(CMC-র নতুন বিল্ডিংয়ে ক্লাস শুরু থেকে গ্র্যাজুয়েট তথা letters testimonial পাবার প্রথম পরীক্ষা – ১৮৩৬-১৮৩৮)
(মাউন্টফোর্ড জোসেফ ব্রামলে, উইলিয়াম ব্রুক ও’শনেসি এবং হেনরি হারি গুডিভের ছবি)
আমি আগের অংশে অর্থাৎ “ক্যালকাটা মেডিক্যাল কলেজের (CMC) ক্লাস শুরু এবং প্রথম ডিসেকশন – ১৮৩৫-১৮৩৬” অধ্যায়ে বলেছিলাম – একটি কলেজকে ভ্রূণাবস্থা থেকে পূর্ণত কলেজে রূপান্তরিত করার যাত্রাপথটি ঐতিহাসিকভাবে অত্যন্ত চিত্তাকর্ষক – কি ঐতিহাসিক, কি শিক্ষিত সাধারণ পাঠকের কাছে। এবং একইসাথে মাথায় রাখতে হবে গোড়ার তিনজন অধ্যাপক কি বিপুল যত্ন এবং পরিশ্রম দিয়ে এই শিক্ষালয়টিকে তিল তিল করে গড়ে তুলেছেন। ব্রামলে উচ্ছ্বসিত হয়ে ও’শনেসির এই ক্লাস এবং সেপ্টেম্বর মাসের (১৮৩৬) পরীক্ষা নিয়ে বলছেন – “I have no hesitation in saying that no chemical class in the world could have surpassed and few would have equalled the brilliant replies of these youths upon this occasion”।
বলেছিলাম – “হসপিটাল মেডিসিন”-এর ভিত্তি প্রস্তর তৈরি হল – রোগীর বেডের পাশে দাঁড়িয়ে রোগের হিস্টরি নেওয়া, মৃত্যুর পরে অটোপ্সি, এবং পরিসংখ্যান তৈরি করা – কিন্তু এর পূর্ণাঙ্গ চেহারা গঠিত হয়নি। এর জন্য আরও কিছুদিন অপেক্ষা করতে হয়েছিল। পাস করা ছাত্রদের মধ্য থেকে ক্লিনিক্যাল ক্লার্ক হত। এরা রোগীরা ওয়ার্ডে ভর্তি হলে প্রথম দায়িত্ব নিত। কেস হিস্টরি নিত। এবং প্রয়োজনে ভারপ্রাপ্ত চিকিৎসককে ডেকে পাঠাতো।
এবারে আমরা ১৯৩৬-এর ১৭ মার্চ নতুন তৈরি বিল্ডিংয়ে তিনজন অধ্যাপক – ব্রামলে, গুডিভ এবং ও’শনেসি – প্রথম “Introductory Address Delivered at the Opening of the Calcutta Medical College” দেন। বৃহৎ লেকচার থিয়েটারে (৫০০ জনের বেশি মানুষ যেখানে বস্তে পারত) স্বয়ং লর্ড অকল্যান্ড দর্শক, শ্রোতা এবং অংশগ্রহণকারী হিসেবে ছিলেন।
এই নতুন কলেজ নিয়ে ১৯ মার্চ, ১৮৩৬ তারিখে সমাচার দর্পণ পত্রিকায় “নতুন চিকিৎসা শিক্ষালয়” শিরোনামে প্রকাশিত সংবাদে জানানো হল – “এতদ্দেশীয় লোকেরদের নিমিত্ত গত বৃহস্পতিবারে নতুন চিকিৎসা শিক্ষালয়ের কার্য্য আরম্ভ হয়। তাহাতে শ্রীযুত ব্রামলি সাহেব যথোচিত বক্তৃতা করিলেন। ঐ শিক্ষালয়ে গবর্নর্ জেনরল বাহাদুর ও শ্রীলশ্রীযুত চার্লস মেটকাফ শাহেব ও বহুতর বিশিষ্ট ও বরিষ্ঠ ব্যক্তি এবং চিকিৎসালয়ের সহকারি এবং এতদ্দেশীয় ও ইউরোপীয় জনগণ উপস্থিত ছিলেন।” (ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় (সংকলিত ও সম্পাদিত), সংবাদপত্রে সেকালের কথা, দ্বিতীয় খণ্ড, ১৮৩৫-১৮৪০, পৃঃ ৩৭)
এর এক সপ্তাহ পরে, ২৬ মার্চ ১৮৩৬ তারিখে জ্ঞানান্বেষণ পত্রিকায় আরেকটি খবর প্রকাশিত হল – “গত বৃহস্পতিবারে নতুন মেডিক্যাল কলেজ খোলা গিয়েছে তাহাতে শ্রীশ্রী্যুত গবর্নর্ জেনরল বাহাদুর কৌন্সেলাধক্ষ্য সভা ও সেক্রেটারী এবং স্বদেশ বিদেশীয় অন্য প্রধান মহাশয়েরাও উপস্থিত ছিলেন এই মহদ্বিদ্যালয়ের কার্য্য দর্শনার্থ যে সকল বহুতর সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিরা মনোযোগ দিয়াছেন ইহা মেডিকেল কলেজাধ্যক্ষদিগের উৎসাহের বিষয় বটে এবং এদেশে চিকিৎসা বিদ্যাপ্রভৃতি নানাবিধ বিদ্যাবিষয়ে যে সকলের মনো্যোগ হইতেছে ইহাতে এ দেশে বিদ্যা প্রচারের বন্ধুরাও আহ্লাদিত হইবেন আমারদিগের এরূপ লিখনের তাৎপর্য্য এই যে ১৮৩৫ সালের ৫ জানুয়ারি তারিখের ছাপাযন্ত্রবিষয়ক সভা এবং অন্যান্য দুই এক সভাব্যতীত কোন সভাতেই এত লোকের সমাগম হয় নাই। …
উপযুক্ত চিকিৎসার অভাবে যে কত অনিষ্ট হইতেছে তাহা প্রতিদিন দেখা যাইতেছে সমুচিত চিকিৎসা না হওয়াতে মূর্খ বৈদ্যেরদের বিদ্যায় ঘন্টায়২ লোক মারা পড়িতেছে যত লোকের মৃত্যু হয় ফর্দ পাইলে বোধ হয় আমরা যাহা মনে করি ভারতবর্ষের মৃতলোকের সংখ্যা অপেক্ষাও অধিক হইবেক তবে গবর্ণমেন্টের আনুকূল্যে যে মেডিকেল কলেজ স্থাপন হইয়াছে এদেশের লোকেরা তাহার সাহায্য করেন না কেন বলিতে পারিনা। …
এই বিদ্যালয়ের কার্য্যের সম্পূর্ণ ভার বিদ্যার্থি বালকদিগের উপর তাহার পরিশ্রম করিলেই বিদ্যালয় স্থাপনকারি মহাশয়দিগের আশা পরিপূর্ণ হইবে অনেকে বলেন এদেশে অস্ত্র চিকিৎসার চালনা হইতে পারেনা কিন্তু বালকেরা এক প্রকার তাঁহারদিগের কর্ম্ম দেখাইয়াছেন আমরা ভরসা করি পরে ঐ বিদ্যা বৃদ্ধি হইলে মেডিকেল কালেজের মিত্রেরা আহ্লাদিত হইবেন শ্রীযুত ডাক্তর ব্রমলি সাহেব শ্রীযুক্ত ডাক্তর গুদেব সাহেব শ্রীযুক্ত ডাক্তর ওসানিসি সাহেব এই সকল ব্যক্তি শিক্ষকতা পদে নিযুত আছেন। …” (বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রাগুক্ত, পৃঃ ৩৮। বানান ও যতিচিহ্ন অপরিবর্তিত।)
১৮ মার্চ ১৮৩৭-এ (একবছর পরে) সমাচার দর্পণ-এ প্রকাশিত আরেকটি খবরের প্রতিলিপি দিচ্ছি।
মেডিক্যাল কলেজের নবনির্মিত বিল্ডিংয়ে ক্লাস শুরুর পূর্ণাঙ্গ আলোচনায় প্রবেশের আগে আমরা প্রথম ডিসেকশন নিয়ে আরও দুয়েক কথা বলবো। আমি অধ্যক্ষ ব্রামলের রিপোর্ট অনুযায়ী এর আগে দেখিয়েছি ২৮ অক্টোবর ১৮৩৬ সালে প্রথম ডিসেকশন করেছিলেন মেডিক্যাল সর্বোত্তম চার জন ছাত্র। কিন্তু এ নিয়ে ভিন্ন মতও রয়েছে, এবং সেটাই জনগ্রাহ্য প্রাধান্যকারী মত। যদিও মনে রাখা দরকার, জনগ্রাহ্য এবং প্রাধান্যকারী হলেই সেটা ঐতিহাসিকভাবে সঠিক এমন ধরে নেওয়ার কোন কারণ নেই।
