চারদিন হ’ল ন’তলার কেবিনে উঠে এসেছি। প্রতিদিনের সেই চেনা হাঁকডাক, গাড়ির হর্ন, রোজকার কেজো আলাপচারিতার চিহ্নমাত্র নেই। ওয়ার্ডে পা রাখলেই বাচ্চার কান্না, বাড়ির লোকের অভাব-অভিযোগ আরও হাজারো কাজের ফিরিস্তি মিলিয়ে আমার যে থোড়-বড়ি-খাড়া পৃথিবী, সেসব যেন ঝুপ করে কোথায় হারিয়ে গেছে! দিনে দু’বার রাউন্ড, পালস-বিপি-অক্সিজেন স্যাচুরেশন মাপা আর ওষুধ-জল-খাবার পৌঁছে দেওয়ার সময়টুকু বাদ দিলে বাইরের কারও সাথে বাক্যালাপ নেই। আমি অবশ্য বরাবরই অসামাজিক। অপরিচিত বা স্বল্প পরিচিত কারো সাথে কথা বলতে গেলে প্রথম দু-তিনটে কথার পর শব্দ হাতড়ে বেড়াই। অদ্ভুত অস্বস্তি আর দোটানায় ভুগি। কারও নাম মনে রাখতে পারি না। বরং, এই একাকীত্ব বড় প্রিয় আমার। নিজের সাথে একলা হলেই আয়নার ওপারে আমার ব্যক্তিগত দুনিয়ার দরজা খুলে যায়। দরজা ঠেলে শব্দেরা ছুটে আসে… নিঃসংকোচ। সৃষ্টিছাড়া।
কাচের জানলার ওদিকে চকিতে বদলে যাচ্ছে আকাশ। সকালের কালো মেঘ ফুঁড়ে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামছে। বৃষ্টি নামছে আমার খুব পরিচিত লাল বাড়িগুলোর ছাদে। জানলার কাচে বৃষ্টির জলছবি। আবছায়া আলো-আঁধারিতে আরও রহস্যময়ী, আরও মায়াবী হয়ে উঠছে এশিয়ার প্রাচীনতম মেডিক্যাল কলেজ। মেডিক্যাল কলেজ মানে শুধু কিছু মাথা উঁচু বাড়ি নয়… প্রতিটি ঘোরানো সিঁড়ি, উঁচু সিলিং, মোটা থাম, ভারী আসবাব, ইঁটের খাঁজের আড়াল থেকে ইতিহাস ফিসফিসিয়ে কথা বলে।
সে ইতিহাস ছুঁয়ে বৃষ্টি নামছে..
শেষ কৈশোরের কলেজবেলার স্মৃতি ছুঁয়ে বৃষ্টি নামছে..
আমাদের আগুন দিন ভিজিয়ে বৃষ্টি নামছে..
আমাদের স্লোগানের চিৎকারে তাল মিলিয়ে বৃষ্টি নামছে..
**
মানসদা.. আমার প্রাণসখা মানস। বারো বছর হ’ল আমাদের সম্পর্কের বয়স। কোভিডেও পিছু ছাড়িনি। প্রায় একই সাথেই দুজনের কোভিড ধরা পড়ে এবং একই জায়গায় ভর্তি! দশটা বিষয় নিয়ে আলোচনা হলে আটটাতেই মেলে না। ঝগড়া করে ফাটিয়ে দিই। তারপর দীর্ঘ পনেরো-কুড়ি মিনিট মুখ দেখাদেখি বন্ধ থাকার পর পরবর্তী ঝগড়ার প্রস্তুতি নিই। এখানে যদিও দুজনেই ‘শান্ত ছেলে’ হয়ে বসে আছি। এতটা সময় একসাথে থেকেও ঝগড়া হচ্ছে না ভেবে বড্ড মুষড়ে আছি। দুজনেই আর একটু সুস্থ হয়ে যাই.. তারপর এসব ‘উল্টে না খাওয়া ভাজা মাছ দিনগুলোর’ সুদ সমেত উশুল করবো।
**
নিচে রাস্তায় রোজকার সাধারণ ভিড়। বেশিরভাগেরই মুখে মাস্ক নেই। ভিড় করে পুজোর কেনাকাটা চলছে। কী দারুণ ‘ফিল গুড’ আবহাওয়া! শুধু আমরা স্বাস্থ্যকর্মীরাই ভয় পাচ্ছি। আগের লেখায় হাসপাতালের উন্নত পরিষেবা নিয়ে লিখেছিলাম। পড়ে অনেকে উৎসাহিতও হয়েছিলেন বোধহয়। কিন্তু মাথায় রাখুন, পুজোর সম্ভাব্য জনসমাগমের পর রোগীর যে ঢল নামতে চলেছে তাকে সুষ্ঠুভাবে সামাল দেওয়ার ক্ষমতা পৃথিবীর কোনও হাসপাতালের নেই। তখন আর এই পরিষেবা.. আচ্ছা, সেসব ছাড়ুন। দু’একজন কেঠো মানুষের কথা শুনে কে কবে এরকম ফুর্তির সুযোগ ছেড়েছে? কাজেই চালিয়ে যান.. শুধু কিছু বেয়াড়া প্রশ্ন সাজিয়ে যাই-
এতজন অকালে ঝরে যাওয়া মানুষের অদৃশ্য লাশ মাড়িয়ে উৎসবে মাততে ভালো লাগবে আপনার?
এত পরিযায়ী শ্রমিকের রক্ত আর বুভুক্ষু চোখের সামনে নতুন জামা-জুতোর ঝলক অশ্লীল মনে হবে না?
**
লেখা এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। কথার খেই হারিয়ে ফেলছি। অসুস্থতার পর অগুনতি শুভেচ্ছাবার্তা পেয়েছি। মাথা পেতে নিয়েছি সবটুকু। এখনো শরীর বেশ দুর্বল, গা গোলাচ্ছে। রক্তেও কিছু সমস্যা আছে। যদিও জ্বরটা এখন আর আসছে না।
লিখতে লিখতে মেঘ সরে গিয়ে আকাশ ঝকঝকে। বৃষ্টি ধোওয়া রোদে ঝলমলিয়ে উঠছে মারীর দেশ। আরও অনেক লড়াই বাকি। আরও অনেক বৃষ্টি-রোদের খেলা পেরিয়ে, অনেক শীত-বসন্তের বলিরেখা শরীরে নিয়ে মারীর দেশের রূপকথা লেখা হবে। জয়ের রূপকথা। দেখো, হবেই।