পশ্চিম মেদিনীপুরের মফঃস্বলে তখন নতুন প্র্যাকটিস শুরু করেছি। এক তপ্ত দুপুরে চেম্বারের ভিড়ে বছর তেরোর এক রোগা মেয়েকে নিয়ে তার বাবা এসেছেন চোখেমুখে যথেষ্ট উদবেগ নিয়ে। বাড়ি থেকে সাইকেলে স্কুলে যাবার পথে কোনো কারণ ছাড়াই মেয়ে মাঝে মাঝেই পড়ে যায়। ভিটামিন, গ্যাসের নানাবিধ ওষুধে কোনও কাজ হয় নি। আজও সাইকেলে রেল লাইন পেরোতে গিয়ে আবার পড়ে গেছে। খবর পেয়ে বাবা উদ্ধার করে আমার কাছে এনেছেন।
মেয়েটির মুখে লজ্জামিশ্রিত অজানা ভয়। সকালে কিছু না খেয়ে বেরিয়েছিলো। তাইই বিস্তর বকাঝকা খেয়ে আবারও এক নতুন ডাক্তারের কাছে বাবা ধরে এনেছেন। “বার বার বলা সত্ত্বেও কিচ্ছু না খেয়ে বেরিয়ে এসেছিলো। কথা শোনে না। এত্ত দুর্বল, এই নিয়ে সাতবার পড়লো। ভাগ্যিস রেল লাইনের ওপর পড়েনি”।
বাবার কথাগুলো শুনে মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করলাম – “পড়ে যাবার সময় মাথা ঘুরছিলো?”
মেয়েটি ঋণাত্মক ভংগিমায় মাথা নাড়ালো।
“পড়ে যাবার পর জ্ঞান হারিয়েছিলি?”
মেয়েটি কিছুটা লজ্জা ঝেড়ে ফেলে আমার দিকে তাকিয়ে বলল- “পড়ে যাবার পর আমার কিচ্ছু মনে নেই। জ্ঞান ফিরলো বাজারের লোকজন যখন চোখেমুখে জলের ছিটে দিচ্ছিলো তখন”।
বাবার দিকে তাকিয়ে বললাম- “একটা ইইজি,আর সিটি স্ক্যান ব্রেন করানো উচিত। আপাতত এই একখান ওষুধ খেতে থাকুক।আবারও হলে অবশ্যই জানাবেন।”
বাবা কি বুঝলেন জানি না। টেষ্ট করানোর খরচ শুনে মনে মনে কিছুটা রাগান্বিতই হলেন বোধহয়। প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী এখনকার ডাক্তারেরা টেষ্ট করানোতেই বেশি খুশি। নিজেদের রোগ নির্ণায়ক কোনো ক্ষমতাই নেই।
এরপর মাস দুয়েক পর ফিরে এলেন ভদ্রলোক। হাতে সি.এম.সি ভেলোরের একখান প্রেস্ক্রিপসান। দুহাত তুলে আশীর্বাদের ভঙ্গিমায় সম্ভ্রমের চোখে বললেন “আপনার কথা শুনে আরও আগে যদি ওষুধটা খাওয়াতাম তাহলে হয়তো মেয়েটা জলে ডুবে মরতে বসতোনা”।
অবাক হয়ে চোখ তুলে তাকানোর আগেই ভদ্রলোক সবিস্তারে বর্ণনা শুরু করলেন। সেদিনের লেখা ওষুধ তিনি খাওয়াননি সেটা বলাই বাহুল্য। একে কমবয়সী ডাক্তার। তার ওপর অত্ত দামীদামী টেষ্ট করতে দিয়ে অবিশ্বাসের বলি হয়েছিলাম আমি।
যথারীতি না খেয়ে দুর্বলতার তত্ত্বে বিশ্বাসী হয়ে পাড়ার ভুঁইফোড় হাতুড়ের কথা শুনে হরেক কিসিমের ভিটামিন,আর “গ্যাসের ঊর্ধ্বগতি” র ব্যাখ্যায় গ্যাসের ওষুধ খাইয়েছিলেন বিস্তর। কিন্তু কাজ কিছুই হয়নি। বরং কখনো স্কুলের প্রার্থনাসভায়,কখনও খেলার মাঠে মাঝেমাঝেই ক্ষণিকের জ্ঞান হারিয়ে উদবেগ বাড়িয়েছে মেয়ে। মিনিট দশেক পর আবার নিজে নিজেই ঠিক হয়েছে। বাবার কপালের ভাঁজ গভীরতর হয়েছে। অবশেষে বাঙ্গালীর আস্থার জায়গা সি.এম.সি. ভেলোরের শরনাপন্ন হয়েছেন তিনি। সেখানে ইইজি আর সিটি স্ক্যান (ব্রেন) করে আমার দেওয়া ওষুধটাই লিখে দিয়েছেন ওখানকার ডাক্তারবাবুরা। বাবার চোখে সম্ভ্রম এসেছে তখনই। কিন্তু লজ্জায় আর এমুখো হননি।
কিন্তু আজ পুকুরে নেমে সাঁতার জানা মেয়ে যখন সবার চোখের সামনেই তলিয়ে যাচ্ছিলো কোনওমতে বাঁচিয়েছেন মেয়েকে। ভয় পেয়েছেন বিস্তর। মেয়েকে গ্রামীণ হাসপাতালে ভর্তি করেও তাই আমার কাছে ছুটে এসেছেন সুরাহার আশায়। চোখেমুখে করুণ আর্তি।