১৮৪৮ সালে গুডিভের “Introductory” ভাষণে মধুসূদন গুপ্তকে প্রথম শব্যবচ্ছেদকারী হিসেবে বলা হয়। কিন্তু এখানে যে খটকা থাকে তাহল ব্রামলের ১৮৩৬-এর রিপোর্ট তো তিনি দেখেছিলেন, এবং অনুমোদনও করেছিলেন ধরে নেওয়া যায়। সেক্ষেত্রে ১৮৪৮-এ তিনি ব্রামলের রিপোর্টের থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন কথা বললেন কেন, যে কথা ১৮৩৬-এ রিপোর্ট পেশের সময়ে বলেননি? এরপরে বেথুনের আলংকারিক এবং রোমহর্ষক বর্ণনার সাথে অনেকেই কমবেশি পরিচিত। ১৮৫০ সালে মিসেস বেলনসের আঁকা মদুসূদন গুপ্তের একটি পোর্ট্রেট কলেজকে উপহার দেন বেথুন। সে উপলক্ষ্যে যে ভাষণ দিয়েছিলেন তাতে যেকোন মানুষ আবেগাপ্লুত হয়ে পড়তে পারে। তাঁর ভাষণের একাংশ – “At the appointed hour, scalpel in hand, he followed Dr Goodeve into the Godown where the body lay ready. The other students deeply interested in what was going forward but strangely agitated with mingled feelings of curiosity and alarm, crowded after them, but durst not enter the buildings where this fearful deed was to be perpetrated … they peeped through the jilmils, resolved at least to have ocular proof of its accomplishments. And then Madhusuden’s knife, held with a strong and steady hand, made a long and deep incision in the breast, the lookers-on drew a long gasping breath, like men relieved from the weight of some unbearable suspense.” (J Kerr, Review of Public Instructions in the Bengal Presidency, from 1835 to 1851, Part II, 1853, পৃঃ ২১০)
বাংলায় পূর্ণচন্দ্র দে তাঁর “কলিকাতা মেডিক্যাল কলেজ” শীর্ষক প্রবন্ধে এ মতকে সমর্থন করেছেন। অরূপরতন ভট্টাচার্যের বাঙ্গালির বিজ্ঞানভাবনা ও সাধনা পুস্তকে আমার জ্ঞানত সর্বপ্রথম ১০ জানুয়ারি, ১৮৩৬ এবং ২৮ অক্টোবর, ১৮৩৬ এই দুটি তারিখের সমন্বয়সাধনের চেষ্টা করা হয় (পৃঃ ১১৮-১২২)। তাঁর মতে ১০ জানুয়ারি, ১৮৩৬-এ মধুসূদন ব্যবচ্ছেদ করেন। ২৮ অক্টোবর, ১৮৩৬-এ চারজন ছাত্র করেন পরবর্তী ব্যবচ্ছেদ। কিন্তু কেন এরকম ঘটলো তার খুব নির্ভরযোগ্য ব্যাখ্যা পাওয়া যায়না। অরূপরতনের এই ধারণাকে আরও জোরালোভাবে প্রতিষ্ঠা করেন শংকর নাথ ২০১৪ সালে প্রকাশিত তাঁর কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের গোড়ার কথা ও পণ্ডিত মধুসূদন গুপ্ত পুস্তকে। সমিতা সেন এবং অনির্বাণ দাসের “History of the Calcutta Medical College and Hospital, 1835–1936” প্রবন্ধে (সংকলিত হয়েছে উমা দাসগুপ্ত সম্পাদিত Science and Modern India: An Institutional History, c.1784–1947 গ্রন্থে, পৃঃ ৪৭৭-৫২২) ডিসেকশনের নির্দিষ্ট তারিখ বলেছেন ১০ জানুয়ারি ১৮৩৬। অবশ্য তাঁদের ৩১ নম্বর নোটে দুটি তারিখেরই উল্লেখ করেছেন। লেখকেরা গুরুত্ব আরোপ করেছেন “a larger shift into the domain of anatomo-clinical medicine”-এর ওপরে। (পৃঃ ৪৭৮)
১৮৭৩ সালে মেডিক্যাল কলেজের উজ্জ্বল ছাত্র, পরবর্তীতে হোমিওপ্যাথির প্রবক্তা এবং ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য কালটিভেশন অফ সায়ান্সের মতো প্রতিষ্ঠানের জনক মহেন্দ্রলাল সরকার তাঁর প্রতিষ্ঠিত ও সম্পাদিত পত্রিকা দ্য ক্যালকাটা জার্নাল অফ মেডিসিন-এর ১৮৭৩ সালের ভল্যুম ৬-এর মে এবং জুন মাসে প্রকাশিত “দ্য ক্যালকাটা মেডিক্যাল কলেজ” শিরোনামের দুটি কিস্তিতে (মোট ৬ কিস্তিতে প্রকাশিত হয়েছিল) মধুসূদন গুপ্তকে প্রথম শবব্যাবচ্ছেদকারী এর অসারতা প্রমাণ করেন। তিনি প্রথম চারজন ছাত্রের একজন দ্বারকানাথ গুপ্তের সাথে কথা বলে প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ নেন। তিনিও এ ধারণা খণ্ডন করেন।
মধুসূদন গুপ্তের নাম এভাবে গুরুত্ব পাবার সম্ভাব্য কারণ হতে পারে – (১) তিনি জাতে বৈদ্য হলেও হিন্দু সমাজের সংস্কারাচ্ছন্ন ছিলেননা, আবার হিন্দুশাস্ত্রে সুপণ্ডিত ছিলেন, এবং (২) যে সামাজিক নিন্দা এবং বয়কটের ভয়ে ব্রামলে চারজন ছাত্রের নাম প্রকাশ করতে পারেননি সে বয়কট ও নিন্দার ভয় হয়তো মধুসূদনের ছিলনা। তিনি ব্যবছেদের গুরুভার নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন। কিন্তু জেনারেল কমিটি অফ দ্য ফিভার হসপিটাল অ্যান্ড মিউনিসিপাল ইম্প্রুভমেন্টস – অ্যাপেনডিক্স ডি-ই (২৭ ফেব্রুয়ারি থেকে ২৯ মে, ১৮৩৭)-র সামনে সাক্ষ্য দেবার সময় মেডিক্যাল কলেজে তাঁর দায়িত্বের বিভিন্ন কথা বললেও ডিসেকশনের কথা একবারের জন্যও উল্লেখ করেননি। (বিস্তৃত আলোচনার জন্য দ্রষ্টব্য – জয়ন্ত ভট্টাচার্য, “The first dissection controversy: introduction to anatomical education in Bengal and British”, Current Science 2011, 101 (9): 1227-1232)
এখানে একটি বিষয় উত্থাপন করে এ আলোচনা শেষ করি। প্রথম ডিসেকশনের আগে ডেভিড হেয়ার খুব দুশ্চিন্তার মধ্যে ছিলেন। এরকম এক দিনে প্যারীচাঁদ মিত্র উপস্থিত ছিলেন তাঁর সমীপে। প্যারীচাঁদের বয়ানে – “One evening as I was sitting with him, I saw Baboo Muddosuden Goopta the then professor of the Sanscrit Medical Science of the Sanscrit College entering the room in all haste.
