আগের পোস্টে অরিজিৎ ভট্টাচার্য বাবু অনেকগুলি প্রশ্ন করেছেন। তার মধ্যে প্রথম প্রশ্নটি হলো চিকেন পক্স নিয়ে। লেখা শুরু করে বুঝলাম, চিকেন পক্স বা জল বসন্ত নিয়ে মানুষের মনে এতো রকম ভ্রান্ত ধারণ আছে, যে অরিজিৎ বাবুর প্রশ্নের উত্তরের সাথে এই নিয়েও বিস্তারিত লেখা উচিৎ।
ওনার প্রশ্ন ছিল, পক্স হলে ২১ দিন মাছ মাংস একেবারে খাওয়া যাবে না। এটা কতটা ঠিক?
এটা যে একেবারেই ঠিক নয়, বরঞ্চ বর্তমানে চিকিৎসকেরা এর সম্পূর্ণ উল্টো বলেন। তবে এই প্রশ্নের উত্তরে যাওয়ার আগে আমরা প্রয়োজনীয় কয়েকটি জিনিস জেনেনি।
পক্স নিয়ে মানুষের এতো ভয় কেন?
অতীতে স্মল পক্স বা গুটি বসন্ত প্রায় বছরই এই বাংলার বুকে মহামারী হয়ে ছড়িয়ে পড়ত। এবং প্রচুর মানুষ গুটি বসন্তে মারা যেতেন। আমার এক ঘনিষ্ঠ বন্ধুর বাবারা ছয় ভাই ছিলেন। ১৯৬৪ সালে গুটি বসন্তের এক মহামারীতে ছয় জনের মধ্যে পাঁচ ভাই মারা যান। বন্ধুর বাবা এখনও জীবিত। কিন্তু এখনও তিনি ক্ষতবিক্ষত মুখ নিয়ে সেই কোন ছোটবেলার মারণ রোগের স্মৃতি বয়ে চলেছেন। আর তার সাথে বয়ে চলেছেন, পক্স নিয়ে এক অপরিসীম ভয়।
আর এই ভয়, অসহায়তা জন্ম দেয় নানা রকমের কুসংস্কারের। মানুষের হাতে যখন বিপদ থেকে বাঁচার কোনো অস্ত্র থাকে না, তখন সে নানারকম অবৈজ্ঞানিক পদ্ধতি গ্রহণ করে। নানা রকম কুসংস্কারের কাছে আত্মসমর্পণ করে মানসিক শান্তি পেতে চায়। সে সময় স্মল পক্সের বিরুদ্ধে লড়ার মতো কোনো অস্ত্র শস্ত্র মানুষের হাতে ছিল না। তাই নানা রকমের লৌকিক আচার গড়ে উঠেছিল এই রোগ নিয়ে।
অনেকে তর্ক করতে পারেন, এই সব লৌকিক আচার বহু দিন ধরে বহু অভিজ্ঞতায় মানুষ শিখেছে। তাই এগুলো ভ্রান্ত নয়। কিন্তু দুঃখের সাথে বলতে বাধ্য হচ্ছি বেশিরভাগ লৌকিক আচার সম্পূর্ণ ভ্রান্ত। অনেকদিন থেকে চলে আসছে বলে সেটা সঠিক, এটার কোনো বিজ্ঞান সম্মত ভিত্তি নেই।
যেমন এককালে লৌকিক ধারণা ছিল কলেরার রোগীদের মুখে কিছু খাওয়াতে নেই। কারণ সেসময় মানুষ দেখেছিল কলেরার রোগীদের কিছু খাওয়ালে তারা আরও বমি করে এবং আরও পায়খানা করে। এই লৌকিক বিশ্বাসের জন্য লক্ষ লক্ষ কলেরার রোগীকে প্রাণ হারাতে হয়েছে। পরে এই বাংলাতেই চিকিৎসক ও বিজ্ঞানীরা প্রমাণ করেছেন লবণ, জল ও গ্লুকোজের দ্রবণ খাইয়েই কলেরায় মৃত্যু হার প্রায় শূন্যে নামিয়ে আনা সম্ভব।
