এক যে আছেন হাতুড়ে– এক মাথা পাকা টাক আর এক মুখ পাকা দাড়ি। এবং তাঁর আছে কিছু এলোমেলো চিন্তা। সেদিন ফাঁকা চেম্বারে বসে ভাবছিলেন তাঁর শেষ রোগীটির কথা। পাঁচ পাঁচটা হাঁ করা মুখ– একজন মাত্র রোজগেরে মানুষ– পাঁচ হাজার টাকা মাসিক উপার্জন। ওষুদ কনে কিনবো? তাহলে এই চিকিৎসার দাম কি আছে? না হোলো ওনার কিছু টাকা পয়সা– না সারলো রোগী– হাতুড়েবাবু আমি বড়ো গরীব– এই নোটটা রাখো– বলুন নেওয়া যায় ঐ পঞ্চাশটা টাকা? হাতুড়েবাবু এর মদ্যি কোন ওষুদটা কিনবো? রয়েছে হার্টের রোগ ডায়াবেটিস প্রেসার– কোন ওষুদটা কিনবো?
হাতুড়েবাবু এর উত্তর জানেন না। আপনি জানেন? যদি খেতেই না পায় ওষুধ গিলে বাঁচবে নাকি? অথচ কতো কতো সমাজসেবী মাইক ফুঁকছে ….
আমাদের দেশের সব রাজনৈতিক নেতাই মধ্যচিত্ত উপনিবেশীয় কেরাণী মনোবৃত্তির। কেউ হয়তো বলেন আমি সর্বহারার– তিনিও ঔপনিবেশিক মতবাদ থেকে জাত এক বিশুদ্ধ পাতিবুর্জোয়া বুদ্ধিজীবী। সবাই ভুলে যায় দেশটা ভাষাহীন সর্বহারা কৃষকের। সামাজিক মাধ্যমে বা সংবাদে উপেক্ষিত এক বিশাল জনগোষ্ঠীর। সবাই মুখপাত্র হয়ে ওঠে মধ্যবিত্ত পাতিবুর্জোয়া গোষ্ঠীর। সুতরাং পাতিবুর্জোয়া কিম্বা ধনতান্ত্রিক কিম্বা ধর্মতান্ত্রিক বা একদা সমাজতান্ত্রিক বংশগত নেতা – সবাই ডেকে আনবেন পুঁজিপতিদের – টাটা বিড়লা ফোর্ড রকফেলার গোষ্ঠীকে – তাদের হাতে তুলে দেবেন শস্যশ্যামল উর্বর জমি আর তৈরি করবেন সব অস্থায়ী চাকর।
স্বাবলম্বী কৃষকের উন্নতি না হয়ে সে হবে বাড়ির ঝি চাকর– অথবা চা বিক্রেতা। আপনি স্যর, ধান গম সবজি কি ঐ কারখানার মধ্যে তৈরি করবেন? চমৎকার! অথচ পড়ে আছে বিস্তীর্ণ অনুর্বর ঢেউ খেলানো লাল মাটি ল্যাটেরাইট মৃত্তিকার দেশ। সেখানে চাষ নেই- বন্ধ্যা জমি– পড়ে আছে বহু আদিবাসী কুর্মী ওঁরাও ভীল জনগোষ্ঠী।
ওরা আমার দেশের আদি নিপীড়িত মানবগোষ্ঠী। সদ্যমৃত (করোনাশহীদ ডাক্তার যাদব চট্টোপাধ্যায়) যাদবদার একটা কবিতা পড়েছিলাম– তার মর্মবাণীটি হলো– এক শহুরে মানুষ লাল মাটির দেশ দেখতে গ্যাছে। গাড়ি থামিয়ে চা খেতে খেতে এক আদিবাসীর সঙ্গে আলাপ। শহরবাসী ঐ আদিবাসী মানুষটাকে একটা সিগারেট দিলো। সাঁওতালটি সিগারেটের দাম শুনে বলছে “পঁনরো ট্যাঁকা – হেই গ্যঁ – উয়াতে আমাদের একদিনের খাওয়া হয়েঁ যাব্যে গ্য”। হয়তো অপ্রাসঙ্গিক হয়তো স্মৃতি থেকে লেখা , ঠিক ঠাক যাদবদার মতো হয়নি । তবু আমি কবিতাটায় ধাক্কা খেয়েছি ।
আমাদের নির্বাচিত সরকার ব্যবসা করতে আসেনি। তাই সব সরকারি সম্পদ বহুজাতিকের হাতে তুলে দিচ্ছে নয়তো মাইনে দিয়ে সরকারি চাকর পুষে সব ব্যবসা লাটে তুলে অবশেষে সেই বিক্রিই করে দিচ্ছে। কেন না স্থায়ী চাকরের চিন্তা মাহিনাটুকুই। লভ্যাংশের ভাগ তার নেই। লাভ না হলে আমার কী? ‘আসি যাই মাইনে পাই’ প্রবচনটির উৎপত্তি এখান থেকেই। সুতরাং মেক ইন ইন্ডিয়া যুগ এসে গেছে– বিদেশীরা এদেশেই ভোগসামগ্রী (যথা গাড়ি, টিভি ইত্যাদি) কারখানা খুলে (পড়ুন উপহার পেয়ে) পেটচুক্তির চাকর তৈরি করছে এবং দেশে বিদেশে বিক্রি করছে।
