অরুণাচল বাবু আমার মতো এলেবেলে জুনিয়ারের লেখা পড়ে ডাক্তারদের হাতের লেখা নিয়ে একটি অপূর্ব লেখা লিখেছেন। সেই লেখা পড়তে পড়তে আমার আবার মনে পড়ল একবার এই হাতের লেখার জন্যে আমি কি বিপদে পড়তে চলেছিলাম এবং সে বিপদ এখনো কাটেনি।
সেই বিপদের কাহিনী শোনানোর আগে যারা ডাক্তার নন তাদেরকে জানানো প্রয়োজন ‘ইনজুরি রিপোর্ট’ জিনিসটা কি।
গ্রামীণ হাসপাতালের চিকিৎসকদের কাছে নিঃসন্দেহ সবচেয়ে বিরক্তিকর কাজ ইনজুরি রিপোর্ট লেখা। স্বামী স্ত্রী কে পিটিয়েছে, ভাইয়ে ভাইয়ে হাতাহাতি হয়েছে, দুই রাজনৈতিক দলের মধ্যে ঝাড় পিট হয়েছে- সবাই হাসপাতালে এসে হাজির, ইনজুরি রিপোর্ট লেখানোর জন্য। লেখার সময় চারজন আবার ডাক্তারের ঘাড়ের উপর দিয়ে উঁকি মারেন। বোঝার চেষ্টা করেন ডাক্তার কি লিখছেন। এবং একজন মাতব্বর গোছের লোক বারবার বলেন, ‘কেসটা বেশ জমাটি করে দিও হে ডাক্তার। ওই যে কি বলে না গরীব হাট ওই খান লিখে দিও।’
একটাই বাঁচোয়া উঁকি ঝুঁকি দেওয়া লোকগুলি ইংরেজি ভাষায় সড়গড় নন। ফলে সিম্পল আর গ্রিভার্স হার্টের মধ্যে পার্থক্য করতে পারেন না। ইংল্যান্ডে গ্রামের চিকিৎসকরা কি করে এই ইনজুরি কেস সামলান কে জানে? ওখানে শুনেছি সকলেই ইংরেজি জানেন।
যাই হোক, একসঙ্গে এমন আট দশটি ইনজুরি কেস আর তার সাথে দুটো অরগ্যানো ফসফরাস পয়েজনিং হাজির হলে তখন চিকিৎসকের একমাত্র লক্ষ থাকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ইনজুরি রিপোর্ট লিখে মারামারি প্রিয় ব্যক্তিদের বিদায় করা। এবং এই তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে মাঝে মাঝেই ইনজুরি রিপোর্টের হাতের লেখা হয়ে যায় দূর্বোধ্য। নানা রকম ভুল ভ্রান্তিও ঘটে। পরে সেই কেস কোর্টে উঠলেই ডাক্তার বাবু বিপদে পারেন। জজ সাহেবের প্রশ্নের মুখে পরতে হয়, ‘ডাক্তার বাবু, আপনি এটা কোন ভাষায় লিখেছেন? নিজের লেখা নিজে পড়তে পারবেন?’
অধিকাংশ চিকিৎসক গম্ভীর মুখে জবাব দেন, ‘মোটামুটি পড়তে পারব। দু’এক জায়গায় আটকে যেতে পারে, তবে পুরোটাই বুঝিয়ে বলতে পারি।’
সব সরকারি চিকিৎসকেরই কোর্টে সাক্ষ্য দেওয়ার অদ্ভুত অদ্ভুত গল্প থাকে। আমারও আছে। কিন্তু সেসব গল্প অন্য দিন। আজকে যে ঘটনা শোনাবো বলে লিখতে শুরু করেছি, সেই গল্পে ফেরত আসি।
বড়কর্তার মাত্রাতিরিক্ত প্রেম সহ্য করতে না পেরে সবে মাত্র এগারো বছরের সাধের চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছি। প্রাক্টিস জমানোর আপ্রাণ চেষ্টা করছি। এরকমই একদিন রাত আটটায় হাসপাতাল থেকে কোর্টের শমন নিয়ে নারানদা হাজির। আগামীকাল সকাল দশটায় আমাকে কান্দি কোর্টে হাজির হতে আদেশ করা হয়েছে। শমনের নিচে মধুর ভাষায় লেখা আছে সঠিক সময়ে সশরীরে হাজির না হলে আমার বিরুদ্ধে কী কী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এতো মহা জ্বালা। কান্দি কোর্ট তো পানিহাটির ঘাট নয় যে সকাল সকাল স্কুটার চালিয়ে একটু হাওয়া খেয়ে আসব। রেকর্ড বেগে রোগী দেখা শেষ করলাম। তারপর নাকে মুখে দুটো ভাত গুঁজে বেরিয়ে পড়লাম। এরমধ্যে কালকের দুটো চেম্বারে ফোন করে জানালাম রোগী দেখা ক্যান্সেল। বাড়ির চেম্বারেও অনেকের নাম লেখা। এসে হুজ্জতি করবে। তবু রোগীর হুজ্জতি সামলে নেওয়া যাবে। আইনের হুজ্জতি আমার মতো ছাপোষা ডাক্তারের পক্ষে সামলানো সম্ভব নয়।
