(মেডিক্যাল কলেজের ক্রমবিকাশ – ১৮৪৯ থেকে ১৮৫২) – অংশ ৮
মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল (MCH) তৈরির জন্য স্বাভাবিকভাবেই বিপুল অর্থের প্রয়োজন পড়েছিল। রাজা প্রতাপচন্দ্র সিং ৫০,০০০ টাকা দিয়েছিলেন। লটারি কমিটি কলকাতার ইম্প্রুভমেন্টের জন্য লটারি করে যে অর্থ জোগার করেছিল তার একটা অংশ এই কাজে লাগে। এছাড়া, আগে একাধিকবার বলা হয়েছে, মতিলাল শীল ১২,০০০ টাকা মূল্যের মেডিক্যাল কলেজ সংলগ্ন এক খণ্ড জমি দিয়েছিলেন। কিন্তু আমরা দেখলাম ভিত্তি প্রস্তরে উৎকীর্ণ থাকল রাণী ভিক্টোরিয়া, ডালহৌসি এবং জন গ্র্যান্টের নাম। উপনিবেশিক শাসনের এটা অন্যতম বৈশিষ্ট্য যে দেশীয় যা কিছু আছে তাকে আত্মসাৎ করে নেওয়া। স্বাভাবিকভাবেই এক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম ঘটলো না। (ARMCB 1848-49, পৃঃ ৭)
এরপরেও হাসপাতাল তৈরি নিয়ে বিস্তর টালবাহনা চলেছে। সরকার অর্থ নেই বলে হাত গুটিয়ে নিয়েছে। (প্রাগুক্তঃ ৭-১২) আদতে “ফিভার হাসপাতাল” বলে যার পরিচিতি হয়েছিল তার নাম পরিবর্তিত হয়ে মেডিক্যাল কলেজে অ্যান্ড হসপিটাল হতে বেশ দীর্ঘ সময় পার করতে হয়েছে। জে আর মার্টিন প্রথম ফিভার হাসপাতাল নামটি দেন। (পৃঃ ১০) গঙ্গা দিয়ে অনেক জল বয়ে যাবার পরে ফিভার হাসপাতালের খুঁটিনাটি বোঝার জন্য যে কমিটি তৈরি হয়েছিল এবং যে কমিটির ১৮৩৭ থেকে ১৮৪৭-এর মধ্যে ৩টি রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছিল সে কমিটি “was considered to have closed its official existence on the 30th October 1847, when the Members resigned their appointment.” (পৃঃ ১২)
একটি সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় – “to name Wards after distinguished benefactors, and donodrs of sums of ten thousand rupees and upwards; and among the names suggested, were those of Sir John Grant, Mr. J. R. Martin, Pertab Chunder Singh, Sttochurn Ghosal, and Muttyloll Seal.” (পৃঃ ১২)
লাইব্রেরির বইয়ের সংখ্যা বিগত সেশন থেকে (৪০০০) বেড়ে ৪,৭০২টি হল। ডঃ গুডিভ মিডওয়াইফারি স্কলারশিপের জন্য মাসে ১৬ টাকা করে দিতেন। যারা এই স্কলারশিপের উপযুক্ত বলে বিবেচিত হত তাঁরাই মেডিক্যাল কলেজের “গুডিভ স্কলার” নামে অভিহিত হতেন। ১৮৪৯ সালের মার্চ মাসে কলেজ কাউন্সিলের হাতে গুডিভ এককালীন ৩,৬০০ টাকা দেন যাতে স্কলারশিপ চালু থাকে। (পৃঃ ১৩)
ঢাকা কলেজ থেকে একজন উজ্জ্বল ছাত্র মি. এম ডিসুজা মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি হলেন এই শিক্ষাবর্ষে। “স্টুডেন্ট অ্যাপ্রেন্টিসেস”দের মধ্য থেকে ৪ জনকে অভব্য আচরণের জন্য কলেজ থেকে বিতাড়িত করা হয়। (পৃঃ ১৪)
আউটডোর ডিসপেনসারিতে চোখের যে হাসপাতাল রিচার্ড ও’শনেসির অভিভাবকত্বে খোলা হয়েছিল সেখানে ইউরোপীয় এবং নেটিভ উভয়ধরনের রোগীর চিকিৎসাই হত। “The return of the Ophthalmic complaints treated during the year embraces almost every variety of eye disease, and thus the students have been afforded a convenient opportunity of receiving a more extended and practical course of instruction in Ophthalmic Surgery”। (পৃঃ ১৫) এই শিক্ষাবর্ষে মিলিটারি ক্লাসে ভর্তি হবার জন্য তৎকালীন আরাকান (বর্তমান মায়ানমার) থেকে ১১ জন ছাত্র আসে।
এই শিক্ষাবর্ষে অ্যানাটমি এবং ফিজিওলজি ক্লাসে মোট ১৪০টি লেকচার দেওয়া হয়েছিল যা আন্তর্জাতিক মানের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ। “The 2nd and 3rd year students and one volunteer from the first year students, were examined in Anatomy and Physiology for honors.” মেডিসিনের অধ্যাপক তাঁর রিপোর্টে জানান summer term-এ মেডিসিনের সমস্ত লেকচার শেষ করা হয়েছে, শীতের টার্মের জন্য ফেলে না রেখে। (পৃঃ ১৬)
সার্জারির ক্লাসে ছাত্রদের নিয়মিত উপস্থিতির প্রশংসা করা হয়। এর আগে লিখেছিলাম ৬ থেকে ৮ মাইল দূরত্বের গ্রামে ছাত্রদের বাসস্থান ছিল, যেখানে ঘড়ি দেখে সময় জানার কোন বালাই নেই। সে প্রসঙ্গে রিপোর্টে বলা হয় “many of them availed themselves fully (notwithstanding the inconvenience to Hindus to be present at 8 o’clock in the morning) of the opportunities of studying Ophthalmic Surgery”। এছাড়া মেটেরিয়া মেডিকা, মেডিক্যাল জুরিসপ্রুডেন্স, কেমিস্ট্রি এবং বোটানি বিভাগের সংক্ষিপ্ত রিপোর্ট রাখা হয়। (পৃঃ ১৭-১৯)
ধাত্রীবিদ্যার ক্লাস সম্পর্কে জানা যায় যে গত মার্চ মাসে ডঃ গুডিভ ইংল্যান্ড থেকে ফিরে আসার পরে তিনি আবার এই বিভাগের দায়িত্ব নিয়েছিলেন। ১৮৪৮-৪৯ সালে প্রসূতি বিভাগে ৬৭ মহিলা ভর্তি হয়েছিল। এর মধ্যে ৫৯ জনের প্রসব হয়েছিল, এবং ৮ জন প্রসূতি অপেক্ষমাণ ছিল। স্বাভাবিক প্রসব হয়েছিল ৫৪ জনের, ফরসেপস ডেলিভারি ৩ জনের, ১ জনের “by perforation”, এবং ১ জনের ক্ষেত্রে প্রসব হয়েছিল “by version”। ৫৫ জন সুস্থ হয়ে উঠেছিল, ৪ জনের মৃত্যু হয়েছিল। (পৃঃ ১৯)
যে ৫৯ জন শিশু জন্ম নিয়েছিল তাদের মধ্যে ২৮ জন ছেলে এবং ৩১ জন মেয়ে। ৫৯ জনের মধ্যে ৩৯ জন শিশু জীবিত ছিল। ৬ জন শিশু মৃত অবস্থায় (stlll-born) প্রসব হয়েছিল, ১৪ জনের জন্মানোর পরেই মৃত্যু হয়। মৃত শিশুদের বৃহদংশ অকালে জন্মেছে এবং জন্মানোর আগেই রোগাক্রান্ত ছিল। (পৃঃ ২০)
অ্যানেস্থেসিয়ার ক্ষেত্রে বলা হয়েছিল যে সাধারণভাবে এটা প্রয়োগ করা হয়না। কিন্তু যেসব ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা হয়েছে সেসব ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য সুবিধে পাওয়া গেছে। “Chloroform was the medicine used in every instance except one, in which Ether was given, because none of the former was at hand. On all these occasions the petients were delivered without consciousness, and in none was the slightest bad symptoms perceptible as the result of the hypnotic agent.” (পৃঃ ২০)
