ক্ষীরমোহনবাবু একজন অবসরপ্রাপ্ত মধ্যবিত্ত, ছোটোখাটো মানুষ। ওনার পারিবারিক পরিচিতি এই প্রসঙ্গে অনুল্লেখ্য তবু আমার আপনার মতো একজন সাধারণ মানুষ সম্বন্ধে জানার জন্য এটা জরুরি। তাহলে নিজেকে ঐস্থলে বসাতে সুবিধে হয়।গীতাদেবীও বলেছেন আত্মাণং বিদ্ধি।
সুতরাং আমরা ক্ষীরমোহনবাবু সম্বন্ধে জানতে থাকি।করোনা সঙ্কটে গৃহাবরোধে খবরের কাগজ পড়া আর নিদ্রাকর্ষণ ওনার একমাত্র অবসরবিনোদন। সঙ্গে থাকেন স্ত্রী হর্ষমতিদেবী, কন্যা দ্রাক্ষালতা এবং পুত্র সুনিনাদ। আর আছেন তণ্বী, সুন্দরী হট্টমেলাদেবী- তিনি লেজষ্মতি, চারপেয়ে। আপাততঃ জানালার পাশে থাবার ওপর মুখ রেখে একটা দুষ্টমতি শালিকের কোউ কোউ, কাকা, ক্রিচ ক্রিচ ইত্যাদি শুনছেন। একটু পরে শালিকটা কুফ্রীইই বলে ডেকে’ গগন নহিলে মোরে ধরিবে কেডা অ্যাটিচিউড নিয়ে উড়ে গেলো। হট্টমেলাদেবী সাধারণ ভাবে ক্ষীরমোহনবাবুর ঘরেই থাকেন, কেননা ওনার ভাই ক্ষীরকদম্ববাবু কুকুর টুকুর পছন্দ করেন না আর ওনার স্ত্রী সাহসিকাদেবী হট্টমেলাদেবীকে দেখলেই আলনার ওপরে বা জানালার গ্রীল বেয়ে ছাদে ওঠার চেষ্টা করেন। এমত সময়ে ক্ষীরমোহনবাবু খবরের কাগজে একটা শ্বাসরোধী, উত্তেজক খবর পড়ে গলা খাঁকারি দিলেন।
হর্ষমতিদেবী পাকশালা থেকে সখুন্তি বেরিয়ে এলেন “গলা খাঁকরালেই চা পাবে ভেবেচো, এ্যাঁ? আমি কি চাকর্নি, যে খ্যাঁকরানি শুনলেই চা করবো? হবে না।”
ক্ষীরমোহনবাবু মনোকষ্টে গান গাইতে লাগলেন “খুশখুশে কাশি, ঘুসঘুসে জ্বর, পাঁজরাতে ব্যথা, বুড়ো তুই মর”। দ্রাক্ষালতার কামরায় শান বাঁধানো মেঝেতে মার্বেল গুল্লি গড়ানোর আওয়াজ পাওয়া গেলো অর্থাৎ বাপসোহাগী কন্যা হাসছে।
ক্ষীরমোহনবাবু তারপর পড়তে থাকলেন “ভুতুমপুরে একজন পেটে ব্যথার রোগী সরকারি হাসপাতালে এলে, সরকারি ডাক্তার তাকে পেটে ব্যথার ইঞ্জেকশন দিয়ে দেন। পরে রোগীর প্রবল ঘাম ও শ্বাসকষ্ট হলে, বিনা ইসিজি বা ইকোকার্ডিওগ্রাফি, খাবি খেয়ে মারা যায়। ভুল ইঞ্জেকশন দেওয়ার অভিযোগ ওঠে। যায়। খুন কা বদলা নীতি অনুযায়ী লোকজন প্রথমে ডাক্তারকে হাতে করে পেটায়, তারপর ডাক্তার না মরায় এবং হাতে ব্যথা হওয়ায় তাকে চেয়ার, টেবিল ইত্যকার দ্রব্যাদি দিয়ে পেটাতে থাকে। (উত্তেজনায় ক্ষীরমোহনবাবুর টাক চকচক করে ওঠে, পুরো লোমহর্ষণ দক্ষিণী সিনেমা!) চেয়ার, টেবিল, টিউলাইট এবং অন্যান্য যন্ত্রপাতি ভেঙে যায় কিন্তু ডাক্তার বেঁচে যায় এবং মাতৃরূপী নার্সরা মার্জারমাতার ক্ষিপ্রতায় তাকে নিয়ে চলে যান।উক্ত মারপিটে জড়িত থাকার জন্য ডাক্তারকে উপযুক্ত কারণ দর্শাতে বলা হয়।”
