অমর্ত্য সেন বলেছেন– “monumental blunder”, আমাদের দেশের স্বাস্থ্য-ব্যবস্থা নিয়ে মন্তব্য করতে গিয়ে হতাশ নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদের এই দীর্ঘশ্বাসে আমরা শঙ্কিত হয়ে উঠি। হাসপাতালের সামনে মুমূর্ষু রোগীর অনন্ত প্রতীক্ষা, জরুরী বিভাগে মৃতপ্রায় মানুষের গভীর আকুতি, নিষ্ঠুর, সম্ভ্রমহীন চিকিৎসাব্যবস্থা ও সর্বোপরি রোগী-চিকিৎসক সম্পর্কের পারস্পরিক আস্থাহীনতা- এই নিয়ে আমাদের চিকিৎসাব্যবস্থা। পীড়িত মানুষ হাসপাতালের কাছে একটি নম্বর, যা আমাদের ভিক্টর হুগোর কয়েদী চরিত্রদের মনে করিয়ে দেয়। চিকিৎসকের অমানবিকতার কাহিনী তাই যে মানুষের মুখে মুখে ফিরবে তা কোন অত্যাশ্চর্য রূপকথা নয়, তা চূড়ান্ত বাস্তব। এই অমানবিকতা ও স্বার্থপরতা কি চিকিৎসাব্যবস্থার ত্রুটি নাকি চিকিৎসকরা বিশেষভাবে অমানবিক আচরণ করেন নেহাত অভ্যাসবশে, কারণ মানবিক মূল্যবোধের উচ্চতর আদর্শ থেকে তারা পতিত হয়েছেন, তারা উচ্চকোটির প্রাণী, তারা এক অলীক স্বপনরাজ্যের অধিবাসী, যেখানে মূল্যবোধের অভাবই শাশ্বত সত্য। সংবাদপত্রের পরতে পরতে অমানবিক চিকিৎসাকান্ডের নিত্যনতুন মহাভারতসম উপাখ্যান, কি করলে মানুষটি বাঁচতে পারতেন কিন্তু হৃদয়হীন চিকিৎসকের নিষ্ঠুরতার বলি হয়ে অকালে চলে গেলেন, তার মর্মস্পর্শী উপাখ্যানে নিজের অজান্তে চোয়াল শক্ত হয়ে ওঠে, বিচারক মন উৎসাহী হয়ে ওঠে, প্রয়োজনীয় কিন্তু পাপদগ্ধ, ভ্রষ্টব্রত এই ক্রুর চিকিৎসক-নামক প্রাণীটিকে ধরাধাম থেকে বহিষ্কারের একাঘ্নী বানে বিদ্ধ করবার জন্য নিজেকেই অর্জুন বলে ভাবতে ইচ্ছে করে। তাই তাৎক্ষণিক বিচারে দোষী সাব্যস্ত করে এই পাপীদের শাস্তি মনে প্রশান্তি আনে। চিকিৎসা-ব্যবস্থায় এই বৈশ্য মনোভাবাপন্ন চিকিৎসকরা না থাকলে নিখুঁত হত- নিষ্কলঙ্ক আয়েশার ভ্রূযুগলের একতিল খামতি হল এই দুরাত্মাদের উপস্থিতি।
অথচ, চিকিৎসকরা মানুষ– এই সমাজ থেকে রসগ্রহণ করে তারা বেড়ে উঠেছে, তার মূল্যবোধ তারা নিজের অজান্তে শুষে নিয়েছে, এই সমাজের আচরণেই তারা ধীরে ধীরে ঋদ্ধ হয়েছে। শৈশব-কৈশরে স্বার্থপরের মত নানা বর্ণ আর বৈচিত্র্যময় গ্রন্থের অক্ষর আর বাক্য কি তাহলে তার মনুষ্যত্বকেই নিংড়ে নিয়েছে? সে কি প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে মেডিকেল স্কুলের চৌকাঠ অতিক্রম করার সময়েই নিজেকে ক্রুর, হৃদয়হীন, অর্থগৃধ্নু পিশাচে পরিণত করেছে, নাকি ঐ চৌকাঠের পারাপারে বিশেষ কোন যন্ত্রের সাহায্যে তার মূল্যবোধকে পিষে বের করে তাকে অমানবিক পিণ্ডে পরিণত করেছে , নাকি আমাদের দৃষ্টিক্ষীণতা আর বিচারের অক্ষমতা ও যূথবদ্ধ-মানসিকতা মুদ্রার অপর পিঠ দর্শনে অপারঙ্গমতার কারণ। আমাদের ক্রোধ কি বিচারক্ষমতাকে পঙ্গু করে রেখেছে যা না-পাওয়ার বেদনার দগদগে ক্ষতচিহ্ন চিকিৎসকের সামান্য স্খলনে অনিয়ন্ত্রিত হয়ে ওঠে?
