প্রাগৈতিহাসিক সমস্ত গল্পের হিরো বা হিরোইন টিবিতে মুখে রক্ত তুলে’ তুলে’ মারা যেতো। ফলতঃ টিবি একটা মহান ট্র্যাজিক রোগ হিসেবে চিহ্নিত হ’য়ে পড়ে। বিশেষতঃ গরীব সর্বহারার রোগ বলে’ ব্যাপক পরিচিতি পায়। সত্যিই কি তাই? আসুন,পড়ুন হাতুড়ের আঙ্গুলে লেখা এই মহাকথা।
টিবি মোট আক্রান্ত আর মৃতের সংখ্যা পড়লে হয়তো বা আপনি চমৎকার হ’য়ে যাবেন। দু হাজার ঊনিশ সালে দশ লক্ষ চল্লিশ হাজার (১০.৪ মিলিয়ন) মানুষ টিবিতে মারা যায় (বিদেশী তথ্য)। এবং এক কোটি লোক (১০০ মিলিয়ন) টিবিতে আক্রান্ত হ’ন (বিদেশী তথ্য)। অথচ প্রায় চল্লিশ শতাংশ ভারতীয় এই রোগ বহন করে’ বেড়াচ্ছেন।আমি অঙ্কে কাঁচা, হিসেব করে’ দেখে নিন (ছাপ্পান্ন কোটি) -কতো মানুষ এই রোগজীবাণু বহন করছেন এবং প্রতিনিয়ত ছড়াচ্ছেন। এই ছাপ্পান্ন কোটিই কিন্তু সর্বহারা, নিরন্ন, ব্যর্থ প্রেমিক নন। এর বড়ো একটা অংশই স্বচ্ছল, অভিজাত পরিবারের। সুতরাং আমরা জাটিল্য বাদ দিয়ে সহজ ভাবে টিবি রোগটাকে বোঝার চেষ্টা করি। মনে রাখবেন আমাদের দেশের ডাক্তাররা সবাই সাহেবী বইয়ের সংখ্যাতত্ত্ব এবং রোগ নির্ণয়ের কথা পড়েন। অথচ সামান্য ছোটোখাটো নিরক্ষীয় অসুখ (ট্রপিক্যাল ডিজিজ) হলেই বিদেশী ডাক্তারবাবুরা আমাদের কাছে ফেরৎ পাঠান। (কম বয়সে এরকম বহু রোগী আমি দেখেছি। সম্পাদকমন্ডলীর অনুমতিক্রমে একদিন না হয় নিজের ঢাক নিজে নিজে পেটাবো)।
টিবি রোগের জীবাণুর নাম মাইকোব্যাক্টেরিয়াম টিউবারকিউলোসিস। কিন্তু সত্যিই কি এই সব তথ্য আর কচকচানিতে আমার পাঠকদের কিছু এসে যায় নাকি আমার চমৎকার জ্ঞানবৃক্ষে জলসিঞ্চন হয়?
আসুন টিবি রোগের প্রকারভেদ পড়ি।
প্রাইমারি টিউবারকিউলোসিস:-
এটা হাঁচি কাশি (ড্রপলেট ইনফেকশন) থেকে ছড়ায়।
এটা হচ্ছে প্রাথমিক টিবি। এটা শিশুদের এক থেকে চার বছর বয়সের মধ্যে হয় (বিদেশী বই বলে বয়ঃসন্ধিকালে হয়। আমার ব্যক্তিগত প্রাচীন অভিজ্ঞতা অন্য)।
এটা বহু ক্ষেত্রেই নিজে নিজে সেরে যায়। এবং এই জীবাণু শরীরে একটা বলের মতো (গ্র্যানিউলোমা) তৈরি করে’ ভেতরে বাসা বেঁধে থাকে, এই ধরণের ঘটনায় এটাকে ঘন’স ফোকাস বা ঘন’স লিশন বলে। এক্স রে’তে এই ক্ষেত্রে ফুসফুসে প্রচুর গ্ল্যান্ড পাওয়া যায়। এছাড়া ফুসফুসের নিচের দিকে অল্প নিউমোনিয়া পাওয়া যায়।দেখা যায় পুষ্ট বাচ্চাদের ঐ রোগ এক মাসে সেরে যায়।আর অপুষ্টিতে ভোগা বাচ্চারা? তারা বেশীরভাগই মা বাবা সিস্টার এবং ডাক্তারকে কাঁদিয়ে চলে’ যায় (আমি তখন মেডিসিনের হাউসস্টাফ। যেহেতু বাচ্চাদের শিরায় ভালো স্যালাইন চালাতাম তাই প্রায়ই শিশু বিভাগ থেকে ডাক আসতো। একরাতে একগাদা সাপেকাটা, ডায়রিয়া নিয়ে ব্যস্ত, নিজে খাওয়ার সময়ও পাইনি, নিজের ওয়ার্ড ছেড়ে শিশু বিভাগে যেতেও পারি নি। সকালে যখন বসে’ রোগীদের ছুটি লিখছি তখন শিশু বিভাগের ডাকসাইটে এক দিদি, খুকুদি, এসে আমার টেবিলের উল্টো দিকে বসলেন, চোখে জলবিন্দু “ডাক্তার ঘোষ আপনি গেলেন না? বাচ্চাটা এক্সপায়ার করে’ গেলো”। কথাটা আমার স্মৃতিতে চিরস্থায়ী অপরাধবোধ তৈরি করে’ দিয়ে গেছে। সেই খুকুদি এখন কোথায় আছেন জানি না। মা বাবার বুকফাটা কান্নার থেকে ঐ দিদির চোখের জলের দাম কিন্তু কিছু কম নয়।)
