মোটা কাঁচের জানালার ওপাশ থেকে পর্দা সরিয়ে উঁকি দিয়ে যাচ্ছে এলইডি আলো। আমার এপাশে অন্ধকার। ফ্যানের অবিশ্রান্ত আওয়াজ। এর পাশাপাশি আর কোনও মানুষ নেই, কোলাহল নেই, ব্যস্ততা নেই।
এবং কালকের সকাল নেই। চেনা সকাল। রোদ, মানুষ, হর্ন, চিৎকার, ঝগড়া, হিসেব, ঘাম, অটোর জন্য দৌড়, বাসের পাদানিতে ঝুলতে ঝুলতে যাওয়া তিনজন মানুষ, টিফিনবক্স, “ঘুম থেকে উঠেছিস?”, স্কুলের সামনে দীর্ঘ জ্যাম, বিরক্তি, হাজার মানুষ পেটের ভেতর গিলে রানাঘাট লোকালের এসে থামা শিয়ালদায়, তারপর আবার “টিকিট দেখি”, “সাইড দিন”, ডেডলাইন, ভারত অস্ট্রেলিয়া, “সাড়ে ছ’টায় নন্দন, টিপ পরে আসিস”, “বিমলদা দু’টো চা দেবে”, “সবাই এভাবে কথা বলছে কেন আজকাল!”, “ওহফ, এত মানুষ কোত্থেকে এলো!”, লাস্ট মেট্রো, কবরডাঙার লাইন, চারটে রুটি আর হাফ ডিম তড়কা, “সিগারেটটা খাস না আর”, “আমি তারায় তারায় রটিয়ে দেবো/ তুমি আমার…”
কিচ্ছু নেই।
যা যা না থাকলে এতদিন মনে মনে ভেবেছিলাম আহা কী ভালো হয়, আজ হঠাৎ ঘন্টা গুনছি, দিন গুনছি, নিঃশ্বাসের শব্দ গুনছি তারা আবার কবে ফিরে আসবে। কবে স্বাভাবিকভাবে ভাববো, কথা বলব, কাঁচাপাকা স্বপ্ন দেখব, গুছিয়ে তর্ক করব, আইসক্রিম খেয়ে অপরাধবোধে ভুগব, আলটপকা বলব “তোকে ছাড়া বাঁচব না”। কবে অপ্রয়োজনীয় মৃত্যুবিলাসী হ’ব, হঠাৎ একলামি থাকবে, বছর পুরোনো অভিমান থাকবে, The pursuit of happyness দেখে কান্না হবে অঝোরে? কবে? কেউই জানি না।
শুধু রোগ নয়, ভয় পাওয়াচ্ছে এই অস্বাভাবিক স্থাণুত্ব, এই ভয়াবহ উত্তরহীনতা, এই চরাচরবিস্তৃত অনিশ্চয়তা। হঠাৎ অনুভব করছি উইল স্মিথের অনেকগুলো লড়াই, তার মধ্যে সবচেয়ে কঠিনটি হ’ল ধু ধু শহরের মধ্যে দিনের পর দিন অসম্ভব একলা বেঁচে থেকে “I’m legend” হয়ে ওঠার লড়াইটা। ভয় পাচ্ছি সেই সর্বগ্রাসী একাকিত্বকে। বিচ্ছিন্নতাবোধ এ সময়ের প্রধানতম বৈশিষ্ট্য, তবু চারটে এবড়োখেবড়ো দৃশ্য আর দশজন ভাঙাচোরা অপরিচিত মানুষ পাশে এসে বসলে, অন্য রঙেরই সই কথা গান হাসি মেলে ধরলে মনে হয় আমরা সবাই জুড়ে আছি, বেঁচে আছি কোনওভাবে। আজ হঠাৎ এই পড়ে পাওয়া অসীম নির্জনতা সারাদিনের হাজার খবর আর গ্রাফ আর তরল ইথারমাধ্যমের দৃশ্য বর্ণ কথা পেরিয়ে আমাদের সবাইকেই ভীষণ বিচ্ছিন্ন করে দিচ্ছে, একলা করে দিচ্ছে। পেটে চেনা খাবার, ফেসবুকে চেনা শব্দমুখ আর একঘেয়ে চেনা চারদেওয়াল নিয়েও মাথার ভেতর এক্কেবারে অচেনা এই ধূ ধূ একাকিত্ব পেরিয়ে ঘন্টা মিনিট গুলো যেন আর টানা যাচ্ছে না কিছুতেই।
আমরা অনেকে, অনেকেই প্রিয় পরিবার, নিজের চেনা জানালা দুয়ার উঠোন থেকে অনেকখানি দূরে। পরিস্থিতি, বাধ্যতা, দায়। ভেতরে বাইরের এই নির্জনতা, বন্ধুহীনতা, এই শূন্যতাকে বয়ে নিয়ে চলা ভীষণ দমবন্ধকর।
“সব ঠিক হয়ে যাবে” বিড়বিড় করতে করতে একসময় ঘুমিয়ে পড়লেও স্বপ্নে ভেসে আসে যুদ্ধবিধ্বস্ত শহরের ছবি। ঘুম ভেঙে আলো জ্বালি, জল খাই; সিলিং থেকে একটা টিকটিকি স্থির তাকিয়ে থাকে আমার দিকে। অন্ধকারে বালিশে মাথা দিয়ে কেন জানি না মনে পড়ে ডায়ানোসরদের কথা, উল্কাপাতের কথা, মহেঞ্জোদারোর কথা। কত ধ্বংস, হত্যা, মৃত্যু, সভ্যতা, অন্ধকার পেরিয়ে আমি আর একটা টিকটিকি আজ সময় গুনছি একইভাবে। সমস্ত দিনের শেষে এক সামান্য নামহীন সরীসৃপ আর জন্মসূত্রে ‘এ পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জীব’ সার্টিফিকেট প্রাপ্ত এই আমি পরস্পরের কাছে দুর্বোধ্য তবু একইরকম একা, বিষণ্ণ, হয়ত সূর্যের সাথে অপেক্ষা করছি পরবর্তী সুসংবাদ ওঠার…
এই মহামারী শুধু বেছে বেছে কিছু ফুসফুসকে আক্রমণ করেনি, সে প্রত্যেককে দিনের পর দিন আরও একা, জড়, বিষণ্ণ করে দিয়ে যাচ্ছে মস্তিষ্কে, সুষুম্নাকান্ডে।
যারা এখনও ভালো আছেন, তারা রাত বাড়লে পরিচিত বিষণ্ণদের খবর নেবেন একবার?