আমার রাজনীতি-বেলার ৪০ দিনে প্রায় ১২০০ কিমি পায়ে হেঁটে বীরভূমের আনাচে-কানাচে ঘুরেছি। এমন নয় যে বীরভূম আমার অচেনা কিন্তু ভোটের ময়দানে অনভিজ্ঞ আমার মনে হয়েছিল নিছক ভোট চেয়ে লোকের কাছে যাওয়ার পরিবর্তে তাদের খোঁজখবর নেওয়া অনেক বেশি জরুরি। বীরভূমে মাথা পিছু আয় কম ও সহজ সরল জীবনযাত্রার জন্য জীবনশৈলীঘটিত সমস্যা আমাদের ছোটবেলায় অজানা ছিল। জলবাহিত নানা অসুখ, হাম, জলবসন্ত এই সব তখন ছিল মূল অসুখ।
এই সুদীর্ঘ যাত্রায় মানুষের সাথে মেলামেশার সুযোগে দেখলাম যে বীরভূমে অসুখের বারোমাস্যায় সেই জলবাহিত অসুখের প্রকোপ তো কমে নি তার সাথে যোগ হয়েছে নতুনতর মারী- এ শুধু প্রাণে নয়, ধনপ্রাণে মারে। এই জেলার যে প্রান্ত বরাবর আমি ঘুরেছি প্রায় ৩৭০০০ পরিবার সরাসরি পাথর খাদানের সাথে যুক্ত। উন্মুক্ত খাদানে অত্যন্ত দূষিত বাতাসে প্রশ্বাসে প্রদাহকারী ক্ষুদ্র কণিকা মানুষের জীবন দুর্বিষহ করে তুলেছে। আমি কিছু তথ্য সংযুক্ত করে এই বিষয়ে আলোকপাত করছি।
বীরভূম জেলায় চারটি ব্লকে পাথর খাদান আছে।
১) রামপুরহাট -১ ব্লক :- সরাসরি পাথর খাদানের শ্রমিক সহ পাথরের অন্যান্য কাজে যুক্ত শ্রমিকের সংখ্যা প্রায় ১৪০০০ জন।
শ্বাসতন্ত্রের সমস্যায় আক্রান্ত শ্রমিক প্রায় ৩০০০ জন।
২) মহম্মদবাজার ব্লক :-সব মিলিয়ে শ্রমিকদের সংখ্যা প্রায় ১২০০০ জন।
শ্বাসতন্ত্রের সমস্যায়
আক্রান্তের সংখ্যা প্রায় ৩০০০ জন।
৩) নলহাটি -১ ব্লক :- সব মিলিয়ে শ্রমিকদের সংখ্যা প্রায় ৫০০০ জন।
শ্বাসরোগে আক্রান্ত শ্রমিকদের সংখ্যা প্রায় ৫০০ জন।
৪) মুরারই -১ ব্লক :- সব মিলিয়ে শ্রমিকদের সংখ্যা প্রায় ৬০০০ জন।
শ্বাসতন্ত্রের রোগেআক্রান্ত শ্রমিকদের সংখ্যা প্রায় ৪০০ জন।
অটোমেশন হওয়ার জন্য সর্বত্র শ্রমিকের সংখ্যা কমেছে।
প্রধান গুরুত্বপূর্ণ খাদান এলাকাগুলি হল শালবাতরা, পাঁচামি, বড়পাহাড়ি, বাহাদুরপুর, খনামারা , কল্যাণপুর, রাজগ্রাম, প্রভৃতি এলাকা।
এইসব এলাকায় আদিবাসী জনগোষ্ঠীর কর্মরত শ্রমিকদের বিরাট অংশ ১৫ বছর থেকে ৫০ বছর বয়সী মহিলা। সর্দি, কাশি, হাঁপানি ছাড়া সবাই রক্তাল্পতার শিকার। একটি গ্রামে একজন অসুস্থ মহিলার বাড়ীতে আমাকে নিয়ে গেল। রক্তক্ষরণে ফ্যাকাসে মহিলা, ভাল করে কথা বলতেও পারছেন না। তৎক্ষনাৎ তাকে হাসপাতালে ভর্তির ব্যবস্থা করা হল। কিন্তু যানবাহনের সমস্যা ও বাড়ীতে কোন পুরুষ মানুষ না থাকার