গুডিভ তাঁর রিপোর্টে একথাও জানান যে তাঁর সাথে ইংল্যান্ড থেকে একই সঙ্গে গোপালচন্দ্র শীল ফিরে আসেন। তিনি রেসিডেন্ট সার্জনের দায়িত্বভার নিয়েছিলেন। কিন্তু তাঁকে পাঞ্জাব অভিযানে সামরিক বাহিনীর সাথে পাঠানো হয়েছিল। (প্রাগুক্ত) সে বছরের মিডওয়াইফারি স্কলার ছিলেন নবীনচন্দ্র বোস। (পৃঃ ২১)
একজন সাবঅ্যাসিস্ট্যান্ট সার্জনের (মেডিক্যাল কলেজ থেকে পাস করা গ্র্যাজুয়েট) ৭ বছর পর্যন্ত চাকরির ক্ষেত্রে মাসিক ১০০ টাকা মাইনে ধার্য হয়েছিল। ৭ থেকে ১৪ বছর পর্যন্ত মাসিক ১৫০ টাকা। এবং ১৪ থেকে তদুর্ধ বছরের চাকরির জন্য ধার্য হয়েছিল মাসিক ২০০ টাকা মাইনে। (পৃঃ ৩০)
এরপরে ২৭ জানুয়ারি, ১৮৪৯-এ গভর্নমেন্ট গেজেটের বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী এই মাইনে কিছুটা বেড়ে যথাক্রমে ১০০ টাকা, ১৫০ টাকা এবং ২৫০ টাকা হয়। (পৃঃ ৩১)
মেডিক্যাল কলেজের ইতিহাস নিয়ে এই দীর্ঘ আলোচনার গোড়ার দিকে বলেছিলাম যে শিক্ষাক্রমে সবসময়েই জোর দেওয়া হয়েছিল মেধা, যোগ্যতা এবং কৃতিত্বের ওপরে। সেকথাই এই রিপোর্টে আরেকবার বলা হল ভিন্ন প্রেক্ষিতে – “Mere seniority will, in instance, constitute in itself a claim to promotion, and it is distinctly to be understood that high attainments “whether the result of eminent talent or of laborious industry” … will give such claim at any time”। (পৃঃ ৩২) এর পরিণতিতে মধুসূদন গুপ্ত এবং শিবচন্দ্র কর্মকার সাবঅ্যাসিস্ট্যান্ট সার্জনের “first and second ranks”-এ উন্নীত হন। (প্রাগুক্ত)
বার্ষিক রিপোর্ট ১ অক্টোবর, ১৮৪৯ থেকে ৩০ সেপ্টেম্বর ১৮৫০ (GRPI 1849-50)
GRPI 1849-50 থেকে শুরুতেই জানা যাচ্ছে মিলিটারি ক্লাসে দুজন দেশীয় শিক্ষকের নাম – পণ্ডিত মধুসূদন গুপ্ত (Superintendent and Lecturer on Anatomy and Surgery) এবং সাব-অ্যাসিস্ট্যান্ট সার্জন শিবচন্দ্র কর্মকার (Teacher of Medicine and Materia Medica)। ফিমেল অ্যান্ড লায়িং-ইন হসপিটাল-এর রেসিডেন্ট সার্জন ছিলেন প্রসন্নকুমার মিত্র এবং “গুডিভ স্কলার” দীননাথ দাস।
এ বছরে ইংলিশ ক্লাসে ছাত্রসংখ্যা বেড়ে ৯৫ জন হয়। এর মধ্যে স্টাইপেন্ডিয়ারি ছাত্র ৩৮ জন, ফ্রি এবং সিংহলী ছাত্র ৪৯, রবার্টসন স্কলার ১, এবং সাবঅর্ডিনেট মেডিক্যাল ডিপার্টমেন্টের ৭ জন। হিন্দুদের মধ্যে বিভিন্ন জাতের ছাত্ররা ছিলেন – ব্রাহ্মণ ১৫, বৈদ্য ৮, কায়স্থ ২৪, তাঁতী ৩, নাপিত ৪, কামার ২, এবং কৈবর্ত্য ৩ জন। একটি নোটে জানানো হয়েছিল সেশনের শুরুতে ছাত্রের সংখ্যা ছিল ১২০ জন। পরবর্তীতে এর মধ্যে ২ জন মারা যান, ১১ জন কলেজ ছেড়ে যান এবং ১২ জনকে অনিয়মিত হবার দরুন কলেজ থেকে নাম কেটে দেওয়া হয়। (GRPI 1849-50, পৃঃ ১২০)
এই সময় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির তরফে পাঞ্জাব দখলের জন্য সামরিক অভিযান চলছিল (১৮৪৮-৪৯), সে অভিযানে, এর আগে দেখেছি গোপালচন্দ্র শীল সাব-অ্যাসিস্ট্যান্ট সার্জন হিসেবে সামরিক বাহিনীর সাথে গিয়েছিলেন। এই রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে ২১ জন পাস করা নেটিভ ডাক্তার এই অভিযানের শরিক হয়েছেন। (প্রাগুক্ত)
নীচে কতসংখ্যক ক্লাস হয়েছে, ক্লাসে সমগ্র শিক্ষাবর্ষে ছাত্রদের হাজিরা কিরকম এবং কত সংখ্যক ডিসেকশন হয়েছে তার টেবিল দিচ্ছি। এই টেবিল থেকে বোঝা যাবে ডিসেকশনের জন্য মোট ৬২৩টি দেহ সংগৃহীত হয়েছিল। প্রকৃত ডিসেকশন হয়েছিল ১৯৬টি এবং আরেকটি অর্ধেক দেহ। মৃতদেহের ওপরে অপারেশন শেখার জন্য ব্যবহৃত হয়েছিল ১০৯টি দেহ। পরীক্ষার জন্য লেগেছিল ৩২টি দেহ। এবং সবচেয়ে বেশি সংখ্যক শবদেহ ব্যবহার না করতে পারা ও উপযুক্ত রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে পচে গিয়েছিল। সে সংখ্যা ২৮৫-র বেশি। (পৃঃ ১২১)
আজ ভাবতে কষ্টকর মনে হতে পারে – কত সহজে কলকাতায় দরিদ্র, নিরাশ্রয়, নাম-গোত্র-পরিচয়হীন মানুষদের কোনরকমের অধিকারহীন দেহ এত সহজে পাওয়া যেত এবং যতগুলো দেহ শিক্ষার কাজে লেগেছে প্রায় সমসংখ্যক দেহ পচেগলে নষ্ট হয়েছে। এত সহজভাবে অপচয়ও এখানে করা যেত। অথচ সরকারের তরফে যথেষ্ট পরিমাণ অর্থ নেই বলে মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের কাজ বেশ কয়েকবছর পেছিয়ে গেছে। মানুষের অপচয় হলেও আর্থিক “অপচয়” করার ইচ্ছে উপনিবেশিক সরকারের ছিলনা।
১৮৪৯-৫০ সালের শিক্ষাবর্ষের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হয় ১৫ জুন, ১৮৪৯, শুক্রবার বিকেল ৫টার সময়ে। উদ্বোধনী বক্তৃতা রাখেন সার্জারির অধ্যাপক রিচার্ড ও’শনেসি। রিপোর্টে বলা হচ্ছে – “among the prominent points of interest referred to, were the extraordinary success of some of the graduates of the College in the performance of the formidable operation of lithotomy, and the valuable results which had followed the introduction of chloroform into the practice of surgery.” (পৃঃ ১২২)
এরপরে বেথুনের একটি দীর্ঘ অলঙ্কারময় বক্তৃতা ছিল। সে বিষয়ে বিস্তৃত কোন আলোচনা বাহুল্য। এখানেই রোমহর্ষক আলঙ্কারিক ভাষায় মধুসূদন গুপ্তের প্রথম ডিসেকশনের বর্ণনা দেন (যদিও আমি এ লেখার প্রথম দিকে এ নিয়ে আমার আপত্তির কথা জানিয়েছি)।
