গতকাল ঘটে গেছে এক অভূতপূর্ব ঘটনা। আতঙ্কিত ডোম এবং স্থানীয় মানুষদের বিক্ষোভের জেরে রাজ্যে করোনায় প্রথম মৃত সমীর মিত্রর দেহ দীর্ঘক্ষন পড়ে ছিল শ্মশানে। পরে রাত সাড়ে বারোটা নাগাদ বিশাল পুলিশ বাহিনীর নিরাপত্তায় শেষকৃত্য সম্পন্ন করা সম্ভব হয়। এদিন রাত সাড়ে নটা নাগাদ নিমতলা শ্মশানে শবদেহ আনার সঙ্গে সঙ্গেই স্থানীয় মানুষ ও ডোমেরা বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। পরিস্থিতি সামাল দিতে নামানো হয়েছিল বিশাল পুলিশবাহিনী। কেন নিমতলা শ্মশানে করোনা আক্রান্ত রোগীর মরদেহ পোড়ানো হবে তা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে থাকে ডোম থেকে স্থানীয় মানুষ প্রত্যেকেই। প্রথমে পুলিশ পরে কুড়ি নম্বর ওয়ার্ডের তৃণমূল কাউন্সিলরও বিক্ষোভকারীদের বোঝাতে পারেননি যে করোনায় মৃত ব্যক্তিকে দাহ করলে আলাদাভাবে সংক্রমণের ঝুঁকি থাকে না। উত্তেজনায় পুলিশকে লক্ষ্য করে ইট পাথর ছোড়ে স্থানীয় মানুষরা। ক্রমশ পরিস্থিতি হাতের বাইরে চলে যেতে থাকলে শেষে রাপিড অ্যাকশন ফোর্স নামিয়ে অবস্থা নিয়ন্ত্রণে আনা হয়।
প্রশ্ন কেন এই ধরনের ঘটনা ঘটলো? আসলে করোনা ভাইরাস সংক্রমণকে ঘিরে বিশ্বজুড়ে আতঙ্কের সৃষ্টি হয়েছে। এমন সময়ে শ্মশানে ওই মৃতদেহ দাহ করার খবরে মানুষের মধ্যে নতুন করে সংক্রমণের আশঙ্কা জন্মায়। তার জেরেই এই বিক্ষোভ।
কিন্তু প্রকৃত তথ্য হলো করোনা সংক্রমণের মৃতদেহ পোড়ালে বা কবর দিলে তা থেকে নতুন করে সংক্রমণের আশঙ্কা থাকে না। তবে এই সম্পূর্ণ বিষয়ে চূড়ান্ত সাবধানতা অবলম্বন করা প্রয়োজন। কি সেই পদ্ধতি?
ভারত সরকারের স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রক ১৫ ই মার্চ কোভিড ১৯ এ মৃত ব্যক্তিদের শবদেহ নাড়াচাড়া ও সৎকারের পদ্ধতি সম্পর্কে একটা নির্দেশিকা জারি করেছে।
নির্দেশিকায় প্রথমেই বলা হয়েছে যে ড্রপলেটের মাধ্যমেই কেবল কোভিড ১৯-এর সংক্রমণ ছড়াতে পারে। তাই মৃতদেহ থেকে স্বাস্থ্যকর্মীদের বা পরিবারের সদস্যদের সংক্রমণের সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। তবুও মৃতদেহ নাড়াচাড়ার ক্ষেত্রে সব ধরনের সাবধানতা অবলম্বন করতে বলা হচ্ছে।
মৃত রোগীদের ফুসফুস যদি পোস্টমর্টেমের সময় কাটাছেঁড়া করা হয় তা থেকে সংক্রমণ হতে পারে।
হাসপাতাল থেকে মৃতদেহ সংগ্রহ করে মৃতদেহ কবর দেওয়া বা দাহ করার মুহূর্ত পর্যন্ত কর্মীরা কি কি সাবধানতা অবলম্বন করবেন সে বিষয়ে বিশদ ব্যাখ্যা দেওয়া আছে ওই নির্দেশিকায়।
করোনা সংক্রমণে মৃত ব্যক্তিদের শব নাড়াচাড়া করার সময় স্বাস্থ্যকর্মীরা কি কি সাবধানতা অবলম্বন করবেন?
************
১: হ্যান্ড হাইজিন।
২: ব্যক্তিগত সুরক্ষার সামগ্রী ব্যবহার করবেন। যেমন জলে ভেজে না এমন এপ্রন, গ্লাভস, মুখোশ ও চশমা।
৩: ধারালো সামগ্রীগুলো নিরাপদে নাড়াচাড়া করা।
৪: মৃতদেহ রাখার থলি, রোগীর জন্য ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি জীবাণুমুক্ত করা
৫: ব্যবহৃত সুতির কাপড় জীবাণুমুক্ত করা। এর পাশাপাশি ব্যবহৃত আসবাবপত্রের উপরিতল পরিষ্কার ও জীবাণুমুক্ত করা।
নির্দেশিকায় বলা হয়েছে সমস্ত কর্মী যারা ওই আইসোলেশন এরিয়ায়, মর্গে ,অ্যাম্বুলেন্সে ,শ্মশান বা কবরখানায় শবদেহ নাড়াচাড়া করবেন তাদের জীবাণু সংক্রমণ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণের পদ্ধতিগুলি সম্পর্কে প্রশিক্ষিত করতে হবে।
আইসোলেশন এরিয়া থেকে শবদেহ সরানো হবে কিভাবে?
