হৈমন্তীদেবীর বয়স ছেচল্লিশ। তিনি স্কুলে শিক্ষকতা করেছেন বেশ কিছুদিন, কিন্তু ছেলে যখন ক্লাস টেনে উঠেছিল, তার পড়াশোনার সম্যক খেয়াল রাখবার জন্য তিনি চাকরি ছেড়ে দেন। তারপর ছেলে দারুণ নম্বর পেয়ে উচ্চমাধ্যমিক পাশ করে বিটস পিলানিতে বায়োইনফরমেটিক্স পড়তে চলে যাওয়ার পর একাকীত্ব কাটাতে বাড়িতেই কিছু ছেলেমেয়েকে বায়োলজি পড়ানো শুরু করেছেন কয়েক বছর হল।
তাঁর স্বামী সুধীরবাবু পেশায় উকিল, এক কর্পোরেট সংস্থার আইনি তত্ত্বাবধানে তাঁর জীবনের সমস্ত সময় এবং শক্তি অতিবাহিত হয়। রক্তে শর্করা এবং ধমনীতে রক্তচাপ দুটোই বেশির দিকে থাকে বলে দিনে নিয়ম করে গোটাতিনেক ওষুধ খেতে হয় তাঁকে।
অন্যদিকে, হৈমন্তীদেবী অত্যন্ত স্বাস্থ্যসচেতন। স্বামীর অসুখগুলি ধরা পরারও আগে থেকে তিনি খাবারে চিনি এবং নুন কম দেওয়ার প্রথা শুরু করেছিলেন বাড়িতে; যার জন্য আগে প্রচুর কথা শুনতে হলেও, এখন ছেলে বাইরে চলে যাওয়ায় আর স্বামীর বিপি এবং শুগার দুইই বেশী জানতে পারায় তার এই স্বাস্থ্যসচেতন রান্না নিয়ে আর তেমন ঝগড়াঝাটি হয়না।
কিন্তু এত কিছু সত্ত্বেও ঠিক শান্তি নেই হৈমন্তীদেবীর মনে। তাঁর মা গত হয়েছেন বছরদেড়েক হল। তাঁর ব্রেস্ট ক্যান্সার হয়েছিল, এবং যতদিনে ধরা পড়েছিল, ততোদিনে তা শরীরের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে গিয়েছিল; কাজেই বাঁচানোর তেমন কোনও চেষ্টা করা যায়নি। মাকে হারিয়ে মানসিকভাবে মুষড়ে পড়েছিলেন তিনি ঠিকই; কিন্তু সেই শোক কাটিয়ে উঠতে উঠতে অন্য এক চিন্তা মাথায় আসতে থাকে তাঁর।
কাগজের একটি খবর থেকে জানতে পারেন যে কিছু ক্যান্সার নাকি পারিবারের একজনের হলে অন্যদেরও হওয়ার সম্ভাবনা থাকে; এবং তাঁর মধ্যে নাকি ব্রেস্ট ক্যান্সার অন্যতম। এহেন খবর জানবার পর ভয় পাওয়া স্বাভাবিক, এবং সেই ভয় থেকেই তিনি ইন্টারনেটে এই বিষয়ে আরও গভীরে পড়াশোনা শুরু করেন। নানান রকম তথ্য জানতে পারেন, তার সাথে সাথে বিভিন্ন ফোরাম থেকে বিভিন্ন মহিলাদের অভিজ্ঞতার কথা জানতে থাকেন। এও জানতে পারেন যে ৩৫-৪০ বছরের ওপর সব মহিলাদের ম্যামোগ্রাম নামক পরীক্ষা করিয়ে নিজের ব্রেস্টে কোনও মারণরোগ বাসা বাঁধছে কিনা তা দেখা উচিৎ। সেই অনুযায়ী ডাক্তার দেখানো, স্ক্রিনিং ম্যামোগ্রাম সবই করানো হয়, এবং সুধীরবাবু খুশি মুখে রিপোর্ট হাতে বাড়ি ফিরে বলেন যে ভয়ের কিচ্ছুটি ধরা পড়েনি। কিন্তু ব্যাপারটায় স্বামীর মতন পুরোপুরি খুশি হতে পারেননা হৈমন্তীদেবী। বারবার তাঁর মনে হতে থাকে যদি “পরীক্ষায় ক্যান্সার মিস হয়ে গিয়ে থাকে?”