Mr. Hare viewing him said at once well — Muddoo what have you been doing all this time? Do you not know what amount of pain and anxious thoughts you have kept me in for a week almost? I have been to Radhacant, and I am hopeful from what he said to me. Now’ what, you have to say. Have you found the text in your shaster authorising the dissection of dead bodies”? Muddo answering in the affirmative said “Sir! fear no opposition from the orthodox section of the community, I and my Pundit friends are prepared to meet them it (hey come forward which I am sure they will not do”. Mr. Hare felt himself relieved at this declaration on the part of the Professor”। (Peary Chand Mitra, A Biographical Sketch of David Hare, 1877, পৃঃ ১২৭)
১৭ মার্চ ১৮৩৬ – “Introductory Address Delivered at the Opening of the Calcutta Medical College”
এপ্রিল ১৮৩৭-এর ক্যালকাটা মন্থলি জার্নাল-এ এই মিটিংয়ের বিস্তৃত বিবরণ প্রকাশিত হয়েছিল “NATIVE MEDICAL COLLEGE – PRINCIPAL BRAMLEY’S ADDRESS” শিরোনামে (পৃঃ ১০৭-১০৯)। এই রিপোর্ট থেকে জানা যায় – লর্ড অকল্যান্ড সোয়া এগারোটা নাগাদ পোডিয়ামে এসে পৌঁছন এবং প্রিন্সিপাল ব্রামলে তাঁকে নিয়ে স্টেজে ওঠেন। সেখানে ছিলেন ও’শনেসি এবং গুডিভ। তৎকালীন কলকাতার সমাজের কেষ্টবিষ্টুরা প্রায় ৫৮০ জন মিটিংয়ে উপস্থিত ছিলেন। রিপোর্টে বলা হয় – “The lecturer (Bramley) then spoke of the absurdity of attempting to study medicine or to practise surgery without a knowledge of anatomy”। ব্রামলের লেকচার শেষ হবার পরে অকল্যান্ড ব্রামলের সাথে হ্যান্ডশেক করে নতুন বিল্ডিংয়ের বিভিন্ন অংশ যেমন অ্যানাটমিক্যাল ফিগার, কেমিক্যাল ল্যাবরেটরি, লাইব্রেরির জন্য ধার্য্য বিল্ডিং ইত্যাদি ঘুরে দেখেন। রিপোর্টে একথাও বলা হয় – “আমরা এতসংখ্যক দেশীয় সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিকে দেখতে পেয়ে নিতান্ত আহ্লাদিত। শুধু তাই নয় ধর্মসভা-র গোঁড়া হিন্দুদের অংশগ্রহণও আমাদের প্রীত করেছে।” রিপোর্টে বলা হয় – “দেশীয় সমাজে সার্জিক্যাল এবং মেডিক্যাল সায়ান্সে সম্পূর্ণ অজ্ঞতার জন্য এদেশের মানুষদের যে বিপুল কষ্ট ভোগ করতে হয় এই বিষয়ের সাথে যে কেউ সামান্য পরিচিত থাকলে মেডিক্যাল কলেজ যে মঙ্গলসাধন করতে চলেছে সে ব্যাপারে নিরাসক্ত থাকতে পারবেনা।” (পৃঃ ১০৭-১০৯)
একই জার্নালে ফেব্রুয়ারি ১৮৩৬-এ “NATIVE MEDICAL COLLEGE” শিরোনামের খবরে সে বছর ১৩ গেব্রুয়ারি যে পরীক্ষা নেওয়া হয়েছিল তার মোটামুটি বিস্তৃত বিবরণ প্রকাশিত হয়। ব্রামলের রিপোর্টে আগের কিস্তিতে আমরা এ পরীক্ষার উল্লেখ পেয়েছি। জার্নালের রিপোর্ট অনুযায়ী – ও’শনেসির পড়ানো কেমিস্ট্রি দিয়ে পরীক্ষা শুরু হয়েছিল। বলা হয় – “Dr. O’Shaughnessy admitted that he was pressing the students latterly rather hard, but we believe he was quite satisfied with the replies he obtained from them”। এরপরে ডঃ গুডিভ ছাত্রদের অ্যানাটমি পরীক্ষা নেন। এমনকি বহিরাগত ডঃ ডানকান স্টুয়ার্টও ছাত্রদের শক্ত প্রশ্ন করেন। কিন্তু ছাত্রদের উত্তর যথেষ্ট সন্তোষজনক ছিল। রিপোর্টের শেষে মন্তব্য করা হয়েছে – “We have only to add that the pupils, about 70 in number, are chiefly Hindoos from 14 to 17 years of age, who are receiving general education at the Hindu College and who come over daily the Medical College for two hours to receive professional education. At the expiration of the first year, however, we understand that the students will devote themselves entirely to study of Medicine.” (পৃঃ ৭৫-৭৬)
বাংলায় এবং অংশত ইংরেজিতেও দুর্বলতা থাকার জন্য ব্রামলে তাঁর ১৮৩৬ সালের প্রথম বার্ষিকী রিপোর্টে বলেছিলেন শিক্ষার দুর্বলতা কাটানোর জন্য এদের আগের স্কুলে আবার কিছুদিন পড়শুনো করা দরকার, এবং একই সাথে মেডিক্যাল কলেজের ক্লাসও করা আবশ্যিক। সে প্রস্তাব এই রিপোর্টে নিশ্চিতভাবে বোঝা গেল।
লর্ড অকল্যান্ড এবং অন্যান্য ভদ্রমহোদয়দের সম্বোধন করে শুরু করা তাঁর বক্তৃতায় ব্রামলে বলেন – “আমি এরকম গুরুত্বপূর্ণ বক্তৃতার অনুপযুক্ত এবং মেডিক্যাল সায়ান্সের বিস্তৃত আলোচনা এখানে করা সম্ভব নয়।” বলেন – “মানুষের সমস্ত অন্বেষণের মাঝে এর চেয়ে মহত্তর কি আছে যা মানুষের কষ্ট লাঘবের জন্য, রোগের নিরাময়ে এবং জীবনকে প্রলম্বিত করাকে সাহায্য করে?” (ক্যালকাটা মন্থলি জার্নাল, থার্ড সিরিজ, ভল্যুম ২, মে ১৮৩৬, পৃঃ ১-৭)
অনেকটা বেন্টিঙ্কের ১৮৩৪ সালের উক্তি “Within a few years however, the progress of education in Calcutta has been exceedingly rapid”-এর প্রতিধ্বনি করে ব্রামলে বলেন – “I will venture to assert that the whole aspect and temper of Native Society (at least, in Calcutta) is changing; and may we not say it is changing for the best?” (পৃঃ ৩) তিনি একটি বৈজ্ঞানিক সত্য অডিয়ান্সের সামনে বলেন – “গতকালের স্বতঃসিদ্ধ আগামীকাল ভুল প্রমাণিত হতে পারে।” উল্লেখযোগ্য, শাস্ত্রনির্ভর যে অটল প্রত্যয় কার্যত তার মূলে আক্রমণ করলেন। সাথে এটাও বলেন – “সমস্ত মেডিক্যাল জ্ঞানের মূল ভিত্তি হল অ্যানাটমি।” (পৃঃ ৪)
