১৮৯২ সালের জার্মানির হামবুর্গ। কলেরা মহামারির আকার নিয়েছে। বার্লিনে বসে ডাঃ রবার্ট কখ ঘোষণা করলেন এর জন্য দায়ী ভিব্রিও কলেরি ব্যাকটেরিয়া। এবং তা ছড়িয়েছে এলবে নদীর দূষিত জল থেকে।
হাসপাতালে কলেরা রোগীর ভিড় সামলাতে সামলাতে রাগে প্রায় ঘোঁত ঘোঁত করছেন ডাঃ পিটেনকোফার। “কোথাকার কে দুদিনের ছোকরা, মাইক্রোস্কোপ নিয়ে ল্যাবটরিতে সারাদিন খুট খুট করছে আর ধরাকে সরা জ্ঞান করছে।”
তাঁর সহকর্মীরা জানেন ডাঃ পিটেনকোফারের মারাত্মক গোঁ। নিজের সিদ্ধান্তে তিনি অবিচল থাকেন। হাজার প্রমাণ দেখালেও নিজের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসবেন না।
তবে তাঁরা মানুষটিকে শ্রদ্ধাও করেন। ডাক্তারবাবু অকুতোভয়। যে কোনও মহামারির খবরে দৌড়ে যান। সাধারণ মানুষের পাশে থেকে ভরসা যোগান।
ডাঃ পিটেনকোফার প্রাচীনপন্থী। তিনি রোগের মিয়াসমা অর্থাৎ বিষ-বাষ্প থিয়োরিতে বিশ্বাসী। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে চলে আসছে এই মিয়াসমা থিয়োরি। এই তত্ত্ব অনুযায়ী যেকোনো মহামারির জন্য দায়ী নোংরা বাতাস। বাতাসে ভাসমান খালি চোখে অদৃশ্য দুর্গন্ধযুক্ত পদার্থই মহামারির জন্য দায়ী। অতএব মহামারি আটকাতে হলে সবার প্রথমে পরিবেশ থেকে দুর্গন্ধের উৎসগুলিকে সরাতে হবে।
এভাবে কতবার কলেরার মহামারিকে আটকে দিয়েছেন তিনি ও তাঁর সহযোগীরা। কলেরার মহামারির সময় দুর্গন্ধ ছড়ায় রোগীদের মল আর মৃতদেহ থেকে। মলত্যাগের জন্য মাটি চাপা দেওয়া পিট পায়খানা চালু করার পর কলেরার মহামারির প্রাদুর্ভাব অনেক কমেছে।
ইদানীং কালের কয়েকজন উচ্চিংড়ে বৈজ্ঞানিক ও চিকিৎসক কিছুতেই মিয়াসমা তত্ত্ব মানতে চান না। তাঁরা হাজির করেছেন রোগের জার্ম থিয়োরি। তাঁদের মতবাদ অনুযায়ী যেকোনো মহামারির জন্য দায়ী রোগের জীবাণু বা ব্যাকটেরিয়া। তাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশী লাফালাফি করছে যে ছোকরা তার নাম ডাঃ রবার্ট কখ। ব্যাটা প্রথমে আনথ্রাক্সের জীবাণু ‘ ব্যাসিলাস অ্যানথ্রাসিস’ আবিষ্কার করেছে। তারপর টিবির জীবাণু ‘মাইকোব্যাক্টেরিয়াম টিউবারকিউলোসিস’। তারপর সুদূর কোলকাতার মেডিকেল কলেজে বসে ১৮৮৪ সালে কমা আকৃতির কলেরার জীবাণু আবিষ্কার করেছে এবং কালচার করে তাকে আলাদাও করেছে।