১৮৪৮-এর নভেম্বরে মেডিসিনের অধ্যাপক ডঃ জ্যাকসন কলেজ ছেড়ে দেন। ডঃ মোয়াট তাঁর স্থলাভিষিক্ত হন মেডিসিন এবং ক্লিনিক্যাল মেডিসিনের অধ্যাপক হিসসেবে। ডঃ মোয়াট যা পড়াতেন (মেটেরিয়া মেডিকা এবং মেডিক্যাল জুরিসপ্রুডেন্স) সে পদের দায়িত্বপ্রাপ্ত হন ডঃ এডওয়ার্ড গুডিভ। এরপরে আবার পরিবর্তন হয়। ডঃ মোয়াট কলেজের সেক্রেটারির পদ, শিক্ষাবিভাগের অন্যান্য দায়িত্ব এবং নিজের গবেষণার কাজ (“requiring much reading and research”) সামলে অধ্যাপনার কাজ করতে অক্ষম বলে কলেজ কাউন্সিলকে জানান। অ্যালান ওয়েব সাগ্রহে এ দায়িত্ব নেবার জন্য সম্মতি দেন, এমনকি ৬ মাসের জন্য হলেও। এজন্য নতুন শিক্ষাবর্ষ শুরু না হওয়া পর্যন্ত তাঁকে মেডিসিনের অধ্যাপক পদে নিয়োগ করা হয়। এডওয়ার্ড গুডিভকে Descriptive and Surgical Anatomy-র অধ্যাপক করা হয়। ডঃ মোয়াট হন মেডিক্যাল জুরিসপ্রুডেন্সের অধ্যাপক। রিপোর্টে জানানো হয় “permanent arrangements will take effect from the 15th of June 1850.” হেনরি গুডিভ কলেজ থেকে ছুটি নেওয়ায় ডঃ ডানকান স্টুয়ার্ট “Professor of Midwifery” হলেন। (প্রাগুক্ত, পৃঃ ১২৬)
এই শিক্ষাবর্ষের একটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হল “Proposed comparison of the proficiency of the Pupils of the Medical Schools of Bengal, Madras and Bombay”। এজন্য ডঃ মোয়াট মাদ্রাজ মেডিক্যাল স্কুলেও পরিদর্শন এবং আলোচনার জন্য গিয়েছিলেন। “The Council requested Dr. Mouat to endeavour to induce the medical authorities of Madras to concur in the proposed competition.” এদিকে তৎকালীন বোম্বের গ্র্যান্ট মেডিক্যাল কলেজের প্রধান ডঃ মোরহেডকে এ প্রস্তাব দেওয়া হয় “who entertained it favourably, and stated his belief that the Institution over which he presided would shortly be prepared for it.” (পৃঃ ১২৭)
কিন্তু শেষ অব্দি নানা প্রশাসনিক জটিলতার কারণে এ ঐতিহাসিক ঘটনা বাস্তবায়িত হয়নি। আমরা ২৫০ বছর আগে ৩টি মেডিক্যাল কলেজের ছাত্রদের মধ্যে পারস্পরিক মেধা, অধ্যবসায়, শিক্ষার গভীরতা এবং প্রত্যুৎপন্নমতিত্বের প্রতিযোগিতা দেখার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হলাম।
এ বছরেই (১৮৫০) মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল তৈরির জন্য খননকার্য শুরু হয়েছে। সেসময়ে মেডিক্যাল কলেজের পশ্চিমদিকে অর্থাৎ এখন যেখানে বি সি রায় অ্যানেক্স বা ফরেন্সিক বিভাগ অবস্থিত সেরকম অঞ্চলে একটি পুরনো পুকুরের হদিশ পাওয়া যায়। এত বেশি রাবিশ দিয়ে সে পুকুর ভর্তি ছিল যে এজন্য কাজের গতি শ্লথ হয়ে পড়েছিল। “In addition to this, the ground itself was so soft and yielding as to render piling, with a great amount of extra masonry, necessary.” যাহোক, ক্যাপ্টেন ফ্রেজারের তত্ত্বাবধানে হাসপাতাল তৈরির কাজ চলতে থাকে। (প্রাগুক্ত)
নভেম্বর, ১৮৪৯-এ হেনরি হারি গুডিভ মিডওয়াইফারি হাসপাতালের রিপোর্ট পেশ করেন। তিনি জানান যে হাসপাতালের বর্তমান অবস্থা খুবই উৎসাহব্যঞ্জক। গতবছর থেকে রোগীর সংখ্যা “has continued to increase steadily”, এবং রিপোর্ট লেখার সময়ে হাসপাতালের ওয়ার্ডে ২০ জন প্রসূতি প্রসবের জন্য অপেক্ষা করছে। গুডিভ জানাচ্ছেন যে যদি সমগ্র হাসপাতালের পরিচালনা “if properly managed and supported, the already established utility of this Institution will rapidly advance in importance.” তাঁর অভিমত ছিল ভারতীয় জনসমাজে হাসপাতালে প্রসব করানোর ব্যাপারে আগ্রহ বাড়ছে। এবং পুরুষ ডাক্তারেরা সামাজিক প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠছে। (পৃঃ ১২৮)
ধাত্রীবিদ্যা শিক্ষার হাসপাতালে পুলিসের তরফে খ্রিস্টান রোগীদের পাঠাতো এবং তাদের খরচ পুলিস বিভাগই বহন করত। গুডিভ আরও জানাচ্ছেন যে একজন উদারমনস্ক ইংরেজ মহিলা হাসপাতালের জন্য ডঃ স্টুয়ার্টের মারফৎ ৫০০ টাকা পাঠিয়েছেন। হাসপাতালের রোগীদের বৈশিষ্ট্য বলতে গিয়ে লিখছেন – “the inmates of this Hospital are very peculiarly placed, and for the most part differ materially from the general class of patients in other Institutions for the sick in this country.” এজন্য এদের একটি বৃহদায়তন প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজন – ইউরোপীয় এবং দেশীয়দের জন্য। প্রয়োজন জামাকাপড়, বিছানার চাদর, ব্যান্ডেজ, গায়ে দেবার বস্ত্র ইত্যাদির। শুধু তাই নয়, “to encourage women to resort to the Institution for delivery, it is necessary (for the present at least) to hold out many little advantages to them, in the shape of clothes for themselves and their children when they depart, allowance for tobacco, and such like indulgences not supplied by the Hospital dietary”। (পৃঃ ১২৯)
মেডিক্যাল কলেজে ডেলিভারি করানোর ব্যাপারে প্রসূতিদের এবং তাদের বাচ্চাদের বিভিন্ন উপঢৌকন যেমন জামাকাপড় এবং তামাকের প্রস্তাব দিচ্ছেন গুডিভ। এবং প্রসবের বেশ কিছুদিন আগে যাতে হাসপাতালে ভর্তি হবার সুযোগ পায় সে প্রস্তাব রাখছেন। দুটো বিষয় এখানে আমাদের ভাবায় – (১) তামাক সেবনের প্রশ্ন যখন আসছে তাহলে প্রসূতিরা কেউই সমাজের উঁচু তলার বাসিন্দা নয়, নীচুতলায় তামাক খাবার চল ছিল, এবং (২) আমরা এর আগের কিস্তিতে দেখেছি সম্ভ্রান্ত বাড়িগুলোতে প্রসবের জন্য মেডিক্যাল কলেজ থেকে পাস করা গ্র্যাজুয়েটরা অন্দরমহলে প্রবেশের অনুমতি পাচ্ছেন, কিন্তু সেসময়ের মেডিক্যাল কলেজে অবশ্যই তারা আসছেনা।
একদিকে চিকিৎসক হিসেবে আধুনিক প্রসূতিবিদ্যার সুফল মানুষের কাছে পৌঁছে দেবার তাগিদ যেমন গুডিভের মতো ডাক্তার ও সহকারীদের মাঝে কাজ করেছে, তেমনি, অন্যদিকে, আধুনিক মেডিসিন তথা প্রসূতিবিদ্যা ভারতীয় সমাজের সর্বস্তরে জনপ্রিয় করার উপনিবেশিক তাগিদও এর মাঝে ছিল।