বিসিজি ভ্যাক্সিন (ব্যাসিলাস কালমেটি গ্যুয়েরিং):-
এটায় জীবিত কিন্তু অক্ষম টিবির জীবাণু (আমার মতোন জীবিত কিন্তু অক্ষম) বাচ্চার শরীরে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়।বাচ্চার ইঞ্জেকশনের জায়গাটা অনেক দিন শুকোয় না-যেহেতু অকর্মণ্য হলেও, টিবির জীবাণু ঢোকানো হয়েছে।কিন্তু পরে ভ্যাক্সিন নেওয়া পুষ্ট বাচ্চাদের কখনো সখনো টিবি হলেও চটপট সেরে যায়, অপুষ্টিতে ভোগা বাচ্চাদের মৃত্যুহার কিন্তু একই থাকে। এটা অরণ্যে রোদন হলো, যে জনগণ এখনও কেটে গেলে তারপর টিটেনাস ভ্যাক্সিন ন্যায়, তাদের বলা বৃথা। আগে, প্রাগৈতিহাসিক যুগে, কাটার পর এটিএস দেওয়া হতো।
সেকেন্ডারি টিউবারকিউলোসিস:-
যদি আপনার শরীরে আগে থেকেই টিবির জীবাণু থাকে, তাহলেই সেকেন্ডারি ইনফেকশন সম্ভব। এটা ফুসফুসে হলে ফুসফুসের উপরিভাগে ইনফেকশন দেখা যাবে।এছাড়াও শরীরের বিভিন্ন অংশে এই রোগ দেখা যায়।
সেকেন্ডারি টিবি কখন হয়?
আপনার অপুষ্টি বা অন্যান্য রোগের জন্য এই রোগ হতে পারে। এটা বাইরে থেকে আসে না। আপনার শরীরে যে সব জীবাণু, শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার জন্য চুপচাপ বসে ছিলো, তারা এবার সক্রিয় হয়ে ফুসফুস ছাড়াও শরীরের নানা জায়গায় ছড়িয়ে পড়ে।
এছাড়া শুগার, অতিরিক্ত মদ্যপান এবং প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়, এমন অসুখ (এইডস) প্রভৃতি রোগে এই শরীরের ভেতরে থেকে যাওয়া অসুখের জীবাণুরা পুনরুজ্জীবিত হয়।
কোথায় কোথায় হয়?
প্রশ্নের উত্তরে প্রশ্ন সমীচীন নয়, তবু প্রশ্নটা এসেই যায়।কোথায় হয় না?
কিডনি, জননাঙ্গ (বিশেষতঃ ফ্যালোপিয়ান টিউব ও ওভারি), পেটের পেরিটোনিয়াম (প্রচুর প্রচুর দেখা যায়), ক্ষুদ্রান্ত্র (এই মুহূর্তে একটাই মনে পড়ছে- এক কাঠগোলার মালিকের সন্তানের হয়েছিলো), চামড়া বা ত্বক (এটাও খুব কম দেখেছি), ভার্টিব্রাল কলম (প্রচুর দেখা যায়)-সব জায়গায় দেখা যায়।
এরথেকেও বড়ো কথা মাথার ভেতরেও হয়। কখনও টিউবারক্যুলার মেনিঞ্জাইটিস (প্রাথমিক বা সেকেন্ডারি), এবং টিউবারকিউলোমা। একবার তো ঘেঁটে একেবারে কখগঘঙ হয়ে গেছিলাম। রোগীর খিঁচুনি হওয়ার পর অন্য জায়গায় পাঠাতে হলো। সেখানে সিটি স্ক্যানে ধরা পড়লো। যে ক’জনের কথা বললাম তারা প্রত্যেকেই আপনার থেকে অনেক অনেক স্বচ্ছল পরিবার থেকে আসা। টিউবারক্যুলোমায় টিবির জীবাণুরা নিজেদের জন্য নিজেদের চারপাশে প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে’ তুলে’ আক্রমণ স্থলের চারপাশে একটা গোলাকৃতি আবরণ তৈরি করে’ ব্রেইনের ভেতরেই বাড়তে থাকে। ফুসফুস বা অন্য জায়গাতেও একই ঘটনা ঘটে।
কী করে’ বুঝবেন?
