উদ্বাস্তু। অসিত বরণ চক্রবর্তী। ষাঠের কোঠায় বয়স। বার্মিজ ধরনের চেহারা - গাঁট্টাগোঁট্টা। ছোট ছোট করে ছাঁটা কাঁচা পাকা চুল। চ্যাপ্টা নাক। দাড়িগোঁফ পরিস্কার করে কামানো। বাঘাযতীন কলোনির বাসিন্দা। বাহাত্তরের টালমাটাল সময়ে চট্টগ্রাম থেকে পালিয়ে এসেছেন। যুদ্ধে ভয় পান। মৃত্যুতেও ভয় পান। এদেশে এসে উদ্বাস্তু কলোনির একটি মেয়ের সঙ্গে ওনার বিয়ে হয়। তারপর মা মারা যান। ডালহৌসি চত্বরে একটা অফিসে চাকরি করে একমাত্র ছেলেকে বড় করেছেন। ওনার স্ত্রী ছায়া। বাহাত্তরের যুদ্ধে তাড়া খেয়ে এখন গৃহবন্দী থাকাই পছন্দ করেন।
অসিত বরণ চক্রবর্তী বরং এবিসি নামেই অফিসে বেশী পরিচিত ছিলেন। এবিসি নিজেও অসম্ভব সঙ্কুচিত থাকতেন। নিজের ক্ষুদ্রতায়- নিজের ঘর আর বাজারের বাইরে কোথাও যেতেন না। না- আরেক জনের কাছে যেতেন। এক মাঝবয়সী ডাক্তার। ডাক্তার কখনও ওনাকে ভয় দেখায়নি। ডায়াবেটিস হলেও বলেছে চালিয়ে যান কিচ্ছু হবে না। অসম্ভব ভীতু এবিসি অন্য কোনো ডাক্তারের কাছে গেলে হাত কাঁপতো – ঘাম হতো – মনে হতো আজই বোধহয় মৃত্যু পরওয়ানা শুনবেন। মৃত্যুকে বড়ো ভয় পান। তাই অবসরের পরে ওনার বাইরের জগৎ এসে মাসে একবার ব্যাঙ্ক, দিনে একবার বাজার আর তিনমাস পর পর সাহস পাওয়ার জন্য ঐ এক চেনা ডাক্তারের চেম্বারে।
না আরেক বার বেরোতেন প্রতি সন্ধ্যায় বাসস্ট্যান্ড এলাকায়। ছেলে কলেজ থেকে না ফেরা পর্যন্ত উনি বসে থাকতেন ল্যাম্প পোস্টের পাশের বেঞ্চিতে। ছেলে ফিরলে শক্ত চওড়া মানুষটি কলেজের ব্যাগটা নিয়ে বাড়ির পথে হাঁটা দিতেন। বাবা ছেলের কথা বিশেষ কিছুই হতো না। এবিসি বরাবরই চুপচাপ। ছেলেও বাবার মতোই। দুজনেই যে যার মতো হেঁটে যেতো বাসরাস্তা থেকে গলি পার হয়ে পুকুরপাড়ে কঞ্চির বেড়া দেওয়া দুকামরার পাকা বাড়িতে। ঝিঁঝিঁ ডাকতো। জামাকাপড় বদলে ছেলে দুটি জলমুড়ি বা মাছভাত খেয়ে পড়তে বসতো। ছায়াদেবী আর এবিসি দুজনেই সামনের বারান্দা কাম খাওয়ার ঘরে – যার একপাশে আছে রান্নার গ্যাস আর হাঁড়ি কুঁড়ি- সেখানে টিভিতে তেরো পার্বণ এটা সেটা আর বাংলা সংবাদ দেখতেন। রাত বাড়তে থাকতো। ছেলেটা টেবিলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়তো। ছায়াদেবী ভাত বাড়তেন। এবিসি বিছানা পাততেন। টানটান করে। মশারি টাঙাতেন। ছেলে মুখে চোখে জল দিয়ে খেতে গেলে ছেলের বিছানাটা করে দিয়ে তারপর নিজে খেতে আসতেন।
আর একটা বছর তারপর ছেলেটা পাশ করে যাবে। চাকরি? অসম্ভব ভীরু এবিসি কিন্তু স্বপ্ন দেখতেন। একটাই স্বপ্ন। ছেলেটা চাকরি পাবে। কোনোদিন কোনও স্বপ্ন দ্যাখেন নি। কেবলমাত্র নিজের কাজটুকু করে গ্যাছেন। ঐ আধবুড়ো ডাক্তারের সঙ্গে গল্প হতো। ছেলের পড়া চাকরি এই সব কিছু নিয়ে। এখন ওনার মৃত্যুভয়টা অনেক কমেছে। শুগার প্রেসার সবই মোটামুটি ঠিক আছে। তবুও তিনমাস পরপরই অভ্যেস বশে ঐ চেম্বারে গিয়ে বসে থাকতেন। একমাত্র ওনাকেই ছেলের চাকরি পাওয়ার খবরটা দিলেন। আর কারুর সঙ্গেই এবিসির বিশেষ পরিচয় ছিলো না। একজন ছোটোখাটো আপাদমস্তক ভীতু অমিশুক মানুষ।