************
১: স্বাস্থকর্মীরা হ্যান্ড হাইজিন পালন করবেন। জলে ভিজে যায় না এমন এপ্রন, চশমা, এন ৯৫ মাস্ক, গ্লাভস ইত্যাদি ব্যক্তিগত সুরক্ষার সামগ্রী যথাযথ ব্যবহার করবেন।
২: শবদেহ থেকে সমস্ত নল, ড্রেন ও ক্যাথিটার খুলে ফেলতে হবে।
৩: শরীরে ক্ষত বা ফুটো থাকলে ১% সোডিয়াম হাইপোক্লোরাইট দিয়ে জীবাণুমুক্ত করার পর এমন সামগ্রী দিয়ে ঢাকা দিতে হবে যাতে রস চুইয়ে না পরে।
৪: শিরায় লাগানো ক্যাথেটার বা অন্যান্য ধারালো সামগ্রী সাবধানে নাড়াচাড়া করতে হবে। সেগুলিকে একটি শার্প কন্টেনারে রাখতে হবে।
৫: শবদেহের মুখ এবং নাক বুজিয়ে দিতে হবে। যাতে শরীরের রস চুঁইয়ে না বেরোয়।
৬: এলাকা থেকে শবদেহ সরানোর আগে রোগীর পরিজন যদি দেখতে চান তাহলে নির্দিষ্ট সাবধানতা মেনে তাঁদের শব দেহ দেখানো যেতে পারে।
৭: দেহকে নিশ্ছিদ্র প্লাস্টিকের বডি ব্যাগে রাখতে হবে। বডি ব্যাগের বাইরেটা ১% হাইপোক্লোরাইট দিয়ে দূষণমুক্ত করতে হবে। বডি ব্যাগের ওপরে চাদর ঢাকা দেওয়া যেতে পারে।
৮: শবদেহ পরিজনদের দেওয়া যেতে পারে বা মর্গে রাখা যেতে পারে।
৯: মৃত ব্যক্তির চিকিৎসায় ব্যবহৃত সব ধরনের সুতির কাপড় সাবধানতার সঙ্গে নির্দিষ্ট বায়ো হ্যাজার্ড ব্যাগে রাখতে হবে। ব্যাগের বাইরেটা হাইপোক্লোরাইট দ্রবণ দিয়ে জীবাণুমুক্ত করতে হবে।
১০: ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি অটোক্লেভ করা যেতে পারে বা জীবাণুনাশক দ্রবণে ডুবিয়ে জীবাণুমুক্ত করা যেতে পারে।
১১: সমস্ত বর্জ্য পদার্থ বায়োমেডিকেল ওয়েস্ট ম্যানেজমেন্ট এর নিয়ম মেনে বর্জন করতে হবে।
১২: সব কাজ হয়ে যাওয়ার পর এইবার স্বাস্থ্যকর্মীরা ব্যক্তিগত সুরক্ষার সামগ্রীগুলো খুলবেন এবং হ্যান্ড হাইজিন পালন করবেন।
১৩: পরিবারের সদস্যদের আবেগকে সম্মান জানিয়ে মৃতের আত্মীয়স্বজনের কাউন্সেলিং করতে হবে ।
আইসোলেশন ওয়ার্ডের পরিবেশকে কিভাবে পরিষ্কার রাখতে হবে?
************
আইসোলেশন এলাকার মেঝে, বেড, রেলিং ,সাইট-টেবিল, আইভি স্ট্যান্ড ইত্যাদি ১% সোডিয়াম হাইপোক্লোরাইট দ্রবণ দিয়ে মুছে ৩০ মিনিট ভেজা রাখতে হবে এবং হাওয়ায় শুকাতে হবে।
মর্গে শবদেহ কিভাবে নাড়াচাড়া করা হবে?
************
১: মর্গের কর্মীরাও নির্দিষ্ট সাবধানতা নেবেন।
২: শবদেহ মোটামুটি ৪° সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রায় সংরক্ষন করতে হবে।
3 মর্গ পরিষ্কার রাখতে হবে। মেঝে, দেওয়াল, ট্রলি এবং যন্ত্রপাতি ১% হাইপোক্লোরাইট দ্রবণ দিয়ে জীবাণুমুক্ত করতে হবে।
৪: শবদেহ বার করে রাখার পর চেম্বারের দরজা, হাতল ও মেঝে ১% হাইপোক্লোরাইট দ্রবণ দিয়ে পরিষ্কার করতে হবে।
এমবামিং করা যাবে কি?
