আজ সন্ধ্যেয় আকাশবাণী কলকাতায় আমার একটা সাক্ষাতকার বাজবে। শোনা হবে না। ঐ সময় আমি ট্রেনে করে টিটাগড়ে যাবো। টিটাগড়ে নেমেও শোনার সম্ভাবনা নেই। মোবাইলে এফ এম শোনাগেলেও, কলকাতা ক শোনা যায় না।
এবারই আকাশবাণীর কৌশিকবাবু জানিয়েছেন, সেট টপ বক্সে এখন রেডিও শোনার একটা ব্যবস্থা আছে। বাড়ী এসে, ও যন্ত্রটার কার্যকৌশল নিয়ে যথেষ্ট পরীক্ষা নিরীক্ষা হল। ছেলে মেয়ে ওসব বোঝে ভাল; ওরাও হার মানল। অগত্যা আদি অকৃত্রিম বন্ধু, আমার রেডিও সেট। কিন্তু এখন তো একটা প্রমান সাইজের ট্রানজিস্টার সেট আমার বাড়ীতে আছে। ওটা নিয়ে রাস্তায় বেরলে, কুকুরে তাড়া করার যথেষ্ট সম্ভাবনা আছে।
মনে পড়ে যায় আমার পুরনো ভালোবাসার মারফি বেবি ডিলাক্সকে। কলেজে ভর্তি হয়ে, বোধহয় বছরখানেক পর থেকে ঐ একটা ছোট্ট রেডিওর স্বপ্ন দেখতে শুরু করি। আমাদের ক্লাশের মানসের একটা বেবি ডিলাক্স ছিল। ওটা দেখেই শেষের শুরুটা হয়েছিল। ফাইনাল ইয়ারে গিয়ে একদিন মানসকে বলেছিলাম; ও যদি ওর পুরনো রেডিওটা বাতিল করে কখনো, আমি কিনতে চাই। ও খুবই বিরক্ত হয়েছিল ঐ কথায়। ওটা যে ওরও কতো ভালোবাসার জিনিস, সেদিন একটু আন্দাজ পেয়েছিলাম। কারো, কোন জিনিসের ওপর কতোটা ভালোবাসা থাকে, কেউ কি কোনদিন বুঝতে পারে?
তখনও ডাক্তারী পড়ার শেষ এগারো মাস বাকী। দাদাকে ঐ একটা রেডিও কিনে দেওয়ার আব্দার করেছিলাম। সেই অপরাধে আমার পড়া বন্ধ করার নির্দেশ এল, বৌদির কাছ থেকে। ভয়ংকর সিদ্ধান্তটা আমাকে জানতে হল অসহায়, দিশাহারা, একশো পঁচিশ টাকা পেনশন পাওয়া বাবার পাঠানো, মানি অর্ডার পেয়ে। জীবনের মতো দুই ভাইকে বিচ্ছিন্ন করে দিল, এক মহিলার অশ্লীল জেদ। তারপর মাতৃসমা মেজ বৌদির গয়না ব্যঙ্কে রেখে টাকা ধার নিতে হল, আমার পড়া সম্পূর্ণ করার থেকেও দিশাহারা বৃদ্ধ বাবার রাতের ঘুমটুকু ফিরিয়ে আনতে। বৈষ্ণব সন্ন্যাসীর মত বাবা, হয়তো মহিলাকে ক্ষমা করে গেছেন। আমি তো আজও সেই গুপ্ত হত্যার নির্দেশকে ভুলতে পারি না। এ হয়তো বৈষ্ণব বাবার উত্তরাধিকারকে অপমান, তবুও এ আমার চরম অক্ষমতা।
“মন কি বাত” লিখতে শুরু করেছি প্রায় আড়াই মাস হল। আমার মনের কথা, দু চারজন সমমনস্ক মানুষ পড়ছেন। তাঁদেরও নানা জনের নানান প্রতিক্রিয়া। কাউকে খুশী করার, কাউকে আঘাত দেওয়ার কোন অভিপ্রায় নেই। এই ধরনীর ধুলিমাখা পথে সাতান্ন বছর ধরে হাঁটছি। পায়ে ধুলো লেগেছে, বারবার ধুয়েও ফেলেছি। কেউ ঐ ধুলোকে, “বৈষ্ণব ভক্তজনের পদরেণু” ভেবে গড়াগড়ি দিচ্ছেন। কেউ আবার নাকে মুখোশ পরছেন। কারুর ওতে হাঁচি হয়; কেউ আবার পরম শ্রদ্ধায় কপালে তিলক লাগান। এমনকি জিভে লাগানোর মানুষেরও অভাব নেই। ধুলোকে ধুলো বলতে, আমার অন্তত কোন অপরাধ বোধ নেই।