স্মল পক্সের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে কিন্তু এধরনের লৌকিক বিশ্বাসের উপর নির্ভর করে সাফল্য মেলেনি। সাফল্য এসেছে বিজ্ঞানের হাত ধরে। ভ্যাক্সিনেশনের সাহায্যে এই রোগকে সম্পূর্ণ নির্মূল করা সম্ভব হয়েছে। স্মল পক্সের শেষ রোগী পাওয়া গেছে ১৯৭৭ সালে। ১৯৮০ সালে পৃথিবীকে স্মল পক্স মুক্ত বলে ঘোষণা করা হয়েছে।
চিকেন পক্স বা জল বসন্ত অনেকটা স্মল পক্সের মতো রোগ। কিন্তু এই রোগের মারণ ক্ষমতা একেবারেই কম। দুটি রোগের জীবাণুও আলাদা। স্মল পক্স করে ভ্যারিওলা ভাইরাস। চিকেন পক্স করে ভ্যারিসেলা ভাইরাস। কিন্তু অতীতের ভয়াবহ স্মৃতির জন্যই আজও চিকেন পক্স নিয়ে কুসংস্কারের এতো বাড়বাড়ন্ত।
এই প্রচলিত কুসংস্কারগুলিকে বিজ্ঞানের আলোয় বিচার করা যাক।
১) পক্স হলে ডিম, মাছ, মাংস ইত্যাদি আমিষ খাবার খেতে নেই।
বাস্তব ঠিক তার উল্টো। যে কোনো প্রোটিন জাতীয় খাবার আমাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে বাড়ায়। এবং রোগকে সারাতে সাহায্য করে। রোগের পরে যে দুর্বলতা থাকে সেটাকেও কমাতে সাহায্য করে।
চিকেন পক্সে যে খাবার গুলো এড়িয়ে চলা উচিৎ
অতিরিক্ত মশলাদার খাবারঃ চুলকানি ও অস্বস্তি বাড়াতে পারে।
তেল যুক্ত খাবার, ভাজাভুজি, ফার্স্ট ফুডঃ হজমের গণ্ডগোল করতে পারে।
অতিরিক্ত কার্বোহাইড্রেট যেমন চিনি গুড় মিষ্টিঃ আমাদের ইমিউনিটি কমিয়ে দেয়। ফলে রোগ জটিল আকার ধারণ করে।
২) চিকেন পক্স হলে স্নান করতে নেই।
একেবারেই ভুল ধারণা। বরঞ্চ স্নান না করলে ও পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন না থাকলে পক্সের গুটিগুলিতে সংক্রমণের ভয় থাকে।
৩) চিকেন পক্স হলে চিকিৎসকের কাছে যেতে নেই। ওষুধ খেতে নেই। ওষুধ খেয়ে রোগের প্রকোপ কমালে পরে আবার চিকেন পক্স হতে পারে।
এটাও ভুল। র্যাশ বের হওয়ার শুরু থেকে এন্টি ভাইরাল খেলে গুটি অনেক কম বেরোয়। ভোগান্তি কম হয় এবং পরবর্তীতেও নানা রকম জটিলতার সম্ভাবনা কমে। এই রোগ একবার হলে সারা জীবনই এর বিরুদ্ধে দেহের প্রতিরোধ ক্ষমতা থাকে। ওষুধ খেলেও তাই হয়।
৪) গুটি শুকিয়ে যখন বাতাসে ওড়ে তখন চিকেন পক্স সবচেয়ে বেশি ছড়ায়।
পুরোপুরি ভুল। চিকেন পক্স ছড়ায় মূলত রোগীর হাঁচি, কাশি ও শ্বাসপ্রশ্বাসের মাধ্যমে। র্যাশ বের হওয়ার পর সর্বাধিক সাতদিন রোগ ছড়ানোর ক্ষমতা থাকে। তাই সাতদিন আইসোলেশনে থাকাই যথেষ্ট।
অরিজিৎ বাবুর বাকি প্রশ্নগুলির উওরও পরবর্তীকালে দেওয়ার চেষ্টা করব।
এভাবেই বয়ে চলা ভুল ভেঙে ভেঙে,
নতুন বিশ্বাস আসে –
শরতের শিউলির মতো।