এলোমেলো দিন চলেছে। রোগের রোজনামচা দিয়ে সকাল আরম্ভ হয়। সকাল। ভোর নয়। আমার জীবনে কোনো ভোর নেই।
হাসপাতাল, ডিউটি, টেলিমেডিসিন (হ্যাঁ, আমা হেন ‘পাতি’কেও ‘কনসাল্ট’ করতে হচ্ছে মানুষকে), তারই মাঝে ব্যস্ত হাতে মায়ের নিত্যকার সুগার, প্রেশার, অক্সিজেন স্যাচুরেশন চেক, বাড়ির টুকটাক কাজ, বাজার হাট — কাজের ফাঁকে গভীর দীর্ঘশ্বাস — শ্বাসকষ্ট নেই তো?
মাঝে মাঝে সিঁড়ির নিচে রাখা নীল কেরোসিনের বোতলের ছিপি খুলে শুঁকে আসি, — গন্ধবোধহীন হয়ে যায়নি তো স্নায়ু?
ফেসবুকের অদেখা অপরিচিত বন্ধু থেকে আরম্ভ করে আত্মীয়সম ভাইয়ের পরিবার, সুদূর ইংল্যান্ড-বাসিনী অসহায় ক্লাসমেটের বাবা থেকে শুরু করে নিজের আত্মীয়-পরিজন, পরিচিত রোগীর তালিকা দীর্ঘ হয়েই চলেছে, শেষ বিকেলের তালগাছের ছায়ার মতো।
কিচ্ছু করে উঠতে পারছি না কারোর জন্য তেমন করে। তবু আশা, একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে। শেষ হয়ে যাবে দুঃস্বপ্নের রাত, কেটে যাবে মহাদুর্যোগ।
এই বিষাদে ডুবে থাকা অস্থির সময়েও চলছে হিংসা, প্রশাসনিক তরজা, অপশাসনের অভিযোগ, পাল্টা অভিযোগ প্রতিশোধমূলক আচরণের —
এরই মধ্যে হু হু করে জ্বলছে অগণিত চিতা, অনামা মানুষের —অগ্নিশুদ্ধ হচ্ছে পৃথিবী।
সন্তান ছেড়ে যাচ্ছে অসুস্থ বাবা মায়ের হাত, সেই হাত এসে ধরছেন অনাত্মীয় মানুষজন। গ্রাম শহরের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত ছুটে বেড়াচ্ছেন কিছু নাছোড়বান্দা মানুষ — জোগাড় করে দিচ্ছেন খাবার, ওষুধ, অক্সিজেন, রক্ত —
বেডের হাহাকার চলছে, অগুন্তি বেড বাড়িয়েও সামাল দেওয়া যাচ্ছে না পরিস্থিতি। সবাই একটু আশ্বাস চায়। অসুস্থ হলে সুচিকিৎসার বন্দোবস্তটুকু যেন থাকে!
এই পোড়া দেশে এভারেস্টকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেওয়া উচ্চতার মহার্ঘ্য মূর্তি, মসজিদ উড়িয়ে পৌরাণিক রাজার স্মরণে মন্দির, প্রত্যন্ত অঞ্চলে মল, কারখানা, হিমালয়ের দুর্গমতম অঞ্চলের বুক ফাটিয়ে রাস্তা, পাহাড়ি স্রোতস্বিনীর পায়ে বেড়ি পরিয়ে বাঁধ, গহীন অরণ্যে ডিজিটাল লেনদেনের নিমিত্ত এটিএম মায় মহামারীর ভয়ংকরতম আবহে গণতন্ত্রের ভোট-মহোৎসব, সব হয়, শুধু ১৩৮ কোটির সুচিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হেদিয়ে যায় সরকার!
সুতরাং, নিজেদের হাতে যেটুকু, সেটুকুই করি। সবাই জেনে গিয়েছি এতদিনে, কি কি করতে হবে। বে আক্কেলের মতো সেই ‘জানা’গুলোকে এখনো যদি চ্যালেঞ্জ করি, এখনো যদি ভ্যাকসিন নিয়ে টালবাহানা করি, মুখ ঢাকতে না চাই মুখচ্ছদে, এখনো লুকিয়ে বেড়াই রোগ — কি হবে, তা আমাকে বলতে হবে না।
ভ্যাকসিন নিয়ে সরকারি অপদার্থতা ও অপরিণতমনস্কতা অচিরাৎ শেষ হবে, আশা রাখি। তখন যেন কেউ তা-না-না-না করে এড়িয়ে না যাই, এটা নেওয়া প্রয়োজন।
সবাই সাধ্যমত চেষ্টা করি ভাল থাকার, ভাল রাখার — এরই মধ্যে খামোখা পরস্পরকে দোষারোপ, নিন্দা, হানাহানি যেন না করি, এই কালান্তক সময়ে এই প্রবণতা আত্মঘাতী।
সকলেই একটু দায়িত্বশীল হই আসুন। মানবিকতার নিরিখে যথেষ্ট দরিদ্র হয়েছি বিগত এক বছরে, আর আমাদের বিশেষ কিছু হারাবার নেই, প্রাণটুকু ছাড়া।
মানুষ অমর নয়, করোনা হলেও নয়, না হলেও নয়, বিজেপি/তৃণমূল/সিপিএম করলেও নয়, না করলেও নয়, অক্সিজেন হোর্ডিং করলেও নয়, না করলেও নয়, জীবনদায়ী ওষুধের কালোবাজারি করলেও নয়, না করলেও নয়, বেড ম্যানেজ করলেও নয়, না করলেও নয়, প্রধানমন্ত্রী হলেও নয়, মুখ্যমন্ত্রী হলেও নয়!
সুতরাং, আসুন, একটু ভাল হই, কারুণিক হই, মানুষ হই। বুড়ি পৃথিবীর মাটিতে, তার গর্ব করার মতো ছাপ রাখি একটু।
তারপরে তো যাবই, যেতেই হবে। যাওয়া ছাড়া পথ নেই।
অনবদ্য।