হাতুড়ের হুহাকার
বিশেষজ্ঞ–(১)
আন্তর্জাতিক ভবাপাগলা মহাসম্মেলন সেরে হাতুড়ে খালপাড়ে নিজস্ব ইঁটের পাঁজার মহারাজ সিংহাসনে পাজামা গুটিয়ে ঠ্যাং তুলে’ বিড়ি পান করছিলেন। এ্যামুন সময় এ্যাক টেকো (থুক্কু, মাঝবয়সী) লেংচে লেংচে ওনার বাগে আসছিল। কাছে এসে বুকে হাত ঠেকিয়ে সে বল্লে “নমস্কার, হাতুড়ে মশয়”।
বিড়ি পানের সময় ব্যাঘাৎ অভিপ্রেত নয়। তবু হাতুড়ে বিরস বদনে প্রতিনমস্কার করেন -“মহাশয়ের কী অভিপ্রায়ে আগমন?”
মাঝবয়সী ফ্যাকাশে মুখে হাঁফাতে হাঁফাতে বলে “রক্তাল্পতা”।
হাতুড়ে টুস্কিতে বিড়ি খালের জলে বিসর্জন দিয়ে’ বলেন “ভাবসম্প্রসারণ করে’ বলুন”।
“ভাব….?” ভদ্রলোক ভেবে উঠতে পারে না “সেটা কি ভাবে সম্ভব?”
হাতুড়ে ওর ভাবগতিক দেখে’ বিষ্মিত হ’ন,এরা কি বাংলা জানে না, নাকি?আহা, সময়ের ক্রমপর্যায়ানুযায়ী বিস্তারিত বিবরণ দিন”।
মাঝবয়সী এবার জলমতি বোঝে। তারপর ধারাবিবরণী শুরু করে “আমার হাঁটুতে ব্যথা, হাড়ের ডাক্তার দেখাতাম, রক্ত পরীক্ষায় অ্যানিমিয়া দ্যাখা গেলো। মাত্র ছয় গ্রাম পার্সেন্ট হিমোগ্লোবিন।তখন হিমাটোলজিস্ট দেখালাম, শরীরে আইরণ কম আছে, আইরণ খাচ্ছি, কিন্তু হিমোগ্লোবিন বাড়ছে না” অর্থাৎ কিনা ভদ্রলোক হিমোগ্লোবিন নিয়ে হিমশিম (এখেনে হিমায়িত শিমের কথা বলা হচ্ছে না)।
হাতুড়ে লোহা খাওয়ার কথায় অ-বাক হয়ে’ থাকেন। “আপনার ইউরিক অ্যাসিড কতো?” বোধহয় বুড়ো মাল্টিপ্ল মায়ালোমার কথা ভাবছিলেন।
মাঝবয়সী পুং নিশ্চিন্ত করে “না, না, সেসব ঠিক আছে, ইউরিয়া, ক্রিয়াটিনিনও ঠিক আছে। কিন্তু আমি ঠিক নেই। দুর্বল হয়ে’ যাচ্ছি, অল্পেই হাঁফিয়ে যাচ্ছি”। দুর্বলতার প্রমাণ হিসেবে সে হাতুড়েকে ধাক্কা দিয়ে ঠেলে সরিয়ে মহারাজসিংহাসনের আর্ধেক দখল করে’ ফ্যালে। “এ্যাখন বলছে গ্যাস্ট্রোএন্টেরো দ্যাখাতে, ও হ্যাঁ আমার ডায়াবেটিস আছে, ডায়াবেটোলজিস্ট দ্যাখেন”
হাতুড়েও এ্যাতো এ্যাতো বিশেষজ্ঞের নাম শুনে’ পকেট হাৎড়ে বিড়ি বার করে’ ধরান। “পেচ্ছাপ পরীক্ষা করান”
মাঝবয়সী উজ্জ্বল হয়ে’ বলে “করিয়েছি তো!”
“কৈ দেখি?”
