করোনার কল্যাণে প্রায় ডা. বিধান রায় হয়ে গেছিলাম। শুধু জ্বরের রোগী, খুক খুকে কাশি। কাশির আওয়াজ শুনেই রোগ ধরে ফেলতাম। “আর টি পি সি আর” রিপোর্টের জন্য অপেক্ষা করতে হতো না। সেসময় সুগার, প্রেশার, গ্যাসীয় সমস্যার অন্যান্য রোগীরা খুব বিপদে না পড়লে খুপরি মুখো হতেন না। রোগী বেশ কম হতো। রাতে হাবিজাবি অপাঠ্য লেখার সময় পেতাম। করোনার প্রথম ঢেউয়ের সময়কার সেসব লেখা নিয়ে গুরুচণ্ডালী রীতিমতো একটা বই করে ফেলেছে- তবে আমার ধারণা সেই বই কেউ কিনে পড়ে না। গুরুচণ্ডালীর পুরোটাই লস।
দ্বিতীয় ঢেউ একটু কমতেই পরিস্থিতি বেশ ঘোরালো হয়েছে। জ্বরের রোগীর ভ্যারাইটি দেখে অবাক হয়ে যাচ্ছি। রোজ দু’চারটে করে করোনা তো বেরোচ্ছেই, তার সাথে ম্যালেরিয়ার কেস পাচ্ছি প্রচুর। একটা অদ্ভুত ব্যাপার যারা মধ্যমগ্রাম থেকে কলকাতার বউবাজার, বড়বাজার, বেলেঘাটা, মেটিয়াবুরুজ এই সব জায়গায় কাজ করতে যান, তাঁদেরই ম্যালেরিয়া হচ্ছে। যাঁরা একেবারেই কলকাতা যান না, তাঁদের মধ্যে ম্যালেরিয়া কেস শূন্য। অথচ মধ্যমগ্রামে মশা নেই এমন অপবাদ কেউ দেবে না। সন্ধ্যে হতেই লাখে লাখে অ্যানোফিলিস কন্যেরা সেজে-গুজে অভিসারে বেরিয়ে পড়ে।
তার সাথে ডেঙ্গুও পাচ্ছি রোজ গোটা তিন। ভাইরাল হেপাটাইটিস, টাইফয়েড, ইউরিনারি ট্রাক ইনফেকশন এনারাও নিজেদের অস্তিত্ব প্রমাণ করতে মরিয়া হয়ে উঠেছেন। এমনকি শেষ মাসে নয় নয় করে গোটা পাঁচেক রোগীর যক্ষ্মাও ধরা পড়ল।
মোদ্দা কথা হল ডাক্তারি করাটা দিনকে দিন জটিল হয়ে উঠেছে। আমার রোগীরা অধিকাংশই পায়ে হেঁটে ডাক্তার দেখাতে আসেন, পকেটের একটা মাত্র নোটকে সম্বল করে। ওর মধ্যেই ডাক্তারের ফি, ওষুধপত্র, পরীক্ষা নিরীক্ষা হয়ে যাবে এমন আশা করেন। ইচ্ছে মতো যে টেস্ট লিখে দেব, সে সুযোগও নেই। তাই রোগী দেখার সময় চোখ কান খোলা রাখতে হচ্ছে।
রবিবার বিকালে বাড়িতে রোগী দেখছিলাম। সঞ্জীবদা দরজার ফাঁক দিয়ে ঘাড় বাড়িয়ে বলল, ‘তাড়াতাড়ি দেখ। এখনও সাতজন রোগী রয়েছে। ছটা থেকে কিন্তু রোহাণ্ডায় ক্যাম্প আছে।’
বললাম, ‘ওষুধ পত্র রেডি করে রাখা রয়েছে। শেষ করেই চা খেয়েই বেরিয়ে যাব। তুমি বাকিদের বেরোতে বলো।’
শেষ করবো বললেই করা যায় না। এক বেচারার ম্যালিগন্যান্ট ম্যালেরিয়া ধরা পড়েছে। যে ওষুধ লিখেছিলাম কোথাও পাচ্ছে না। কোন দোকানদার আর ফ্যালসিফেরাম ম্যালেরিয়ার ওষুধ দোকানে রেখে পচাবে? বললাম, ‘পারলে বারাসত অথবা আর জি কর হাসপাতালের সামনে খোঁজ কর। অথবা কাল গ্রামীণ হাসপাতালে চলে যাও। সব সরকারি হাসপাতালেই এসিটি কিট বিনা পয়সায় পাওয়া যায়।’