===================================================
ভলতেয়ার বলেছিলেন– সেবিকারা রোগ নিরাময়ের কাণ্ডারী, চিকিৎসক শুধু রোগীর মনোরঞ্জক। পুরনো সিনেমার চিকিৎসকরা যেমন হতেন আর কি! রাগী ধন্বন্তরী, বেখেয়ালী, দানে মুক্তহস্ত, গানে মানবেন্দ্র, গ্রহণে সঙ্কুচিত সেইসব মহাপ্রাণ রূপালী নায়ক-নায়িকারা স্মৃতির কন্দরে যতই আবেগের জন্ম দিক, বর্তমান সমাজে তার অনুপস্থিতি যে নিষ্ঠুর সত্য তা যতটা না আকস্মিক তার চেয়ে ও তা যুদ্ধোত্তর পৃথিবীর বিকৃতির প্রতিফলন। সেই শান্ত, সৌম্য, মানবিকতা-আক্রান্ত দেবশিশুদের সরবরাহ সমাজের সর্বস্তরে দুষ্প্রাপ্য হয়ে উঠেছে। আজকের যুগে বিধাতা পুরুষ যেন প্রতিমার নিঁখুত রূপে দৃষ্টি দিচ্ছেন বেশী করে, তার প্রাণ প্রতিষ্ঠায় তার তেমন আগ্রহ নেই। যে সমাজে সিদ্ধ পুরুষের ছড়াছডি ছিল, সেখানে অর্ধসিদ্ধ কূপমন্ডুকতার মৈনাক পর্বত। প্রয়াত সিদ্ধার্থ শঙ্কর রায় মহাশয়কে অনেকে নিন্দা করেন, নানা বর্ণময় বিশেষণে তাঁকে বামপন্থীরা স্মরণ করেন। তাঁর সাথে একবার আকস্মিক সাক্ষাতের সুযোগ হয়েছিল। তাঁর প্রহরব্যাপী স্মৃতিচারণ আমার স্বাভাবিক নির্বুদ্ধিতায় হারিয়ে ফেলেছি কিন্তু জনপ্রতিনিধিদের সম্পর্কে তাঁর দাদামশায়ের উক্তিটি এখনো অমলিন হয়ে আছে। এক প্রায়ান্ধকার সন্ধ্যায় চিত্তরঞ্জন দাশ মহাশয়ের কাছে কোন কৃপাভিক্ষু তাঁর নাতির জন্য এক বাক্স চকোলেট নিয়ে এসেছিলেন, ভদ্র সভ্য মানুষটি ক্রোধে ক্ষিপ্ত হয়ে বাক্সটি আস্তাকুঁডে বিসর্জন দিয়েই ক্ষান্ত হননি, সেই ভিক্ষু মহামানবের জন্য চিরতরে তাঁর গৃহদ্বার বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। তিনি বলেছিলেন-রাজনীতি করতে এসেছি, সিজার-পত্নীর মত নিষ্পাপ থাকতে হবে। আজকে যাদের আমরা নির্বাচিত করি তাঁরা সকলেই না হলেও বেশীর ভাগই সিজারের পত্নীর চেয়ে ম্যাকবেথ-পত্নীর আদলে তৈরী- তাঁদের দুহাতে রক্ত, যা ধুলেও পরিষ্কার হয় না, তাদের উচ্চাশার রথচক্রে সাধারণ মানুষরা আহত, রক্তাক্ত হচ্ছেন। কিম্বা মনে করুন সেই দরিদ্র শিক্ষককে- শিক্ষাদান যাঁর আদর্শ, কাঞ্চনমূল্যেও যা ক্রয় করা যায় না, সেই বিদ্যা দান করেই তার অপার সুখ। গৃহিণীর শিবের সংসারে সব বাড়ন্ত, শুধু হৃদয় দিয়ে ক্ষুধাতৃষ্ণা জয় করা সেই মহতী শিক্ষককুল যেন পৃথিবী থেকে চিরতরে বিদায় নিয়েছে। কচের মত সঞ্জীবনীবিদ্যালিপ্সু চিকিৎসককুল যারা একদিন ধান্যমুষ্ঠি লাভে করেও খুশি মনে আর্তের সেবা করতো তারা চিরতরে বিদায় নিয়েছে। তাদের জায়গা নিয়েছে সাদাকুর্তা পেশাদার, মাপা হাসি আর চাপা ঠোঁটের ত্র্যহস্পর্শে রোগ নিরাময় হয় কিনা জানি না, রোগীর অটল বিশ্বাস আর আস্থা যেন চিড খায়। বেশীর ভাগ রোগ নিরাময় হয়, রোগী আবার তার বাঁধাঘাটে তরী ভিডিয়ে দেয়, কিন্তু না পাওয়ার বেদনা আর সূক্ষ্ম অপমানবোধে স্পৃষ্ট থাকে। চিকিৎসকের স্নেহের সে স্পর্শ যা একসঙ্গে সমীহ ও ভরসা জোগাত তা কেমন সবার অলক্ষ্যে বিদায় নিয়েছে। খাদ্যে ক্ষুন্নিবৃত্তি হয়, কিন্তু তুষ্টি? সে মায়াবী মারীচের মত জগত থেকে বিদায় নিয়েছে।