চলফোনে (মোবাইল) ছবি দ্যাখা যায়। পেচ্ছাপের সঙ্গে ইকটু ইকটু প্রোটিন বেরিয়ে যাচ্ছে।
হাতুড়ে ওনার চলফোনে অঙুলি লিখনে লেখেন “চব্বিশ ঘন্টার পেচ্ছাপের প্রোটিন পরীক্ষা করতে।
খবর আছে, প্রতিদিন প্রায় পঁচিশ গুণ বেশী প্রোটিন বেরিয়ে যাচ্ছে, কিডনি খারাপ হয়ে গেলে ইউরিয়া, ক্রিয়াটিনিন বাড়ে-তখন তো আর বিশেষ কিছু করার নাই। তার আগে পর্যন্ত শরীর থেকে প্রোটিন বেরিয়ে যায়। যেটা এ্যাক্কেবারেই স্বাভাবিক নয়।
বিশেষজ্ঞ–(২)
অকর্মণ্য হাতুড়ে রোদে রাঙা ইঁটের পাঁজায় বসে’ বসে’ বিড়ি খাচ্ছিলেন, কিন্তু গিলছিলেন না (বিড়ি কি কেউ খায়? দ্দুর ছাগলেও খায়না)। এমন সময় মোটামুটি দুজন ঐ পথে ইতি উতি দৃষ্টি নিক্ষেপ করতে করতে যাচ্ছিলেন। হাতুড়েকে দেখে’ আর্কিমিডিসের ইউরেকা আবিষ্কারের মতো খুশি হয়ে ওনার কাছে এসে হাজির। “এজ্ঞে, আমি এসেছি”
“দেখতেই পেলাম”
ভদ্রমহিলা বলেন “আমিও এসেছি”
“কি কারণে আপনাদের আগমন, যদি একটু জানান, তাহলে কৃতার্থ হৈ”
ভদ্রমহিলা কৃতার্থ করতে উদ্যোগপত্নী হয়ে ওঠেন। “আমার ইয়ে….মানে পটির জায়গা থেকে রক্ত পড়ছে” ভদ্রমহিলা সর্বসমক্ষে এই কথা বলে গোলাপি হয়ে’ ওঠেন।
“অতঃ কিম?”
“বিশেষজ্ঞ সার্জন দেখে বলেন, পাইলস। তিনটে আছে, বাঁধতে হবে। কিন্তু রক্ত কম আছে।আইরণ ট্যাবলেট খেতে”
হাতুড়ে কর্ণময়। মনোযোগী।
“এদিকে ওর পেটে ব্যথা, অসম্ভব দুর্বল, তাই গ্যাস্ট্রোএন্টেরো দ্যাখালাম-তা উনি বললেন কোলোনোস্কোপি করতে, শেষে আপনার এই খালপাড়ের এখানে ইয়ে করতে…”
বিশেষজ্ঞ দ্যাখানোর পরে হাতুড়ের মতামত? হাতুড়ে বাঙালির এই অদ্ভুৎ ধরণধারণ বুঝতে পারেন না। যাই হোক, যস্মিন দেশে যদাচার, কাছা তুলে নদী পার। সুতরাং হাতুড়ে হাত বাড়ান “কৈ রিপোর্ট দেখি”
রিপোর্ট দেখে তো ওনার বাক্য হরে গেল। চলফোনে সময় দেখে বল্লেন “এই মাত্র বারোটা বাজলো… এক্ষুণি গিয়ে আরেকটা হিমোগ্লোবিন, টোটাল কাউন্ট আর ডিফ্যরেন্সিয়াল কাউন্ট করান”
ভদ্রলোক বলেন “কি হয়েছে হাতুড়েমশায়?”
“আসলে… আসলে…”
ভদ্রমহিলা তাড়া দ্যান “বলে ফেলুন”
হাতুড়ে বিড়িটা ফেলে’ বলেন “আসলে টোটাল কাউন্টটা অনেক বেড়ে গেছে… প্রায় আড়াই লাখ”
“আগের ডাক্তারবাবুরা দ্যাখেন নি?”