*********
না, মৃতদেহ এমবামিং-এর অনুমতি দেওয়া উচিত নয়।
কোভিড ১৯-এ মৃতদের শব ব্যবচ্ছেদ করা যাবে কি?
************
১: কোভিড ১৯ এ মৃতদের শবদেহ ব্যবচ্ছেদ এড়িয়ে যাওয়াই ভালো। যদি কোন কারণে করতেই হয় তাহলে কর্মী দলটিকে জীবাণু সংক্রমণ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণের বিষয়ে ভালোভাবে প্রশিক্ষিত হতে হবে।
২: ফরেনসিক এক্সপার্ট ও সহায়কদের সংখ্যা হবে সীমিত।
৩: সবাই সমস্ত ব্যক্তিগত সুরক্ষার উপকরণ ব্যবহার করবেন।
৪: শব ব্যবচ্ছেদে ব্যবহৃত কাঁচিগুলোর ডগা সূচালো না হয়ে গোল হবে।
৫: যে ব্লেড দিয়ে কাটা হবে তার ডগা হবে ভোতা যাতে শব ব্যবচ্ছেদকারীর হাতে ফুটে না যায়।
৬: এক এক বারে শরীরের একেকটি গহ্বর খোলা হবে।
৭ঃ যে প্রত্যঙ্গগুলো ফিক্স করা হয়নি সেগুলো কাটার সময় সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে।
৮ঃ শব ব্যবচ্ছেদের ঘরে নেগেটিভ প্রেসার বজায় রাখা জরুরী।
৯: ব্যবহৃত সূঁচ ও সিরিঞ্জ শার্প কন্টেনারে রাখতে হবে।
১০: শব ব্যবচ্ছেদের সময় বিশেষত ফুসফুস নিয়ে কাজ করার সময় এরোজল যাতে কম উৎপন্ন হয় সেই দিকে নজর রাখতে হবে।
১১: শব ব্যবচ্ছেদ হয়ে যাওয়ার পরে মৃতদেহ ১% সোডিয়াম হাইপোক্লোরাইট দিয়ে জীবাণুমুক্ত করে বডি ব্যাগে রাখা প্রয়োজন। বডি ব্যাগের বাইরেটাও একইভাবে জীবাণুমুক্ত করতে হবে।
১২: শবদেহ এবার পরিজনের হাতে দেওয়া যেতে পারে।
১৩: শব ব্যবচ্ছেদের টেবিল নিয়ম মেনে জীবাণুমুক্ত করতে হবে।
শব পরিবহনের সময়কার নিয়ম কানুন
************
১: বডিব্যাগে রাখা শব থেকে সংক্রমণের ঝুঁকি নেই যদি বডি ব্যগের বাইরেটা জীবাণুমুক্ত করা থাকে।
২: যেসব পরিবহন কর্মী শবদেহটি নাড়াচাড়া করবেন তারা সার্জিক্যাল মাস্ক, গ্লাভস ইত্যাদির মত সাবধানতাগুলি অবলম্বন করবেন।
৩: গাড়ি থেকে শবদেহ নামানোর পর গাড়িটিকে ১% সোডিয়াম হাইপোক্লোরাইট দ্রবণ দিয়ে জীবাণুমুক্ত করতে হবে।
শ্মশানে বা কবরখানায় কি করা উচিত?
************
১: শ্মশান বা কবরখানার কর্মীদের বোঝাতে হবে যে কোভিড ১৯-এ মৃতদের দাহ করলে বা কবর দিলে অতিরিক্ত কোনো ঝুঁকি নেই।
২: কর্মীরা হ্যান্ড হাইজিন, মুখোশ, গ্লাভস ব্যবহারের মতো সাবধানতা নেবেন।
৩: মৃতের পরিজনদের শেষবারের মতো দেখাবার জন্য কর্মীরা যথাযথ সাবধানতা অবলম্বন করে বডিব্যাগের মুখের দিকটা খুলে দেখাতে পারেন।
৪: মন্ত্র পড়া, পবিত্র জল ছিটানো বা অন্য কোন ক্রিয়া যাতে শবদেহকে ছুঁতে হয়না, সেগুলির অনুমতি দেওয়া যেতে পারে।
৫: কিন্তু শবদেহ স্নান করানো, চুমু খাওয়া, জড়িয়ে ধরা ইত্যাদির অনুমতি একেবারেই দেওয়া উচিৎ নয়।
৬: দাহ বা কবরের পর কর্মীরা এবং পরিবারের সদস্যরা অবশ্যই হ্যান্ড হাইজিন পালন করবেন।
৭: ছাই থেকে কোনো ঝুঁকি নেই। তাই মৃতদেহ পোড়ানোর পর ছাই সংগ্রহ করা যেতে পারে।
৮ঃ সামাজিক দূরত্বের নিয়ম মেনে শ্মশানে বা কবরখানায় বড় জমায়েত করা উচিত নয়। কেননা এমনটা হতেই পারে যে পরিবারের অন্য কোন
সদস্যেরও একই সংক্রমণ হয়েছে এবং তিনি জীবাণু ছড়াচ্ছেন।