‘রামকানাইয়ের নির্বুদ্ধিতা’ গল্পের প্রথম বাক্যটি একটু বদলে নিয়ে বলা-ই যায় – যাহারা বলে, সরকারি আপিস মানেই আঠারো মাসে বৎসর, সরকারি হাসপাতাল মাত্রেই তারিখ পে তারিখ, তাহারা বিশ্বনিন্দুক, তাহারা তিলকে তাল করিয়া তোলে।
নইলে দেখুন, গতকাল বিকেলের পর প্রকাশিত বদলির অর্ডার – সে অর্ডারও সোশ্যাল মিডিয়া না থাকলে আমার পক্ষে জানার সুযোগ ছিল না, কেননা অর্ডারটি এমনকি স্বাস্থ্য-দফতরের ওয়েবসাইটেও নেই, আমার মতো অভাজনের হাতে পৌঁছাতে পারা তো দূরের কথা – সেই অর্ডার হাতে নিয়ে শনিবার সকালেই আপিস থেকে ফোন, স্যার, রিলিজটা কিন্তু আজকেই নিতে হবে।
কে বলে, সরকারি পদাধিকারী তৎপর হতে পারেন না!
তৎপর মানুষটিকে স্বচক্ষে দেখতে গেলাম। মানে, মানুষটা তো চেনা। রামকৃষ্ণ বিবেকানন্দ মহান আদর্শ এথিক্স ইত্যাদি ভাসা ভাসা কথা বাদ দিয়ে যাঁর মুখে কাজের কথা কখনোই শুনিনি, এখন স্রেফ আমাকে রিলিজ করানোর জন্য তিনি কর্মোদ্যোগী হয়ে উঠতে পারলেন, এ কি আমার পক্ষে কম গৌরবের কথা!! তো সামনাসামনি গিয়ে জানা গেল, রিলিজ আজই নিতে হবে। রিলিজ পেতে পেতে শনিবার বেলা আড়াইটে বেজে গেলেও সেখানে রিলিজের সময় ‘ফোরনুন’ লেখা রইল, এ স্রেফ অবান্তর ডিটেইল।
আপিসের শিক্ষাকর্মীরা খুবই আগ্রহের সঙ্গে আমাকে দেখছিলেন। অনেকেই পূর্বপরিচিত। তাঁরা আমাকে নিরীহ মানুষ হিসেবেই জানতেন। কিন্তু আমি যে এমন বিপজ্জনক উপাদান, যাকে অকুস্থল থেকে হাপিস করে ফেলতে সরকারি আদেশনামা জারি হয়, এবং সে আদেশনামা তড়িঘড়ি কার্যকর করতে আঠারো-মাসে-বৎসর স্বভাবের অধ্যক্ষও টাট্টু ঘোড়ার মতো কর্মচঞ্চল হয়ে ওঠেন, তার ন্যূনতম আঁচ তাঁরা পাননি। কাজেই…
পরিবেশ-পরিস্থিতির বিচারে একদিকে বিরক্ত লাগছিল। আরেকদিকে নিজেকে অল্পবিস্তর হনু-ও মনে হচ্ছিল। পরিভাষায় যাকে বলে, মিক্সড ফিলিংস।
একজন বলেই বসলেন, স্যার, আর কখনও প্রতিবাদ করতে যাবেন না যেন। বললাম, চেষ্টা তো করি না করারই, কিন্তু কী আর করি, এতদিনের অভ্যেস…
একখানা চিঠি লিখলাম। স্বাস্থ্য-দফতরের বয়ান অনুসারে যা নাকি ‘রুটিন বদলি’, তা কার্যকরী করতে এমন তাড়াহুড়ো, এই পুরো বিষয়টা নিয়ে আমার বিরক্তির কথা লিখিতভাবে জানালাম। ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজের রেডিওথেরাপি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান হিসেবে অধ্যক্ষকে লেখা আমার শেষ চিঠি।
কাজকর্ম মিটে যেতে অধ্যক্ষ আমাকে ঘরে ডেকে পাঠালেন।
আপাতত আমার খপ্পর থেকে তিনি নিরাপদ। কেননা, আমি রিলিজড। এই সময়ে শুভানুধ্যায়ী হিসেবে চাট্টি খেজুরে গল্প করা-ই যায়। তদুপরি, বলা তো যায় না, পাশা উলটে গেলে দৈবাৎ যদি আমি ক্ষমতাবান হয়ে উঠি, তখন যদি… মেরুদণ্ডহীনের এই বড় মুশকিল। আপাতত ভয়ে তো থাকতেই হয়, উপরন্তু পরবর্তী কালে কাকে ভয় পাওয়া উচিত, সে হিসেবটাও সবসময় মনে মনে কষে চলতে হয়। ভদ্রলোকের উপর এতক্ষণ রাগ হচ্ছিল। এখন মায়া।
চা খাওয়ালেন। সঙ্গে চানাচুর। গুনে গুনে ছয়খানা কাজু। সঙ্গে কিছু উপদেশ। সদুপদেশই, সম্ভবত। আজ রামকৃষ্ণ বিবেকানন্দ নয়, একদম ওরিজিনাল। নিজের জীবন থেকে উৎসারিত অনুভূতিমালা। নিজেই বললেন, এগুলোর গুরুত্ব এখন না বুঝলেও দশ বছর বাদে বুঝতে পারব।
সত্যিই। সময়ের থেকে এগিয়ে থাকা মানুষ একজন।
এও জানলাম, দলমত নির্বিশেষে চিকিৎসকদের একজোট হতে হবে, নইলে নাকি ইত্যাদি প্রভৃতি। ঠিকই। চিটিংবাজি জালিয়াতি ধান্দাবাজি অগ্রাহ্য করে স্রেফ ডাক্তার বলেই তাঁদের বুকে জড়িয়ে ধরা উচিত। বলা উচিত, হে ভারত, ভুলিও না, মূর্খ চিকিৎসক, চিটিংবাজ চিকিৎসক, ধান্দাবাজ চিকিৎসক, ধূর্ত ধড়িবাজ ও ঘোড়েল চিকিৎসক, মেরুদণ্ডহীন চিকিৎসক – চিকিৎসক মাত্রেই আমার ভাই। দৃশ্যটা যত কল্পনা করছিলাম, ততই শিহরণ জাগছিল। নিজে বেশি আবেগ-বিহ্বল হয়ে পড়ার আগেই উঠে পড়লাম। তাছাড়া চানাচুর ও কাজু দুইই শেষ।
ওঠার আগে তিনি বললেন, মাঝেমধ্যে এসে দেখা করে যেতে। জানালেন, আমার সঙ্গে কথা বলতে তাঁর ভালো লাগে। মাঝেমধ্যে আসতে।
বললাম, অবশ্যই।
বললাম, আসি তাহলে, স্যার।
তিনি বোধহয় আশা করছিলেন, বেরোনোর আগে প্রণাম করে আসব। বিজয়ার সময় করি। ভোট চাওয়ার সময়ও করেছিলাম। কেননা, মানুষটা সৎ। অন্তত আর্থিকভাবে। আজকালকার বাজারে সেটাই বা কম কী!! আর তাছাড়া, সরকারি আধিকারিকদের মধ্যে দুর্মুখ ও অপদার্থ হওয়াটা আলাদা করে দোষের কিছু নয়।
কিন্তু ওঁর আজকের আচরণ আরেকটা দিক বড্ডো বিচ্ছিরিভাবে সামনে এনে ফেলল। তা দেখে ফেলার পর প্রণাম করাটা আমার পক্ষে বড় বেশি অভিনয় হয়ে যেত।
আজ থাক।