তাড়াহুড়োয় চা খেতে গিয়ে জিভ পোড়ালাম। স্কুটার বের করে দেখি অন্যরাও হাজির। ডিউক, ছোটকু, বাপ্পাদা, সঞ্জীবদা। সঞ্জয়দাও যাবে আমাদের সাথে। চারটে স্কুটারে ছয়জন।
বাপ্পাদাকে বললাম, ‘আমার স্কুটারে ওঠো।’ কিছুতেই রাজি হলো না। বললাম, ‘দেখো, আমার বছরে সাধারণত একবারই স্কুটার এক্সিডেন্ট হয়। গত সপ্তাহেই মিলন পল্লীতে একটা টোটার সাথে জমকালো এক্সিডেন্ট করেছি। অতএব তুমি নির্ভয়ে উঠে পরো।’ বাপ্পাদা তেমন ভরসা পেল বলে মনে হয় না। সঞ্জয়দার স্কুটারে উঠল।
সঞ্জীবদা বারবার খোঁজ নিচ্ছিল, যেখানটায় যাব, কতো কিলোমিটার? সঞ্জীবদা কিলোমিটার হিসেব করে কোথাও যাওয়ার আগে স্কুটারে তেল ভরে। এবং সেই কিলোমিটারের হিসেব ঘেঁটে গিয়ে নিয়মিত বিপদে পরে।
রোহাণ্ডায় আরবিসি ইটভাটায় যখন পৌঁছালাম, সন্ধ্যা হবো হবো করছে। তিনটে বাইকে পাঁচজন চলে এসেছি, সঞ্জীবদার পাত্তা নেই। ছোটকু বলল, ‘মনে হচ্ছে রাস্তার কোথাও তেল শেষ হয়ে গেছে।’
বললাম, ‘যাওয়া আসা হিসেব করে তেল ভরেছে। শেষ হলে ফেরার পথে হবে। আসার সময় কিছুতেই শেষ হতে পারে না।’
মধ্যমগ্রাম আমার তোমার সংগঠনের অনেকেই এসেছেন। ওনারা ইটভাটার মায়েদের ও শিশুদের জন্য খাদ্যদ্রব্য নিয়ে এসেছেন। সুরজিৎদাকে চিনি। তিনি বললেন, ‘অফিস ঘর রেডি করাই আছে। ওখানেই দিব্যি রোগী দেখা যাবে।’
রোগী তো সারাদিনই দেখি। আগে একটু এদিক ওদিক ঘুরে দেখি। এ মধ্যমগ্রামের মধ্যেই আছে আরেকটা মধ্যমগ্রাম। চারিদিকে ধুধু মাঠ, আর মাটির ছোটো ছোটো টিলা। সূর্য ঢুলছে সে টিলার পেছনে। আমার মতো অকাট পাবলিকের জন্যও আকাশে রঙের খেলার কোনও খামতি নেই।
অবশেষে সঞ্জীবদা হাজির হলো। রাস্তা ভুল করে অন্যদিকে চলে গেছিল প্রায় দেড় কিলোমিটার। গম্ভীর মুখে বিড়বিড় করে দূরত্ব আর তেলের হিসেব করছে। জটিল হিসাব। ইদানীং ভাজক ভাজ্যের থেকে বড় হয়ে গিয়ে হিসেব জটিলতর করেছে। হিসেবে গণ্ডগোল হলে সঞ্জীবদাকে আর বাড়ি ফিরতে হবে না। বাঁশপুলের বাঁশগাছের জঙ্গলে স্কুটার নিয়ে রাত কাটাতে হবে।
ধীরেসুস্থে অপূর্ব চা খেয়ে স্বাস্থ্য শিবির শুরু করলাম। অবাক হয়ে দেখলাম এখানকার ইটভাটার অধিকাংশ মহিলা শ্রমিকই বাংলা বলতে পারেন না, এমনকি বুঝতেও পারেন না। অথচ এখানে এনারা বছরের পর বছর কাজ করছেন। এনারা কি ইটভাটার চৌহুদ্দির বাইরে যান না? এনাদের সন্তানেরাও কি কোনদিনও স্কুলে যায় নি?
