মানুষটা বুঝলো, আর কিছুক্ষণ বাদে সে মরে যাবে।
ডাক্তার বদ্যি ওষুধের পালা শেষ,
পাওনা দেনার হিসেবনিকেশের আর দরকার নেই,
আগামীর স্বপ্ন আর অতীতের রোমন্থন,
দুটোই সমান অপ্রয়োজনীয়।
মানুষটা বুঝতে পারলো ,
ওর জীবনে ঘড়ি আর ক্যালেন্ডারের ভূমিকা ফুরালো।
আশ্চর্যজনক ভাবে সেই আসন্ন বিদায়ে ওর শোক নেই। উপায়ান্তরহীন বৈরাগ্যজনিত শান্তিও নেই।
একটাই পার্থিব বৈশিষ্ট্য শেষমুহূর্ত পর্যন্ত লেপ্টে রইলো মানুষটার সাথে।
কৌতুহল।
মৃত্যুর পরে কিছু থাকে কি?
আর থাকলে, থাকে কী?
মানুষটার হৃৎপিণ্ড থেমে গেলো।
ফুসফুস চিরস্থবির হলো।
নিয়মমাফিক স্টেথো বসিয়ে ডাক্তার মাথা নাড়লেন।
সাদা চাদর, দুচোখ বোজা, নাকে তুলো,
নিস্পন্দ দেহটা দেখে হাহাকার করে উঠলো
তার সাথী সন্তান ও বন্ধুরা
মানুষটা..
অবশ্য যদি অবয়বহীন চেতনাকে মানুষ বলা যায়,
হঠাৎই অনুভব করলো
এক অপার্থিব সৌরভ নিয়ে এক ঠাণ্ডা বাতাস বয়ে গেলো ওর ওপর দিয়ে,
যেন সারাজীবনের সমস্ত ক্ষততে প্রলেপ দিচ্ছে কেউ।
ওর ইহলোকের সাথীরা ঠাণ্ডা হওয়া শবের চারধারে
চুপচাপ বসে আছে,
অজস্র স্মৃতির ফোঁটা চোখের জল হয়ে বয়ে চলেছে,
ভালোবাসা আর ঝগড়ার,
কাছে আসার আর দূরে যাওয়ার,
চেয়ে না পাওয়া আর না চাইতে পাওয়ার
নানান ঢেউ ঝাপটা দিচ্ছে একেকটা মনে,
আর তার সাথে সঙ্গত দিয়ে,
তার চারদিকে গড়ে উঠছে অনুপম এক সব পেয়েছির দেশ,
গাছে গাছে রঙবেরঙের পাখি,
তাদের কলকাকলি পৃথিবীর মিষ্টতম বাদ্যযন্ত্রের চেয়েও সুমধুর,
হাত বাড়ালেই সুস্বাদু খাদ্য ও পানীয়,
ব্যথাহীন, শোকহীন রোগহীন এক জগৎ
সুখ, শুধু নিদাগ প্রশান্তি তার সমগ্র চেতনা জুড়ে,
আহা, এই তো সেই স্বর্গ.
সব গ্রন্থে বর্ণিত পুণ্যবানদের কাঙ্খিত শেষ গন্তব্য..
হঠাৎই যন্ত্রণায় কঁকিয়ে ওঠে সে,
চেতনায় কে যেন চাবুক চালালো।
এইমাত্র তার মৃত্যুর খবর পৌঁছে গিয়েছে সেই মানুষটার কাছে,
যাকে সে ভালোবেসে ঠকিয়েছিলো,
সেই মানুষটার কাছেও,
যার সাফল্যকে নিজের বলে চালিয়ে
বন্ধুত্ব পায়ের নিচে মাড়িয়ে
অবলীলায় জীবনে সে সামনে এগিয়ে গেছিলো,
দুজনের কারো সাথেই আর যোগাযোগ রাখেনি।
খবরটা পেয়ে ঠকে যাওয়া প্রেমী
হো করে হেসে উঠে বললো’ আপদ গেছে!’
প্রাক্তন বন্ধুটি আরো এক কাঠি ওপরে গিয়ে বলে উঠলো,
‘পচ এবার তুই নরকে।’
সে দেখলো ,
তার চারদিকে দাউদাউ জ্বলছে আগুন,
তার ওপরে ঢালার জন্য কড়ায় ফুটছে তেল,
কারা যেন তাকে এফোঁড়ওফোঁড় করে দিচ্ছে জ্বলন্ত শলাকায়,
কখনো ফেলে দিচ্ছে তাকে সূর্যের মতো গরম অগ্নিকুণ্ডে,
আহ.. এ যন্ত্রণার সামান্যতম অনুভব
পৃথিবীর নিষ্ঠুরতম জেলখানাতেও নেই,
ওকে কেউ ছিঁড়ছে, পোড়াচ্ছে, কাটছে, মারছে,
অন্তহীন অত্যাচারের নরকে সে অসহায় এক বন্দী ..
হঠাৎই সে বোঝে।
সে কোনো অবিনশ্বর আত্মা নয়,
দেহাতীত চেতনা নয়,
পুনর্জন্মপ্রত্যাশী আগামীর ভ্রূণ নয়,
সে শুধু স্মৃতি।
কারোর প্রেমের ও ভালোবাসার, কারোর আবার ঠিক তার বিপরীতই।
আর সেই অনুযায়ী তার স্বর্গ ও নরকে কমে বাড়ে স্থিতি।