তৃতীয় পর্ব—যে সব ইঁদুর ‘কাটা লেজ’ নিয়ে জন্মাল
২০১৪ সালে একটি মেডিক্যাল জার্নালে এক গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয় (তথ্যসূত্র ১)। ধেড়ে ইঁদুর বা rat নিয়ে গবেষণা। পরীক্ষার উদ্দেশ্য হল গর্ভাবস্থায় ‘স্ট্রেস’ বা চাপের ফল বিচার।
গবেষকরা কয়েকটি গর্ভবতী মেয়ে ইঁদুরকে সাতদিন ধরে প্রতি দিন কুড়ি মিনিট একটা ছোট জায়গায় আটকে রাখেন, আর পাঁচ মিনিট ধরে জলের মধ্যে তাদের সাঁতার কাটতে বাধ্য করেন। এইভাবে তাদের ওপর ‘স্ট্রেস’ সৃষ্টি করা হয়। তারপর দেখা হয় তাদের বাচ্চা নির্দিষ্ট সময়ের আগে জন্মাচ্ছে কিনা, এবং গর্ভাবস্থায় তাদের ওজন বৃদ্ধি ঠিকমত হয়েছে কিনা। তাদের আচরণ স্বাভাবিক কিনা সেটাও পর্যবেক্ষণ করা হয়। এছাড়া এই ইঁদুরদের রক্তের গ্লুকোজ এবং কর্টিকোস্টেরয়েড হরমোন মাপা হয়। কর্টিকোস্টেরয়েড হরমোনকে চলতি কথায় স্ট্রেস হরমোন বলে। স্ট্রেসের ফলে মানুষের বা ইঁদুরের রক্তে কর্টিকোস্টেরয়েড হরমোন বেড়ে যায়, গ্লুকোজও বেড়ে গিয়ে ডায়াবেটিসের লক্ষণ দেখা যেতে পারে। এছাড়া ইঁদুরদের বাচ্চাদের জন্মকালীন ওজন মাপা হল, ও প্রথম একমাস বয়স পর্যন্ত সেই ওজন কতটা বাড়ে তাও দেখা হল।
ফলাফল যা আশা করা হয়েছিল তাই হল। স্ট্রেসের ফলে ইঁদুরদের নির্দিষ্ট সময়ের আগেই বাচ্চা হয়ে গেল, আর বাচ্চাদের পুষ্টি কম হল। মা-ইঁদুরদের গর্ভাবস্থায় ওজন যথেষ্ট বাড়ল না। তাদের আচরণ অস্বাভাবিক হয়ে উঠল। তাদের রক্তে গ্লুকোজ এবং কর্টিকোস্টেরয়েড হরমোন বেড়ে গেল। বাচ্চাদের জন্মকালীন ওজন কম হল এবং প্রথম একমাস বয়স পর্যন্ত সেই ওজন বৃদ্ধিও কম হল।
এগুলো কোনোটাই অপ্রত্যাশিত ছিল না। এর আগে ইঁদুর নিয়ে এরকম অনেক পরীক্ষা হয়েছে, গিনিপিগ ইত্যাদি অন্য জীব নিয়েও পরীক্ষা হয়েছে। দেখা গেছে গর্ভাবস্থায় স্ট্রেসের ফল এরকমই হয়। এমনকি মানুষের ক্ষেত্রেও আমরা জানি, গর্ভাবস্থায় স্ট্রেস হলে একই ধরণের নানা সমস্যা হয়। তাই ধাত্রীবিদ্যার চিকিৎসকেরা গর্ভাবস্থায় মায়েদের স্ট্রেস এড়িয়ে চলতে বলেন।
তাহলে এই পরীক্ষার বিশেষত্ব কোথায়? বিশেষত্ব এখানেই যে, এই পরীক্ষায় স্ট্রেসযুক্ত ইঁদুরের মেয়ে ও নাতনিদেরও খুব যত্ন নিয়ে পর্যবেক্ষণ করে দেখা হয়েছে। দেখা গেছে যে, মেয়ের প্রজন্ম বা নাতনির প্রজন্ম যখন বড় হয়ে গর্ভবতী হচ্ছে, তখনও তাদের গর্ভাবস্থায় একই সমস্যা হচ্ছে। তাদের তাড়াতাড়ি বাচ্চা হয়ে যাচ্ছে, গর্ভাবস্থায় ওজন কম বাড়ছে, আচরণ অস্বাভাবিক হচ্ছে। এবং তাদের রক্তে গ্লুকোজ এবং কর্টিকোস্টেরয়েড হরমোন বেড়ে যাচ্ছে। সদ্যোজাত বাচ্চাদের জন্ম-ওজন কম, ওজনের বৃদ্ধিও কম হচ্ছে।
মনে রাখতে হবে, পরবর্তী প্রজন্মের ইঁদুরদের গর্ভাবস্থায় কোনও স্ট্রেস হয়নি। তাহলে এর ব্যাখ্যা একটাই। গর্ভাবস্থায় রক্তে গ্লুকোজ এবং কর্টিকোস্টেরয়েড হরমোন বেড়ে যাবার মত নানা প্রবণতা যেন ‘বংশগত’ হয়ে গেছে। পারিভাষিক শব্দে বললে, একটি অর্জিত বৈশিষ্ট্য ‘বংশগত’ হচ্ছে!