তাঁর বক্তৃতার পরবর্তী অংশ জুড়ে অ্যানাটমির জ্ঞানলাভের কার্যকারিতা বিভিন্নভাবে বুঝিয়েছেন। এ জ্ঞান ছাড়া সার্জারি ও মেডিসিনের জগতে দিশাহীন নাবিকের মতো অবস্থা হবে বলে জানান। এর সাথে গুরত্ব আরোপ করেন ডঃ ও’শনেসি এবং ডঃ গুডিভের শেখানো ক্লিনিক্যাল শিক্ষার ওপরে। লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক এবং স্যার চার্লস মেটকাফকে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে তাঁর বক্তৃতা শেষ করেন। (পৃঃ ৭)
এরপরে শুরু হয় ও’শনেসির দীর্ঘ বক্তৃতা – “Lectures on General Chemistry and Natural Philosophy”। বক্তৃতার শুরুতে তিনি বলেন – “of the foundation pupils of the Medical College, and of pupils of the Hindu College, not destined for medical profession, I cannot but feel that I will best discharge my duty to the entire by explaining the nature, objects and useful application of the science … study of the chemistry is but a subordinate branch”।
এখানে কয়েকটি বিষয়ে আমরা নজর দেবো – (১) বেসিক সায়ান্স যেমন কেমিস্ট্রি, ফিজিক্স ইত্যাদি তখনও “ন্যাচারাল ফিলসফি”র অন্তর্গত, আলাদা শাখা হিসেবে তেমন গ্রাহ্য নয়, এবং (২) বোঝা যায় ও’শনেসির কেমিস্ট্রির ক্লাস এতটাই মনোগ্রাহী এবং গুরুত্বপূর্ণ ছিল যে হিন্দু কলেজের ছাত্ররাও তাঁর লেকচার শোনার জন্য নিয়মিত আসছে।
এখানেই তাৎপর্যপূর্ণ মেল গরম্যানের মন্তব্য – “At a time when a chemical laboratory in an American medical school was rare, this course with lectures and laboratory work was the equal of any in a European medical institution. Most importantly, the students were just as capable and enthusiastic about chemistry as they were about anatomy, and the testimony of outside examiners gives ample proof as to the rigor of the examinations.” (মেল গরম্যান, “Introduction of Western Science into Colonial India: Role of the Calcutta Medical College”, পৃঃ ২৮৭)
তাঁর লেকচারে ও’শনেসি ফ্যারাডে এবং ওরস্টেডের পরীক্ষার কথা উল্লেখ করেন। লক্ষ্যণীয় ফ্যারাডের আবিষ্কার ১৮৩১ এবং ওরস্টেডের আবিষ্কার ১৮২০-তে। ১৮৩৬ সালের মার্চ মাসে মেডিক্যাল কলেজের ছাত্রদের সামনে এদের পরীক্ষার ফলিত প্রয়োগ করে হাতেকলমে শেখাচ্ছেন, তত্ত্ব বোঝাচ্ছেন। আমরা ও’শনেসির লেকচারের পরবর্তী অংশে দেখবো কিভাবে উপনিবেশিক বিজ্ঞানকে গ্লোবাল সায়ান্স বা আন্তর্জাতিক বিজ্ঞানের তুল্য করে তুললেন, সে স্তরে উন্নীত করলেন। এমনকি সেদিনও সমস্ত শ্রোতা ও দর্শকদের সামনে কিছু কিছু পরীক্ষা হাতেকলমে করে দেখিয়েছিলেন।
তিনি ছাত্রদের উদ্দেশ্যে বললেন – “they know not how to make the observations which chiefly render travels of scientific interest or utility.” বিজ্ঞান বোঝার জন্য এ কথাগুলো খুব গুরুত্বপূর্ণ। তিনি একেবারে গোড়া ধরে ছাত্রদের শেখাতে চাইছেন –“We are in India situated in the vicinity of many territories to which Europeans are denied access, and which a scientific has never explored.” (পৃঃ ১১)
কেমিস্ট্রির জ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে ছাত্ররা “rich mines of the precious metals, as well as of copper, iron, tin, and lead” আবিষ্কার করতে পারবে। বিভিন্ন ধরনের dye আবিষ্কার করতে পারবে। এ প্রসঙ্গেই ছাত্রদের স্মরণ করালেন – “পৃথিবীর সবচেয়ে উন্নত ও নিখুঁত বহু dye-এর সম্পদ থাকা সত্ত্বেও India is forced to export them to a enlightened land, where the cottons also exported from India receive their colours and return to their place of original production.” (পৃঃ ১২) আমার দেশের সম্পদ উপনিবেশিক লুঠের পরে আবার আমাদের কাছে ফিরিয়ে দেওয়া হচ্ছে যদিও এন্ড প্রোডাক্ট তৈরির সমস্ত সামগ্রী ভারতের। কিন্তু “the skill to apply them does not exist, and the consumer is consequently forced to pay the expense of their exportation to Europe and return to India, as well as the remuneration of the European dyer.” (পৃঃ ১২) অর্থাৎ, ভারতীয়দের যথেষ্ট স্কিল বা দক্ষতা না থাকার জন্য বহুগুণ বেশি দামে নিজেদের তৈরি সম্পদ ইংরেজ বেনিয়াদের কাছ থেকে কিনতে হচ্ছে। তাঁর নিজের অভিজ্ঞতা থেকে জানাচ্ছেন “shawl weavers of Cashmere and upper India have on more than one occasion purchased up English green cloth at fifteen rupees a yard”।
এ যেন দাদাভাই নওরোজির “drain theory”-র প্রতিধ্বনি শুনতে পাচ্ছি। ১৮৩৬ সালে প্রায় ৬০০ জনের অডিয়ান্সের সামনে অকল্পনীয়ভাবে ভারতের বৈজ্ঞানিক মুক্তির কথা বলছেন। তাঁর স্বাধীন আইরিশ সত্তা কোন ভূমিকা পালন করেছিল কিনা জানিনা। বলছেন উপনিবেশিক শোষণের কথা। বলছেন “necessity of disseminating such valuable knowledge”-এর কথা। কেমিস্ট্রির সঠিক শিক্ষা, তাঁর ধারণানুযায়ী, “a fertile source of national and personal emoluments”। স্বাজাত্যবোধের ধারণা কি জারিত হচ্ছিল তাঁর সেদিনের লেকচারে?