আমরা সবাই এই সংবাদ পড়েছি। তফাৎ এই ক্ষীরমোহনবাবুর মনে অনুসন্ধিৎসা গজায়, অথচ এই সব খবরে আমাদের উদাসী মগজপুকুরে তরঙ্গ উঠেই মিলিয়ে যায়। ক্ষীরমোহনবাবুর প্রশ্ন জাগে। কী ওষুধে একঘণ্টা পরে ঘাম আর শ্বাসকষ্ট হয়ে মারা যাবে? এই অনুসন্ধিৎসার পেছনে ওনার কুমৎলব না জিজ্ঞাসু মনোভাব, সেটা জানা যায়নি। কিন্তু গোগোলবাবুও এই জাতীয় কোনও ওষুধের সন্ধান দিতে পারেন না। তাহলে কোন অসুখে এরকম হতে পারে? পড়তে পড়তে ক্ষীরমোহনবাবুর কপালে ঘাম জমে,মুখের হাঁ’য়ের ভেতর বিশ্বরূপ দেখা যায়।
ইকি কান্ড? এভাবে তো উনিও মরতে পারেন! সুতরাং পড়া চলতে থাকে। অবশেষে নানা অসুখের লক্ষণ এবং প্রাথমিক কর্তব্য নিয়ে একটা সারমর্ম তৈরি চিক্কুর তুলে’ ডাক দেন “কদমা, হস্যমতি, সুনিনাদ, তোমরা সবাই ইদিকে এসো গো”
অনতিবিলম্বে সক্কলে হাজির হয়।
ক্ষীরমোহনবাবু পড়তে থাকেন। “হার্ট অ্যাটাক হলে কি কি কষ্ট হয় এবং আগে কিভাবে সাবধান হবো”
কলেজছাত্রী দ্রাক্ষালতা প্রশ্ন করে “এটা কিসের ক্লাস হচ্ছে?”
ক্ষীরমোহনবাবু বলেন “বেঁচে থাকার সহজ পাঠ”
ক্ষীরকদম্ববাবু বললেন “দাদা, তুই শুরু করে দে”
“হার্ট অ্যাটাক হলে, বুকে, পেটে, পিঠে, বাঁ হাতে, চোয়ালে, কাঁধে, যে কোনও জায়গায় ব্যথা হতে পারে। দীর্ঘদিনের শুগার পেশেন্টের ব্যথা নাও হতে পারে”
হর্ষমতিদেবী হ্রেস্বাধ্বনি ছাড়েন “সব জাইগাতেই হতে পারে, যতোসব গজকপিত্থ কান্ড”
ক্ষীরমোহনবাবু পাত্তা না দিয়ে পড়তে থাকেন “প্রচুর ঘাম হবে, বমি হতে পারে, প্রেসার ফল করার সম্ভাবনা, হার্টরেট কমে যাওয়া মানে অবস্থায় খারাপ হচ্ছে। তৎক্ষণাৎ হাসপাতালে নিয়ে চিকিৎসা শুরু করতে হবে। সঙ্গে পরীক্ষা নিরীক্ষা। ছ’ঘন্টার বেশী চিকিৎসা ছাড়া পড়ে থাকলে ভবিষ্যৎ দুর্ঘটনাবহুল হবে”
“আগে বোঝা যায় না?” সুনিনাদের সুচিন্তিত প্রশ্ন।
“আগে বোঝা যায় …হাঁটতে গেলে দম ফুরিয়ে আসা, বুকে বেল্ট বাঁধার মতো চাপ লাগা, ব্যথা বাঁ হাত বা চোয়ালে হওয়া, তবে কয়েক মিনিট ব্যথা থাকবে, এবং বিশ্রাম নিলে কমবে। আগে থেকে বছর বছর নিয়ম করে পরীক্ষা টরীক্ষা করলে ঠিক মতো বোঝা যায়। না হলেই ভুতুমপুর কেস হয়ে যাবে, তখন চারঘন্টার মধ্যে অ্যাঞ্জিওপ্ল্যাস্টি না করলে বাঁচলেও সারা জীবন অকেজো হয়ে থাকতে হবে।”
সাহসিকা কান্ড বোঝার চেষ্টা ছেড়ে বলেন “ডাক্তার বদ্যি, যতসব ইল্লুতে ব্যপার….”