রেডিওর গল্প বলতে গিয়ে কোথায় নিয়ে এলাম আপনাদের! ঐ স্বপ্নের বেবীডিলাক্স কিনতে পেরেছিলাম, বাঁকুড়ায় যখন আমি জুনিয়ার ডাক্তার। এখন জুনিয়াররা পয়সা জমিয়ে মোটর বাইক কেনে। তখন ঐ একটা শ দেড়েক টাকার রেডিও কিনতেও অনেক কষ্ট করে টাকা জমাতে হয়েছিল। অনেক বছর ঐ ছোট রেডিওটা আমার সাথে সাথে ঘুরেছে। মনে আছে, একদিন আজহারউদ্দিনের সেঞ্চুরী শুনেছিলাম, বম্বে রোডে ট্রাফিক জ্যামে পড়েও। সেও ঐ বেবীডিলাক্সেই। আর সেই মস্কো অলিম্পিকের হকি ফাইনাল।
গ্রামের বাড়ীতে, সন্ধেবেলা, একা একা শুনছিলাম। শেষের দিকে ক্রমশ শব্দ ক্ষীণ হয়ে আসছিল। আমি কিন্তু হাজার হাজার মাইল দূরে, মেদিনীপুরের প্রত্যন্ত গ্রামের একটা মাটির বাড়ীতে বসে, চোখ বন্ধ করে দেখতে পাচ্ছি, অলিম্পিক স্টেডিয়ামের, “কোনে কোনে মে, ভারতকা তেরঙ্গা লহরতে হুয়ে!” টান টান উত্তেজনার খেলা। শেষ মিনিটেও দেশ জিতছে চার তিনে। এবার ইংরেজ-এর ধারাভাষ্যকার উত্তেজনায় ফুটছেন। শেষ দশ সেকেন্ড বাকী; উনি শুরু করলেন কাউন্ট ডাউন। নাইন, এইট, সেভেন, সিক্স, ফাইভ….. গোল্ড! ঐ শেষ দশ সেকেন্ডে আমার হৃদকম্পন কতোতে উঠেছিল জানিনা। ওনার পাঁচ গোনার পর আর রেডিওর শব্দ কানে এসেছিল কিনা জানি না; তখন বুকে হাতুড়ি পেটানোর শব্দই কানে আসছিল। বয়সটা নেহাতই বছর চব্বিশ ছিল; আজকের বয়স হলে নিশ্চিত হার্ট আটাক হতো।
সেই বেবীডিলাক্সও কবে যেন আমাকে ছেড়ে গেল। কিন্তু রেডিও শোনার নেশা আজও কাটেনি। আমরা যারা পঞ্চাশ পেরিয়ে ষাটের কাছে এসে গেলাম, রেডিও আমাদের রক্তে মিশে আছে। জ্ঞান হওয়ার আগে থেকেই, আমাদের দুর্গাপূজা শুরু হত, এক ভোরে, আধো ঘুমে আধো জাগরণে ভদ্রবাবুর অলৌকিক উচ্চারণে, “আশ্বিনের শারদ প্রাতে…….” শুনেই। তখন গোটা গ্রামে একটা কি দুটো রেডিও। মিত্রামাসির ঢাউস রেডিওটা ঐ দিন রাত্রে আমাদের বাড়ীতেই থাকতো।
বহু বছর পরেও, বাঁকুড়ার হস্টেলের থেকে, ঐদিন ভোরে একদল ছেলে বেরিয়ে পড়েছি। ঘোষালের হাতে একটা বড় রেডিও। কয়েকজনের হাতে টর্চ। হাসপাতাল, নার্সিং হোস্টেল ছাড়িয়ে, ধানক্ষেতের আল ধরে চলেছি দারকেশ্বর নদীর দিকে। উন্মুক্ত প্রান্তরে ঐ ব্রাম্ভমুহুর্তে দশদিক আমোদিত করে ছড়িয়ে পড়ছে, বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র মহাশয়ের পবিত্র শ্লোক উচ্চারণ, ” ইয়া দেবী, সর্বভূতেসু শক্তিরূপেন সংস্থিতা”। শব্দ, ব্রহ্ম কিনা জানি না। কিন্তু শব্দ যে একটা শক্তি, এতো সাধারণ শিক্ষিত মানুষ মাত্রেই জানেন।
ঐ সকল টি ভি, মোবাইল, ইন্টারনেট বিহীন সময়ে, একটা রেডিও সেটের মাধ্যমে যে প্রবল মর্মভেদী শব্দ আমাদের চেতনাকে উজ্জীবিত করতো, আজকের বধির করা ডি জে শব্দে উদ্দাম নৃত্য করা প্রজন্ম তার মর্ম কখনোই বুঝবে না।
২০১৭-র বিশ্ব রেডিও দিবসে লেখা।