ধীরে ধীরে আগস্ট মাসের শোচনীয়, নারকীয় ঘটনার বিরুদ্ধে সার্বিক নাগরিক প্রতিবাদ নিভে আসছে।
খুব স্বাভাবিক ব্যাপার। দোর্দণ্ডপ্রতাপ হুক্ক বুক্ক-র বিজয়নগর রাজ্যের কিরীটকেতন হেমকূট পর্বতের ধুনির আগুনও এক-দেড় শতাব্দীর পরে নিভে গিয়েছিল। সর্বগ্রাসী দাবানলের আগুন নেভে, একসময় প্রশমিত হয়ে যায় অসীম ক্রোধ বা ক্ষোভের আগুনও।
ধিকিধিকি আঁচটুকু থাকে, কখনো বা তা-ও থাকে না।
কিন্তু আগুন নিভে আসা মানে কি? শান্তিকল্যাণ?
এই সার্বিক নাগরিক প্রতিবাদের অনেকগুলো দিক ছিল, ছিল অনেকগুলি কোণ। মূল হত্যাকাণ্ড, তার শিকড়ের প্রশাসনিক দুর্নীতি, সমস্ত স্তরের স্বাস্থ্যকর্মীদের নিরাপত্তার বিষয়গুলি যেমন ছিল, তেমনই ছিল সরকারি স্বাস্থ্যব্যবস্থার রোগ চিহ্নিতকরণের একটা প্রচেষ্টা। দুর্বল প্রচেষ্টা হয়ত, কিন্তু কথাগুলো উঠেছিল।
তৃণমূল স্তরের স্বাস্থ্যকেন্দ্রের পরিষেবা থেকে উচ্চতম মেডিক্যাল কলেজের কাজকর্ম — কোথায় কোন রোগের চিকিৎসা হওয়ার কথা, না হলে রেফার কেন করা হচ্ছে, রোগীকে অন্যত্র পাঠানো হলে, কোথায় পাঠানো হবে — সেখান থেকে আবার রেফারাল হবে কি না, সেটা জানার জন্য হাসপাতালভিত্তিক রোগীর শয্যাসংখ্যার স্বচ্ছতা, বেড অ্যাভেলেবিলিটি জানার ব্যবস্থা সহ নানারকম দাবি উঠে এসেছিল এই চিকিৎসক এবং নাগরিক আন্দোলনে।
কথাগুলো বহুশ্রুত। উত্তরও স্বাভাবিকভাবে অজানা থাকার কথা নয় কারোরই।
কিছু কিছু দাবি, যেমন নিরাপত্তাসংক্রান্ত দাবি বা হাসপাতালের খালি শয্যাসংখ্যা জানার এবং জানানোর দাবির আংশিক সুরাহা হয়ত হয়েছে বা হচ্ছে।
আমার লেখার উপজীব্য তা নয়।
আমার প্রশ্ন, আন্দোলন তার তীব্রতা হারিয়ে ফেলল কেন? অনেকেই হয়ত প্রতিবাদ করে বলবেন, হারায়নি তো! উদাহরণ স্বরূপ নানা মিছিল, কনভেনশন, সভার উদাহরণ আমাকে দেবেন। অস্বীকার করি না, স্ফুলিঙ্গের মতো এক আধটা টুকরো এখনো জ্বলে উঠছে এখানে ওখানে — বিশাল ভূমিকম্পের পরবর্তী আফটার-শকের মতো মাঝেমধ্যেই কাঁপিয়ে দিচ্ছে নাগরিক মাটি, কিন্তু সেও অনিয়মিত হয়ে আসছে আস্তে আস্তে।
প্রথম থেকেই বলে এসেছিলাম, রাজ্যের প্রান্তিক, গ্রামীণ, দূর বাসিন্দাদের এই আন্দোলনে শামিল না করতে পারলে প্রতিবাদ দীর্ঘমেয়াদী হওয়া সম্ভব নয়।
নাগরিক সুযোগ সুবিধা সম্বলিত কয়েকটি আধাশহর বা মফস্বলে আন্দোলন দানা বাঁধলেই হবে না, এতে জড়িয়ে নিতে হবে সব শ্রেণীর মানুষকে। আপাতদৃষ্টিতে, আজকের দিনে দাঁড়িয়ে ঐ মেডিক্যাল কলেজের অঘটনটির মতো ‘কমন ইস্যু’ তৈরি করে যা প্রায় অসম্ভব।
এক ছাদের নিচে বাপ ছেলে বা স্বামী-স্ত্রীর মনোমালিন্য মেটাতে যেখানে রাজনীতির অনুপ্রবেশ প্রয়োজন হয়, সেখানে এতবড় গণ আন্দোলনের মূলধারার রাজনীতির থেকে দূরত্বের ছুঁৎমার্গ বজায় রাখলে তাকে দীর্ঘদিন টিকিয়ে রাখা যায় কি? ইউটোপিয়ান পৃথিবীতে হয়ত যেত, বিশ্বায়ন পরবর্তী ধনভিত্তিক ভুবনায়নের যুগে তা অলীক।
কয়েকদিন আগেই বহুল প্রচারিত পত্রিকায়, খ্যাতনামা অর্থনীতিবিদের সমাজবিশ্লেষণ পড়ছিলাম এই নারকীয় ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে। উচ্চ-মধ্যবিত্ত নাগরিক যাপনের বাইরের বিপুলসংখ্যক প্রান্তিক পশ্চিমবঙ্গবাসীর উপরে ঐ নারকীয় ঘটনাটির তেমন জোরালো অভিঘাত না হওয়ার কারণ হিসেবে তিনি অবলীলায় লিখছেন, ‘তাঁদের সমাজে নারী-নির্যা তন, ধ র্ষ ণ, খু ন নতুন কিছু নয়।’