শুধু ছেলের চাকরিটা বড্ড দূরে হয়েছে। সেই দূর সল্টলেকের অফিস। প্রাইভেট ফার্ম। বড্ড খাটায়। রাতে ফেরার ঠিক থাকে না। ফিরতে বড় অসুবিধে হয়। সবদিন বাস পায় না। মাইনে পেয়ে ছেলে মিষ্টি নিয়ে এসেছিলো। ছায়াদেবী একটা শাড়ি আশা করেছিলেন। কখনও মুখ ফুটে কিছু না চাওয়া ছায়াদেবী মুখ ফুটে সেটাও ছেলেকে বলেন নি।
সংসারটা একটু খানি স্বচ্ছল হয়েছে। এখন আর বাজার করতে এবিসি টাকার কথা আর ভাবেন না। ছেলেকে ছোটবেলায় যা যা খাওয়াতে পারেন নি সেগুলো প্রায়ই কিনে ফ্যালেন। টিভি দেখতে দেখতে কখনও ছায়াদেবীর সঙ্গে নতুন স্বপ্নজাল বোনেন। দুটো তো ঘর আছেই। ভালোই দিন চলে যাবে। এখন ছেলেটা মোটরসাইকেল কিনেছে। আসার সুবিধে হয়। মোটরসাইকেলটা রাতে আর ছুটির দিনে বেড়ার ভেতরে রাখা থাকে। এবিসি সকালে উঠেই ওটা মুছে রাখেন। ছেলে কিছু বলে না। কিন্তু মা বাবার প্রতি করুণায় মন ভরে যায়। এবারের পুজোয় দুজনকেই ভালো ভালো শাড়ি জামা দেবে।
??????????
ফ্ল্যাট জীবনের যাপন
বাবলু জানালা দিয়ে সিগারেটের স্টাম্প টুসকি দিয়ে বাইরে ফেলে চিৎকার করে “এই মিঠু বাবাইএর হলো? নাহলে কিন্তু আজকেও অফিস লেট ….”
বাবাই ভেতর থেকেই চ্যাঁচায় “জাস ওয়ান সেক পাপা, অলমোস্ট রেডি”
মিঠু বেরিয়ে আসে “বাবাই তাড়াতাড়ি আয়, পাপা লেট হয়ে যাবে – এই শোনো আমি টুইশন থেকে তুলে ওকে নিয়ে সোজা টাকিলা চলে যাবো – তুমি বাই এইট ওখানে রীচ করবে কিন্তু -”
বাবুল বলে “হ্যাঁরে ক্লাস এইট হলো এখনো তোর একটা সিরিয়াসনেস এলো না? যাও দ্যাখো তো আর কতো দেরি?”
“আ গিয়া পাপা”
বাবুল বলে “চলো লেটস গো”
মিঠু একটু হাসে তারপর বাই করে ফ্ল্যাটের দরজা লাগায়। টাকিলা থেকে খেয়ে বেরোতে বেরোতে প্রায় রাত এগারোটা। বাইরে একটা পানের দোকানে বেশ ভিড়। অল্পবয়সী সব ছেলেমেয়েদের দল। মিঠু ঈঙ্গিত করলো দ্যাখো মেয়েরাও সবাই সিগারেট খাচ্ছে। বাবলু একটুখানি টলমল করছে। যদিও দুপেগ মাত্র পান করেছে। পান আর সিগারেট শেষ হলে বাবলুর খেয়াল হয় আরে কালকে তো অফিস মিটিং। ওরা পার্কিং লট থেকে গাড়িটা বার করলো রাস্তা মোটামুটি ফাঁকা।
“এই জোরে চালাবে না … তুমি কিন্তু টিপসি হয়ে গ্যাছো”
“আরে দুজনে তো সমান সমানই নিয়েছি”
“আমি তো এখুনি ঘুমিয়ে পড়বো হিহিহি”
রাস্তা রাস্তার মতোই পিছলে পিছলে যাচ্ছে। বাবুল ছেলেকে নিয়ে চালালে ভীষণ সাবধানে ড্রাইভ করে। ক্যামাক স্ট্রিট, পার্ক সার্কাস, বালিগঞ্জ ফাঁড়ি, গোলপার্ক সব পেরিয়ে সিগন্যাল খেলো যাদবপুর থানায়। মিঠু চোখ খোলে “এইই আমরা কোথায় এলাম গো?”
বাবাই বলে “এমা মা তুমি আউট হয়ে গ্যাছো …. এটা তো যাদবপুর থানা…”
সিগন্যাল ছাড়তেই ওরা আবার রওয়ানা দ্যায়…. আগামীকাল বাবাইয়ের ইউনিট টেস্ট ……সকালে ওঠা……
* * * * * * **
রাত প্রায় বারোটা বাঘা যতীন কলোনির একটা ঘরে কেবল আলো জ্বলছে। এক বৃদ্ধ বারবার ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছেন। পাশে তাঁর জীবনসঙ্গিনী। বৃদ্ধ অস্থির হয়ে পড়েছেন। ছায়াদেবী সান্ত্বনা দিলেন “অফিসে তো কাজ পড়ে যায় … হয়তো ….”