এই মহামারির সময় আক্রান্ত অসহায় মানুষদের পাশে না থেকে ডাঃ রবার্ট কখ বার্লিনে নিরাপদ দূরত্বে বক্তব্য রেখে বেড়াচ্ছেন। ঐ সুবিধাবাদী ডাক্তারের দুগালে দুটো থাপ্পড় মারতে পারলে ডাঃ পিটেনকোফারের সবচেয়ে ভালো লাগত। কিন্তু তা হওয়ার নয়। সারা বিশ্বের কাছে ডাঃ কখ এখন প্রায় হিরোর মর্যাদা পাচ্ছেন। সংবাদপত্রের প্রথম পাতায় তাঁর ছবি। বিশেষ করে যক্ষ্মা রোগের জীবাণু আবিষ্কার তাকে রাতারাতি বিখ্যাত করে দিয়েছে।
অবশেষে ডাঃ পিটেনকোফার চিঠি লিখলেন ডাঃ কখকে। “আপনার জার্ম থিয়োরি অনুযায়ী কলেরা রোগের ক্ষেত্রে দুষিত বাতাসের কোনও ভূমিকা নেই। এই জীবাণু খাদ্য পানীয়ের মাধ্যমে শরীরে প্রবেশ করে। আপনাকে আমি চ্যালেঞ্জ করছি, আপনি প্রমাণ করে দেখান।”
জার্মানির হামবুর্গ শহরেই দেখা হল দুজনের। ডাঃ কখের নিজের থিয়োরির উপর অগাধ বিশ্বাস। অল্প বয়সে একাধিক সাফল্য পেয়ে তিনি বেশ অহংকারী। তিনি বললেন, “প্রাণী দেহে এই পরীক্ষা করা অসম্ভব। কারণ অন্য জীব জন্তুর কলেরা হয় না।”
“তাহলে মানব স্বেচ্ছাসেবক জোগাড় করতে হবে।”
“আপনি কি বলছেন ডাঃ পিটেনকোফার? কলেরা আক্রান্ত হলে রোগীর মৃত্যুর সম্ভাবনাই বেশী। কে জেনে শুনে মৃত্যুকে বরণ করবে?”
“যদি আমি স্বেচ্ছাসেবক হই।” স্মিত হাসি ফুটে উঠল ডাঃ পিটেনকোফারের মুখে।
সে যুগে কলেরা হলে মৃত্যু প্রায় অবধারিত। চিকিৎসা তো দূরের কথা রোগীর মৃত্যুর পরে সৎকার করার লোক পাওয়া যেত না। চিকিৎসা পদ্ধতিও ছিল অদ্ভুত। রোগীকে নির্জলা উপোষ করিয়ে রাখা হত। কোথাও জোঁক দিয়ে রক্ত টানানো হত। কোথাও নানারকম পরগাছার রস খাওয়ানো হত।
ডাঃ রবার্ট কখ বয়স্ক ডাক্তারবাবুর দুঃসাহস দেখে শিহরিত হলেন। কিন্তু পিছিয়ে যাওয়ার উপায় নেই। তাহলে সাধারণ মানুষ ভাববে নিজের আবিষ্কারের উপর তাঁর বিশ্বাস নেই।
অবশেষে হামবুর্গ শহরের এক অডিটোরিয়ামে সকলের সামনে ভিব্রিও কলেরির কালচার থেকে যথেষ্ট পরিমাণ জলে গুলে ঢক ঢক করে খেয়ে নিলেন ডাঃ পিটেনকোফার। হাসি মুখে বললেন, “এর সাথে একটু পাতিলেবুর রস মেশালে খেতে দুর্দান্ত লাগত।” ডাঃ রবার্ট কখ দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। “আহারে, লোকটা বেশ রোগী দরদি ডাক্তার ছিল। নিজের একগুঁয়েমির জন্য জীবনটা দিল।”