সমাজের সর্বস্তরে চিরায়ত মূল্যবোধের এই ক্রমানবতি ও অবক্ষয় কি কোন আকস্মিক সমাপতন নাকি ধূমায়মান পর্বত দেখছি কিন্তু প্রকৃত অগ্নিকে অস্বীকার করছি? সমাজ বিবর্তন অন্যতর মূল্যবোধের জন্ম দেয়, কিন্তু এ কেমন সমাজ যার যূপকাষ্ঠে জীর্ণবস্ত্রের মত আমাদের যা কিছু মহান, যা মানবিক গুণে সমৃদ্ধ, যা অপরকে কাছে টেনে নেয় তাকে বিসর্জন দিচ্ছি!!
এইরকম সমাজে একজন চিকিৎসকের কাছে মানুষের প্রত্যাশা আর প্রাপ্তির তুল্যমূল্য আলোচনা খুবই প্রয়োজনীয়। রোগীর প্রত্যাশা শুধু নিরাময় নয়, তার দরকার নির্ভরতা, আস্থা মানবিকতা, সম্ভ্রমপূর্ণ সদ্ব্যবহার। বর্তমান চিকিৎসা পরিকাঠামোতে কি সেটা আদৌ সম্ভবপর? এদেশে চিকিৎসাখাতে ব্যয় অপ্রতুল (মাথাপিছু ৩৯ ডলার) যা এমনকি অনেক অনুন্নত দেশের থেকেও কম। প্রতি হাজারে শয্যা সংখ্যা ০.৮ যা প্রতিবেশী শ্রীলঙ্কার (৩/১০০০) থেকে কম। স্বাস্থ্য খাতে বাজেট বরাদ্দ জিডিপির মাত্র ১.২%। জনস্বাস্থ্যে খরচের হার মাত্র ২০% (প্রয়োজন ৭০%), স্বাস্থ্যে ব্যক্তিগত বিনিয়োগ শতকরা ৮০% যার ৭৪ % ব্যয় হয় ওষুধ ও সরঞ্জামের জন্য। সরকারী পরিকাঠামোর রোগী-চিকিৎসক সাক্ষাতের গড় সময় ১ মিনিট মাত্র। স্বাস্থ্যের মানোন্নয়নেত্র জন্য যে উপযুক্ত পরিকাঠামো প্রয়োজন তার অভাবের কথা চিন্তা করে সরকার শ্রীনাথ রেড্ডি কমিশন গঠন করেন, যা সাম্প্রতিককালে সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য ব্যবস্থা বলে বিবেচিত হয়। শ্রীনাথ রেড্ডি কমিশনের সুপারিশ সরকার গ্রহন করেন নি। সে রিপোর্টে বলা হয়েছিল ২০২২ সালের মধ্যে স্বাস্থ্যখাতে বাজেট বরাদ্দ বৃদ্ধি করে ৩ শতাংশ করতে হবে, ব্যক্তিগত খরচ কমিয়ে ৩৫% করতে হবে ও জনস্বাস্থ্যব্যবস্থা শক্তিশালী করতে হবে। দেশে এখন যেখানে স্বাস্থ্য ব্যয়ের বেশীরভাগই বেসরকারী বিনিয়োগ, স্বল্প বিনিয়োগকারী সরকারের পক্ষে বেসরকারী ক্ষেত্রকে প্রভাবান্বিত করা প্রায় অসম্ভব। চিকিৎসা ব্যবস্থার আর একটি বড় সমস্যা হল অসম বিন্যাস। চিকিৎসক , হাসপাতাল ও শয্যা সংখ্যার নিরিখে গ্রাম-শহর বিভাজন স্পষ্ট- গ্রামীণ চিকিৎসা ব্যবস্থা সঙ্কটজনক বললেও অত্যুক্তি হয় না। বস্তুত চিকিৎসা নিয়ে মানুষের বাস্তব অভিজ্ঞতা অতীব করুণ ও ভয়াবহ কিন্তু তার মূল দায়ভার কার সেটা নিয়ে খুব জরুরী আলোচনার প্রয়োজন আছে।
