আমি ভয়ানক মঞ্চ ফোবিক। ছোটো বেলায় পাড়ার ফাংশনে মা ঠেলে ঠুলে মঞ্চে তুলে দিয়েছিল, আমি মাইকের সামনে ভ্যাবলার মতো দাঁড়িয়ে ছিলাম। কবির নাম, কবিতার নাম তো ভুলেই গেছিলাম, নিজের নামটাও বলতে পারিনি।
একটু বড়ো হওয়ার পর দু-চারবার মঞ্চে কবিতা বলার চেষ্টা করেছি। হাতে চোতা নিয়ে উঠতাম, দেখে দেখে বলতাম। শ্রোতারা আবৃত্তির সাথে একটা ‘ধক ধক’ ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক শুনতে পেতেন। সেটা আমার হৃদপিণ্ডের শব্দ ছিল।
বোধবুদ্ধি হওয়ার পর থেকে মঞ্চ এড়িয়েই চলতাম। অদ্ভুতভাবে অন্য কোথাও আমার অসুবিধা হতো না। হাসপাতালে মারমুখি জনতাকে দিব্যি ভুজুং ভাজুং দিয়ে অক্ষত দেহে বেরিয়ে এসেছি। মেডিক্যাল কলেজে নামকরা সব মেডিসিনের প্রফেসর এবং ভুল ধরতে উৎসুক সবজান্তা দাদাদের সামনে রেয়ারস্য রেয়ার কেস প্রেজেন্ট করেছি- সমস্যা হয়নি।
তাই মঞ্চ ফোবিয়া নিয়ে কোনোদিনও দুশ্চিন্তা করিনি। আমি তো আর নেতা, মন্ত্রী হচ্ছি না। তবে হতচ্ছাড়া করোনা এসে সব গুবলেট পাকিয়ে দিয়েছে। ইদানীং রক্তদান শিবির, বস্ত্র দান শিবির, যে কোনও মেলা- খেলায় আমন্ত্রণ পাচ্ছি। অধিকাংশই কাটিয়ে দেওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করছি। কিন্তু কয়েকজন নাছোড়বান্দা এবং পরিচিত মানুষ আছেন, যারা আমায় মঞ্চে তুলে মই কেড়ে নিচ্ছেন।
যাই হোক, গল্প শুনতে এসে ব্যক্তিগত বকবকানি শুনতে ভালো লাগার কথা নয়। ঘটনায় ফেরত আসি। দ্বিতীয় ঢেউয়ের সময়ে অনুরোধের ঠেলায় এরকম একটি অনুষ্ঠানে গেছি। একটি কমিউনিটি কিচেনের রজত জয়ন্তী। যথারীতি সময়ে পৌঁছে দেখি আমি ছাড়া অন্য কোনো আমন্ত্রিত অতিথি আসেন নি। একধারে কমিউনিটি কিচেন থেকে প্যাকেট করা খাবার দরিদ্র মানুষের মধ্যে বিতরণ করা হচ্ছে। সেখানে ভিড় ভাট্টা- তুমুল হই হট্টগোল চলছে। আর মঞ্চের উপর একটি নেড়ি ফুল ফ্যামিলি সহ (নেড়া ও এক গণ্ডা বাচ্চা) আয়েস করছে।
একজন কর্মকর্তাকে পাকড়াও করলাম। বললাম, ‘এই যে, আপনারা বলেছিলেন অনুষ্ঠানের সময় ঠিক বেলা বারোটা। আমি বারোটাতেই এসেছি। কিন্তু আপনাদের তো কোনও প্রস্তুতিই হয়নি।’
তিনি দাঁত বের করে হেসে বললেন, ‘প্রস্তুতি নেওয়াই আছে। থানার বড়োবাবু, হাই স্কুলের হেড মাস্টার, লোকাল কাউন্সিলার এখনই এসে যাবেন। আপনি মঞ্চে গিয়ে বসুন। এই সুরো, কুকুর গুলোকে মঞ্চ থেকে তাড়িয়ে ডাক্তারবাবুকে একটু বসিয়ে দে।’
মঞ্চে বসে থাকার বিন্দু মাত্র বাসনা আমার নেই। বললাম, ‘আমার ইয়ে… একটু তাড়া আছে। চেম্বারের সময় তো। রোগীরা অসুস্থ শরীরে অপেক্ষা করবেন।’
কর্মকর্তা বললেন, ‘দশটা মিনিট দেখুন। কেউ না এলেও অনুষ্ঠান শুরু করে প্রথমেই আপনাকে ছেড়ে দেব। চলুন আমাদের কর্মকাণ্ড একটু দেখাই।’
যেখানে প্যাকেট বিতরণ চলছে সেখানে গেলাম। কর্মকর্তা ভদ্রলোক বললেন, ‘বিপ্লব, ইনি ডাক্তারবাবু। এনাকে একটু আমাদের কাজ কর্ম সম্পর্কে বলো।’
বিপ্লব আমার থেকে বছর পাঁচেকের ছোটোই হবে। হেসে বলল, ‘এনাকে চিনি তো। আমিই অনেকবার গেছি আপনাকে দেখাতে।’ তারপর কর্মকর্তা ভদ্রলোককে বলল, ‘তপনদা, একশো প্যাকেটে হবে না। এখনও অনেক লোক অপেক্ষা করছে। আরও অন্তত সত্তর আশিটা প্যাকেট লাগবে।’