হাতুড়ে বলেন “ওঁরা তো বিশেষজ্ঞ, কেউ অপারেশনের,কেউ বা পেটের…..এটা ওঁদের এক্তিয়ারে আসে না….”
(এটা সিএমএল, ব্লাড ক্যানসার, এবং সম্পূর্ণ নিরাময়যোগ্য)
বিশেষজ্ঞ–(৩)
হাতুড়ে একদা সঞ্ঝাকালে, শীতের কামড় থেকে বাঁচার জন্য, একটা পলিক্লিনিকের উষ্ণ আশ্রয়ে চলফোন খেলছিলেন। বাইরে বেশ উচ্চস্বরে কেউ চ্যাঁচাচ্ছে, ইসিজি করবো, ইসিজি করবো, আমার হার্টের ব্যামো। হয় গুন্ডো নয়তো কালা, নাহলে এ্যামন সুরে কেউ কথা বলে না। হাতুড়ের আবার নিজের ইচ্ছামত পরীক্ষা করা না-পসন্দ। উনি বললে তবেই পরীক্ষা নিরীক্ষা।যথারীতি কাঁচুমাচু পিসিমা অনুমতি চাইতে এসেছেন। পিসিমাকে মনে আছে? সেই যে সুন্দরী অভ্যর্থনা বালিকা-যে অবসর সময়ে কান পরিষ্কার করে, নখপুলিশ মাখে….! চিৎকার টিৎকার শুনলে হাতুড়ের হৃদস্পন্দন দ্রুততর হয়, শরীরে ঘাম হয়, পেট গুড়গুড় করে, হাঁটু কাঁপে (অর্থাৎ উনি ভয় পান-অ্যাস্টেরিক্স ও নর্ম্যান দস্যু দ্রষ্টব্য)। হাতুড়ে ইসিজি করতে বলে নিশ্চিন্ত হ’ন।
অবশেষে খোঁচাদাড়ি এক বৃদ্ধ আর কলপচুলো তাঁর বৌ এসে বসেন। “আমার হার্টের রোগ আছে….অনেক দিন ওষুধ খাচ্ছি…”
“কী অসুবিধে হয়?” প্রশ্নটা ওনার সঙ্গিনী বৃদ্ধাকে করা হয় (ছোটবেলায় সজারু কামড়েছিলো তাই হাতুড়ের গলার জোর কম, চ্যাঁচাতে পারেন না) কিন্তু ঘটনা অবিশ্বাস্য হলেও বৃদ্ধ শুনতে পান।
“হাঁটতে গেলেই আমার শ্বাসকষ্ট হয়, দোতলায় উঠলেই মুখচোখ ফেটে আসে, দম খৎম হয়ে এ্যাকেবারে সিঁড়িতেই বসে পড়ি”
“আর কিছু কষ্ট হয়?”
“শুয়ে থাকলেই ঠিক থাকি, একদম হাঁটতেই পারি না”
সঙ্গিনী বলেন “সকালে উঠে ও খুব কাশে, সাতেরো হাজার পেনশন, ভাসুর অক্ষম, এক মেয়ে বেকার…..ঐ সব টেস্ট কিভাবে করবো?”
হাতুড়ে বুড়োর সব জামা, সোয়েটার খুলিয়ে বুকে স্টেথোস্কোপ বসালেন। ব্রঙ্কিয়াল ব্রেথ সাউন্ড, অবরে সবরে ঘড়ঘড় শব্দ।ইসিজি স্বাভাবিক। বুড়ো জামা পরতে লাগলো, হাতুড়ে লিখতে।
“এটা এম্ফাইসিমা, হয়তো বংশে কারো ছিলো। শুলে হাঁফানির মতো শ্বাসকষ্ট হবে না, বরং আরাম পাবেন। তবে হার্টের কিছু নেই বলেই মনে হচ্ছে। ওষুধ খেলে কিছুদিন ঠিক থাকবেন, তারপর আবার আসতে হবে।
হাতুড়ের আফিহেন সেবনের সময় হয়ে গেছে। উনি বিদায় নিলেন।