শুনবেন?
শ্যামাপোকা! মায়ের পবিত্র কীট কুল –! — টিউবলাইটের ঠিক নীচে বসে রুগীর ডিসচার্জ সার্টিফিকেট লিখছি — কুট্টুসসসস — !!! হালার কাজকাম নাই – দুতিনটা ”দেবীপোকা” – জামাগেঞ্জী ফুঁড়ে পিঠ-কামড় লাগালো! উর্ধাংগ বিবসন হয়ে স্টীলের একটা স্কেল দিয়ে চুলকে চুলকে ওহ! খসড় খসড়ড়ড় — চুলকে যাচ্ছি তো যাচ্ছিই!! সব্বাই হাসছে আর আমি “বিকৃত করিয়া মুখ ……”!
ঠিক তখনই মনপাখিটা স্মৃতির পাখনা মেলে উড়ে গেল মালদা জেলার এক হেলথ সেন্টারে – “বেদ্রাবাদ প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র” আমার ভালবাসা – চিকিৎসার প্রতি আমার প্রথম প্রেম – আর উর্ধাংগ বিবসন হয়ে অদ্ভুত এক অপারেশন ……
ফারাক্কা ব্যারেজ পেরিয়ে এন এইচ থার্টি ফোর ধরে মালদা জেলার দিকে পাঁচ ছ কিলোমিটার – আঠারো মাইল মোর! তার ডান হাতি আট ন’ কিলোমিটার সরু পিচরাস্তা — টাংগায় চড়ে মুস্লিম সাম্রাজ্যের মধ্যে লেঠেল ঘোষ ঘেরা গাঁ … বৈষ্ণবনগর!
স্বাস্থ্যকেন্দ্রের নাম – “বেদ্রাবাদ”! আমার কোয়ার্টারের পেছনের পাঁচিলের পাশ দিয়ে মেঠোপথ ধরে – বাংলাদেশ! কাঁটাতারহীন!! ওদেশের লোকজন আমাদের আউটডোরে এসে ওষুধ নিয়ে যায়! শচীনকত্তা এ জিনিষ দেখলে কক্ষোনো গাইতেন না – “কে যাস রে ভাটি গাং বাইয়া ……ভাইয়ের দেখা পাইলাম না পাইলাম না”…
কোথায় হায়দ্রাবাদ সেকেন্দ্রাবাদ – আর কোথায় আধাআধি বাংলাদেশের আঁচলে থাকা – আঁধার – ঘুটঘুট্টি বেদ্রাবাদ! — “বিঘেদুই জমি”-র ওপর ছোট্ট সাড়েপাঁচ ঘরের হলদেটে একটা বাড়ি‚ বারোটা বেড! স্বাস্থ্যকেন্দ্র ……
ঘন আর বিশাল উঁচু উঁচু বাঁশবন শাল শিমুল কাঁঠাল তেঁতুল নিমগাছের অন্ধকারে ঢাকা গ্রামীণ ধুলোমাখা চিকিৎসাকেন্দ্র – প্রথম পাঁচ-ছ’ দিনতো আমার কলকাতার ভবানীপুরের বৌ বিস্ফারিত চোখ আর আফ্রিকামার্কা এই জায়গায় আদৌ থাকা সম্ভব কিনা – সেই চিন্তায় এক্কেরে কোল্যাপ্স মেরে বিল্কুল থম! থাইরয়েড রুগীর মতো তিরতির–! ভাবলাম পালাই – সব ছেড়ে প্রাইভেট প্র্যাকটিস শুরু করি!
স্টাফ আর সাফাই কর্মিদের বলে কোয়ার্টারে আলো আর জলের মোটামুটি একটা চেহারা দেওয়া গেল – কিন্তু ওসবে কি শহুরে বৌ সামলানো যায়?— 🙂 🙂
সত্যিই যেত না! — সম্ভব হয়েছিল প্রথম রাতেই দুটো বিষ খাওয়া রুগী (ওখানে বলে “তেলবিষ” – জমিতে সার হিসাবে ব্যবহার হয় – ভীষণ কড়া বিষ) আর একটা সাপে কাটা রুগী! এছাড়া রাতদুপুরেও বিরামহীন রুগী — আমার প্রেমের বেদ্রাবাদ! সেই প্রথম হ্যারিসন খোলানো‚ কান ধরে বই ছেড়ে বাস্তবের মাটিতে নামানো বেদ্রাবাদ ……!
প্রথম চার-পাঁচ দিন ও রাত ইনচার্জ মেডিক্যাল অফিসার (বিএমওএইচ) আমাকে দেখেই শহরে কাট —-! আফ্রিকার জংগলে আমি একা ডাক্তার আর পাগল হতে বসা আমার ইসতিরী– আর ওখানকার ভাষা? ওরেব্বাস!! আমার মালদা শহরেই জন্ম বেড়ে ওঠা – বন্ধু-বান্ধব মা-বাবা ভাই-বোন আত্মীয়স্বজন! শহর থেকেই শুনতাম – কালিয়াচকের ভাষা নিয়ে রিসার্চ করে অনেকেই নাকি পিএইচডি ডিলিট এসব ফাটিয়েছেন!!!