তপনবাবুর কপালে চিন্তার ভাঁজ, ‘সেটা আমি আগেই বুঝতে পেরেছি। রান্না আবার চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। তুমি একটু ধৈর্য্য ধরে বাকিদের অপেক্ষা করতে বলো। আমি দেখছি যতটা তাড়াতাড়ি করা যায়। ডাক্তারবাবু, আপনি মিনিট দশেক বিপ্লবের সাথে থাকুন। ও খুব ভালো ছেলে। স্টেশনে একটা ছোটো পরোটার দোকান ছিল, অনেকদিন বন্ধ। ওদের নিজেদের খাওয়া ঠিক ঠাক জোটেনা, অথচ ওই রোজ অনেক মানুষের মুখে খাবার তুলে দিচ্ছে। আমি রান্না কতোদূর এগোলো দেখে আসি। তারপর কথা দিচ্ছি কেউ আসুক বা না আসুক, অনুষ্ঠান শুরু করে আপনাকে ছেড়ে দেব। আপনি মহামারীর সময়ে দরিদ্র মানুষদের, যাদের পেটের দায়ে লকডাউনেও রোজ বেরোতে হচ্ছে, তাঁদের কি সাবধানতা নেওয়া উচিৎ এই নিয়ে দুচার কথা বলবেন।’
ব্যাস, মঞ্চে উঠে বলতে হবে শুনেই আমার পেটের মধ্যে গুড়গুড় শুরু হল। চেয়ারে বসে কী বলবো গুছিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছিলাম, বুকের ধুক ধুকানি আরও বাড়ছিল। হঠাৎ বিপ্লবের চিৎকারে ঘোর কাটলো, ‘এই… এই… তুমি লাইন ভেঙে এসেছো কেন। যাও গিয়ে লাইনে দাঁড়াও। খাবার শেষ হয়ে গেলেও সমস্যা নেই, আধঘন্টার মধ্যেই নতুন প্যাকেট চলে আসবে।’
দেখলাম একজন শীর্ণ মহিলা বছর দেড়েকের একটি বাচ্চাকে কোলে নিয়ে বিপ্লবকে কিছু বলছেন আর বিল্পব ঘাড় নেড়ে শুধু না না বলছে।
মহিলাকে দেখে বেশ খারাপই লাগল। বেচারা একটু খাবারের আশায় কে জানে কতক্ষণ বাচ্চা কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। তাঁর চেহারাতে অপুষ্টির ছাপ স্পষ্ট। মহিলা ম্লান মুখে আবার লাইনে গিয়ে দাঁড়ালেন।
বিল্পবের উপর বেশ রাগ হলো। ভালো ছেলে না ছাই। যার যেটুকু ক্ষমতা আছে, সুযোগ পেলেই দুর্বলের উপর সেই ক্ষমতা দেখায়। যুবকটিও যেমন দেখাচ্ছে। ঘড়ি দেখলাম, দশ মিনিট প্রায় হয়ে গেছে। এবারে বিরক্তি লাগছে।
প্যাকেট শেষ, লাইনে সামান্য কোলাহল শুরু হয়েছে। বিপ্লব জোর গলায় বলল, ‘এখুনি প্যাকেট চলে আসবে। অধৈর্য হবেন না।’
আমি বললাম, ‘ঐ মহিলাকে খাবারটা আগে দিয়ে দিতে পারতে। বেচারার ছেলে কোলে দাঁড়িয়ে থাকতে কষ্ট হচ্ছে।’
বিপ্লব বলল, ‘আগে কেন দেব? ওর আগে থেকে যারা দাঁড়িয়ে আছে, তাহলে তাঁদের সাথে অবিচার করা হতো।’ তারপর সে এগিয়ে গিয়ে মহিলার কাছ থেকে বাচ্চাটিকে নিল। বাচ্চাটি দিব্যি হাত বাড়িয়ে তার কোলে চলে এলো। অবাক হয়ে বললাম, ‘বাচ্চাটি কে?’
‘এইটি আমার সন্তান। আর ওইটি আমার স্ত্রী।’
‘সে কী, তুমি নিজের স্ত্রীকে এভাবে লাইনে দাঁড় করিয়ে রেখেছো?’
বিপ্লব হাসল, ‘কেন আমার বউ কি বিশেষ কেউ? ও লাইনে দাঁড়াবে না কেন? এই তো আজকেই ফেসবুকে একটা ছবি দেখলাম, কানাডা না কোন দেশের প্রধানমন্ত্রী একটা দোকানে খাবার কেনার জন্য লাইনে দাঁড়িয়েছেন। এক দেশের প্রধান মন্ত্রী যদি স্বয়ং লাইনে দাঁড়াতে পারেন, আমাদের কী করা উচিৎ?’
কী করা উচিৎ আর কী করা অনুচিত জানিনা। তবে এটা পরিষ্কার বুঝতে পারলাম যে সত্যিকারের মানুষ, সে ঠিক মনের মতো আদর্শ খুঁজে নেবে। নাহলে ভারতবর্ষে নেতা মন্ত্রী কী কম পড়েছিলো? বিপ্লবকে কিছু বলতেও পারলাম না, কারণ ততোক্ষণে মঞ্চ থেকে কেউ আমার নাম বারবার ঘোষণা করতে শুরু করেছে।
?
ধন্যবাদ ?