সেই থেকে, প্রত্যেকদিন বারবার নিজের স্তন পরীক্ষা করা, যাকে ডাক্তারি ভাষায় বলে ‘সেলফ প্যালপেশন’, বারবার বিভিন্ন ডাক্তারের কাছে গিয়ে তাঁদেরকে দেখানো, পরামর্শ নেওয়া চলতে থাকে বারংবার। ডাক্তারবাবু একবার পরীক্ষা করে ছেড়ে দিলে যেন ঠিক মন ভরে না, বার দুই তিন ভালোভাবে দেখবার পর যখন নিশ্চিন্ত থাকার আশ্বাস দেন, তখন কিছুদিনের জন্য আশ্বস্ত হন তিনি। কিন্তু সেই স্বস্তি বড় ক্ষণস্থায়ী। ইন্টারনেট, কাগজ, রেডিয়ো, টিভি, ম্যাগাজিন ঘেঁটে তিনি জমাতে থাকেন ক্যান্সার সম্বন্ধে নানান তথ্য। প্রথমদিকে যেখানে মাস তিন চার বাদে বাদে ডাক্তারের কাছে যেতেন, ধীরে ধীরে সেটা কমতে কমতে প্রতি সপ্তাহ, এমনকি এক দুদিন ছাড়া ছাড়া হতে থাকে। ডাক্তারবাবু রাগ করেন তাঁর ওপর, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আশ্বস্ত করে বাড়ি পাঠাতে পারলে বাঁচেন, ছেলে মায়ের এমন ব্যবহারের কথা শুনে হাসাহাসি করে, বলে এরকম পাগলামি করা বন্ধ করতে। সুধীরবাবু অনেকবার বোঝানোর চেষ্টা করে বিফল হয়ে ছেড়ে দিয়ে বলেছেন যা করে শান্তি পাও, তাই কর। আর সে জন্যই শান্তি খুঁজতে হৈমন্তীদেবী হন্যে হয়ে একটু আশ্বাস খুঁজতে থাকেন, বারবার বিভিন্ন পরীক্ষা করিয়ে, ডাক্তার দেখিয়ে আর ইন্টারনেট ফোরামে জিজ্ঞাসাবাদ করে।
যতবার যত পরীক্ষার রিপোর্ট ঠিক আসে, তত যেন চিন্তা আরও বাড়ে তাঁর। ডাক্তারবাবুকে দিয়ে লিখিয়ে নতুন নতুন জেনেটিক পরীক্ষা করাতে উন্মুখ হন বারবার আর ডাক্তারবাবু না বলে দিলে মনের মধ্যে এমন আস্বস্তি চলে যে তিনি নতুন কোনও ডাক্তার খোঁজেন যিনি কিনা ওই পরীক্ষা লিখতে রাজি হবেন। মাথার ভেতর চলতে থাকে ঠিক এই পরিক্ষাটাতেই তাঁর ক্যান্সার ধরা পড়ে যাবে।
এই চিন্তার চোটে বাকি সব কাজ কর্ম মাথায় ওঠে তাঁর। টিউশান তো বটেই, এমনকি বাড়ির রোজকার রান্নাবান্নারও খেয়াল থাকে না আর। মাথার ভেতর ওই চিন্তাই কেবল ঘুরেফিরে চলে আসে, যতই তিনি অন্য কিছু ভাবার চেষ্টা করুন না কেন। শেষমেশ এক সদ্য পাশ করা সার্জেন হৈমন্তীদেবীর অবস্থা দেখে তাঁকে বুঝিয়ে বলেন যে তাঁর হয়ত শারীরিক চিকিৎসার সাথে সাথে কোনও একজন মনোরোগ বিশেষজ্ঞকে দেখানো দরকার।
প্রথমে একেবারেই মানতে চান না তিনি, ভাবেন এই কমবয়সী ডাক্তার তাঁর সাথে রসিকতা করছেন। তাঁর এই চিন্তার কথা ধরতে পেড়ে ডাক্তারবাবু তাঁকে বোঝান যে অতিরিক্ত চিন্তা করারও নানান কুফল হয় শরীরের উপর, সেজন্যই চিন্তা কমানোর চিকিৎসা করতে সাইকিয়াট্রিস্ট ডাক্তার মিত্রের কাছে যাওয়ার একরকম উপদেশই দেন তিনি।
অনেক দোটানা অতিক্রম করে সপ্তাদুয়েক বাদে একদিন সুধীরবাবুকে নিয়ে হাজির হন তিনি সেই চেম্বারে। ডাক্তারবাবুকে বার বার বুঝিয়ে বলেন যে তাঁর আদৌ কোনও মানসিক রোগ নেই, তিনি শুধু নিজের ব্রেস্ট ক্যান্সারের বিষয়ে একেবারে ঝুঁকি নিতে চান না।
ডাক্তারবাবু মন দিয়ে বিনা মন্তব্যে সবটা শোনেন। জিজ্ঞাসা করেন তাঁর কতখানি বিশ্বাস যে তাঁর ক্যান্সার হয়েছে? একটু হকচকিয়ে গিয়ে হৈমন্তীদেবী নানান লক্ষণের উদাহরণ দিয়ে প্রমাণ করার চেষ্টা করতে থাকেন যে তাঁর কেন মনে হয় যে তাঁর নিশ্চিতভাবে ক্যান্সার হয়েছে এবং তা এতরকম পরীক্ষাতেও কিছুতেই ধরা পড়ছেনা বলেই মায়ের মতন হয়ত তাঁরও চিকিৎসায় দেরী হয়ে বড় কোনও ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা বাড়ছে। তিনি এও বলেন যে তিনি চান তাঁর দুটি স্তনই অপারেশন করে বাদ দিয়ে দেওয়া হোক কিন্তু ডাক্তারবাবুরা কেউ রাজি হচ্ছেন না।
ডাক্তার মিত্র খুব একটা বেশী কথা বাড়ান না এই প্রথম মিটিঙে। শুধু বলেন যে অপারেশন করতে চাইলেও তাঁর মানসিক চিন্তা কম করা জরুরী। সেই কারণেই একটা হাল্কা ওষুধ খাওয়ার অনুরোধ করেন তাঁকে। আর জানতে চান তিনি নিজেকে আবার পুরনো জায়গায় দেখতে চান কিনা?
