হাসপাতাল থাকলে কিছু মিছু পুজোআচ্চাও হয়|হয় বৈকি|ইমার্জেন্সির হট্টগোলের আবডালে শালুক টানিয়ে বিশ্বকর্মাকি জয় হয়|ক্রমশই বিখ্যাত হয়ে উঠতে থাকা শনির থানটাতে বারবেলার সিন্নি চাপে|বজরংবলীর লাল শরীর আর হলুদ গদার সামনে সিকি আধুলি টুকটাক পড়তে থাকে বছরভর|অথচ হোস্টেল টোস্টেল ছাড়া নিখাদ হসপিটালে সরস্বতী পুজোর দেখা মেলা ভার|সাধেকী লেখাপড়ায় মন নেই আর|দিনরাত কি সমস্যা, ব্যথা কোথায় এইসবের ফোঁকরগলে বিদ্যা আর তাঁর দেবী দুজনেই ফি বছর এবসেন্ট এখানে|
সরস্বতী পুজোর অনকলে ডিউটি দিতে দিতে ভাবছিলাম এসবই|সামনে অনেক্ষণ হাঁ করে হাই তোলা হ্যারিসন|টুকুস টাকুস করে চলছে ইমার্জেন্সি|বিকেল হবো হবো করছে|শেষ শীতের ওম টুকুর মধ্যে দুমদারাক্কা ঢুকেপড়ছে ফিনফিনে হাওয়া|ঢালু রোদে চকচক সজনে ফুলের পাতলা লাজুকতা উপুড় করে দিচ্ছে বসন্ত বসন্ত হাবভাব|ধুর ছাতা, এসময় ডিউটি ফিউটি ভাল্লাগে!
ধুম করে হ্যারিসন বন্ধ করি|তখনি তেঁনারা আসেন|হলুদ শাড়ির বয়েস বড়োজোর সতের আঠেরো|চকোলেট পাঞ্জাবীটির গালে এবারো খেবড়ো কচি দাড়ি|একি! এই বাসন্তিক বিকেলে হঠাৎ হাসপাতাল!
প্রশ্ন করি: কিরে কি হয়েছে?
হলুদ শাড়ি খুঁড়িয়ে হাঁটছে|চোখে টসটসে জল ঠিক যেরকম ক্লাসে নীলডাউনের সময় গার্জিয়ান দেখে ফেললে মুখ টুখ হয় সেরকমই কাঁচুমাচু মুখ ছেলেটির|
কিরে শুধু কাঁদবি না বলবি কি হল?
এতক্ষণে তেনার ফোঁপানি ভেদকরে ফুটে ওঠে অস্ফুট কথাটুকু|না কোনও ব্যথার কথা নয়|
‘মা বকবে …জানতে পারলে …চালাতে পারে না|ফেলে দিলো।’
এতক্ষণে বোঝা যায় বেপারটা|বাড়ি থেকে বেরিয়ে তিনি চেপেছেন চকোলেট পাঞ্জাবির চকচকে পালসার-এ|ভালোই ছিল সব|এখন পড়ে গিয়ে মচকে যাওয়া পা তিনি লুকোবেন কি ভাবে!