==================================================
পৃথিবীর সব দেশের মত এদেশেও চিকিৎসা নিয়ে মানুষের চাহিদা সীমাহীন। পৃথিবীর অন্যতম ধনী ব্যক্তি একজন ভারতীয় হতে পারেন, কিন্তু পিঁপড়ের ডিম খেয়ে বেঁচে থাকা মানুষটিও ভারতীয়। চাহিদার নিরিখটিও তাই আলাদা। একই কেন্দ্রে একজন রমণী মা হওয়ার আকাঙ্খা নিয়ে চিকিৎসকের কাছে মাথা ঠুকছেন, সেই কেন্দ্রে অবাঞ্ছিত শিশুকে পৃথিবীর আলো দেখতে না দেওয়ার জন্য অন্য মায়ের আকুতি। একজন খেতে না পেয়ে অসুস্থ, অন্যজন মেদ কমানোর জন্য প্রাণপণে দৌড়াচ্ছে। কিন্তু পরিকাঠামোর অসম বিন্যাস ও অপ্রতুল স্বাস্থ্য পরিকাঠামো এই বহুমুখী চাহিদা পূরণে অক্ষম। চিকিৎসা শিক্ষা-ব্যবস্থাটিও অন্যতর ব্যাধিতে আক্রান্ত। যে অল্পবয়সী ছাত্রটি মেডিকেল স্কুলের পেষণযন্ত্রে পিষ্ট হয়ে অবশেষে চিকিৎসক হয়ে বেরোচ্ছে, সে এই সমাজ ব্যবস্থার কতটুকু খবর রাখে? যে দারিদ্রপীডিত আর্ত মানুষের সেবায় সে আত্মনিবেদন করতে চায় সে কি তাদের একজন হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে চায়, নাকি সে সমাজের বাইরে উচ্চকোটির কোন ছদ্ম সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত হতে চায়? সমাজবিজ্ঞান, ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিমুখতা চিকিৎসকের নিজস্ব পছন্দের বিষয় নয়, বস্তুত: চিকিৎসা বিদ্যা এক অন্যতর কলা যা তার মনোযোগ অন্য সবকিছু থেকে বিচ্ছিন্ন করে তাকে একধরনের সমাজচ্যুত বিচ্ছিন্ন দ্বীপে পরিণত করে। অধীত কেতাবী বিদ্যার বাইরে তার দক্ষতা কম, সে অন্য কোন বিষয়ে সহজ সরল আলোচনার বদলে তার বিশেষ পারঙ্গমতা নিয়ে বেশী চিন্তিত। দক্ষ নাবিক সে কিন্তু সমুদ্রের আবহাওয়া বিদ্যা তার করায়ত্ব নয়। সে সহজেই উচ্চমানের চিকিৎসা দেয় কিন্তু রোগীর সাথে ভাব বিনিময়ে তার স্পষ্ট অনীহা।”আপনি বুঝতে পারবেন না” তখনই বলতে হয় যখন যিনি বুঝতে চান আর যিনি বোঝাতে চান তাদের বিপরীতমুখী মনোভাব ও উদ্দেশ্য থাকে। রোগী-চিকিৎসক সম্পর্ক মনোবিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে মনে হয় দাতা ও গ্রহীতার সম্পর্ক অহেতুক জটিল হয়েছে ।রোগীর সীমাহীন ও কখনো কখনো অবাস্তব প্রত্যাশা আর চিকিৎসকের অতি পেশাদারিত্ব, যা হয়ত পেশার কোন ক্ষতি করে না কিন্তু মনুষ্যত্বের নিরিখে নিজেকে ক্ষুদ্র করে ফেলে। তারা যদি আরো বেশী সময় দিয়ে আরো ভাব বিনিময় করেন, তাহলে জটিলতা কমতে পারে। কিন্তু সংসার অনভিজ্ঞ চিকিৎসকদের খুব প্রথমেই এর প্রয়োজনীয়তা ও তাত্ত্বিক ভিত্তিকে শক্তিশালী করা প্রয়োজন ও পাঠ নিয়ামকদের এ বিষয়ে নজর দেওয়া দরকার।