তাঁর এই লেকচারেই রক্ত, মূত্র এবং দেহের অন্যান্য উপাদানের বিশ্লেষণের শিক্ষাদানের মধ্য দিয়ে তিনি আজকের বায়োকেমিস্ট্রির ভ্রূণের জন্ম দিলে – তাঁর লেকচারে, ছাত্রদের মাঝে, মেডিক্যাল কলেজের ল্যাবরেটরিতে সেই সুদূর ১৮৩৬ সালে যখন ইউরো-আমেরিকান বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে কেমিস্ট্রি শিক্ষাও শৈশবাবস্থায় রয়েছে বলা যায়। (পৃঃ ১৪-১৫)
শুধু তাই নয়, সম্ভবত ভারতে ধাতুবিদ্যার (mineralogy) বীজও উপ্ত হয়েছিল তাঁর লেকচারে, মেডিক্যাল কলেজের ছাত্রদের কেমিস্ট্রি শিক্ষার ক্লাসে। তিনি বলেছিলেন তাঁর কাছে কুমায়ুন অঞ্চলের মাটি ও পাথরের অনেক নমুনা আছে যেগুলো থেকে তিনি বুঝেছেন তামা এই স্পেসিমেনগুলোতে প্রচুর পরিমাণে রয়েছে। তিনি প্রশ্ন রেখেছিলেন, কেমিস্ট্রি না শিখলে এগুলো জানবে কি করে? দেশের সম্পদকে ব্যবহার করবে কিভাবে? (পৃঃ ১২)
তিনি ভারতের বাজারে যেসব ভেজাল পদার্থ পাওয়া যায় তা কি করে বোঝা যাবে সে শিক্ষা হাতেকলমে শেখালেন। বিদেশ থেকে আমদানি করা“Peruvian bark” বা সিঙ্কোনা গাছের ছালের বিকল্প কিভাবে ল্যাবরেটরিতে তৈরি করা যায় প্রাথমিক শিক্ষা দিয়েছিলেন। ইউরোপ থেকে কি পরিমাণ ওষুধ দরিদ্র ভারতবাসীকে বিপুল দামে আমদানি করতে হয় তার একটা লিস্ট তিনি তৈরি করেছিলেন। এর সংখ্যা ছিল্ কয়েকশ। ও’শনেসি বলছেন “all of which, except about 80, may be prepared or grown in the country.” এবং এই ৮০টি উপাদানও দেশীয় প্রোডাক্ট থেকে তৈরি করে নেওয়া সম্ভব। (পৃঃ ১৬)
তিনি ভারতে প্রথমবারের মতো শুরু করলেন মেডিক্যাল টক্সিকোলজি (পরবর্তীতে যা ফরেনসিক মেডিসিন হিসেবে পড়ানো হয়) শিক্ষার ক্লাস। তিনি ছাত্রদের জানালেন যে অসংখ্য অতি শক্তিশালী বিষ ভারতের বাজারে বা অন্যত্র পাওয় যায় – যেমন প্রুসিক অ্যাসিড, ব্যারাইটস, অক্সালিক অ্যাসিড, corrosive sublimate, caustic potash, oil of vitriol ইত্যাদি। এগুলোর প্রতিষেধকও আছে। কিন্তু তার বিষটিকে চিহ্নিত করতে হবে – “I tell you that a very little practice in the laboratory will enable you to detect the 100th part of a grain of arsenic, corrosive sublimate &c. in any mixture that can be presented to you.” এ বিদ্যা করায়ত্ত হলে “will very often enable you to protect persons labouring under false accusations.” (পৃঃ ১৬) এভাবে যদি নিরপরাধকে সাজার হাত বাঁচানো যায় এবং অপরাধীকে শাস্তি দেওয়া তাহলে সেটাই হয়ে ওঠে ফরেনসিক মেডিসিনের একেবারে গোড়ার পাঠ ও শিক্ষা। ভারতের শিক্ষাজগতে এ কাজের সূত্রপাত ঘটালেন ও’শনেসি মেডিক্যাল কলেজের ল্যাবরেটরিতে।
তাপবিদ্যা বোঝানোর জন্য তিনি উপনিবেশিক কলকাতার সদ্যস্থাপিত মেডিক্যাল কলেজের ল্যাবরেটরিতে ইতালিয়ান বিজ্ঞানী মেলোনি এবং নোবিলির (Nobili and Melloni) সদ্য আবিষ্কৃত তত্ত্ব ও প্রয়োগ নিয়ে আলোচনা করেছেন। ওদের তৈরি থার্মোপাইল (thermopile) যন্ত্র নিয়ে বিশদে বুঝিয়েছেন। এদের তত্ত্ব ও যন্ত্র ১৮৩১ সালে আবিষ্কৃত। মেডিক্যাল ও’শনেসি পড়াচ্ছেন ১৮৩৬ সালের গোড়ায়। অবিশ্বাস্য!