সেসময় মেডিক্যাল কলেজে ধাত্রীবিদ্যার হাসপাতালের জন্য মাসিক বরাদ্দ ছিল ২৫০ টাকা। এ টাকায় ভালোভাবে ডিপার্টমেন্ট চালানো সম্ভব নয় বলে গুডিভ আক্ষেপ করছেন। (প্রাগুক্ত) প্রসঙ্গত তিনি একথাও জানাচ্ছেন – “In the Madras Lying-in Hospital, the salary allowed to the matron alone is nearly as much as we receive for our whole outlay.” (প্রাগুক্ত) অর্থাৎ ভারতে আধুনিক মেডিসিনের পরিচালনার জগতে কোন একটি uniform structure ছিলনা। এজন্য মাদ্রাজে যা করা সম্ভব হচ্ছিল বা সহজ ছিল ভারতের তত্থা এশিয়ার প্রথম মেডিক্যাল কলেজে সে কাজ করা যাচ্ছিলনা। এ কারণে তিনি আরও ৫০ টাকা ভাতা বৃদ্ধির আবেদন করেন। মাদ্রাজের হাসপাতালকে এক্ষেত্রে দৃষ্টান্ত হিসবে গণ্য করছিলেন। (পৃঃ ১৩০)
এরফলে যেটা হয় তাহল “the Council have applied to Surgeon W. B. Thompson, the officer in charge of the Lying-in Hospital at Madras, for particulars regarding the expense of maintaining the Institution, which is connected with the Madras Medical School, and appears, in some respects, to be more completely organized than the corresponding department of the Medical College in Calcutta.” (পৃঃ ১৩০)
মাদ্রাজ হাসপাতালে ১৮৪৭ সালে ১১৬ জন obstetric patient ভর্তি হয়, ১৮৪৮ সালে সে সংখ্যা হয় ১৬২। ১৮৪৭ সালে ভর্তি হওয়া রোগীর ৮৭ জন দেশীয় রোগী এবং ১৮৪৮ সালে ১৩১ জন দেশীয় রোগী ছিল। সহজে বোঝা যায়, মাদ্রাজে বাংলার তুলনায় প্রাতিষ্ঠানিক প্রসবের ধারণা সামাজিকভাবে বেশি গ্রাহ্যতা পেয়েছিল। (প্রাগুক্ত)
লাইব্রেরিতে বইয়ের সংখ্যা আগের সেশনের চাইতে ১,০০০-এরও বেশি বৃদ্ধি পেয়ে ৫,২১৫টি হয়। এরমধ্যে অ্যানাটমি এবং ফিজিওলজির বই ৭৫৫, সার্জারির ৫০০, মেডিসিনের ১,৪২৬ এবং মেটেরিয়া মেডিকার ১,০৯৮। এছাড়া অন্যান্য বিষয়ের বইও ছিল। (পৃঃ ১৩১)
একটি অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেছিল student apprenticesদের ক্ষেত্রে – “their behaviour in quarters was not quite exemplary. Instigated by bad example, they preferred in body charge of misconduct against Staff Sergeant under whose control they are placed.” (প্রাগুক্ত) পরিণতিতে দুজন অ্যাপ্রেন্টিসকে কলেজ থেকে বিতাড়িত করা হয়। এর আগে যা দেখেছি – ছাত্রদের বসবাসের “ক্ষতিকর প্রভাব” থেকে মুক্ত করে কলেজের মধ্যে ইউরোপীয় মডেলে ল্যাবরেটরি তুল্য “noise-free” এবং বাইরের হস্তক্ষেপ ছাড়া একটি আদর্শ পরিবেশ গড়ে তোলার যে প্রচেষ্টা সে প্রচেষ্টা এখানে বিনষ্ট হল (একধরনের subversion বলা যায়)। প্রকৃত অর্থে শাসক শ্রেণী কোন সময়েই কোন অবস্থাতেই ছাত্রদের মধ্য থেকে লাগাতার অনুগত, বাধ্য, সুশীল নাগরিক তৈরি করে যেতে পারেনা।
শবদেহের সরবরাহ “has been more abundant than any former year, chiefly owing to the able management of pundit Masuden Gupta, lecturer on Anatomy to the Hindustani class.” (পৃঃ ১৩২) রাজানুগ্রহপুষ্ট মধুসূদন গুপ্তরা সংখ্যায় বেশি হননা, যদিও তাদের সামাজিক প্রভাব অনেক বেশি থাকে।
Descriptive and Surgical Anatomy-তে অধ্যাপক অ্যালান ওয়েব ১০০টির বেশি লেকচার দিয়েছিলেন। কেমিস্ট্রিতে রবার্টসন ৮৮টি এবং মেটেরিয়া মেডিকার অধ্যাপক ৮৫টি লেকচার দিয়েছিলেন। (পৃঃ ১৩২)
মেডিক্যাল জুরিসপ্রুডেন্সের অধ্যাপক (মেটেরিয়া মেডিকার অধ্যাপকও বটে) এডওয়ার্ড গুডিভ ৪৫টি লেকচার দিয়েছিলেন এবং প্রত্যেক শনিবার “was devoted to the practical testing of such poisonous agents as are capable of being detected by chemical analysis.” (পৃঃ ১৩৩) পুরুষদের হাসপাতাল সারাইয়ের জন্য দুমাস ধরে বন্ধ ছিল। এজন্য ক্লিনিক্যাল ট্রেইনিং ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। ধাত্রীবিদ্যার অধ্যাপক স্টুয়ার্ট জানিয়েছিলেন ছাত্রদের অগ্রগতি তাঁকে পূর্ণত তৃপ্তি দিয়েছে।
জুনিয়র ডিপ্লোমা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ ছাত্ররা হলেন – J. Kearny, বক্সী রাম, জে জে ডুরান্ট, সি র্যাডক, J. W. Breechman (Ceylon stdent), J. W. Marganout (Ceylon student), শ্রীনাথ মুখার্জি (প্রথম স্থানাধিকারী), ভোলানাথ দাস, শ্রীনাথ মুখার্জি (আরেকজন) এবং মাধবলাল সোম। স্বর্ণ পদক পেয়েছিলেন J. Kearny। পাঞ্জাব অভিযানের জন্য ২১ জন নেটিভ ডাক্তারজকে পাঠানো হয়েছিল। (পৃঃ ১৩৪)
নীচে ১৮৫০ সালের জুনিয়র ডিপ্লোমা পরীক্ষার ফলাফল দেওয়া হল। (পৃঃ ১৩৫)
বার্ষিক রিপোর্ট ১৮৫০-৫১
GRPI 1850-51-এ প্রকাশিত মেডিক্যাল কলেজের বার্ষিক রিপোর্টে দেখতে পাচ্ছি অ্যানাটমির অ্যাসিস্ট্যান্ট ডেমন্সট্রেটর পদে নিযুক্ত হয়েছেন ইংল্যান্ড থেকে ফিরে আসা দ্বারকানাথ বোস (এমআরসিএস)। ফিমেল অ্যান্ড লায়িং-ইন হাসপাতালের রেসিডেন্ট সার্জন হলেন প্রস্ননকুমার মিত্র এবং গুডিভ স্কলার ছিলেন দীননাথ বোস। (পৃঃ ৭৯)
এ সেশনে স্টাইপেন্ডিয়ারি (৫০) ও ফ্রি (৫৮) এবং রবার্টসন স্কলার (৩) ও সাবঅর্ডিনেট মেডিক্যাল ডিপার্টমেন্ট (৮) মিলিয়ে সর্বমোট ১১৯ ছাত্র ভর্তি হয়েছিল। দেশীয় ছাত্রদের মধ্যে ৯ জন মুসলিম ছাত্র এবং বাকীরা হিন্দু ছাত্র ছিল। হিন্দু ছাত্রদের জাত ভিত্তিক যে সংখ্যা দেওয়া হয়েছিল তা এরকম –