চৌমাথা থেকে উত্তর বঙ্গের বাস ধরলাম। বাস জার্নি খারাপ লাগে না। ঘুম ঘুম চোখে রাত সাড়ে বারোটায় কৃষ্ণনগরে ধোঁয়া ওঠা ভাত খেলাম। রাত ২ টো ৫০ শে বহরমপুরে নামলাম। বহরমপুরেই আমার শ্বশুর বাড়ি। বাসস্ট্যান্ড থেকে হাঁটতে হাঁটতে শ্বশুর বাড়ি গেলাম। আমি শ্বশুর বাড়ি সাধারণত এরকম অসাধারণ সময়েই যাই। শ্বশুর শাশুড়ী দুজনেই এটা স্বাভাবিক বলে মেনে নিয়েছেন। রাত তিনটেয় আবার গরম ভাত আর মুরগীর মাংসের ঝোল খেলাম। এক রাতে তিনবার ভাত খেয়ে শুয়ে পড়লাম। চোখ বন্ধ করার সাথে সাথেই মোবাইলে এলার্ম বাজল। ভোর ছটা। ছোলার ডাল দিয়ে ফুলকো লুচি খেয়ে বেরিয়ে পড়লাম।
অনেকদিন বাদে বাদশাহি সড়ক দিয়ে যাচ্ছি। সেই টিকিট হীন, যেখানে সেখানে থামা বাস। সেই দু’পাশের ধোঁয়া পাক খেয়ে ওঠা ধানক্ষেত আর হাওর। নস্টালজিয়ায় ডুব দিতে দিতে ঘুমিয়েই পড়লাম। ঘুম ভাঙলো কান্দি পৌঁছে। নটা বাজে। প্রথমে পীযূষদার বাড়ি যাব৷ আমার খড়গ্রাম হাসপাতালের কলিগ।
অনেক দিন বাদে পীযূষদা আর কাকিমার সাথে দেখা হলো। সেখানে আবার কচুরি খেলাম। কাল রাত থেকে শুধু খাওয়ার উপরেই আছি।
সেখান থেকে সোজা কোর্টে। পি পি পীযূষদার পরিচিত। ওনার ছেলেকে পীযূষদাই দেখে।
ওনাকেই জিজ্ঞাসা করলাম, ‘কি কেস একটু বলা যাবে। খড়গ্রাম হাসপাতাল ছেড়ে গেছি আট বছর।’
উনি খুঁজে পেতে একটা কাগজ হাতে ধরিয়ে বললেন, ‘শিগগিরি একবার চোখ বুলিয়ে নিন।’
আমারই লেখা একটা ইনজুরি রিপোর্ট। অত্যন্ত জটিল লিপি। নির্ঘাৎ তখন ঘাড়ের উপর আরও গোটা দশ জন রোগী নিশ্বাস ফেলছিল।
বহু কষ্টে পাঠোদ্ধার করলাম, ২০০৯ সালের ডিসেম্বর মাসের এক শীতের সকালে রোগীর বক্তব্য অনুযায়ী একজন তার হাতে লাঠির বাড়ি মেরেছে। আমি রোগীকে পরীক্ষা করে পেয়েছি তার কবজি ফোলা। এখন মুশকিল হলো কোন কব্জি ফোলা? ডান না বাম। অনেক চেষ্টা করেও সেটা বুঝতে পারলাম না। রিস্টের আগের শব্দটায় কাটাকাটি করেছি। রাইট না লেফট বোঝা যাচ্ছে না।
আমি এক্সপার্ট ওপিনিয়ন দিতে এসেছি। সেখানে যদি রাইট লেফট বলতে না পারি বা ভুল বলি বিবাদী পক্ষের আইনজীবী আমাকে ছিড়ে খাবেন।
কি করা যায়? কাগজ ফেরত দিয়ে কোর্টের বারান্দায় হাঁটাহাঁটি করছি, এমন সময় একজন ডাকলেন, ‘আরে আপনি খড়গ্রাম হাসপাতালের ডাক্তারবাবু ছিলেন না?’
বললাম, ‘হ্যাঁ, কিন্তু আপনাকে তো ঠিক চিনলাম না।’
উনি বললেন, ‘আপনি যে কেসের সাক্ষী দিতে এসেছেন আমি সেই কেসের আসামী। চলুন ডাক্তারবাবু, আপনাকে চা সিগারেট খাওয়াই।’
সরকারি সাক্ষী হয়ে আসামীর পয়সায় চা সিগারেট খাওয়া উচিৎ হবে না। কিন্তু আমার একটা প্রশ্নের উত্তর জানা দরকার। আমতা আমতা করে বললাম, ‘ইয়ে… সিগারেট আমি ছেড়ে দিয়েছি। আচ্ছা, আপনার কি সেদিনের ঘটনার কথা মনে আছে?’