অবাক হলাম, আবার হলামও না।
সমস্ত ক্ষেত্রে দুর্নীতি একটা বৈধতার সিলমোহর পেয়ে গিয়েছে সমাজের সকল স্তরের মানুষের থেকেই। সব সময় সরকারকে, রাষ্ট্রকে দোষ দেবার প্রবণতা একটি সাংঘাতিক উন্নাসিক, পলায়নপর মনোবৃত্তির পরিচায়ক।
ভেবে দেখুন, যে মুহূর্তে রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে কোনো জনহিতকর একটি নীতি নেওয়া হয়, সমান্তরালে সেই নীতি নিয়ে দুর্নীতির পথেরও জন্ম হয়।
সরকারি চাকরি পেতে গেলে ঘুষ, পছন্দসই বদলি পেতে গেলে ঘুরপথে আধিকারিকদের আবদার মেটানো, পরীক্ষায় প্রশ্নফাঁস, ইন্টারভিউতে নম্বরে কারচুপি করে অযোগ্য প্রার্থীদের চাকরি প্রদান, হাসপাতালে শয্যা/রক্ত/জীবনদায়ী ওষুধ/পরীক্ষানিরীক্ষা সুষ্ঠুভাবে করাবার জন্য দালালচক্র, চিকিৎসক/শিক্ষক/অন্যান্য বিভাগের সরকারি কর্মচারীদের তরফে ফাঁকি দিয়ে সময় চুরি, সর্বোপরি বেসরকারি ক্ষেত্রে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, এমন কি জন্ম-মৃত্যুরও নির্লজ্জ পণ্যায়ন এখন ন্যায্য — কর্তা বা ভোক্তা, কাউকেই তা আর অবাক করে না।
তোলাবাজি শুধু হাতকাটা বুল্টনরাই করে না, বিভিন্ন বিভাগের সরকারি উর্দিধারীরাও সগৌরবেই করেন। ‘এ’রকম তো হয়েই থাকে’ — এই লব্জ এখন আর কুখ্যাত নয়, রীতিমতো জলচল।
হ্যাঁ, এই দুর্নীতি হালে হয়েছে, আগে সবাই দেবশিশু ছিলাম, এইরকম অতিসরলীকরণেও আমার বিশ্বাস নেই।
তবে কি গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকারের কিছুই করার নেই? জল মেপে যাওয়া ছাড়া? কিংবা হাত উলটে ‘চতুর্দিকে অবক্ষয়, আমরা কি করতে পারি’ বলা ছাড়া?
হ্যাঁ, সরকার নৈরাজ্যে লাগাম পরাতে পারে। প্রশাসকের কাজ শাসন, শোষণ নয় — এটা নির্ভরশীল জনগণকে প্রমাণ করতে পারে একমাত্র নির্বাচিত সরকার।
আইন রয়েছে। বলবৎ করার সৎসাহস নেই, এমন চলতে পারে না। বিশ্বায়নোত্তর যুগে সব্বাই কাঁচের ঘরে বাস করি, ভাবের ঘরে চুরি করে অন্যের বাড়িতে পাথর মারলে নিজের ইমারতটিও অক্ষত থাকবে না।
সব, সমস্তকিছু যদি ভোট-রাজনীতিকে ঘিরেই আবর্তিত হয়, তবে আমি অন্তত আগামীদিনে আশার কিছু দেখছি না।
খবরের কাগজের পাতা খুললেই নব নব উৎকট পন্থায় নারী ও শিশু নিগ্রহের সংবাদ আরো আরো বাড়বে। বাড়বে ধনীর ধনগরিমার কুৎসিত বিজ্ঞাপনের বহর, আরো অনাদর হবে পরিবেশের, বন্যপ্রাণীর, সহমানবদের। সাম্প্রদায়িক হিংসা, প্রতিবেশী রাষ্ট্রের লেঠেলগিরি, ধর্মের নামে, জাতীয়তাবাদের নামে ভয়াবহ ‘জেনোসাইড’ — বাড়বে চক্রবৃদ্ধি হারে। আমরা মণিপুরের সংবাদে আগ্রহী হবো না, আর জি কর বা তৎপরবর্তী বীভৎস নারীমৃত্যুর উপাখ্যান আমাদের বিচলিত করবে না আর, হয়ত বা ভুলে যাব ভারতবর্ষের রক্তক্ষয়ী স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসও।
আর নামজাদা অধ্যাপক যখন লিখবেন, প্রান্তিক সমাজে খু ন, ধ র্ষ ণ ইত্যাদি জলভাতের তুল্য — আমরা কেউ(যদি তখনো বেঁচে থাকি) আর অবাক হওয়ার ভানও করব না।