ব্রাহ্মণ – ২৩, বৈদ্য – ৮, কায়স্থ – ৩২, তাঁতী – ৪, নাপিত – ২, বেনে – ৬, কৈবর্ত্য – ২, তিলি -১, সদগোপ – ১, এবং মোদক – ১। শুরুতে ১৪৫ জন ছাত্র ভর্তি হয়েছিলেন। এদের মধ্যে ১ জন মারা যান, ৯ জন কলেজ ছেড়ে চলে যান, এবং ১৬ জনকে অনিয়মিত হবার জন্য বিতাড়িত করা হয়। (পৃঃ ৮০) এর অনেকদিন পরে ব্রিটিশ মেডিক্যাল জার্নাল-এ (২৫ মে, ১৯০৭) একটি “British Medicine in India” শীর্ষক রিপোর্টে বলা হয় – “Within the walls of hospital (পড়ুন মেডিক্যাল কলেজ) the rules of caste in which the whole system of native life is swathed, as in mummy bandages, are suspended … where was to be seen so wonderful an example of the power of medicine to break the bondage of immemorial tradition.” (পৃঃ ১২৪৬) এই সেশনে মিলিটারি ক্লাসে ৭ জন ছাত্র আসাম থেকে এবং ৮ জন ছাত্র আরাকান থেকে যোগ দেন।
আগের সেশনে ডিসেকশনের জন্য ৬২৩টি শবদেহ সংগৃহীত হয়েছিল। এই শিক্ষাবর্ষে সে সংখ্যা বেড়ে ৭২২ হয়। অর্থাৎ আরও ১০০টি অতিরিক্ত শবদেহ ডিসেকশনের ক্লাসে ব্যবহার করা হয়েছিল। মাথায় রাখতে হবে নভেম্বর, ১৮৫০ থেকে মার্চ, ১৮৫১ পর্যন্ত ডিসেকশন চলেছিল। অর্থাৎ মাত্র ৫ মাসে ব্যবহৃত শবদেহের সংখ্যা ৭২২। আবারও বলতে হয় মৃতদেহ সংগ্রহ করা কত সহজ ছিল ইংরেজের লুণ্ঠনে ছিবড়ে হয়ে যাওয়া এই হতভাগা ও দরিদ্র দেশে।
১৮৫০-৫১ শিক্ষাবর্ষ শুরু হয়েছিল ১৫ জুন তারিখে অধ্যাপক অ্যালান ওয়েবের উদ্বোধনী বক্তব্য দিয়ে। সেদিনের উদ্বোধনী ভাষণে ওয়েব যা বলেছিলেন সেটা পরে কাউন্সিল অফ এডুকেশনের অনুরোধে পুস্তিকা হিসেবে প্রকাশিত হয় – The historical relations of ancient Hindu with Greek medicine in connection with the study of modern medical science in India : being a general introductory lecture delivered June 1850, at the Calcutta Medical College (মিলিটারি অরফ্যান প্রেস, কলকাতা, ১৮৫০)। তাঁর বইয়ের নাম থেকে তিনি কি বিষয়ে বলেছিলেন তার আন্দাজ পাওয়া যায়। এছাড়া তাঁর বক্তব্যে মেডিক্যাল সায়ান্সের যে অগ্রগতি ঘটেছে তার জন্য দুটি বিষয়কে আলাদা করে গুরুত্ব দিয়েছিলেন – (১) আধুনিক যন্ত্রপাতির ব্যবহার, এবং (২) গবেষণার নতুন পদ্ধতি। তিনি বলেছিলেন – “In Europe, the Schools of Medicine generally rose up in the neighbourhood of hospitals … Clinical Experience and Morbid Anatomy are our best guides to a knowledge of disease.” (পৃঃ ২৩, নজরটান মূল লেখায়।)
তিনি তাঁর বক্তৃতায় জানালেন – “At the Native Hospital I have seen large stones crushed in the bladder, and thus removed by my former colleague Dr. JACKSON, without pain and without cutting at all; or if cutting be required the patient is first made insensible to pain by chloroform.” (The historical relations of ancient Hindu with Greek medicine, পৃঃ ২৯) সাথে এটাও জানিয়েছিলেন – “The use of chloroform and anaesthetic agents, which are universally adopted now, followed as necessarily upon the discovery of the power of animal magnetism, as did the use of the ligature to suppress bleeding”। (পৃঃ ২৭) এই “অ্যানিম্যাল ম্যাগনেটিজমের” সূত্র ধরে তিনি এই বক্তৃতায় বলেছিলেন – “In the Mesmeric Hospital, so successfully established by Government in this city under the superintendenceof Dr. Esadaille … the power of animal magnetism to render human frame absolutely insensible to pain during the most formidable operations of surgery.” (পৃঃ ২৬)
জেমস এসডেইলকে নিয়ে মেডিক্যাল কলেজের শতবার্ষিকী স্মারক গ্রন্থে আলোচনা রয়েছে – একটি সংক্ষিপ্ত প্রবন্ধ “Operations by Mesmerism” স্মারক গ্রন্থে ছাপা হয়। (Centenary, Appendix VI, পৃঃ ১৩৪-১৩৬) এ প্রবন্ধ থেকে জানা যায় মেসমেরিজম বা সম্মোহন করে ২৬১টি বেদনাহীন সার্জারি করেছিলেন তিনি। নভেম্বর, ১৮৪৬-এ ১ বছরের জন্য কলকাতার মট লেনে একটি মেসমেরিজমের হাসপাতালও তৈরি হয়েছিল। এই হাসপাতাল বন্ধ হয়ে গেলে সুকিয়া স্ট্রিটের ডিসপেনসারিতে জুন, ১৮৫১ পর্যন্ত চাকরিরত ছিলেন এসডেইল। সুকিয়া স্ট্রিটের ডিসপেনসারিতেও তিনি মেসমেরিজম প্র্যাকটিস করেছিলেন। যদিও মেসমেরিজম নিয়ে ভিন্ন মতও বেশ জোরালোভাবে ছিল। (দ্রষ্টব্যঃ Waltraud Ernst, “’Under the influence’ in British India: James Esdaile’s Mesmeric Hospital in Calcutta, and its critics”, Psychological Medicine, 1995, 25, পৃঃ ১১১৩-১১২৩) এই প্রবন্ধে বলা হয় – “Dr Mouat, a decided critic of Esdaile, was therefore likely to gain government’s sympathy when he exclaimed (after having calculated that one mesmerizer was needed for every four patients, thus necessitating in a hospital of 300 beds a mesmeric staff of 75, and a substantial additional expense of 750 rupees per month), that none of the ‘Medical Officers of reputation or experience, could conscientiously recommend the Government to continue so costly an experiment’, in particular as the outcome of the mesmeric procedure was ‘uncertain’ and ‘inadequate’.” (Ernst, “’Under the influence’ in British India”, পৃঃ ১১৭-১১৮) এরকম বিভিন্ন প্রভাবশালী মহল থেকে সমালোচনার পরে শেষ অব্দি মেসমেরিজম সম্পূর্ণত পরিত্যক্ত হয়।
যাহোক আমরা মূল প্রসঙ্গে ফিরি। এই শিক্ষাবর্ষেও শিক্ষকদের ক্ষেত্রে কিছু পরিবর্তন হল। মেটেরিয়া মেডিকা এবং মেডিক্যাল জুরিসপ্রুডেন্সে ৩৫টি করে ক্লাস নেওয়া হয়েছিল। এই সময় স্থির করা হয় “to institute a course of lectures on the latter science, which should exhibit the whole subject of Legal Medicine in a single session, as is the custom in Europe … and to afford the pupils practical instruction in the method of carrying on Medico-legal investigations”। (প্রাগুক্ত, পৃঃ ৮৩) পুলিস সার্জন ডঃ উডফোর্ডকে এক্স-অফিসিও প্রোফেসর অফ মেডিক্যাল জুরিসপ্রুডেন্স করা হয়।