“কুন্ঠে যেছিস বে?” – মানে কোথায় যাচ্ছিস রে?
— “ডাক্তার উপরে বহেছে নীচে ভি বহেছে – দোনো দিকে বহে চলে যেচ্ছে” — দ্রুতগতিতে এসব বললে বোঝা সম্ভব? মানে ডায়েরিয়া – বমি আর পায়খানা – উপরে- মানে বমি‚ নীচে – মানে পায়খানা বইছে ! একই সাথে! 🙂 🙂
আমরি বাংলা ভাষা! আহা – কি তার মাধুর্য আহা!
আসল গল্পে যাই … ফেনালাম অনেক্ষন!
সেদিন সন্ধ্যেরাত থেকেই দিকবিদিক অন্ধকার করে বৃষ্টি! আসমুদ্রচরাচর অন্ধকার! ওইরকম অঝোরে বৃষ্টি আমি খুব কমই দেখেছি আজ পর্যন্ত|একনাগাড়ে ঝড় ও তুমুল বৃষ্টি – চলছে তো চলছেই …………!
রাত তিন সাড়ে তিনটা – কোয়ার্টার আর বাইরের মাঠ রাস্তাঘাট হাঁটুসমান জলে ভাসছে — ঘি ভাত আর পাঁপর ভাজা খেয়ে চৌকিতে বসে একটু ফুঁকছি! লন্ঠনের মৃদু আলোয় ঘুম – নিরুদ্দেশ!
বাইরে সোঁসোঁসোঁসো অবিরাম আওয়াজ আর দার্জিলিং মেলের মতো ঝমঝম শব্দ!
— দরজায় খটখট! “ডাক্তারবাবু ও ডাক্তারবাবু” -! অনেক্ষণ পরে সেটা কানে ঢুকলো!
দুটো ছাতা আর দুটো টর্চ নিয়ে লালাদা একহাটু জলে – জবজবে ভিজে দাঁড়িয়ে! লালাদা– স্বাস্থ্যকর্মী নন কিন্তু বি এম ও এইচ সাহেব মানে ডক্টর রায়ের রামভক্ত লক্ষণ ভাইটি!
– কী ব্যাপার লালাদা? এই বৃষ্টিতে?
– ওই দ্যাহন – রায়বাবু (ডাঃ রায়) আপনাকে ডাইকছেগো! আহেন! একটা পেশেন্ট – আক্ষুনি অপারেশন না কইরলে মইরবেই এবরে সিওর! ওই দ্যাহন রায়বাবু আপ্নাকে ডাইকছে!
ঘুরঘুট্টি অন্ধকারের মধ্যে স্বাস্থ্যকেন্দ্রের বাড়ি – প্রায় তিনশো ফুট দুর থেকে – একটা উজ্জ্বল টর্চের আলো উঠেছে আর নামছে – যার মানে “কাম হিয়ার” আর পাশাপাশি নাড়ালে মানে হচ্চে দূরে যাও / যান! গো এওয়ে! জলে সেই আলো বিম্বিত হচ্ছে –!
হাটু জল ঠেলেঠেলে ছাতার নীচেই ভিজে কাক হয়ে পৌঁছে দেখি একরুগিণী! রায়দা স্যলাইন চালিয়ে রেখেছেন – চারিদিকে ষাট সত্তর জন লোক – প্রায় প্রত্যেকের হাতেই ছ আট ব্যাটারির টর্চ জ্বলছে – বেশ উজ্জ্বল আলো!
দেখোতো কি হতে পারে কেসটা? রায়দা আমায় বল্লেন!
দেখেশুনে বললাম — রাপচার্ড ইউটেরাস (জরায়ু ফেটে গ্যাছে ) – রায়দা খুব খারাপ অবস্থা!”
“– হুমমমম – আগে সীজার অপারেশন করে বাচ্চা হয়েছিল -এবার ব্যথা ওঠার পরে বৃষ্টিতে শহরে যেতে পারেনি বেচারা! ন্যাশনাল হাইওয়েও তিনফুট জলের নীচে! কপাল দেখো অমিতাভ ও হচ্ছে তুবীর বৌ আর তুবী আমার এখানকার বন্ধু! তুবী নিজেই গাড়ি চালায়! আজ নিজের বৌকে শহরের হাসপাতালে নিয়ে যাবার উপায় নেই” – একনিশ্বাসে ডাঃ রায় বল্লেন
“তাহলে?”
— “যা করার এখানেই করতে হবে” – রায়দা বল্লেন
— “এখানে কি করবে?”
— “কেন তুমিতো স্পেশালিস্ট – পারবেনা কিছু করতে? লাইগেশন আর হাইড্রোসিল এসব আমি করি জানোনা! সেসব যন্ত্রপাতি দিয়ে পারবেনা?”
বাব্বা একি বলেরে রায়দা! একে রুগী প্রায় শকে
তার ওপর এই আধুরা গাঁয়ে পেটকেটে এমারজেন্সি সাবটোটাল হিস্টেরেকটমি? পাগল নাকি?