ভাইজম্যান ইঁদুরের ওপর পরীক্ষা করে ১৮৮৮ সালে দেখিয়েছিলেন, অর্জিত বৈশিষ্ট্য বংশগত হতে পারে না। সেই ইঁদুরের ওপরেই কিনা আরেক পরীক্ষা ১২৬ বছর পরে দেখিয়ে দিল, অর্জিত বৈশিষ্ট্য বংশপরম্পরায় যেতে পারে! ইতিহাসের পরিহাস বলব নাকি? তাহলে কি ল্যামার্ক ঠিক বলেছিলেন?
ইঁদুরের রক্তে গ্লুকোজ এবং কর্টিকোস্টেরয়েড হরমোন গর্ভাবস্থায় বেড়ে যাবার প্রবণতা এক প্রজন্ম থেকে অন্য প্রজন্মে যায় কোন প্রক্রিয়ায়?
হল্যান্ডের ক্ষুধার্ত শীতের শিশুগুলির ক্ষেত্রে আমরা দেখেছি, মায়ের গর্ভে থাকাকালীন গর্ভের পরিবেশ শিশুর জিনকে প্রভাবিত করতে পারে। পরিবেশ জিনকে প্রভাবিত করে, কিন্তু কোষের মধ্যেকার জিনের মূল গঠন তাতে বদলে যায় না। কিছু জিন, বা বলা উচিৎ কিছু জিনের উপাদান ডিএনএ, রাসায়নিকভাবে সামান্য পরিবর্তিত হয়ে যায়। কিন্তু সেই পরিবর্তন (মেথিলেশন) পরের প্রজন্মের জিনে পৌঁছায় না।
হিউম্যান জিনোম প্রজেক্ট ও তারপরের নানা প্রযুক্তিগত উন্নতি হবার ফলে এখন আমরা যে কোনও প্রাণীর সমস্ত জিনের গঠন সরাসরি জানতে পারি। হল্যান্ডের ক্ষুধার্ত শীতের শিশুগুলির সঙ্গে অন্যদের জিনগত ফারাক খুঁজে পাওয়া যাবে না। তাদের ডায়াবেটিস, হার্টের রোগ বা স্থূলত্বের জন্য দায়ী হল কিছু জিন যারা শিশুদের জন্মের আগেই ‘সুইচ অফ’ হয়েছিল। তেমনই ২০১৪ সালে যেসব ইঁদুর নিয়ে পরীক্ষা করা হয়েছিল, তাদের জিনের গঠনে কোনও পরিবর্তন হয়নি। তাদের জন্মের আগেই কিছু জিনের কার্যকারিতা বদলে গিয়েছিল। ফলে তাদের রক্তে গ্লুকোজ ও কর্টিকোস্টেরয়েড হরমোন বংশপরম্পরায় বেড়ে যায়।
আমরা আগে দেখি সাধারণ ইঁদুরের ক্ষেত্রে স্ট্রেসের ফলে কী হয়।
স্ট্রেসে রক্তে কর্টিকোস্টেরয়েড হরমোনের মাত্রা বেড়ে যায়, আর স্ট্রেস দূর হবার পরে কর্টিকোস্টেরয়েডের মাত্রা স্বাভাবিকে নেমে আসে। নামিয়ে আনার কাজটির জন্য মস্তিষ্কের একটি অংশের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। গর্ভবতী ইঁদুরের স্ট্রেসের ফলে শরীরে কর্টিকোস্টেরয়েড হরমোনের মাত্রা বাড়ে। এই হরমোনের প্রভাবে তাদের আগেভাগে বাচ্চা জন্মায় ও বাচ্চার মস্তিষ্কের কিছু অংশ অপরিণত থাকে। মস্তিষ্কের যে অংশটা স্ট্রেস কমলে কর্টিকোস্টেরয়েডের মাত্রা স্বাভাবিকে নামিয়ে আনার কাজটি করে, সেই অংশটিই এই ইঁদুর বাচ্চাদের ক্ষেত্রে অপরিণত থাকে। ফলে এই ইঁদুর বাচ্চাদের শরীরে কর্টিকোস্টেরয়েডের মাত্রা একবার বেড়ে গেলে চট করে নামতে চায় না। গড়ে তাদের এই হরমোনের মাত্রা স্বাভাবিকের চাইতে বেশি থাকে। এই বাচ্চারা বড় হয়ে যখন নিজেরা গর্ভবতী হয়, তখনও তাদের রক্তে কর্টিকোস্টেরয়ডের মাত্রা বেশি থাকে। ফলে তাদের পেটের বাচ্চাদের মস্তিষ্কের একই অংশ একই ভাবে অপরিণত থাকে। ফলে সেই বাচ্চাদের রক্তে কর্টিকোস্টেরয়েড মাত্রা বেশি থাকে। এইভাবে বংশানুক্রমে শরীরে কর্টিকোস্টেরয়েডের মাত্রা বেশি হয়ে যায়। মনে হয় এটা যেন বংশগত বৈশিষ্ট্য।