ভেলোরের প্রেসক্রিপশনে চোখ মেলে দেখলাম ডায়াগনোসিসের জায়গায় “সিজার ডিসঅর্ডার” লেখা। যা ভেবেছিলাম তাই। ক্যাটেগরি ভাগ না করতে পারলেও ওনাদের প্রাথমিক ওষুধ হিসেবে অক্সকার্বামাজেপিন দিয়েই শুরু করেছেন। প্রোটোকল মেনে এরপর শুধু ওষুধের ডোজটুকু বাড়িয়ে দিয়ে বললাম- “সহজ ভাষায় গ্রামবাংলায় এ রোগের নাম অনেক। খিঁচুনি, তড়কা, মৃগী। অনেকে অনেক নামে ডাকলেও এ রোগের সাধারণীকৃত নাম “সিজার ডিসঅর্ডার”।
ভদ্রলোক বিস্মিত চোখে তাকিয়ে বললেন “কিন্তু আমার মেয়ের তো খিঁচুনি কখনোই হয় নি। মৃগী রোগীর তো অজ্ঞান হয়ে খিঁচুনি হয় শুনেছি”
আশ্বস্ত করে বললাম সিজার ডিসঅর্ডারের অনেকগুলো প্রকারভেদ। মৃগী বা এপিলেপ্সি তার এক প্রকার মাত্র। উদাহরণ দিয়ে বললাম – “টোনিক সিজারে যেমন শুধুই হাত পা ঘাড় খিঁচিয়ে যায়। ক্লোনিক সিজারে শরীরের মাংসপেশিগুলোর দমকে দমকে খিঁচুনি হয়। টোনিক-ক্লোনিক সিজারে দুয়েরই সমন্বয় দেখা যায়। সাধারণত এই দুই সিজারে অনেকক্ষেত্রেই রোগীর জ্ঞান থাকে না। এ্যাটোনিক সিজারে হঠাৎ দমকা দিয়ে ধরুন মাথাটা সজোরে নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে দুম করে একবার ঝুঁকে পড়লো। পরমুহূর্তেই আবার ঠিক। মায়োক্লোনিক সিজারে হঠাৎ নিজের হাতটাই নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে সজোরে বার দুয়েক ঝাঁকিয়ে উঠলো। এ্যাবসেন্ট সিজারে ক্ষণিকের অন্যমনস্কতাই একমাত্র লক্ষ্মণ। ফোকাল সিজারে শরীরের কোনোও এক প্রত্যঙ্গের শুধুমাত্র খিঁচুনি হলেও জেনারালাইজড সিজারে সমস্ত শরীরের খিঁচুনি ঘটে সাথে জ্ঞানলোপ পায়।”
ভদ্রলোক আমাকে তাড়াতাড়ি থামিয়ে বললেন “এত কিছু মনে রাখতে পারবো না। আমার মেয়ের কোন ধরনের খিঁচুনি হয়েছে তা বললেই চলবে। প্রাথমিক ভাবে কি করণীয় সেটাও যদি বলেন”।
মেয়ের কি ধরনের খিঁচুনি সেটা বুঝতে ঘটনার সময়কার ভিডিওগ্রাফি সেরা উপায়।আর খিঁচুনি হলে সাধারণত মাথাটি কোলের ওপর রেখে মুখটি একদিকে কাত করে দিন যাতে মুখনিঃসৃত লালা শ্বাসপথে ঢুকে শ্বাসরোধ না করতে পারে।খেয়াল রাখুন যাতে দাঁতকপাটির চাপে পড়ে জিভ না ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ঐ সময় মুখে ভুলেও কিচ্ছু দেবেন না।
মনে রাখবেন জেনারালাইজড টোনিক- ক্লোনিক সিজারকেই গ্রামবাংলার মানুষ মৃগী বলে জানেন। এতে সারা শরীরের খিঁচুনি হয়। অধিকাংশ সময় এই রোগীর জ্ঞান থাকে না। খিঁচুনি পর্ব শেষ হলে সারা শরীর অবশ হয়ে রোগী ঘুমিয়ে পড়ে।এই ঘুমকে চিকিৎসার পরিভাষায় “টড’স পলসি” বলে। সাধারণত এই সিজারে রোগীর খিঁচুনি ভয়ংকর এক দৃশ্যের অবতারণা করে বলে মানুষ একে সম্ভ্রমের চোখে দেখে। তাই মনেও রাখে।চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতেও দেরী করে না। সমস্যা হয় অন্যান্য সিজারগুলি নিয়ে।বেশিরভাগ ভাগ সময়েই বাকি সিজারগুলির মৃদু স্বল্পমেয়াদী প্রকাশের কারণে মিসডায়াগনিস হয় অধিকাংশ ক্ষেত্রেই।
এ ছাড়াও বাচ্চাদের উচ্চতাপমাত্রাজনিত খিঁচুনিও (ফেব্রাইল কনভালসান) আকছার দেখা যায়। সেক্ষেত্রে জ্বর বাড়তে না দেওয়াই প্রধান লক্ষ্য হওয়া উচিত।
প্রতি ক্ষেত্রেই মস্তিষ্কের অন্দরমহলে ইলেকট্রিক তারতম্যে এই রোগের প্রকাশ।
জটিল বিষয়। চিকিৎসাও দীর্ঘমেয়াদী। তাই ডাক্তারবাবুই ভরসা। তা সে ভেলোরেরই হোক বা বাংলার।