গাড়িঘোড়া বন্ধ হয়ে যাওয়ার সাথে সাথেই রোগীর সংখ্যা এক ধাক্কায় অনেকটা কমে গিয়েছে। নিশ্চিতভাবেই দূরদূরান্তের অনেক রোগী ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন। আবার এটাও ঠিক, বহু লোকজন সারা বছর ধরে অনর্থক বেড আঁকড়ে বসে থাকেন। না, না… অবাক হওয়ার কিছু নেই। বেশ কিছু রোগীকে দেখলে সত্যিই মনে হয় সকালে কোলকাতা ঘুরতে এসে রাতে থাকার জায়গা না পেয়ে কিংবা হোটেলের বিল বড্ড বেশি হওয়ায় হাসপাতাল নামক বিনে পয়সার হোটেলে এসেছে! এমনও হয়েছে এক বাচ্চার ছুটি লিখে দেওয়ার পর মা এসে বলেছে-
– ডাক্তারবাবু, আর দিন দুয়েক রেখে দিলে হয় না?
– কেন? বাচ্চা তো একদম ঠিক হয়ে গেছে। দিব্যি হাসছে, খেলছে।
– না। আরেকটু ভালো ওষুধ-টষুধ খাইয়ে যদি বাড়ি পাঠাতেন ভালো হ’ত…
– আমরা কি খারাপ ওষুধ দিচ্ছি নাকি?
– না। সে কথা নয়। কিছু মনে করবেন নি ডাক্তারবাবু, সত্যি কথাটাই বলি- বাড়ি গেলে আবার সেই শাশুড়ির খ্যাঁচখেঁচানি শোনার চেয়ে এখানেই ভালো আছি। ওখানে গেলেই তো আবার ভাত রাঁধা, কাপড় কাচা…
আধা-লকডাউনের জন্য এসব ‘বিনোদনপূর্ণ কেস’ আসা প্রায় বন্ধ। তবে বাকি যারা আসছে তাদের বেশিরভাগেরই অবস্থা আশঙ্কাজনক। সকালে ওয়ার্ডে বসে আড়মোড়া ভাঙছি। এখনো ঘুম কাটেনি ভালোভাবে। চোখে পাতলা, সূক্ষ্ম চাদরের মতো জড়িয়ে আছে। আর এক কাপ চা খেলে ভালো হয় কিনা ভাবছি। জুনিয়রের ফোন- “দাদা, শিগগির দশে এসো। পয়জনিং কেস এসেছে!”
ব্যাস! ঘুম উড়ে গেল। বাড়ির লোকের কথা অনুযায়ী, দেড় বছরের বাচ্চাটা মেঝে পরিষ্কার করার অ্যাসিড খেয়ে ফেলেছে। একদম নেতিয়ে পড়েছে। প্রাণবায়ু কোনোমতে ধুকপুক করছে। চোখের মণি আলোতে সাড়া দিচ্ছে না। চার-পাঁচজন ডাক্তার আর তিনজন নার্স দৌড়োদৌড়ি শুরু করে দিলেন। চ্যানেলে খান চার-পাঁচেক ইঞ্জেকশন পরপর দিয়ে দেওয়া হ’ল। গলায় নল পরিয়ে হাওয়া পাম্প করতে করতে আইসিইউ-তে ঢোকানো হ’ল। “কী থেকে কী হয়ে গেল ডাক্তারবাবু… এই তো এক্ষুনি মেয়েটা আমার কেমন খেলছিল। কত কথা! বাঁচিয়ে দিন না ডাক্তারবাবু… এই একটাই তো বাচ্চা আমার…” বাচ্চার মা পাগলের মতো কাঁদতে শুরু করেছেন।
এসব কথায় অভ্যেস হয়ে গেছে বহুদিন। আজকাল এসব শুনলে মুখের একটা পেশীও নড়ে না। কথাগুলো বুকে এসে লাগে- ধক! কিন্তু ওই কয়েক মুহূর্তের জন্যই। আবার যন্ত্রচালিতের মতো কাজে লেগে যাই। যুদ্ধক্ষেত্রে আবেগের দাম কানাকড়ি।