হৈমন্তীদেবীর আধখানা হ্যাঁ এর উত্তরে খুব খুশি হয়ে বলেন যে, “আমি আপনার ব্রেস্ট ক্যান্সার ঠিক করতে পারি কি না পারি, আপনাকে আবার আপনার পড়াতে দেখতে চাই”; তারপর, বারবার ডাক্তার বদলানোর কুফল বুঝিয়ে বলেন যে কোনও একজন সার্জেনের কাছেই বার বার দেখাতে আর মাসে একবারের চাইতে বেশী কোনওভাবেই কোনও ডাক্তারের কাছে না যেতে, তাতে লাভের তুলনায় তাঁর ক্ষতির সম্ভাবনা বেশী।
ক্যান্সার সম্বন্ধে প্রায় কোন কথাই বলেন না ডাক্তার মিত্র, শুধু বেরোনোর সময়ে তাঁর সুস্বাস্থ্য কামনা করে বলেন যে তিনিও চান যেন তিনি তাড়াতাড়ি আগের পরিস্থিতিতে ফিরে যেতে পারেন।
ডাক্তারবাবুর বোঝানোতে কী যে ঠিক হয় বোঝেন না হৈমন্তীদেবী, ওষুধটা খেতে শুরু করেন নিজে থেকেই। খানিকটা যেন মানসিক শান্তি আসে তাতে। ডাক্তারবাবুকে কথা দিয়ে এসেছিলেন মাসে একবারের বেশী ডাক্তার দেখাবেন না, কিন্তু সেটা বেশ মুশকিল কাজ তা বুঝতে পারেন। তবুও খুব চেষ্টা করেন মনের ভেতরের চিন্তাগুলোকে দমিয়ে রাখার, নিজেকে মনে করান বারবার চিন্তা করে নিজের কেবল ক্ষতিই হয়।
প্রায় বছরখানেক ডাক্তার মিত্রের কাছে কেটে গেছে হৈমন্তীদেবীর। জানতে পেড়েছেন যে তাঁর অসুখটির নাম হাইপোকনড্রিয়াসিস বা illness anxiety disorder. এই রোগ একধরনের ও সি ডি-র মতন, যেখানে রোগীর বদ্ধপরিকর ধারণা হয় যে সে কোনও এক গম্ভির রোগে আক্রান্ত, এবং সবরকমের প্রমাণ পাওয়া সত্ত্বেও সে মেনে নিতে পারে না যে তার শরীরে সেই রোগের কোনও অস্তিত্ব নেই। বারবার প্রমাণ খোঁজার চেষ্টার সাথে সাথে এই রোগ আরও বাড়তে থাকে আর বিশ্বাস তত গাড় হয়। এই রোগের চিকিৎসা করা রীতিমতন জটিল এবং সময়সাপেক্ষ, এবং রোগীর নিজের অংশগ্রহণ ছাড়া প্রায় দুষ্কর। চিন্তা কমানোর কিছু ওষুধ দিয়ে এই অসুখ কে খানিক বাগে আনা গেলেও, এর প্রধাণ সমাধান কাউন্সেলিং বা থেরাপি। ধীরে ধীরে বিভিন্ন ডাক্তারের কাছে বার বার যাওয়া (Doctor shopping) , বিভিন্ন পরীক্ষা- নিরীক্ষা করানো আর রোগের বিষয়ে অতিরিক্ত ভাবনা চিন্তা বন্ধ করে রোগীকে জীবনের অন্যান্য জিনিসে মনোযোগ দেওয়া শুরু করাতে পারলে এই রোগের উপশম সম্ভব।
প্রচুর চেষ্টায় হৈমন্তীদেবী প্রায় মাস চারেক কোনও ডাক্তার দেখাননি। আবার করে পড়ানোটা শুরু করেছেন, একটা ছোটখাট বাগান করাও শুরু করেছেন বাড়ির ছাদে। এখনও যে কখনও কখনও পুরনো চিন্তাগুলো ভয় দেখিয়ে যায়না এমন নয়, কিন্তু তাদের গুরুত্ব দেওয়া কমিয়ে দিয়েছেন তিনি। ডাক্তার মিত্রের পরামর্শে সুধীরবাবুও পরিবারের দিকে মন দিতে শুরু করেছেন। স্ত্রী বড় বেশী ভয় পেলে বলেন, ”আমায় ছেড়ে তোমায় আগে ভাগে যেতে দিচ্ছে কে শুনি?” অভিমানী মধ্যবিত্ত কথা কাটাকাটিতে তখন হৈমন্তীদেবীর মৃত্যুভয় কোথায় যেন উবে যায়।