জন্য সেদিন আর পাঠানো গেল না। মুরারইয়ে একটা গ্রামে একজন মহিলা অসুস্থ হয়ে প্রায় শয্যাশায়ী। আমি আর বন্ধু দীপক তাঁকে দেখতে গেলাম। মহিলার ডানদিক পক্ষাঘাতগ্রস্ত, পিঠের নীচে ক্ষতচিহ্ন। পরীক্ষা করে বোঝা গেল মেরুদণ্ডের কশেরুকার যক্ষ্মা হয়েছে, তার ফলে পক্ষাঘাত হয়েছে। এই ঘটনাটি আমাকে গভীর ভাবে নাড়া দেয় এই জন্য যে, এই ভদ্রমহিলা পক্ষাঘাতের আগে নিয়মিত ডাক্তার দেখিয়েছেন। তিনি যক্ষ্মারোগ বলে সন্দেহ করেছেন কিন্তু যেহেতু তাঁর কফে জীবাণু পাওয়া যায় নি তাই হাসপাতালে তিনি ওষুধ পাননি। এখন যক্ষ্মার ওষুধ দোকানে কিনতে হলে নাকি জেলা যক্ষ্মা অফিসারের অনুমতি লাগে। সরকারী নিয়মনীতি যদি মাছিমারা কেরানির মত অনুসরণ করা হয় তাহলে কি অসুবিধা হতে পারে এ তার আদর্শ উদাহরণ।
গ্রামে গঞ্জে মানসিক অসুখ খুব বেড়েছে- মূলত অনিদ্রা, হতাশা আর যৌন অক্ষমতার বেশ কিছু রোগীর সাথে কথা বলেছি। ফিটের ব্যামো আমাদের ছোটবেলায় মেয়েদের একচেটে ছিল। এবার দেখলাম সেটা তেমন নেই, তার জায়গা নিয়েছে অনিদ্রা। উচ্চ রক্তচাপজনিত সমস্যা, স্থূলতা ও ডায়াবেটিস রোগও অনেকগুলি চোখে পড়ল।
আমি সবচেয়ে বেশি দুঃখিত হয়েছি গ্রামের পুকুরগুলোকে দেখে। আগে বীরভূমের গ্রাম ছিল সত্যি ছায়া সুনিবীড় শান্তির নীড়। পুকুরের কাকচক্ষু জল ছিল চোখের শান্তি আর স্বচ্ছ সেই জল আঁজলা ভরে খাওয়াও যেত। কতদিন স্কুল থেকে ফেরার পথে কচুরিপানা আর পদ্মশোভিত পুকুরে নেমে আঁজলা ভরে জল খেয়েছি। এবার দেখলাম ঘোলাটে জলে পোকা কিলবিল করছে। বাড়িতে বাড়িতে স্যানিটারি প্রিভি, তার জল নির্গমনের নিকাশি নালার অভাবে জল বেরিয়ে জমা হচ্ছে পুকুরে। এই পোকা কিলবিল জলে ছোটরা স্নান করছে, থালা বাসনও ধোয়া চলছে।
জলবাহিত পেটের অসুখ তাই ঘরে ঘরে। গ্রামে গ্রামে গ্রাম্য চিকিৎসকের রমরমা। সেখান থেকে মুড়িমুড়কির মত ওষুধ কিনে গলাধঃকরণ চলছে। রানিটিডিন, প্যানটোপ্রাজল খাওয়া চলছে, চলছে আন্টিমাইক্রোবিয়ালের অবাধ প্রয়োগ। এই বীরভূম আমি চিনি না। আমার ছোটবেলার বীরভূম ছিল মনোরম পরিবেশ, শান্তির নিকেতন। তখনো ব্রতচ্যুত কোন মণ্ডলাধিকারী তার তিক্ত, তপ্ত জিহ্বা আর রোমশ হাত দিয়ে একে দলিত মথিত করে নি। রাজনৈতিক ও সামাজিক অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াই আর স্বাস্থ্যের অধিকার কেন সমানুপাতে বাড়ে কমে তার যেন হাতে কলম শিক্ষা দিয়ে গেল।