অভিমানের তীর যাঁর দিকে তিনি এখন আপ্রাণ চেষ্টা করছেন সামাল দিতে|..আরে কিচ্ছু হবে না|দেখা কি হয়েছে|পা টা দেখা স্যারকে|
তা আমি দেখি|খস খস ব্যথার ওষুধ|টক্সয়েড লিখতে লিখতে মনে পরে কত কি|
ঠিক এরকম না হলেও অঞ্জলির ফোঁকর গলে গোলাপ ছুঁড়ে দেওয়া নিজস্ব সরস্বতীর দিকে|প্রসাদ হাত পেতে নিতে গিয়ে আলতো ছুঁয়ে দেওয়া আরাধ্য হাতের কাঁচা হলুদ স্পর্শগুলি|কম কিছু ছিলো না সে সময়|স্মৃতি যখন আসে হুড়মুড়িয়েই আসে|লহমায় চলে যাই ক্লাস টেন|কচি গোঁফ|এটলাস সাইকেল|
দুপ্পুর থেকে দাঁড়িয়ে আছি সে আসবে|এই প্রথম তার শাড়ী|চিঠি গেছে সময়ই|বলা ভালো চিরকুট|
‘তিনটায় এস|বকুলতলায়|হলুদ শাড়ি পড়লে কেমন লাগে দেখবো|’
দাঁড়িয়ে আছি অনেক্ষণ|খুব দ্রুত পেরিয়ে যাওয়া সময়ে চোখ খুঁজছে নীল লেডিবার্ড, হলুদ শাড়ি|কাঁধের উপর গড়িয়ে আসা চুল|
সে আসেনি|বিকেল গড়িয়ে অন্ধকার নেমে এসেছে বকুলতলায়|বিবেকব্রতী সংঘের প্যান্ডেল থেকে অবিরাম ভেসে এসেছে :হাল্লো ..মাইক টেস্টিং ..হ্যালোও .|আরেকটু পরেই আমাদের পুজোয় আজকের অনুষ্ঠান এক বিরাটটট মোমবাতি প্রতিযোগিতা|হালকা হিমেল সন্ধ্যায় রাত জেগে লেখা চিঠি, ঘন ঘন চেন পড়ে যাওয়া এটলাস সাইকেল এক বুক অভিমানে আস্তে আস্তে ফিরে এসেছিলো ব্রীজের ঘাটে|সন্ধ্যার ঘোলাটে রোডলাইট চকচক করছে জলে|চূর্ণীতে ভাসিয়ে দেওয়া সেই চিঠির কথা জানতে পারেনি কেউই|কোনও দিন|পরে জানতে পারি চিরকুট পাকড়াও হওয়ায় সে বছর গৃহবন্দী ছিল সে|
হাসপাতালের ডিউটি তো আর পঞ্জিকা টিকা দেখে হয় না! অষ্টমীর সন্ধ্যা, হোলির দুপুর, কিংবা কালীপুজোর রাত পরিবার থেকে দূরে কেউ না কেউ রাত জাগে ইমার্জেন্সির ব্যস্ততায়, অপারেশন থিয়েটারের হলুদ আলোয়|মাঝে মধ্যে ফোন আসে|বাড়ি থেকে|কিগো কি খেলে আজ?
এক চিমটে আবীর কপালে লাগিয়ে দিতে দিতে জ্যোসনা মাসি কাগজের ঠোঙা থেকে লাড্ডু বের করে|একটা খান ডাক্তারবাবু|বছরকার দিন|
তারই মধ্যে এসে পরে হাঁফ ওঠা দু বছর|
নেবুলাইজেশনের পর পাঁজরের কমে আসা ডিস্ট্রেস, আস্বস্ত মা, তৃপ্তির ..আসি ডাক্তারবাবু|
একমাত্র বিশ্বকর্মা পুজোয় পরিমল মিস্ত্রীর ছুটি|সারাবছর পাথরের শিল খুঁদে খুঁদে তিনি ধার দেন|নিপুণ দক্ষতায় এঁকে দেন মাছ কিংবা ফুল, পাথুরে ক্যানভাসে|পাড়ায় পাড়ায় ভরা দুপুরে এখনো শোনা যায় তার ‘ধার করবেন? শিল ..নোড়া ….’
টেনিস এলবোর যন্ত্রণা নিয়ে সে আজ হাসপাতালে হাজির|
এইসব মিক্সার গ্লাইন্ডার, গুঁড়ো মশলার যুগে তোমার শিলনোড়া ধার চলে? ওষুধ লিখতে লিখতে প্রশ্ন করি|
সে হাসে|চলে বাবু|নাইলে বাঁইচ্যা আছি কেমনে!
ব্যথার ওষুধ|একঘেঁয়ে রেস্ট নেবার এডভাইস|এইসব গুছিয়ে নিয়ে দুপুরের ঝাঁ ঝাঁ রোদে হাসপাতালের গেট দিয়ে ধীরে ধীরে মিলিয়ে যায় পরিমল মিস্ত্রী|তাঁর পাথুরে শরীর|কাছা দিয়ে পরা ধুতি|বিশ্বকর্মার মতনই|
হাসপাতালের ইমারজিন্সির পাশে প্যান্ডেল করে পুজো হচ্ছে|শোনা যাচ্ছে: বিশ্বকর্মাকি ..জয়