দ্রাক্ষালতা জেনারেল নলেজ পড়ে, সে বললো “এসব তো কয়েকটা মাত্র হাসপাতালে হয়!”
সুনিনাদ, ব্যতিক্রমী আন্দোলনী। সে বলে “আন্দোলন করে জনসাধারণের জন্যে এই সব দাবী আমাদের আদায় করতে হবে।”
ক্ষীরমোহনবাবু বলতেই থাকেন “ক্যানসার, এযুগে আর এটা মানেই মৃত্যু নয়, তবে প্রথম অবস্থায় ধরতে হবে, হুঁ হুঁ”
ক্ষীরকদম্ববাবু বলেন “কিভাবে?”
ক্ষীরমোহনবাবু বলে চলেন “বেশীরভাগ ক্যানসারে ওজন কমে, হিমোগ্লোবিন কমে, ইএসআর বাড়ে। একমাত্র লিম্ফ নোড ক্যানসারে ওজন কমে না। তাতে শরীরের বিভিন্ন জায়গায় ব্যথাহীন ছোটো ছোটো গ্ল্যান্ড দেখা যায়। মেয়েদের জরায়ুর ক্যানসারে সহবাসের পরেই রক্ত আসে। ওভারির ক্যানসারে একটা ব্লাড টেস্টের ফলাফল বেড়ে যায়। ছেলেদের প্রস্টেট ক্যানসারে অন্য একটা মার্কার বাড়ে। এগুলো বছর বছর করা উচিত। স্তন ক্যানসারে মেয়েটি নিজেই মাসে একবার বিশেষ কয়েকটি ভাবে নিজের স্তনে হাত দিয়েই ক্যানসার অনুভব করতে পারে।এগুলো ডক্টরস ডায়ালগের হাতুড়ে ইতিমধ্যেই লিখে ফেলেছেন। আর ব্লাড ক্যানসার? জ্বর আসবে, ওজন কমবে, রক্তের শ্বেতকণিকা কয়েক শো গুণ বেড়ে যাবে।এতেও গ্ল্যান্ড বাড়তে পারে, পিলে বাড়তে পারে”
“এরপর কিডনি খারাপ।”
“দাদা গো একটু চা পান করি? আমার মাতাটা তাজ্ঝিম মাজ্ঝিম করছে।”
দ্রাক্ষালতা ও সাহসিকার যুগ্ম প্রয়াসে তৎক্ষণাৎ চায়ের ব্যাগ ডোবানো গরম জল চলে আসে। গরম চায়ে চুমুক। সুরুৎ। গোঁফে শিশির বিন্দুসম একটা চায়ের ফোঁটা আটকে চকচক করে(তনে বুরুৎ, মন এ বুরুৎ, বুরুৎ শনাক্তদার) [প্রিয় সম্পাদক এটা মুজতবা আলীর দেশে বিদেশে লেখা থেকে একটু মিলিয়ে নেবেন]
“কিডনি খারাপ হলে প্রথমে পেচ্ছাপে প্রোটিন বেরোবে, রক্ত চাপ বাড়বে-ভয়ানক, তারপর হিমোগ্লোবিন কমে হিমশিম, শেষে শরীরে জল জমবে”
হর্ষমতি, হর্ষহীন প্রশ্ন করেন “আর ক্যানসার?”
ক্ষীরমোহনবাবু কাগজপত্র ঘন্টকারি করে বলেন “তাতে পেচ্ছাপে রক্ত আসবে। শুধু কিডনি কেন? পেচ্ছাপের যে কোনও জায়গায় ক্যানসার হলেই পেচ্ছাপে রক্ত আসবে।
এবার হর্ষমতি হ্রেস্বাধ্বনি ছাড়েন “এবার তোমরা চ্যান করতে যাও-এক মিনিট সময় দিলাম।কয়েকটা চায়ের কাপ ছাড়া সবাই তৎক্ষণাৎ হাওয়া হাওয়া ও হাওয়া, মুঝকো লটা দে…হয়ে গেল।