—“শোনো অমিতাভ – আমি প্রায়ই হাইড্রোসিল হার্নিয়া আর লাইগেশন অপারেশন করি, তুমি নতুন জানো না হয়তো! ক্যটগাট (সুতো) আছে তবে যন্ত্রপাতি অতটা হয়তো নেই! কিছু না করলে তো এমনিতেই সবশেষ” স্টেরয়েড আর হিমাকসিল নামক বিশেষ জীবনদায়ী স্যলাইন দিতে দিতে ভাবলেশহীন বলে যাচ্ছিল রায়দা! এগারো বছর এখানে একাই রাজত্ব করছেন উনি! অন্য কোনো ডাক্তারকে জয়েন করতে দেননি আজ পর্যন্ত! নিজেই বলেন সেকথা!
আমি যে কি ভাবে এসেছি সেই লড়াইয়ের গপ্পো পরে হবে!
ছোট্ট একটা লাইগেশন ওটি আছে মহিলাদের বন্ধ্যাত্বকরণ অপারেশনের জন্যে আর লোহার নড়বড়ে একটা ওটি টেবিল! ছোট্ট ড্রামে লালা যন্ত্রপাতি গজ ফুটিয়ে জীবাণুমুক্ত করে! মায় ইথার (এখন অমিল) দিয়ে অজ্ঞান করতে পারে!
– “ডাক্তারবাবু একঘন্টায় হবে না?” লালা জিজ্ঞেস করলো!
আরে এরা কি সত্যিই জলভাত ভাবছে নাকি এইসব অপারেশনকে?
-“দাদা তুমিই করো! আমার দ্বারা এই জায়গায় এই পরিস্থিতিতে অসম্ভব” – বল্লাম!
হঠাৎই পায়ে কারুর হাত – “ডাক্তার পারলে আমার বৌটাকে বাঁচিয়ে দাও” তুবী দুইহাত দিয়ে আমার পা জড়িয়ে ধরেছে! – কিযে করি?
-“তুমি হাই রিস্ক বন্ড মার্কা শহুরে নিয়মকানুন নিয়ে ভেবোনা অমিতাভ – তুবী জেনেই গ্যাছে ওর বৌ উপরে যাচ্ছে “! রায়দা বলে উঠলেন!
–“কিন্তু লাইট?”
বলতেই সেই জনসমুদ্র চেঁচিয়ে উঠল – “আরে ডাক্তার এত্তগুলান টর্চ আছে গো – হবে না?”
নাহ! সত্যিইতো হাত না লাগলে রুগীণীর মৃত্যু নিশ্চিত!
একঘর লোক টর্চ ধরে আছেন! অপারেশন শুরুর আগে ডাঃ রায় বলে উঠলেন – “আমিই ডানদিকে দাঁড়াবো”- সব্বার সামনে বামদিকে দাঁড়ালে উনার এগারো বছরের জমানো পেস্টিজ মাঠে মারা যাবে আরকি!
-“দাদা এখন আর সময় নেই! ওদিকে না দাঁড়ালে আমি হাতই তো দিতে পারবোনা”
ঘরভর্তি লোকজন চেঁচিয়ে উঠল – “লয়া ডাক্তারকে ডেকি আনলি ক্যানে তবে?”
নর্মান বেথুন আর বি এন সি (আমার স্যার)-কে স্মরণ করে যা থাকে কপালে ভেবে এবডোমেন ওপেন করলাম! ঘন্টা দেড়েক ধরে অর্ধমৃতা রুগিণীর পেট থেকে চাপচাপ রক্ত‚ একটি মৃত শিশুকে বের করে ছিন্নভিন্ন জরায়ুটা বাদ দিলাম – ভেতরকার রক্তক্ষরণ বন্ধ করে অপারেশন শেষ করলাম ……!
বাইরের পেরিটোনিয়াম আর চামড়া সেলাইটার সময়ে বাঁদিকে দাঁড়িয়ে দাদার সম্মান আর নিজের ক্লান্তি রক্ষা করলাম! বাইরে ততক্ষণে ভোরের আলো ফুটে উঠেছে-
তুবীর বৌ বেঁচে গ্যালো!
পরদিন সকালে মোটামুটি স্টেবল অবস্থা- তাও দুপুর নাগাদ – জল নেমে যাবার পরে সদর হাসপাতালে (এখন মেডিক্যাল কলেজ) রেফার করা হলো!
দুইদিন পর খোঁজ নিতে গিয়ে দেখি পেটটা ঢাউস ফোলা – রক্তশূন্যতা নেই! বিমানদাকে (ডিসট্রিক্টের স্পেশালিস্ট) জানতে চাইলাম! কি ব্যাপার গো?
-“চাদ্দিকে অনেক শ্যামা পোকা উড়ছিলো নারে? শালার পোকা পেরিটোনাইটিস জীবনে প্রথম দেখলাম! এই দ্যাখ এক্সরে প্লেটে পোকা গিজগিজ কচ্ছে”!
CMOH ডেকে পাঠিয়ে বল্লেন – ” মরতো মরতো! তোমায় কে দিব্ব্যিbদিলো যে হাত লাগাতেই হবে??”