‘কোন ঘটনা?’
‘যে ঘটনার জন্য আপনি আসামী। মনে আছে লাঠির বাড়িটা আপনি লোকটার কোন হাতে মেরেছিলেন।’
‘ন’বছর আগের ঘটনা!! মনে থাকে নাকি!! তাছাড়া লাঠি চালানোর সময় কেউ খেয়াল রাখে নাকি কোথায় মারলাম!! আমি এরকম একাধিক কেসের আসামী। এই কেসটার কথা ভুলেই গেছিলাম।’
খানিকক্ষণ থেমে আসামী ফোঁস করে নিশ্বাস ফেললেন। বললেন, ‘সুখ নাই, বুঝলেন ডাক্তারবাবু। বয়স বাড়ছে। আর কোর্টে হাজিরা দিতে ভালো লাগে না। কেস ফেস উঠে যাবে এই আশায় দাদা পাল্টালাম। কোথায় কি? মেয়ের বিয়ের বয়স হচ্ছে। এসময় জেল টেল হয়ে গেলে সমস্যায় পড়ব।’
না, এর সাথে বকবক করে লাভ নেই।
বারান্দার কোনে একজন গুটিসুটি মেরে বসে ছিলেন। তাঁর সামনে দাড়াতেই বললেন, ‘বুঝলেন ডাক্তার বাবু, এই দুনিয়া টাকা আর ক্ষমতার বশ।’
আমি বললাম, ‘আপনিও আমাকে চেনেন?’
‘আমি খড়গ্রামের মানুষ। আর খড়গ্রাম হাসপাতালের ভৌমিক ডাক্তারকে চিনব না। তবে ডাক্তার বাবু, আমি বড় আশাহত হলাম।’
‘কি জন্য আশাহত?’
‘আপনি আমার পক্ষের সাক্ষী। আর আসামীর সাথে এতক্ষণ আলাপ করলেন। ও ব্যাটা চিটিংবাজ। ওর কোনো কথা বিশ্বাস করবেন না। আপনাকে কতো দেবে বলছিল?’
মানে? আমি একই সাথে বিস্মিত ও অপমানিত বোধ করলাম। কড়া গলায় বললাম, ‘আমাদের টাকা পয়সা নিয়ে কোনো কথা হয়নি।’
না হলেই ভালো। লোকটি পিত্তি জ্বালানো একটা হাসি দিলেন। বললেন, বুঝলেন মশাই দশ বছর ধরে কেস চালাচ্ছি। আমি এর শেষ দেখে ছাড়বো। চলেন আপনাকে চা সিগারেট খাওয়াই।
এনাকে কি ভাবে কাটাবো ভাবছিলাম। কারণ লক্ষ করেছি আসামী একদৃষ্টিতে আমাদের দেখছেন। তবে তার আগে জেনে নেওয়া দরকার এনার কোন হাতে লেগেছিলো।
এমন সময় পি পি বেরিয়ে এলেন। বললেন, ডাক্তার ভৌমিক। আজকে আর কেস উঠবে না। বিচারপতি ম্যাডামের ছেলে খুব অসুস্থ। ছেলেকে নিয়ে উনি পীযূষবাবুর কাছেই গেছেন। পরের ডেট ঠিক হলে আমি জানিয়ে দেব।
দেখলাম লোকটির আমাকে চা সিগারেট খাওয়ানোর আর ইচ্ছে নেই। তিনি অত্যন্ত বিরক্ত মুখে বিড়বিড় করতে করতে হাটা লাগালেন। আমাকে প্রশ্ন করার আর কোনো সুযোগ দিলেন না।
পি পি ভদ্রলোককে বললাম, পরের বার কেস ওঠার কদিন আগে যদি জানানো যায়। একেবারে শেষ মুহূর্তে জানলে অতদূর থেকে আসতে বড্ড সমস্যা হয়।
উনি বললেন, ঠিক আছে, আপনি ফোন নাম্বার দিয়ে যান। আজই ডেট পাওয়া যাবে। আমি ফোন করে জানিয়ে দেব।
সেদিনই পি পি ভদ্রলোক ফোন করেছিলেন। জানুয়ারির ৩০ তারিখ পরের ডেট। ঘটনাক্রমে সেটা সরস্বতী পুজোর পরের দিন। সে যাত্রা দায়িত্ব নিয়ে মাননীয় মুখ্যমন্ত্রী আমাকে বাঁচিয়ে দিলেন। সরস্বতী পুজোয় দুদিন ছুটি ঘোষণা করে দিলেন।
তারপর তো করোনা চলে এলো। অবস্থা আস্তে আস্তে স্বাভাবিক হচ্ছে। আবার যে কোনো দিন শমন হাতে পাব। আবার সেই ডান বামের চক্করে পরব।