বাচ্চাগুলোর কেমন খড়ি ওঠা, খড়ি ওঠা চেহারা। পেট চেপে দেখতে গেলেই ভ্যাঁক করে কেঁদে ওঠে। আমি বড়োদের ডাক্তার। বাচ্চা দেখার অভ্যাস নেই। মনে হয় একটু জোড়েই চাপ দিয়ে ফেলছিলাম।
বাচ্চাদের নাম প্রিন্স, রাজা, নবাব, শাহাজাদী, রানী, মুন্না এই ধরণের। কারোরই পদবী বা বয়স বলতে পারছেন না তাদের মা। নাম শুনে জাত, ধর্ম বোঝা অসম্ভব। অনেক ধরণের রোগী এ জীবনে দেখেছি; কেউ মাথা টনটন করলেই কলকাতার শ্রেষ্ঠ নিউরোলজিস্টের কাছে দৌড়ান, কারও কারও আবার প্রানঘাতি রোগে ভগবান- আল্লাহ-ই ভরসা। মুশকিল হলো এই লকডাউনের বাজারে ঐ না দেখা ব্যক্তির উপর এতো বেশি চাপ পড়েছে, যে ভদ্রলোক আর পেরে উঠছেন না।
ওদিকে খাদ্য বিতরণও চলছে মহিলা এবং শিশুদের জন্য। পুরুষেরা দূর থেকে জুল জুল করে দেখছেন। পুরুষ জাতির প্রতিনিধি হিসেবে এমন বঞ্চনা দেখতে বেশ খারাপই লাগল। ওখানকার একজনকে বললাম, ‘ছেলেদের কেউ অসুস্থ থাকলে শেষে দেখিয়ে যেতে বলবেন।’
ঘণ্টা দেড়েক কেটেছে, হঠাৎ বাইরে গণ্ডগোল। আমি গণ্ডগোলের মধ্যেই রোগী দেখে অভ্যস্ত। বরঞ্চ বেশ খানিকক্ষণ গণ্ডগোল না হলে রোগী দেখতে দেখতে ঘুম পায়। এতক্ষণে জমজমাট মেডিকেল ক্যাম্প চলছে বলে মনে হচ্ছে। একজন দরকচা চেহারার শ্রমিক ঘরে ঢুকে দেহাতী হিন্দিতে যা বললেন, তার সারমর্ম, ‘এ কেমন অন্যায় চলছে। সকলের বাচ্চারা ডাক্তার দেখাল, আর আমার বাচ্চারা দেখাতে পারবে না।’ মানুষটির কোলে একটি ছোট্ট শিশু। আর জামা ধরে দাঁড়িয়ে রয়েছে একটি ছোটো ছেলে আর একটি মেয়ে।
বললাম, ‘বাচ্চাদের মা কই?’
মানুষটি হাসলেন, ‘আমিই ওদের মা ডাক্তারসাব।’
ইটভাটার একজন মুরুব্বী অনেকক্ষণ ধরে আমাকে সাহায্য করছিলেন। তিনি বললেন, ‘ইনসানের বউ গত মাসে মরে গেছে হুজুর। হঠাৎ করেই মরে গেছে। ওর বড় ছেলেটির আবার বোধ বুদ্ধি কম। কথা বলতে পারে না।’
ইনসান বললেন, ‘ছোটোটার জ্বর। একটু দাওয়া দিন।’
বাচ্চাটার বুকে স্টেথো বসালাম। ভেতরে সাঁই সাঁই স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে। খুপরিতে এমন রোগী আনলে দিব্যি বলে দিতাম, ‘আমি বাচ্চাদের কিছু বুঝি না বাপু। বাচ্চাদের ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাও বা হাসপাতালে যাও।’ কিন্তু ডাক্তার যখন একজন রোগীকে তার সামাজিক পরিবেশের মধ্যে দেখে তখন পরিস্থিতি অনেক পাল্টে যায়। তাই ঘড়ি ধরে বাচ্চাটির নিঃশ্বাস প্রশ্বাসের গতি মাপতে শুরু করলাম।
ডিউক অ্যামক্সিক্লাভ সিরাপ খুঁজে চলেছে। আমি জানি পেয়েও যাবে। অ্যাস্থালিন সিরাপও আছে। অন্যান্য প্রয়োজনীয় ট্যাবলেটও আছে। গুঁড়ো করে খাওয়ানো যেতে পারে। একবার নেবুলাইজেশন দিতে পারলে হতো। কী আর করা যাবে, যা নেই সেটা নিয়ে ভেবে লাভ নেই।
বাচ্চাটার ওষুধপত্র বুঝিয়ে দেওয়ার পরও ইনসান দাঁড়িয়ে থাকেন। বললাম, ‘কিছু বলবে?’
‘আজ্ঞে ডাক্তারসাব, আমাকে দাওয়াই দেবেন? আমার ঘুম হয় না। হাত পা কাঁপে।’
‘মদ খাও তুমি?’
ইনসান হাসেন। ‘খেতাম ডাক্তারসাব, রোজই খেতাম। তবে ওদের মা মরে যাওয়ার পর আর খাই না। বড়ো কষ্ট হয়, তবু খাই না। ওদের কথা ভেবে খাই না।’
ইনসান ছোট্ট বাচ্চাটির গালে চুমু খান। স্পষ্ট অনুভব করি পিতৃ হৃদয়ের আদিম ভালোবাসার, যে ভালোবাসার জোরে অ্যালকোহল উইথড্রয়াল সিন্ড্রোমের মারাত্মক কষ্ট একজন দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করে।
আমরা ক্ষণিকের অতিথি। একটু পরেই অন্ধকার ইটভাটা ছেড়ে চলে যাব আলো ঝলমল শহরে। গল্পের শেষটুকু চিরকাল অজানা থেকে যাবে।