এডোয়ার্ড গুডিভকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ডেপুটি অ্যাপোথেকারি পদে নিয়োগ করা হয়। ১৫ জুন ডঃ মোয়াট ওয়েবের জায়গায় মেডিসিনের অধ্যাপক হলেন। ওয়েব হলেন প্রোফেসর অফ ডেস্ক্রিপটিভ অ্যান্ড সার্জিকাল অ্যানাটমি। এসব পরিবর্তন থেকে একটি বিষয় বোঝা যায় – তখনও মেডিক্যাল কলেজের শিক্ষায় specialization শুরু হয়নি। যেকোন অধ্যাপক যেকোন সাবজেক্ট পড়ানোর অধিকারী ছিলেন।
যখনকার কথা বলা হচ্ছে সেসময় উড স্ট্রিটে একটি ঘর ভাড়া নিয়ে চোখের হাসপাতাল চালানো হত। বাংলার সরকার এসময়ে অনুমোদন দেয় যে মেডিক্যাল কলেজ সংলগ্ন অঞ্চলে এই হাসপাতাল তৈরি হবে। (পৃঃ ৮৩) মি. মার্টিনকে এক্স-অফিসিও প্রোফেসর অফ অপথ্যালমিক মেডিসিন অ্যান্ড সার্জারি করে চোখের হাসপাতালের ক্লাস শুরু হবে।
১৮৪৯-৫০ শিক্ষাবর্ষে মেডিক্যাল কলেজের ছাত্রদের সাথে মাদ্রাজ এবং বোম্বের মেডিক্যাল কলেজের ছাত্রদের মেধা, কুশলতা ইত্যাদির তুল্যমূল্য বিচার করার যে প্রস্তাব নেওয়া হয়েছিল এই শিক্ষাবর্ষে এসে দেখা গেল সেটা “was found impossible to complete the necessary preliminary arrangements this year, and the contest has therefore been postponed for the present.” (পৃঃ ৮৪) এর মধ্যে সূর্যকুমার চক্রবর্তী UCL থেকে এমডি করে ফিরে এসেছিলেন। সঙ্গে ছিল যেসব অধ্যাপকের কাছে পড়াশুনো করেছিলেন তাঁদের শংসাপত্র। ফিরে আসার পরে তিনি মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের অ্যাসিস্ট্যান্ট অধ্যাপক পদে নিযুক্ত হয়েছিলেন। (পৃঃ ৮৫)
এর মধ্যে কলেজ হাসপাতালের প্রাচীর তোলার কাজ প্রায় সম্পূর্ণ হয়ে এসেছিল। কিন্তু আউটডোরে রোগীদের সংখ্যা কমেছিল এবং হাজিরা অনিয়মিত হচ্ছিল। “To remedy this, they (ছাত্ররা) were required to attend and act as Clinical Clerks, after having served the usual term the usual term of duty at the Dispensary as Compounders and Dressers.” (প্রাগুক্ত) লাইব্রেরির বইয়ের সংখ্যা বেড়ে ৬,৫০৩টি হয়।
“Conduct of the Students of Hindustani Class” অংশে জানানো হয় “several of them were engaged in a riot with persons on the outside of the College walls, which led to the interference of the police, by whom ten of the pupils were seized and taken before the Magistrate, who punished all of them by fines.” (পৃঃ ৮৬) এরকম “বিপজ্জনক” ঘটনার প্রেক্ষিতে কাউন্সিল অফ এডুকেশন হস্তক্ষেপ করে এবং তদন্তের পরে ৬ জন স্টাইপেন্ডিয়ারি ছাত্র এবং ৪ জন ফ্রি ছাত্র “were dismissed from the school.” এ ঘটনা বাধ্য, অনুগত, সুশীল নাগরিক তৈরির ক্ষেত্রে এমন অশনি সংকেত বহন করেছিল যে লন্ডন থেকে প্রকাশিত The Medical Times and Gazette: A Journal of Medical Science, Literature, Criticism, and News (New Series, vol. 5, July 3 to December 25, 1852)-এও গুরুত্ব দিয়ে প্রকাশিত হয়েছিল। “Bengal Medical College” শীর্ষক সংক্ষিপ্ত রিপোর্টে বলা হল – “It appears necessary to enforce a strict discipline in the school, as towards the end of the session some the students were engaged in a riot with persons outside the College walls, which led to the interference of the police, whom ten of the pupils were seized and taken before the magistrate, who ounished them all of them by fines.” (Medical Times and Gazette, পৃঃ ২৫) এর আগেও আমরা ছাত্রদের তরফে উপনিবেশিক সিস্টেমের subversion করার ঘটনা দেখেছি – সিস্টেম যতই বাইরের আবর্জনাময় “নেটিভ পরিবেশ” থেকে আলাদা করে ধুয়েমুছে পরিচ্ছন্ন নাগরিক তৈরির চেষ্টা করুক না কেন। এটাই সমাজের আভ্যন্তরীন গতিময়তা, জনসমাজের ধারা।
এরকম ঘটনার প্রেক্ষিতে বিদ্যাসাগর যুক্ত হয়ে পড়েন মেডিক্যাল কলেজের সাথে – পরোক্ষে, আবার প্রত্যক্ষও বলা যায়। সমধর্মী আরেকটি ঘটনায় ছাত্রদের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন মেডিক্যাল কলজের বাংলা বিভাগের ছাত্র বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী। মেডিক্যাল কলেজের প্রিন্সিপাল বাংলা বিভাগের একটি ছাত্রকে চোর সন্দেহে পুলিসের হাতে তুলে দিয়েছিলেন। শুধু তাই নয়, বাংলা বিভাগের প্রায় সব ছাত্রকেই গালমন্দ করেছিলেন। বললেন – ইতর, ছোটলোক, চোর, বদমায়েশ। এতে অত্যন্ত অপমানিত বোধ করে ছাত্ররা। অনেকেই একসঙ্গে কলেজ ছেড়ে দেয়। এরপরে দল বেঁধে কয়েকজন এল বিদ্যাসাগরের কাছে। বিদ্যাসগর প্রথমে ওদের কথা শুনতে চাননি। কিন্তু বিজয়কৃষ্ণ যখন জাত্যাভিমানের প্রসঙ্গ উত্থাপন করলেন তখন বিদ্যাসাগর সক্রিয় হয়ে ছোটলাটের কাছে সমস্ত ঘটনা জানিয়ে চিঠি লিখলেন। যারা জাত্যাভিমানে কলেজ ছেড়েছিল তাদের অনেকেরই সংসার চলত বৃত্তির টাকায়। ছাত্রদের বৃত্তি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এখন তাদের অভুক্ত থাকার অবস্থা। তিন-চার মাস ওদের প্রায় সমস্ত খরচ জুগিয়েছেন বিদ্যাসাগর। লাটসাহেবকে বিদ্যাসাগরের লেখা চিঠির ভিত্তিতে তদন্ত হল। প্রমাণিত হল প্রিন্সিপালের দোষ। প্রিন্সিপালকে ত্রুটি স্বীকার করতে হল। (ইন্দ্র মিত্র, করুণাসাগর বিদ্যাসগর, আনন্দ, ২০১৪, পৃঃ ৪৪-৪৫)
