। মণিদিদি আর কুলসুম দিদি দুজনেই খুব আশা করেছিল যে তহমিনা তাদের সাবজেক্টে ভালো নম্বর পাবে।
যা হল না তা নিয়ে ভেবে আর কি হবে! দিনের পর দিন ঘরে বন্দী। পরে হবে এই আশায় আশায় থেকেও বাকি পরীক্ষা আর হলই না। মহামারী করোনা তার স্বপ্নকে মাটিতে মিশিয়ে দিল। এবার নাকি রেজাল্ট বেরোবে- হায়ার সেকেন্ডারির। পরীক্ষাই হল না। কিসের রেজাল্ট কে জানে!
মাধ্যমিকে ষ্টার পাওয়ার পরে তহমিনা ভেবেছিল ভালো রেজাল্ট করলে দাদা হয়তো আরো পড়াবে। হায়ার সেকেন্ডারির পরে কলেজ। বিএসসি। তারপর আল্লাহ করুণা করলে বিএড। সবশেষে দাদীর মত স্কুলে চাকরি। দাদীর আঁকা ছবিটার দিকে তাকিয়ে স্বপ্ন দেখতে থাকে বাপ মরা মেয়ে তহমিনা। দাদীর আদরের তহমিনা।
ছবিটা একটা গাছের সবুজ পাতার উপরে একটা সুন্দর রঙীন পোকা-র। দাদী-র হাতে আঁকা। ওর দাদী আরেফিন নাহার ছিলেন কৃষ্ণপুর হাইস্কুলের হেডমিষ্ট্রেস। স্কুলটা এক সাধারণ গ্রামের স্কুল থেকে ক’বছরে অসাধারণ স্তরে উন্নীত হয় ওর দাদীর গুণে। আরো অনেক গুণ ছিল দাদীর। খুব ভালো ছবি আঁকতেন তিনি। সেলাই করতেন অসাধারণ। দাদীর মত ছবি আঁকতে চেষ্টা করেছিল তহমিনা। হয় নি। সবকিছু তো হয় না স্বপ্নের মত। তবে লেখাপড়ায় সে ভাইবোনদের মধ্যে সবচেয়ে ভাল। আর তাই দাদীর সবচেয়ে বেশী প্রিয় ছিল সে। দাদী তার আঁকা অনেকগুলো ছবি আর গয়নার বাক্স উপহার দিয়েছিলেন তাকে। তার মধ্যে এই কাঁচপোকার ছবিটা বের করে মাঝে মাঝেই তন্ময় হয়ে দেখে সে।
‘এটা তো খুব সুন্দর! কাঁচ পোকা কোথায় পাওয়া যায়, দাদী?’
‘আগে খুব দেখা যেত রে। এখনো মাঝে মাঝে উড়ে বেড়ায়। আমাদের সময় মেয়েরা কাঁচপোকা রঙীন টিপ বানিয়ে পরত। আমারো ছিল কয়েকটা।’
‘আমায় একটা দেবে?’
‘দেবো।’
তারপর রিটায়ারমেন্টের কিছুদিন পরে একদিন হঠাৎ স্ট্রোক হল দাদীর। দুবছর বিছানায় পড়ে থাকার পরে অবশেষে এন্তেকাল হল তাঁর। সেই থেকে তহমিনার জেদ চেপে গেল, দাদীর মত কলেজে পড়তে হবে তাকেও। মাধ্যমিক, তারপর উচ্চমাধ্যমিক। এদিকে দাদার একার আয়ে সংসার। মা তলায় তলায় তার বিয়ে ঠিক করছে। বিয়ে থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার একটাই রাস্তা। উচ্চমাধ্যমিকে ভালো রেজাল্ট। দাদা আসফাক কথা দিয়েছে ৯০% পেলে আরো পড়াবে।
সেদিন সকাল থেকে বন্ধুদের ফোন, ‘আজ রেজাল্ট বেরোবে’। দশটা বাজতেই কম্পিউটারের দোকানের সামনে লম্বা লাইন। সে লাইন পেরিয়ে হাতে পেল স্বপ্নের রেজাল্ট, ৯৫%। বিয়েটা আপাততঃ আটকানো গেল তাহলে! বড়ি ফিরেই দাদীর গয়নার বাক্স হাতড়াতে লাগল তহমিনা।
বেথুন কলেজে আজ প্রথম দিন। অনেক নামকরা কলেজ। কেমিষ্ট্রি অনার্সে ভর্তি হয়েছে সে। দাদা আসফাক তাকে নিয়ে কলকাতা চলল। খুশীতে উচ্ছল তহমিনার পরনে সাদা এম্ব্রয়ডারি করা সালোয়ার কামিজ। কপালে রঙীন কাঁচ পোকার টিপ।
দাদী আরেফিন যেন কাঁচপোকার টিপ হয়ে তার সাথে সাথে চলেছে কলকাতা।