(মেলোনির থার্মো-মাল্টিপ্লায়ার যন্ত্র – ১৮৩১)
এ যন্ত্র সেসময় মেডিক্যাল কলেজের ল্যাবরেটরিতে বানানো হয়েছিল বা আনানো হয়েছিল। এ যন্তের বৈশিষ্ট্য ছিল ফুটন্ত ফুল কিংবা মাছির পাখা ঝাপটানো বা চাঁদের আলোয় কতটা তাপ থাকছে তা মাপতে পারত। (পৃঃ ১৭) কি কি বিষয় পড়াবেন বলে জানিয়েছিলেন ও’শনেসি?
প্রথম, ছাত্রদের প্রতিটি পদার্থের সাথে পরিচিত করানো, পদার্থগুলোর বিশিষ্ট ধর্ম সহ। তিনি জানাচ্ছেন – “I imitate with slight modification the plan pursued in the schools of Chemistry of Universities of Edinburgh and London.” (পৃঃ ১৭) অর্থাৎ, পৃথিবীর সর্বোৎকৃষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যা পড়ানো হচ্ছে মেডিক্যাল কলেজেও সেগুলো শেখানো হচ্ছে।
দ্বিতীয়, তাপবিদ্যা এবং ইলেজট্রিসিটি নিয়ে ক্লাস নেবেন। একইসাথে গ্যালভানিজম নিয়েও পড়াবেন। এছাড়া তিনি “give lectures on astronomy”। (পৃঃ ১৭)
তৃতীয়, প্রতি একদিন অন্তর “medical preparations and testing of poisons and analysis of ores and menral.” এছাড়াও ল্যাবরেটরিতে “practical details of chemistry” শেখানো তো ছিলই। এক্ষেত্রে তিনি প্যারিসের Ecole Praque প্রতিষ্ঠান এবং বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয়ের “extraordinary professor of chemistry” হাইনরিখ রোজের পদ্ধতি অনুযায়ী পড়াতেন। রোজ আজ যাকে অ্যানালিটিক্যাল কেমিস্ট্রি বলা হয় সেক্ষেত্রে নতুন নতুন কাজ করছিলেন।
চতুর্থ, তাঁর কাছে “admirable class books of Europe” ছিলনা বলে পরিকল্পনা করেছিলেন তাঁর লেকচার নোটগুলো নিয়ে দেশীয় ছাত্রদের উপযোগী একটি কেমিস্ট্রির বই ১৮৩৭ সালে পরকাশ করার। করেওছিলেন Manual of Chemistry নামে এই বই। এ বইয়ের ১৮৪২ সালের দ্বিতীয় সংস্করণ আমার সংগ্রহে আছে।
সম্ভবত ও’শনেসির এরকম বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধিৎসা, পড়ানোর ক্ষেত্রে ছাত্রদের মাঝে বৈজ্ঞানিক বীক্ষার স্পিরিট তৈরি করা এবং বিপুল জ্ঞানের জন্য ব্রামলে তাঁর বার্ষিক রিপোর্টে (৩২ থেকে ৬৭ পৃষ্ঠার রিপোর্ট) ৭ পৃষ্ঠা ব্যয় করেছিলেন ও’শনেসির পড়ানো নিয়ে, আর গুডিভের জন্য বরাদ্দ ছিল ৩ পৃষ্ঠা।
ও’শনেসির পরে ডঃ গুডিভ “প্র্যাক্টিস অফ ফিজিক” নিয়ে “Introductory Lecture” দেন। তবে সেটা একই দিনে নয়, ৩ মে, ১৮৩৬-এ। ভারতীয় চিকিৎসার – অসংখ্য হাতুড়ে এবং বৈদ্য উভয়েরই – ভয়াবহতা এবং পূর্ণ অজ্ঞানতা (মেডিসিন, সার্জারি, অ্যানাটমি এবং প্যাথলজির সাপেক্ষে) নিয়ে আলোচনায় অনেকটা অংশ ব্যয় করেছেন। একটি গুরুত্বপূর্ণ উপদেশ ছাত্রদের দিয়েছিলেন তিনি – “ভারতের দরিদ্র হতভাগ্য অসংখ্য মানুষ সঠিক চিকিৎসার অভাবে প্রতিদিন মারা যাচ্ছে। ধনীদের সঙ্গতি আছে ইউরোপীয় চিকিৎসার সুযোগ নেবার। কিন্তু হায়! দরিদ্ররা সম্পূর্ণত নিরাশ্রয়, এরা জানেনা কোথায় যেতে হবে কোন ধরনের চিকিৎসার জন্য, সামান্য চিকিৎসার অভাবে হাজারে হাজারে মারা যায়।” তাঁর বক্তব্য ছিল মেডিক্যাল কলেজের ছাত্ররা এ অভাব মেটাবে।
মেডিসিনকে সঙ্গতভাবেই সাম্রাজ্যবাদের “মানবিক মুখ” হিসেবে বিচার করা হয়। সাম্রাজ্যবিস্তারের অন্যতম “মানবিক” হাতিয়ার ছিল মেডিসিন। এ নিয়ে অসংখ্য মূল্যবান আলোচনা রয়েছে। কিন্তু ও’শনেসি বা গুডিভ যখন স্বাধীন ও স্বতন্ত্রভাবে মেডিসিনের শিক্ষালাভ ও চর্চার কথা বলেন তখন সেগুলো মেডিসিনের হিতকারী internal dynamics মেনে ঘটে, সাম্রাজ্যবাদের ঈপ্সিত নিয়ম মেনে হয়না। এখানে মেডিসিন নিজে এবং সাম্রাজ্যবাদের মানবিক মুখ হিসেবে মেডিসিনের মাঝে একটি দ্বন্দ্ব রয়ে যায়। এটা আমাদের নজরে রাখা উচিত।
গুডিভ জানান – “The physician was looked upon as a superior being, while the surgeon was treated as a common artisan.” ফরাসী বিপ্লব-পরবর্তী প্যারিসের হাসপাতালগুলো এ দ্বন্দ্বের নিরসন করেছিল। এর আগে জেভিয়ার বিখাটের উদাহরণ দিয়েছি আমি। ঐতিহাসিকভাবে শুধু ভারতবর্ষ নয়, সমগ্র এশিয়ায় ফিজিসিয়ান-সার্জন বিভাজন মুছে দেবার কাজটি করেছিল মেডিক্যাল কলেজ। এর গুরুত্ব অপরিসীম। গুডিভের ভাষায় “This distinction, however, for all practical purposes, is extremely absurd and inconvenient.” (পৃঃ ২২)
তিনি মেডিসিন, সার্জারি, অ্যানাটমি, প্যাথলজি, মেটেরিয়া মেডিকা, ওষুধের যথার্থ প্রয়োগ এবং মরবিড অ্যানাটমি শিক্ষার ওপরে জোর দিয়েছিলেন। তিনি জানান তাঁর পরবর্তী লেকচারগুলোতে তিনি মেডিসিনের তত্ব ও প্রয়োগের ওপরে জোর দেবেন। পরের বছর (১৮৩৭) এগুলোকে আরও বিস্তারিতভাবে পড়ানো হবে। সাথে ক্লিনিক্যাল মেডিসিনের ওপরে জোর দেওয়া হবে। ১৮৩৮-এ মেডিক্যাল কলেজের সাথে একটি ২০ বেডের একটি হাসপাতাল যুক্ত হল ক্লিনিক্যাল শিক্ষার জন্য। (Centenary, পৃঃ ১৬)