এই মেক ইন ইন্ডিয়ার টাকা বিশেষ বিশেষ কয়েকজনের ব্যাঙ্কে জমা হচ্ছে (সম্ভবতঃ ব্যাঙ্কগুলোও তাদেরই ব্যক্তিগত হবে) মেক ইন ইন্ডিয়া হয়তো বা হচ্ছে কিন্তু দেশের মানুষ স্বাবলম্বী হচ্ছে না– থাকছে সেই একই অবস্থায়।
অত্যাবশ্যকীয় পণ্য বলে আর কিন্তু কিছু নেই। চাল ডাল সবজি আলু পেঁয়াজ কমলালেবু কলা আপেল – সবই কিনবে বহুজাতিক সংস্থা – বিক্রি করবে নিজেদের নীতি এবং প্রয়োজন অনুযায়ী – লাভের হিসেব কড়ায় গন্ডায় বুঝে। অথচ নিত্য প্রয়োজনীয় বহু জিনিস আসছে বিদেশ থেকে – অনেক অনেক ওষুধের কাঁচামাল, অনেক যন্ত্রাংশ। সরকারের দায়িত্ব কি শুধু যুদ্ধ করা?
ভয়ানক ভয়ানক সব মারণাস্ত্র আসছে বিদেশ থেকে অথচ আমাদের দেশে কি বৈজ্ঞানিক কম পড়িয়াছে? নাকি কাঁচামাল আর শ্রমিকের সংখ্যা কমে গেছে? চমৎকার সব কান্ড! আমাদের হাতুড়েবাবু কি সাধে ভদ্রলোকের মতো ঘরে লুকিয়ে বিলাইতি না পীয়ে বাংলুর দোকানে পড়ে থাকেন?
বন্ধ হোক অনুদান নামের ভিক্ষা– বন্ধ হোক ভিআইপি প্রতিরক্ষা আর মাসিক সুযোগ সুবিধা– তৈরি হোক অনূর্বর প্রান্তরে রাস্তা এবং আনুষঙ্গিক ব্যবস্থা। সরকারের এক চতুর্থাংশ লাভের ভিত্তিতে তৈরি হোক ক্ষুদ্র শিল্প। সাইকেলের যন্ত্রাংশ এবং অ্যাসেম্বল করার কারখানা। লেদ মেশিনে তৈরি হোক ছোট ছোট লোহার নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস আর খেলনা পুতুল আলোকসামগ্রী বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি– বাল্ব ইত্যাদি। হ্যাঁ হে ভোগবাদী সমাজ বিদেশী জিনিস আপনাকে অনেক বেশী ট্যাক্স দিয়ে কিনতে হবে। সুতরাং কৃষি হোক সমবায় ভিত্তিক।
বাজার মূল্যের থেকে কিছু কমে কিনে সরকার সেটা খোলা ও পাইকারি বাজারে বিক্রি করবে। বাজারের দামও নির্দিষ্ট থাকবে। সরকার *ব্যবসা* *করবে*। সেই টাকায় তৈরি হবে প্রতিটি গ্রামে ইশকুল – প্রতিটি গ্রামে যথেষ্ট সুবিধেযুক্ত হাসপাতাল (শুধুমাত্র একজন ডাক্তার– একটা বাড়ি আর কয়েক শত রোগীর ভিড় নয়। চিকিৎসাহীন পরিকাঠামো নিয়ে কেবলমাত্র বড়ো কর্পোরেট হাসপাতালে অ্যাম্বুলেন্স পাঠানো নয়। হাসপাতাল হবে এমন– যেখানে একজন নবীন চিকিৎসক চিকিৎসা করতে পারবে।
আর নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি? সেটিও একটা *পেশা* হয়ে উঠবে। একটা জবাবদিহিযোগ্য চাকরি। অবশ্যই তারও পাঠ্যক্রম থাকবে। আর সাধারণ পাঠ্যক্রম ঔপনিবেশিক হবে না- অর্থাৎ কেরাণী প্রজননেকেন্দ্র বা চাকর উৎপাদনের জায়গা হয়ে উঠবে না। পাঠ্যক্রম হবে কিছু মূল বিষয় আর উঁচু ক্লাস থেকে থাকবে কৃষি খেলা নাটক গান প্রভৃতির ঐচ্ছিক শিক্ষাক্রম।
(ক্ষমা করবেন এ শুধু অলস মায়ায় তৈরি এলোমেলো স্বপ্নগুলি)
অনবদ্য।