এবিসি অস্থির হয়ে বলেন “এবার আমাদের একটা মোবাইল ফোন কিনতে হবে” ওনার কপাল বেয়ে ঘাম পড়ে। গেঞ্জি ভিজে যায়। ঘড়ির কাঁটা ঘুরতেই থাকে। অসিতবাবু গায়ে জামা চাপান। হাত কাঁপছে। বোতাম লাগাতে পারছেন না। আগে খোকন যখন ছোট্ট ছিলো রাতে যদি কেঁদে উঠতো অসিতবাবু ভয় পেতেন। খোকনের যদি কিছু হয়? যদি খোকন…..
এই মানুষকে ছায়াদেবী মাঝরাতে কোথায় পাঠাবেন? উনি অসিতবাবুর জামা খুলে ন্যান ” বোসো তো স্থির হয়ে… কাজে আটকে গ্যাছে তাই হয় তো অফিসেই….”
ছায়াদেবীও ভয় পাচ্ছেন। সবপেয়ে আবার সব হারানোর ভয়। এ্যাতো বড়ো পৃথিবী … ঈশ্বর তুমি আমাদের খোকনকে দেখো। ক্রমশঃ সকাল হয়ে আসে। অসিতবাবুকে আর আটকে রাখা যায় না। উনি কাঁপা কাঁপা হাতে পোশাক পরে নিয়ে বেরিয়ে পড়েন।
“কোথায় যাচ্ছো?”
অসিতবাবু জানেন না কোথায় যেতে হয়। ভয়ে দুশ্চিন্তায় ওনার মাথা অকেজো হয়ে গ্যাছে। উনি ছায়াদেবীর দিকে তাকিয়ে থাকেন।
“একবার থানায় গেলে হয় না?” এবিসি রওয়ানা দ্যান।
পেছন থেকে ছায়াদেবী বলেন “একটা ট্যাক্সি করে নিও”
বাঘা যতীন মোড়ে ভোর রাতে মাছের লরি এসেছে। মাছের গন্ধ। কুলিদের কোলাহল। আড়ৎদার। চায়ের কিয়স্ক। বিড়ি সিগারেটের ধোঁয়া। একটা ট্যাক্সিওয়ালা চা খাচ্ছিলো ” না যাদবপুর যাবো না… এইতো একটুকুন রাস্তা …. হেঁটে চলে যান দাদা -এটুকু কোনও ট্যাক্সি যাবেনা …” লোকটা বিড়ি ধরায়।
* * * * * * **
বহুদূরে একটা ফ্ল্যাটেও তখন ভোর হচ্ছে। ওখানেও সবাই রাত জেগে আছে। বাবাই খেয়েএসেই উজাড় করে বমি করেছে। তারপর থেকে ছটফট ছটফট। বাবুল বারান্দায় বসে একটার পর একটা সিগারেট …. পাশে মিঠু
“দ্যাখো আমি নামলেই কেস খেতাম. … আগামীকাল অফিস মিটিং বাবাইয়ের ইউনিট টেস্ট… কতো দেরি হতো….” মিঠু চুপ করে থাকে।
বাবুল মুখ খারাপ করে “শিট কিছু বলছো না ক্যানো অ্যাজ ইফ আয়্যাম দ্য কালপ্রিট… শিট শিট শিট”
ভেতরে বাবাইয়ের বমির আওয়াজ আসে।
“বাবাই বারান্দায় হাওয়ায় আয় ভালো লাগবে”
বাবাই আস্তে আস্তে এসে দাঁড়ায় “বাবা লোকটা বেঁচে যাবে না?”
“হ্যাঁ বাবা ওর তো শুধু একটা পায়ে লেগেছিলো”
“তাও কত্তো রক্ত না বাপি?”
বাবুল উঠে চলে যায়। লোকটার একটা পা পিষে গেছিলো। রক্তে ভেসে যাচ্ছিলো। হাসপাতালে নিলে হয়তো… কিন্তু মিটিং ইউনিট টেস্ট… সব ডুবে যেতো – সে অনেক ঝামেলা হতো। বাবুল বিছানায় মুখ গোঁজে। শালা সবাই এমন করে তাকাচ্ছে যেন আমি ভিলেন … আমিই খুন করেছি –
“মিঠু দিস ওয়জ অ্যান অ্যাকসিডেন্ট বাই সাম আদার কার। রাস্তায় পড়েছিলো … কোনও লরি বাস কেউ মেরে চলে গ্যাছে… বাস্টার্ডস … এখানে আমার কি দোষ?”
একটা বিধ্বস্ত পরিবার রাতজাগা। আর রাত জাগা বৃদ্ধ এবিসি টলোমলো পায়ে ঘামতে ঘামতে থানায় যাচ্ছেন ওনাদের মৃত সন্তানের সন্ধানে। পায়ে পায়ে। রেলিং ধরে ধরে। স্বপ্নের টুকরো কুড়িয়ে আনতে।