প্রোফেসরদের রিপোর্টে ডঃ মোয়াট জানান যে “he had much reason to be satisfied with the attention and attendance of his class, that the duties of the Medical Wards of the Male Hospital were well performed by the Assistant Physician Dr. Chuckerbutty, and that the Clinical Clerks generally were regular in their attendance, and zealous in their attention to the important office assigned to them.” ডঃ এডওয়ার্ড গুডিভ জানিয়েছিলেন যে তিনি ২১টি লেকচার দিয়েছেন, তবে পরীক্ষা নেননি। এর সঙ্গে ডঃ মোয়াটের পূর্ববর্তী লেকচারগুলো যোগ করলে মোট লেকচার সংখ্যা দাঁড়াবে ৯৪টি। কেমিস্ট্রির প্রোফেসর জনান যে তিনি ৮৯টি লেকচার দিয়েছেন। এবং প্রতিটি লেকচার ক্লাসের সময় ছিল ১ ঘন্টা ১৫ মিনিট। (GRPI 1850-51, পৃঃ ৮৭)
মেটেরিয়া মেডিকার অধ্যাপক জানান – “additional lectures on Materia Medica required by the revised curriculum has produced good results, in the improved knowledge of the subject shown by the pupils at the junior diploma examination.” এছাড়া ঊল্লেখ করার মতো ছিল মেডিক্যাল জুরিসপ্রুডেন্সের রিপোর্ট। ফরেন্সিক মেডিসিনের ওপরে ২০টি লেকচার এবং টক্সিকোলজির ওপরে ২৯টি লেকচার দেওয়া হয়েছিল। এছাড়া “spent some fifty hours in examining bodies and instructing the students upon the morbid appearances of the same.” ছাত্ররা মেডিক্যাল জুরিসপ্রুডেন্সে জানাবোঝার ক্ষেত্রে বিশেষ দক্ষতা দেখিয়েছিল। (পৃঃ ৮৮)
ধাত্রীবিদ্যার অধ্যাপক ডঃ স্টুয়ার্ট জানান – “I was much pleased with the eagerness evinced by all of them to be present, and to take charge of the cases during parturion; but except to the English youths resident in or near the College, the advantage of actual experience in this department must always, I fear, be limited … (as it is necessarily is during the 5th year), inprepartion for their final examinations, and their residence in Town are at some distance from Hospital.” (পৃঃ ৮৯) পূর্ববর্তী এক রিপোর্টে ছাত্রদের বাড়ির দূরত্ব ৬ থেকে ৮ মাইল দূরত্বে গ্রামে বলা হয়েছিল। স্টুয়ার্টের রিপোর্ট থেকে মনে করা যায় অল্প কয়েকবছরের মধ্যে শহরের বৃদ্ধি ঘটেছে, গ্রাম ঢুকে পড়েছে বর্ধমান শহরের মাঝে। ফলে ছাত্ররা শহরের চৌহদ্দির মধ্যেই রয়েছে – বেশি দূরত্বে।
গুডিভ স্কলারশিপের মতো “A few such endowments in the form of of fellowships for one year after graduating, would be of immense advantage to the holders of them, and would be noble objects of competition among our passed men, pre-eminently fitting them thereafter for the public service”-এর প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। (প্রাগুক্ত) মেডিক্যাল শিক্ষার জগতে পাবলিক সার্ভিসের ধারণা, আমরা স্মরণ করতে পারব, আসতে শুরু করে নেটিভ মেডিক্যাল ইন্সটিটিউশনের পত্তনের সময় থেকে। তার আগে এ ধারণা ভারতীয় চিকিৎসার জগতে ছিলনা।
সিনিয়র ডিপ্লোমা পরীক্ষায় মোট ৮ জন পরিক্ষার্থী পাস করে। পরীক্ষক ছিলেন ৭ জন। এঁদের মধ্যে পূর্বোল্লেখিত জন গ্র্যান্ট এবং মেসমেরিক সার্জারির হোতা জেমস এসডেইলও ছিলেন। যেসব ছাত্ররা পাস করেন তাঁরা হলেন – মহম্মদ জান, জে হিন্ডার, দীননাথ দাস, উমেশচন্দ্র মিত্র, কানাইলাল সেন, গিরীশচন্দ্র পালিত, ডি রেন্টন এবং বিশ্বনাথ গুপ্ত। স্বর্ণ পদক দেওয়া হয় মহম্মদ জানকে।
মেডিসিন, সার্জারি, মেডিক্যাল জুরিসপ্রুডেন্স, এবং “Operative Surgery in the Dissecting Room”-এর রিপোর্ট একসঙ্গে সংক্ষিপ্তাকারে দেওয়া হয়। সেখানে বলা হয় – “We consider the two students, whose written answers have been handed to the Officiating Secretary of the Medical College, to be printed, as usual, in the Annua; Report, as by far the best and most deserving of the season.” (পৃঃ ৯০) স্থান সংকুলানের জন্য সে উত্তরপত্র দুটি এখানে দেওয়া গেলনা।
২৪ জন ভারতীয় ছাত্র এবং আসামের ৩ জন ছাত্র ফাইনাল পরীক্ষায় নেটিভ ডাক্তার হিসেবে পাস করেছে। প্রশ্ন আসবে – আসামকে কি তখন মূল ভারতীয় ভূখণ্ডের মধ্যে গণ্য করা হতনা? নাহলে ভারতীয় ছাত্রদের থেকে আসামের ছাত্রদের পৃথকভাবে বলা হবে কেন? (প্রাগুক্ত)
ইংলিশ ক্লাসের জুনিয়র ডিপ্লোমা পরীক্ষায় ৫ম বর্ষের (১) উমেশচন্দ্র মিত্র, (২) আমিনুদ্দিন, (৩) বিশ্বনাথ গুপ্ত, (৪) গিরীশচদ্র পালিত, (৫) কানাইলাল সেন এবং (৬) ডি রেন্টন উত্তীর্ণ হয়েছিলেন। ৪র্থ বর্ষের (১) আব্দুল হামিদ, (২) গোপালচন্দ্র পাঠক, (৩) ডব্ল্যু ই হানা, (৪) এ জে মেয়ার, এবং (৫) ডি ও’ব্রায়েন উত্তীর্ণ হন। ৩য় বর্ষের ১৩ জন ছাত্র পাস করেছিলেন। তবে যথেষ্ট পরিমাণে শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হওয়ায় অর্থাৎ আরও কিছুদিন শিক্ষার পরে এই পরীক্ষা নেওয়া উচিত বলে কলেজ কাউন্সিল এবং এডুকেশন কাউন্সিল সহমত হন। (পৃঃ ৯০-৯১)
শিক্ষাবর্ষ ১৮৫১-৫২ (সপ্তদশ বর্ষ)
মেডিক্যাল কলেজের অ্যানুয়্যাল রিপোর্ট ১৮৫১-৫২ (ARMCB 1851-52) অনুযায়ী কাউন্সিল অফ এডুকেশনে ৩ জন ভারতীয় প্রতিনিধি দেখা যাচ্ছে – রসময় দত্ত, রামগোপাল ঘোষ, এবং আশুতোষ দেব।
ইংরেজি বিভাগে যেসমস্ত বিষয় শিক্ষাতালিকায় অন্তর্ভুক্ত ছিল সেগুলো হল –
অ্যানাটমি এবং ফিজিওলজি
ডেসক্রিপটিভ এবং সার্জিকাল অ্যানাটমি
বোটানি
মেডিসিন
সার্জারি
মিডওয়াইফারি বা ধাত্রীবিদ্যা
মেটেরিয়া মেডিকা
মেডিক্যাল জুরিসপ্রুডেন্স
অপথ্যালমিক মেডিসিন এবং সার্জারি। (ARMCB 1851-52, পৃঃ ১)
মিলিটারি ক্লাসে অধ্যাপনার পদে ছিলেন মধুসূদন গুপ্ত (Superintendent and Lecturer on Anatomy), সাবঅ্যাসিস্ট্যান্ট সার্জন শিবচন্দ্র কর্মকার (Teacher of Materia Medica) এবং সাবঅ্যাসিস্ট্যান্ট সার্জন প্রসন্নকুমার মিত্র (Teacher of Medicine)।