প্রতিদিন সন্ধেবেলা জ্বর আসবে। ওজন কমে’ যাবে।অক্ষিদে (ক্ষুধামান্দ্য) ইত্যাদি ঘটবে। ইএসআর বেড়ে যাবে। লিম্ফোসাইটও বাড়বে (সব ক্ষেত্রে নয়)।
রোগনির্ণয় কী ভাবে হবে?
সাধারণ ভাবে এই রোগ ধরা গরীব মানুষের কর্ম নয়।ফুসফুসে টিবি না হলে বুকের এক্স রে বা থুতু পরীক্ষায় কিচ্ছু পাওয়া যাবে না। সম্ভব হ’লে আক্রান্ত অঙ্গ থেকে পূঁজ বা রস বার করে’ সেটায় টিবি জীবাণুর অস্তিত্ব খুঁজে বার করতে হবে।
মান্টু টেস্ট অনির্ভরযোগ্য, প্রায় সব ডাক্তারের মান্টু টেস্ট পজিটিভ আসবে। কেননা প্রচুর টিবি রোগী দেখার জন্য ডাক্তারদের শরীরে অ্যান্টিবডি তৈরিই থাকে। চামড়ার তলায় অ্যান্টিজেন দিলে, অ্যান্টিজেন অ্যান্টিবডি বিক্রিয়ায় টেস্ট পজিটিভ আসবে, সুতরাং ডাক্তারের এটা পজিটিভ আসবেই। আবার যে মানুষটার একেবারেই প্রতিরোধ ক্ষমতা নেই, তার ক্ষেত্রে শরীরে রোগ থাকলেও অ্যান্টিজেন অ্যান্টিবডি কোনও বিক্রিয়া হবে না, তাই টেস্ট নেগেটিভ আসবে। পজিটিভ মানে রোগ আছে ধরা হয়, নেগেটিভ মানে রোগ নেই।
এইসব ক্ষেত্রে অন্য যে পরীক্ষাগুলো করতে হয়, সেগুলো দীনদরিদ্র মানুষের আওতার বাইরে। অথচ আমরা সহনাগরিকদের স্বাস্থ্যের জন্য গলা ফাটাবো না। বরং ব্যবসাকেন্দ্রগুলোর (কর্পোরেট বা প্রাইভেট হাসপাতালের) চড়া মূল্য কেন? এই প্রশ্নে ডাক্তারকে ফাটাবো।
মনে রাখবেন প্রতি মিনিটে প্রায় তিন জন মানুষের টিবিতে মৃত্যু হচ্ছে। এর মধ্যে আপনিও থাকতে পারেন।
জনস্বাস্থ্যের দাবী জোরদার করুন। ভারতের ছাপ্পান্ন কোটি মানুষ (তথ্য অনুযায়ী) লেটেন্ট টিবির রোগী। এরা কোনও রোগলক্ষণ দেখায় না, কিন্তু রোগ ছড়ায়।
নোটাবেনে:- এই লেটেন্ট টিবি রোগী যদি ওষুধ মাঝপথে বন্ধ করে’ থাকে, তাহলে তার জীবাণুরা ইতিমধ্যেই টিবির ওষুধের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে। সেই জীবাণু আপনার শরীরে ঢুকলে, আপনার ক্ষেত্রেও কোনও ওষুধ কাজ করবে না। এটাকে মাল্টি ড্রাগ রেজিস্ট্যান্ট টিউবারকিউলোসিস বলা হয়।
আমরা এটাকে ভয় পাই। আপনিও দয়া করে’ ভয় পান।সচেতন হোন, সচেতনতা গড়ে তুলুন। আপনি বাঁচলে….. নাম। নিজেকে বাঁচান।