আমরা ১৯৮০-র দশক পর্যন্ত জেনে এসেছি বংশানুক্রমিক বৈশিষ্ট্য মাত্রেই জিনঘটিত। ফলে কর্টিকোস্টেরয়েডের মাত্রা বংশানুক্রমিক ভাবে বেশি থাকলে তাকে আমরা জিনঘটিত বৈশিষ্ট্য বলেই ভাবতাম। কিন্তু এরকম বৈশিষ্ট্য জিনঘটিত নয়। এই বৈশিষ্ট্য এপিজেনেটিক, অর্থাৎ জিনকে নিয়ন্ত্রণের ফলে উৎপন্ন বৈশিষ্ট্য। খেয়াল রাখতে হবে যে সাধারণ জেনেটিক বৈশিষ্ট্য যেখানে এলোমেলো বা রান্ডম, এপিজেনেটিক বৈশিষ্ট্য পরিবেশে খাপ খাওয়ানোর অভিমুখে, ও তা দ্রুত উদ্ভূত হয়। দ্বিতীয়ত, এ হল অর্জিত বৈশিষ্ট্যের বংশানুক্রমিক সঞ্চালন।
অনেকে বলছেন, শেষ হাসিটা তাহলে ল্যামার্ক-ই হাসলেন।
তাই কি?
হ্যাঁ, কারণ কিছু অর্জিত গুণের বংশানুক্রমিক সঞ্চালন সম্ভব।
না, কারণ আমাদের জানা অধিকাংশ অর্জিত বৈশিষ্ট্য এভাবে বংশানুক্রমিক সঞ্চালিত হতে পারে না। তাছাড়া কয়েকটি প্রজন্মের পরে এরকম অর্জিত গুণ উধাও হয়ে যায়। কয়েক প্রজন্ম পরে ‘স্ট্রেস’ পাওয়া ইঁদুরের বংশধররা অন্যদের সঙ্গে একই রকম হয়ে যায়। ফলে চেষ্টা করে যে জিরাফ গলা লম্বা করেছে, তার বংশধরদের মধ্যে লম্বা গলার বৈশিষ্ট্য যদি আসতও, তা কোনোভাবেই কয়েক প্রজন্মের পরে স্থায়ী হতে পারত না।
তবে অর্জিত বৈশিষ্ট্যের বংশানুক্রমিক সঞ্চালনের আরও নানা উপায় আছে। যেমন মায়ের ডিম্বাণুতে কিছু নির্দিষ্ট ‘ট্রান্সক্রিপশন ফ্যাক্টর’-এর অভাব গর্ভস্থ সন্তানের একটি জিনকে সক্রিয় হতে দেয় না। পরিবেশে কিছু রাসায়নিক বিষের উপস্থিতির প্রভাবে এই সব ট্রান্সক্রিপশন ফ্যাক্টরের অভাব হতে পারে। পরিবেশজনিত অর্জিত এইরকম বৈশিষ্ট্য বংশানুক্রমিক হতে পারে—এমনকি ত্রিশটি প্রজন্ম ধরে এর প্রভাব চলতে পারে।
ল্যামার্ক মৃত। ল্যামার্ক দীর্ঘজীবী হউন।
বিধিসম্মত সতর্কীকরণঃ যে ল্যামার্কবাদের মৃত্যু হয়েছে, সেই ল্যামার্কবাদের পুনরুত্থান সম্ভব নয়। এ হল জেনেটিক্সের হাত ধরে ওঠা নব্য-ল্যামার্কবাদ। তাই দিয়ে আজ থেকে সাত-আট দশক আগেকার জেনেটিক্স অস্বীকার করা ল্যামার্কবাদকে সমর্থন করার প্রচেষ্টা সম্ভব নয়।
ল্যামার্ক মৃত। এবং চিরনিদ্রায় শায়িত। কিন্ত জিন কোনও স্বরাট সম্রাট নয়। তাকে নিয়ন্ত্রণ করে পরিবেশ। আর তা প্রজন্মান্তরেও দীর্ঘ ছায়া ফেলার ক্ষমতা রাখে।
-সমাপ্ত-
চিত্র পরিচিতি
১) দেখে চিনে নেবেন
তথ্যসূত্র
১) Yao et al. BMC Medicine 2014, 12:121 Ancestral exposure to stress epigenetically programs preterm birth risk and adverse maternal and newborn outcomes. http://www.biomedcentral.com/1741-7015/12/121