Male Hospital-এ অ্যাসিস্ট্যান্ট ফিজিশিয়ান সুর্য গুডিভ চক্রবর্তী (সূর্যকুমার চক্রবর্তী খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বী হয়েছিলেন এবং তাঁর প্রিয় শিক্ষক গুডিভের নামকে মধ্য নাম হিসেবে ব্যবহার করা শুরু করেছিলেন), Female and Lying-in Hospital-এ রেসিডেন্ট সার্জন সাবঅ্যাসিস্ট্যান্ট সার্জন প্রসন্নকুমার মিত্র এবং গুডিভ স্কলার হিসেবে অম্বিকাচরণ চ্যাটার্জি ছিলেন। এই শিক্ষাবর্ষে ছাত্রের সংখ্যা হয়েছিল ৭৮। (পৃঃ ২)
বাংলা বিভাগের ক্ষেত্রে বলা হয়েছিল – “Native Zeminders and the Governors of Charitable Institutions shall have the privilege of sending students to be educated in the Bengali Class for subsequent employment by them. These students shall be supported by the persons recommending them.” (পৃঃ ৪-৫)
মেডিক্যাল জুরিসপ্রুডেন্সের অধ্যাপক জানিয়েছিলেন, বিগত শিক্ষাবর্ষের তুলনায় এ বছরে অনেক বেশি নিয়মিত ক্লাস হয়েছে, ছাত্রদের উপস্থিতিও বেশি ছিল এবং ১১৬টি “judicial post mortem” করা হয়েছিল। মোট ৮ জন ছাত্রকে জুনিয়র ডিপ্লোমা দেওয়া হয়েছিল। (পৃঃ ৬) সিনিয়র ডিপ্লোমা দেওয়া হয়েছিল ১৩ জন ছাত্রকে। সিনিয়র ডিপ্লোমা পরীক্ষার পরে মূল্যায়নে বলা হয় – “a fact that in itself argues much for the efficiency of the Institution, and for the diligence of the pupils, leaves indeed little room for remark on our part.” (পৃঃ ৭) একথাও বলা হল – “On the important practical subjects of Medicine and Surgery, as shown both in the written theses and oral examinations, the candidates generally afforded very gratifying evidence of careful tuition and assiduous study”। (পৃঃ ৮) লক্ষ্যণীয় বিষয় হল, এই প্রথম লিখিত পরীক্ষা না বলে “written theses” বলা হচ্ছে। এর থেকে অনুমান করা যায় যে শিক্ষার মান UCL-এর আরও কাছাকছি এবং ইউরোপের মেডিক্যাল স্কুলগুলোর তুল্য হয়ে উঠছে। জর্জ ড্যালি (যিনি আউটডোর ডিসপেন্সারিরর দায়িত্বে ছিলেন) স্বর্ণ পদক পান।
এই শিক্ষাবর্ষেই মেডিল্যাল কলেজ হাসপাতাল সরকারিভাবে খুলে দেওয়া হয় রোগীদের ভর্তি হবার জন্য – ১ ডিসেম্বর, ১৯৫২ তারিখে। কিন্তু ১ মার্চ, ১৮৫২ থেকেই রোগীরা ওয়ার্ডে ভর্তি হতে শুরু করে। (Centenary, পৃঃ ৩৮)
বিভিন্ন ওয়ার্ডের নামকরণও যারা মেডিক্যাল কলেজ তৈরির ক্ষেত্রে দান করেছেন বা ভূমিকা পালন করেছেন তাঁদের নামে করা হয়। ভারতীয় ওয়ার্ডের ক্ষেত্রে – (১) প্রতাপ সিং ওয়ার্ড (দানের পরিমাণ ৫০,০০০ টাকা), (২) সত্যচরণ ঘোষাল ওয়ার্ড (দানের পরিমাণ ১০,০০০ টাকা), এবং (৩) মতিলাল শীল ওয়ার্ড (১২,০০০ টাকা মূল্যের জমি দান করেছিলেন)। ইউরোপীয় ওয়ার্ডের ক্ষেত্রে – (৪) গ্র্যান্ট ওয়ার্ড (স্যার জন পিটার গ্র্যান্টের স্মৃতিতে), (৫) মার্টিন ওয়ার্ড (জেমস রানাল্ড মার্টিনের স্মরণে), এবং (৬) মোয়াট ওয়ার্ড। মহিলাদের জন্য – (১) গুডিভ ওয়ার্ড, এবং (২) ও’শনেসি (রিচার্ড) ওয়ার্ড (যিনি প্রথম লায়িং-ইন হাসপাতাল তৈরির ক্ষেত্রে ৩০,০০০ টাকা সংগ্রহ করেছিলেন)। (Centenary, পৃঃ ৩৭-৩৮)
হাসপাতালের বিভিন্ন খাতে যে ব্যয় করা হবে তার একটি হিসেবও দেওয়া হয়েছিল।
(১) ২ জন ফিজিশিয়ান, (২) ২ জন সার্জন, (৩) ১ জন অবস্ট্রেটিক ফিজিশিয়ান – এই তিন বিভাগের জন্য ব্যয়ের কোন হিসেব দেওয়া হয়নি।
১ জন হাউস সার্জন – মাইনে মাসিক ৩০০ টাকা
১ জন হাউস ফিজিশিয়ান – ১০০ টাকা
১ জন ইউরোপীয় অ্যাপোথেকারি – ১৫০ টাকা
১ জন ইউরোপীয় স্টুয়ার্ড – ১৫০ টাকা
১ জন হাউস সার্জন (লায়িং-ইন ওয়ার্ডে) – ১০০ টাকা
হসপিটাল এস্টাব্লিশমেন্ট, নার্স এবং ভৃত্য – ৩৯৪ টাকা
১০০ জন ইউরোপীয় রোগীর খাদ্য – ৭০০ টাকা
২৫০ জন ভারতীয় রোগীর খাদ্য – ৩০০ টাকা
আলোর ব্যবস্থা – ৪০ টাকা
আপৎকালীন খরচ – ৫০ টাকা
হসপিটাল ডিসপেন্সারি – ৭০ টাকা
আউটডোর ডিসপেন্সারি – ৭০ টাকা (Centenary, পৃঃ ৩৫)
আমরা Rules and Rugulations (1849)-এ দেখেছিলাম ভারতীয় রোগীদের খাদ্যের জন্য যেখানে দৈনিক বরাদ্দ ১ আনা, ইউরোপীয় রোগীদের ক্ষেত্রে সে বরাদ্দ দৈনিক ৪ আনা। এখানেও দেখতে পাচ্ছি – ১০০ জন ইউরোপীয় রোগীর জন্য মাসিক খাদ্য বরাদ্দ ৭০০ টাকা, অথচ ২৫০ জন ভারতীয় রোগীর জন্য সে বরাদ্দ ৩০০ টাকা।
তথাকথিত সেক্যুলার মেডিসিনের মধ্যেও জাতিগত বৈষম্য প্রকটভাবে চোখে পড়ে এবং সেটা এখনও আছে। এজন্য গবেষকদের একাংশের ব্যাখায় একে “racial medicine” বললে অত্যুক্তি হয়না। বিশেষ করে কোভিডের সময়ে আমেরিকা এবং ইউরোপে এটা ভীষণ প্রকট হয়ে এসেছে। এদেশে প্রচ্ছন্ন থেকেছে, কিংবা আমরা কোন কথা বলিনি।
Once again, a very well researched detailed article. Looking forward to more of these as history turns to the present. Well done Jayanta. These compilations will be invaluable documents.
তথাকথিত সেক্যুলার মেডিসিনের মধ্যেও জাতিগত বৈষম্য প্রকটভাবে চোখে পড়ে এবং সেটা এখনও আছে।
– অত্যন্ত সত্যি কথা –
Excellent one sir.
অষ্টম অংশে মেডিকাল কলেজের নতুন (যা আজও চালু এবং অগণিত মানুষের সম্ভ্রম আদায় করে) বাড়ীতে শুরু হওয়ার বর্ণনা করা হয়েছে। ভিত্তিপ্রস্তরে দেশীয় অনুদানদাতাদের নাম থাকল না। কিন্তু আমরা তো আর একটি প্রস্তর দৃষ্টিনন্দন জায়গায় লাগাতে পারি। তবে পুরনো প্রস্তরে রোগীদের জন্য হাসপাতাল লেখাটা বড় মন টানল।
কলকাতা, মাদ্রাজ, বোম্বাই হাসপাতালের সাফল্যের তুল্যমূল্য বিশ্লেষণ পদ্ধতি চালু হলে ভালই হত। একটা সুস্থ্য প্রতিযোগীতা থাকত, তাতে শিক্ষার মান উঁচু হত।
ছাত্র শাসন অত সহজ নয়। তাহলে তো মেরুদন্ডহীন প্রাণীরাই ছাত্র থাকবে।
মেডিকাল কলেজের আলোচনা এখন পুরো সুন্দর জায়গায় পৌঁছে গিয়েছে। নব যুগের সূচনা হয়েছে।
চমৎকার লিখছেন ডঃ জয়ন্ত ভট্টাচার্য। ধন্যবাদ জানাই আপনাকে।
ধন্যবাদ!