আমি বলেন্দ্রনাথ ঘোষ। এই ঘোষবাড়ির সব চে বড় ছেলে। আমাকে ডাকনাম ধরে, বল্টু বলে ডাকার আর কেউই বাকি নেই। মা বাবা কাকা জ্যাঠা কেউ না। বাইশারির বিখ্যাত ঘোষদের বংশধর আমরা।
বহুদিন পর ভাইফোঁটা হল এককালের একান্নবর্তী এই বাড়িতে। বহুদিন আগে সেই ছোটোবেলায় হত। তারপরে সব ছড়িয়ে ছিটিয়ে গেলাম আমরা। বাহান্ন রকম আবর্তে বাহান্নবর্তী হয়ে গেলাম তুতো ভাইবোনেরা।
আমার থেকে বয়সে অনেক ছোট খুড়তুতো ভাই সল্টু সপরিবারে দিল্লি থেকে ফ্লাইটে আসছে। একটু দেরি হবে আসতে। তুতো ভাইবোনেরা সবাই আসতে পারেনি। তবু বেশ কয়েকজন এসেছে ছানাপোনা নিয়ে।
কতদিন পর আবার একসাথে হওয়া গেল। পুরোনো স্মৃতির জাবর কাটা। আর আধুনিক কালের হাল হকিকত বিনিময়। এই সব হতে হতেই শেষতম প্রজন্মের কথা উঠে এল।
এর বাচ্চা, তার নাতি নাতনি। সবার মুখ চিনি না। চেনার প্রশ্নই নেই। কিন্তু নিশ্চিত জানি ওই শিশুদের জিন ছানবিন করলে দু’চারটে নয় অনেক বেশিই মিল ধরা পড়বে আমার সাথে। একই রক্তের বংশধর আমরা।
পাঁচ ছয় থেকে বারো তেরো বছরের এই বাচ্চারা প্রায় সবাইই আধুনিক প্রযুক্তিতে খুব দড়। একেবারে নতুন বেরোনো মোবাইলের সব ফিচার আর সেটিং এদের আঙুলের ডগায়।
আমার বোন শুভ্রা বলছিল তার ছোটো মেয়ের ঘরের নাতি বিলুর গল্প। সাত বছর বয়সী সেই ওস্তাদকে নাকি মোবাইল থেকে নিরস্ত করাই মুশকিল।
– জানিস তো, ওর বাবা আর মা হাজার চেষ্টা করেও ওই ছেলের মোবাইল ঘাঁটা বন্ধ করতে পারেনি।
– সে কী, প্যাটার্ন না কী ছাতার মাথা, সে ওই পিচ্চি বাচ্চা আঁকবে কী করে? উৎসুক প্রশ্ন করে ঢাকা থেকে আসা শুভ্রার বড় মেয়ে পলি। ওর বর ও’খানে ইন্ডিয়ান এমব্যাসিতে আছে।
পলির বাচ্চাটা আর বাচ্চা নয়। বেশ বড়ই। ঢাকায় থেকেই ডাক্তারি পড়ছে, মিটফোর্ডে মানে স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজে।
শুনে গম্ভীর ভাবে শুভ্রাকে বলল, – বুঝলা দিদা, এই ছেলে আর ক’দিন পর থেকেই গার্ল ফ্রেইন্ডকে ফোন দিব তার মায়ের ফোন থেকে। চাইল্ড সাইকোলজি আইজকাল এমনই। প্যাটার্ন দ্যাখাও কেন?
শুভ্রার ছোটো মেয়ে, মানে বিলু-ওস্তাদের মা, মিলি ঠোঁট ওল্টাল।
– না রে বাবু, আমার ফোনের প্যাটার্ন সে আড়চোখে দেখেই শিখে ফেলে। ওর বাবা তাই পাসওয়ার্ড সেট করে দিয়েছে। ঘরের এক কোণায় গিয়ে আড়ালে ফোন খুলি। শয়তান ছেলে আঙুলের নড়াচড়া দেখে পাসওয়ার্ড জেনে ফেলে ফোন খুলেছে, সেদিন যখন ঘুমোচ্ছিলাম দুপুরে।
হবু ডাক্তার বলে, – মাসি, আমার এই ভাইটা তবে বড় হয়ে প্রফেশনাল হ্যাকার হবে। প্রচুর ডিমান্ড!
শুভ্রা হাসে। মেয়েদেরকে বলে, – হবে না কেন? তোদের ছোটোমামা, সল্টু তো ওই করেই পরীক্ষা পাশ করত ইশকুলে। তারই তো নাতি হয় সম্পর্কে।
– কী রকম, কী রকম? টুকত?
– নাঃ, সেই ভাবে বললে ব্যাপারটা টোকা বলতেও পারিস। নাও বলতে পারিস।
– সে আবার কী?
– ব্যাপার তার কাছে কঠিন কিছুই না। লাস্ট বেঞ্চে বসে পাঁচ বেঞ্চ আগে বসা ফার্স্ট বয় সুশীলের পেনের ডগার নড়াচড়া দেখে নিজের উত্তর লিখত। অবিশ্যি কলেজে ভর্তি হয়ে পালটে গেছিল।
শুভ্রা এ’টুকু বলেই আমাকে সাক্ষী মানে। – বল দাদা, সল্টু নিজেই এইসব গল্প করত না?
আমি অল্প হেসে বলি, – ইহারেই কয় বংশগতি। জিনের খেলা। সে পেনের ডগার নড়া দেখে লেখা আন্দাজ করত, আর এই শিশু আঙুলের নড়া দেখে পাসওয়ার্ড। এই যা তফাত।
যে’টা বলি না, আমার ঠাকুরদা ঈশ্বর রাসবিহারী ঘোষ রায় চৌধুরী দেয়ালে ঝোলানো তার ছবি থেকে, হেসে হেসে সেই কথাটা আমাকে মনে করায়।
বুড়োর শেষের দিকে কথাবার্তার ঠিক ছিল না। আমাকে চুপিচুপি বলেছিল মরার আগে, – কাউকে বলিস না দাদুভাই, আমি এই ঘোষবাড়ির কেউ না। আমার আসল বাবা পঞ্চানন হাওলাদার ছিল ঝালোকাঠির সব চেয়ে নাম করা চোর। পাঁচু চোরা। অন্ধকারের মধ্যে দেওয়াল ছুঁয়ে বলতে পারত, কোথায় সিঁদ কাটতে হবে। আমার আসল বাবা আর মা কলেরায় মরার পর আমাকে দত্তক নিল ছেলেপুলে না থাকা হরেরাম ঘোষ রায় চৌধুরী। পড়াশোনা করাল। আসলেই এই যে ঘোষ বংশ দেখিস, এই বাড়ির সবাই আসলে চোরের বংশ।
আমি দাদুর মুখ চেপে বলেছিলাম, – চুপ, চুপ!
আমি ছবির দিকে তাকিয়ে বলি, – তুমি সারা জীবন খুব সৎ ছিলে। কিন্তু তোমার মধ্যে থাকা জিনেরা কী সব অসৎ কাণ্ড করছে দেখছ দাদু?
দাদু বলে, – অসততা বলে কিছু হয় না রে বল্টু দাদা। এই বাঁচাটাই, বাঁচার লড়াইটাই সব।