মিনিট পনেরো বাদেই পরের পেশেন্ট। সেই ঝাড়খণ্ড থেকে আসছে। সিকল সেল অ্যানিমিয়া নামক রক্ত ভেঙে যাওয়ার জটিল রোগ। লোহিত রক্ত কণিকাগুলো কাস্তের মতো দেখতে হয়ে যায়। তারা ছোট ছোট রক্তবাহগুলোর রাস্তা বন্ধ করে দেয়। সেখান থেকেই যত বিপত্তি। বাচ্চা হাঁফাচ্ছে! চোখের পাতা ফ্যাটফেটে সাদা! কিছুক্ষণ বাদেই নেতিয়ে পড়লো। সাড়াশব্দ নেই। তাড়াতাড়ি আইসিইউ পাঠাতে হবে। এদিকে বাড়ির লোক নেই। মায়ের পরণে শতচ্ছিন্ন একটা শাড়ি। বাংলা, হিন্দি কোনোটাই ভালোভাবে বোঝে না। শুধু অলচিকি জানে। কোনওভাবে আকারে-ইঙ্গিতে কাজ চালাতে হচ্ছে। বাবা বাচ্চাকে পৌঁছে দিয়েই কোথায় উধাও! তার আর দেখা নেই। মাইকে ডেকে ডেকে পাওয়া গেল না। ওয়ার্ড মাস্টার আর পুলিশকে জানানো হ’ল। বাচ্চাকে রক্ত দিতে হবে এদিকে বাবাকে আর কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না। যে মোবাইল নম্বর দেওয়া আছে সেটা ভুল। মহা বিপত্তি! বাচ্চাটা চোখের সামনে আরও খারাপ হচ্ছে…
অবশেষে প্রায় ঘন্টা পাঁচ-ছয়েক বাদে পিতৃদেবের দেখা মিলল। রোগীর ইতিহাস খুঁজে দেখা গেল, এ বাচ্চাটা প্রথম পক্ষের। পিতৃদেব কোনওমতে হাসপাতালে পৌঁছে দিয়েই দায় সেরেছেন। বাচ্চার মা তাকে ধরেবেঁধে অনেক কষ্টে হাসপাতাল অব্দি আনতে পেরেছে। নইলে রাস্তা চিনে মা’র পক্ষে আসা সম্ভব ছিল না। পিতৃদেব প্রথমে কিছুতেই রক্ত আনতে রাজি নয়। শেষমেশ পুলিশের ভয়ে নিতান্ত অনিচ্ছাসত্ত্বেও রক্ত আনতে যেতে বাধ্য হ’ল।
বাইরে তখন ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নেমেছে। রাস্তায় লোকজন অনেক কমেছে। বাস, অটো, বাইক ইত্যাদি মিলিয়ে সাধারণত যে ‘প্যাঁক-পিঁক-ভোঁওওও-দেখে দাদা’ ইত্যাদি আওয়াজগুলো থাকে সেটাও অনেক কম। নাইট ডিউটি আছে। দুপুরে একটু গড়িয়ে নিতে হ’বে। ‘নীলকন্ঠ পাখির খোঁজে’ উপন্যাসটায় ক’দিন বুঁদ হয়ে আছি। বইটা বুকের ওপর রেখে মোবাইল খুটখুট করছি। মেসেজ এলো- সকালের পয়জনিং বাচ্চাটা আর নেই! আইসিইউতে যাওয়ার পরপরই নাক-মুখ দিয়ে রক্ত আসা শুরু হয়ে যায়। তারপর বার তিনেক হার্ট অ্যাটাকের পর…
বডি পোস্ট মর্টেমে যাবে। অন্ধকার ঘরে ঠান্ডা পাথরের টেবিলে শুয়ে থাকবে ছোট্ট শরীর। হাতের ওপর দিয়ে আরশোলা চলে গেলেও এখন আর চিৎকার করে কেঁদে উঠবে না সে। অথচ, আজই হয়তো বৃষ্টিভেজা দুপুরে বাবার কোলে শুয়ে রাখাল বালকের গল্প শোনার ছিল তার..