“হসপিটাল মেডিসিন”-এর মূল মন্ত্র যেন গুডিভ উচ্চারণ করেছিলেন – “It is only at the bed side of the sick, by observing closely the symptoms and progress of disease, watching the effects of remedies, and, – should the termination of the malady prove a fatal one, and the death of your patient afford you an opportunity to inspect the body, – carefully noting the changes which have taken place in the various organs: it is only by these means you can hope to render your yourselves worthy and useful members of the profession you have chosen.” (ক্যালকাটা মন্থলি জার্নাল, ১৮৩৭, পূর্বোক্ত, পৃঃ ২৭)
১৮৩৮ সালের প্রথম পরীক্ষা সংক্রান্ত রিপোর্ট (১৮৩৯)
এইচ টি প্রিন্সেপের স্বাক্ষরিত (২৭ ফেব্রুয়ারি, ১৮৩৯) এ রিপোর্টটি একটি স্পেশাল রিপোর্ট হিসেবে পেশ করা হয় (GCPI, 1839)। শুরুতেই ২৯ জুন ১৮৩৭-এ যে সমস্ত কৃতী ছাত্রদের বিভিন্ন প্রাইজ দেওয়া হয়েছিল তার লিস্ট দেওয়া হয়।
লক্ষ্যণীয়, সরকারের তরফে যে প্রাইজ দেওয়া হয়েছে সে দুটি গোল্ড এবং সিলভার মেডাল। দ্বারকানাথ ঠাকুরের তরফে দেওয়া হয়েছে নগদ টাকা। সহজ কথা, সরকারের অর্থ কিমি. ব্যবয় হবে। আবার সেই আমার আলোচনার একেবারে গোড়ায় আলোচিত “ইকনোমি অফ এডুকেশন”-এর ছায়া দেখতে পাচ্ছি।
এই রিপোর্ট অনুযায়ী, ১৮৩৮ সালের ১ এপ্রিল মেডিক্যাল কলেজের ছাত্রসংখ্যা ৭২। এরমধ্যে ফাউন্ডেশন স্টুডেন্ট ৪৮ জন, যার একজন খ্রিষ্টান এবং বাকীরা হিন্দু। “non-stipendiary” ছাত্রের সংখ্যা ২১ – ১০ জন খ্রিষ্টান, বাকীরা বাঙ্গালী হিন্দু।
যেসমস্ত বিষয়ের ওপরে শিক্ষকেরা লেকচার দিয়েছিলেন – (১) অ্যানাটমি এবং ফিজিওলজি, (২) কেমিস্ট্রি, (৩) মেটেরিয়া মেডিকা, (৪) প্র্যাক্টিস অফ ফিজিক (তথা মেডিসিন), (৫) ক্লিনিক্যাল ইন্সট্রাকশন, (৬) অ্যানাটমির ডেমন্সট্রেশন, (৬) সার্জারি, এবং (৭০ বোটানি। এই রিপোর্টে প্রস্তাব দেওয়া হয় “transmission to London of the most proficient pupils, for the observation of Medical Institutions in Europe, and attainment of diplomas.” (পৃঃ ৬০) কয়েকজন মেধাবী ছাটড়োকে লন্ডনে পাঠিয়ে ওখানকার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে ডিপ্লোমা অর্জনের কথা ১৮৩৯ সালেই প্রস্তাবিত হয়েছিল। যদিও বাস্তবায়িত হয়েছিল আরও ৫-৬ বছর পরে।
বিহারের ছাপরা জেলার সারানের মহারাজা ছত্রধারি সহায় ৫০,০০০ টাকা মেডিক্যাল কলেজের জন্য দান করেছিলেন। এর সাথে রিপোর্টে এ সতর্কবাণীও উচ্চারণ করা হয় – “in some places, particularly in Wstern India, our system of education has not yet attained the popularity, which it enjoys in the Bengal provinces”।
মেডিক্যাল কলেজের স্নাতক হবার (letters testimonial) প্রথম পরীক্ষা
মঙ্গলবার, ৩০ অক্টোবর ১৮৩৮-এ মেডিক্যাল কলেজের সিলেবাস শেষ করার পরে প্রথমদিনের পরীক্ষা শুরু হল। বেন্টিঙ্কের প্রস্তাব ছিল ৫ থেকে ৬ বছর পড়াশুনো করতে হবে। কিন্তু প্রথম পরীক্ষা হল সাড়ে তিন বছরেরও কম সময়ের মাথায়। প্রত্যেক পরীক্ষার্থী অ্যানাটমি ও ফিজিওলজির ৩টি কোর্স, প্রকৃত অর্থে ডিসেকশনের ২টি কোর্স, কেমিস্ট্রির ৩টি, ন্যাচারাল ফিলজফির ১টি, মেটেরিয়া মেডিকার ২টি, সাধারণ এবং মেডিক্যাল বোটানির ২টি, প্রায়োগিক মেডিসিনের ২টি, সার্জারির প্রিন্সিপল এবং প্র্যাকটিসের ২টি এবং অপারেটিভ সার্জারির ১টি করে কোর্স সম্পূর্ণ করেছিল। (Centenary, পৃঃ ১৮) ৩০ অক্টোবর, ১৮৩৮ তারিখে শুরু হয়ে শুক্রবার ৯ নভেম্বর, ১৮৩৮ পর্যন্ত পরীক্ষা চলে। তৃতীয় দিনের পরীক্ষায় (১ নভেম্বর, ১৮৩৮) উমাচরণ শেঠ, দ্বারকানাথ গুপ্ত, রাকজকৃষ্ণ দে এবং নবীনচন্দ্র মিত্র সম্পর্কে বলা হয় “performed various operations on the dead body, in pretty good style”। (পৃঃ ৭৪) চতুর্থ দিনের (২ নভেম্বর, ১৮৩৮) পরীক্ষার মূল্যায়নে বলা হয় – নবীনচন্দ্র মিত্র ছাড়া অনেকেই “did not know how to strap the tourniquet”।
কিন্তু ১৮৩৯ সালের পূর্বোক্ত এবং পূর্বোদ্ধৃত রিপোর্টে বেশ কতগুলো গুরুত্বপূর্ণ পর্যবেক্ষণ রাখা হল। সেগুলো পরপর বললে এরকম –
(১) “the examination should of thoroughly searching and strict character”।
(২) “the necessity for a more protracted and strict examination than usually obtains in England was recognized also”। কারণ? ইংল্যান্ডে ছাত্ররা কলেজে ঢোকার আগে আগাম প্রস্তুতি হিসেবে স্কুল শিক্ষার সাহয্য পায় – “advantage of a prior state of preparation and ratiocinative discipline; which it would be vain as yet to look for in India.” ভারতে এগুলোর সম্পূর্ণ অনুপস্থিতি শিক্ষার একটি প্রধান অন্তরায়।