মিনিট যায়, ঘণ্টা যায়, দিন যায়। ডাঃ পিটেনকোফার দিব্যি আছেন। খাচ্ছেন, দাচ্ছেন। ঘুরে বেড়াচ্ছেন। আর ডাঃ কখের সামনা সামনি হলেই বলছেন, “কি হল বিচ্ছু বৈজ্ঞানিক, তোমার ব্যাকটেরিয়ারা গেল কোথায়। এত সাধের আবিষ্কার হজম করে ফেললাম নাকি।”
সাতদিন কেটে যাওয়ার পরে ডাঃ রবার্ট কখ স্বীকার করতে বাধ্য হলেন, কিছু একটা গণ্ডগোল হয়েছে। তিনি বললেন, “গ্যাস্ট্রিক অ্যাসিডের কলেরার জীবাণু ধ্বংস করার ক্ষমতা আছে। হয়ত সেই জন্যই…”
“কুছ পরোয়া নেই।” ডাঃ পিটেনকোফার বললেন, গ্যাস্ট্রিক অ্যাসিড নিউট্রিলাইজ করেও তিনি এই পরীক্ষায় রাজি।
আবার তিনি ভিব্রিও কলেরির দ্রবণ খেলেন। কিন্তু ফলাফল একই।
তারপর অনেক বছর কেটে গেছে। আজ আমরা নিঃসন্দেহে জানি ডাঃ পিটেনকোফারের মিয়াসমা থিয়োরি হাস্যকর। ডাঃ রবার্ট কখই ঠিক।
আমরা এটাও জানি ক্লাসিক্যাল কলেরা ব্যাকটেরিয়া দ্বারা আক্রান্তদের ৬ জনের মধ্যে এক জনের রোগ লক্ষণ প্রকাশিত হয়। (ratio of severe cases to mild or inapparent infection is about 1:5- source Park’s text book)
El Tor কলেরার সেটা ১:২৫ থেকে ১:১০০ এর মত। অর্থাৎ কারো খাদ্যনালীতে জীবাণু প্রবেশ করলেই তাঁর যে কলেরা হবেই এরকম কোনও নিশ্চয়তা নেই। তাছাড়া ভিব্রিও কলেরি সরাসরি কলেরা করে না। ব্যাকটেরিয়াটি একটা এক্সোটক্সিন বা অধিবিষ তৈরী করে। এই অধিবিষ কলেরা রোগের জন্য দায়ী। এই অধিবিষটির আবিস্কর্তা একজন বাঙালি, ডাঃ শম্ভুনাথ দে। অত্যন্ত অধিক পরিমাণে কলেরার জীবাণু থাকলে একটা সময়ের পরে ভিব্রিও কলেরি জীবাণু অধিবিষ তৈরি বন্ধ করে দেয়।
এই হার ডাঃ রবার্ট কখকে থামিয়ে রাখতে পারেনি। সারা বিশ্ব কিছুদিনের মধ্যেই মেনে নেয় কলেরা মহামারির জন্য দায়ী ভিব্রিও কলেরি ব্যাকটেরিয়া এবং বিষ-বাষ্প বা মিয়াসমা নয়, এর জন্য দায়ী দূষিত জল।ডাঃ কখ যক্ষ্মা রোগের জীবাণু নিয়ে কাজ কর্মের জন্য ১৯০৫ সালে নোবেল পুরস্কার পান। অন্যদিকে ডাঃ পিটেনকোফার আজীবন মিয়াসমা থিয়োরি নিয়ে জার্ম থিয়োরির বিরুদ্ধে লড়ে যান এবং শেষ জীবনে হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়েন। তিনি শেষ পর্যন্ত আত্মহত্যা করেন।
তবে একটু শ্রদ্ধা তাঁরও প্রাপ্য। প্রকৃত বৈজ্ঞানিকের মত তিনিও নতুন থিয়োরিকে পরীক্ষা নিরীক্ষার মাধ্যমে যাচাই করে নিতে চেয়েছেন। তার জন্য জীবনের ঝুঁকি নিতেও ইতস্তত করেননি।
ফিচারড ইমেজ–ডাঃ রবার্ট কখ