১১ জন পরীক্ষার্থী যারা মেধা এবং প্রস্তুতির দিক থেকে এগিয়েছিল তাদের নিয়ে পরীক্ষা শুরু হল। নীচে ১৮৩৯-এর রিপোর্ট থেকে হুবহু তুলে দিচ্ছি। (GCPI, 1839, পৃঃ ৭২) বলা হল, একান্ত আবশ্যিক সমস্ত বিষয়ের পরীক্ষাই হচ্ছে, বাদ গেছে মিডওয়াইফারি বা ধাত্রীবিদ্যা। প্রথমদিনের পরীক্ষার পরে মূল্যায়ন করা হল। (GCPI, 1839, পৃঃ ৭২) উল্লেখযোগ্য, প্রথম যে চারজন ছাত্র ডিসেকশন করেছিল তাঁদের তিনজন রীতিমতো দারুণ স্কোর করেছে।
চতুর্থ দিনের পরীক্ষার শেষে রিপোর্টে লেখা হল – “The following four now only remained to be examined further for letters testimonial, viz. Umachurn Set, Dwarakanath Gupto, Rajkisto Dey, and Nobinchunder Mitter.” (GCPI, 1839, পৃঃ ৭৫)
প্রথম পরীক্ষার পরে ছাত্রদের গ্র্যাজুয়েট ডিগ্রি দেওয়া হয়নি। উত্তীর্ণ ছাত্রদের দেওয়া হয়েছিল letters testimonial। ৯ নভেম্বর, সপ্তমদিনের শেষে মূল্যায়ন হল। অন্যান্য দিনের মূল্যায়ন নীচে দেওয়া হয়েছে।
লক্ষ্যণীয়, উপরোক্ত চারজন ছাত্রই প্রথম ডিসেকশনে সম্পন্ন করেছিলেন। পঞ্চম দিনের (৭ নভেম্বর, ১৮৩৮) পরীক্ষা হয়েছিল মেটেরিয়া মেডিকা এবং প্র্যাকটিস অফ ফিজিকের ওপরে। তার মূল্যায়ন নীচে দিলাম।
চতুর্থ দিনের পরীক্ষায় (২ নভেম্বর, ১৮৩৮) বদনচন্দ্র চৌধুরী এবং James Pote “had voluntarily withdrawn from further examination for six months.” (GCPI, 1839, পৃঃ ৭৪)
অবশেষে লম্বা ৭ দিন ধরে লম্বা পরীক্ষার শেষে (ডিসেকশন এবং অপারেটিভ সার্জারির একদিনের প্র্যাক্টিক্যাল পরীক্ষা ২ ঘন্টা ধরেও নেওয়া হয়েছে) উমাচরণ শেঠ, দ্বারকানাথ ঠাকুর, রাজকৃষ্ণ দে এবং নবীনচন্দ্র মিত্র সসম্মানে উত্তীর্ণ হয়ে letters testimonial পান। (GCPI, 1839, পৃঃ ৭৭) তাদের সম্পর্কে রিপোর্টে মন্তব্য করা হয় – “we consider them competent to the practice of medicine and surgery, we beg to recommend them accordingly to the liberal consideration of the Government as the first Hindus, who rising superior to the trammels of prejudice and obstacles of no ordinary character, have distinguished themselves by attaining to a complete medical education upon enlightened principles.” (GCPI, 1839, পৃঃ ৭৭) এই ৪ জন ছাড়াও আরেকজনকে (শ্যামাচরণ দত্ত) পাস করানো হয় “for the post of laboratory and medical Assistant at the Opium Board of Patna.” (Centenary, পৃঃ ২০)
যেহেতু পড়াশুনোর সময়কাল ৪ বছরের কম ছিল (৩ বছর ৬ মাসের কাছাকাছি) সেজন্য ২৮ জানুয়ারি, ১৮৩৫-এর সরকারি নির্দেশ অনুযায়ী, যেখানে বলা ছিল শিক্ষাকাল ৪ বছরের কম নয় বা ৬ বছরের বেশি নয়, এদেরকে গ্র্যাজুয়েট ডিগ্রি দেওয়া যায়নি, দেওয়া হয়েছিল letters testimonial। এদের গ্র্যাজুয়েশনের ডিগ্রি সম্পন্ন করার জন্য প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল – “at the end of five years they should undergo another examination, and that their expenses to and from the presidency on that account should be defrayed by government”। শুধু তাই নয়, চাকরিতে বা প্র্যাক্টিসে যেকোন সময় প্রয়োজন পড়তে পারে বলে তাদেরকে একান্ত প্রয়োজনীয় এক সেট বই দেওয়া হয়।
এদেরকে ১০০ টাকা মাস মাইনেয় সরকারি চাকরিতে বহাল করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। দ্বারকানাথ গুপ্ত কখনো সরকারি চাকরিতে যোগ দেননি। শুরু থেকেই কলকাতায় সফলভাবে প্রাইভেট প্র্যাক্টিস করে গেছেন।
প্রথম পরীক্ষার পরে মেডিক্যাল কলেজের পরিচালনা, পড়াশুনো এবং ক্লিনিক্যাল স্টাডিজের ব্যাপারে অনেক দুর্বলতা প্রতীয়মান হয়। সে অনুযায়ী ব্যবস্থাও নেওয়া হয়। আমরা পরের কিস্তিতে এর বিস্তৃত আলোচনা করব। আলোচনা করব মেডিক্যাল কলেজের পরবর্তী বিকাশ নিয়ে।
চমৎকার। ইংরেজী চিকিৎসায় শিক্ষাগ্রহণে সফল ভারতীয় ছাত্রদের প্রথম পুরুষদের নামও জানতে পারলাম ডঃ জয়ন্ত ভট্টাচার্যের কল্যাণে। এরপর নিশ্চয়ই শুরু হবে ভারতীয় ইংরেজী চিকিৎসার উত্তরণ ও ক্রমাগত আধুনিকীকরণের বিবরণ। সফল ছাত্রদের পুরস্কৃত করার সরকারী এবং দ্বারকানাথ ঠাকুরের উদ্যোগ অবশ্যই প্রশংসনীয়। মড়া ঘেঁটে শবব্যবচ্ছেদ করা নিয়ে প্রথমদিকে যে প্রতিরোধের চেষ্টা হবে সেটা ডেভিড হেয়ার সাহেব সঠিক বুঝেছিলেন। মধুসূদন গুপ্তকে নিয়ে চর্চা সেই কারণেই। উচ্চতর শিক্ষার জন্য বিলেত পাঠানোও তো ভাবনা প্রগতিশীল চিন্তার প্রমাণ।
দারুণ লেখা আবার। ধন্যবাদ ডঃ জয়ন্তকে।
Insightful. Carry on.
খুব ভালো লেখা