যেহেতু বাল্যবিবাহ আর বহুবিবাহ তৎকালীন সমাজের দুটি অনপনেয় কলঙ্ক; তাই ইয়াং বেঙ্গলের জীবিত সদস্যরা বঙ্গদেশে মুক্তির আলোকবর্তিকা হিসেবে এই দুই কুৎসিত প্রথার বিরুদ্ধে কলম ধরলেন। এঁদের মধ্যে বিশেষ উল্লেখ্য প্যারীচাঁদ মিত্রের নাম তিনি তাঁর ক্ষুরধার যুক্তি, অসামান্য শাস্ত্রজ্ঞান এবং তীক্ষ্ণ লেখনীতে ব্রাহ্মণ্যবাদকে ছিন্নভিন্ন করে দিলেন। ১৮৫০ সনে (পাঠিকা লক্ষ্য করুন এই সময়েই আমার ঈশ্বর পায়ে হেঁটে গোটা বঙ্গদেশ ঘুরে ঘুরে স্ত্রীশিক্ষার প্রসারে ব্যস্ত) দি বেঙ্গল স্পেক্টেটর নামক পত্রিকায় বেনামে কিছু লেখা প্রকাশিত হয়। প্যারীচাঁদ লিখছিলেন শাস্ত্র এবং আধুনিকতার আলোকে। এই নামহীন লেখক নিয়ে এলেন লোকাচার, সমাজনীতি এবং মানবিক স্পর্শ, সঙ্গে অবশ্যই ছিলো অসাধারণ শাস্ত্রজ্ঞান। ইয়াং বেঙ্গল সদস্যরা, বিশেষতঃ শাস্ত্র বচন নিয়ে কূপমন্ডুক বাঙালি সমাজকে ছিন্নভিন্ন করছিলেন। এই ব্যক্তি নিয়ে এলো লোকাচার। গেঁয়ো, টুলো এই পন্ডিত জানতো যে সাধারণ ব্যক্তি অধিক শাস্ত্র পড়ে নাই; যা চলে সেটা শুধুই লোকাচার (ভ্রাতা শম্ভুচন্দ্র বিদ্যারত্নের লেখায় প্রমাণিত নামহীন লেখক আর কেউ না, ছিলো আমার ঈশ্বর)।
এই প্রসঙ্গে কেশবচন্দ্র সেনের নামোল্লেখ না করলে ইতিহাস বিকৃত করা হয়। কেশবচন্দ্র প্রথম নিজের স্ত্রীকে মুক্ত, খোলা রাস্তায় নিয়ে নেমে এলেন। গোঁড়া ধার্মিকের দল রে রে করে উঠলো। কিন্তু কেশবচন্দ্র অদম্য। এর পর আমাদের ঈশ্বর তত্ত্ববোধিনীতে শাস্ত্র, লোকাচার এবং মানবতা মিশ্রিত লেখা প্রকাশ করেন। বলা যেতে পারে সেই প্রথম নারীর যৌন অধিকার এবং গর্ভপাত বিষয়ে বঙ্গদেশে প্রথম প্রকাশ্য বিবৃতি এলো। ঈশ্বর লিখেছিলো মনুষ্যজাতির স্বাভাবিক প্রবৃত্তি অনুসারে অল্পবয়সী বিধবাদিগেরও গর্ভসঞ্চার হতে পারে। তখন তাহাদিগের জন্য আত্মহত্যা ব্যতীত পথ থাকে না। সুতরাং গর্ভপাত আইনসঙ্গত হৌক।
”সকল সুখের মূল যে শারীরিক স্বাস্থ্য, তাহাও বাল্যপ্রণয়প্রযুক্ত ক্ষয় পায়।”
“অপ্রমত্ত শারীরতত্ত্বাভিজ্ঞ বিজ্ঞ ভিষগ্বর্গেরা কহিয়াছেন, অনতীতশৈশব জায়াপতিসম্পর্কে যে সন্তানের উৎপত্তি হয়, তাহার গর্ভবাসেই প্রায় বিপত্তি ঘটে, যদি প্রাণবিশিষ্ট হইয়া ভূমিষ্ঠ হয়, তাহাকে আর ধাত্রীর অঙ্কশয্যাশায়ী হইতে না হইয়া অনতিবিলম্বেই ভূতধাত্রীর গর্ভশায়ী হইতে হয়। কথঞ্চিৎ যদি জনক-জননীর ভাগ্যবলে সেই বালক লোকসংখ্যার অঙ্ক বৃদ্ধি করিতে সমর্থ হয়, কিন্তু স্বভাবতঃ শরীরের দৌর্বল্য ও সর্বদা পীড়ার প্রাবল্যপ্রযুক্ত সংসারযাত্রার অকিঞ্চিৎকর পাত্র হইয়া অল্পকালমধ্যেই পরত্র প্রস্থিত হয়। সুতরাং যে সন্তানোৎপত্তিফলনিমিত্ত দাম্পত্য সম্বন্ধের নির্বন্ধ হইয়াছে, বাল্যপরিণয় দ্বারা সেই ফলের এই প্রকার বিড়ম্বনা সঙ্ঘটন হইয়া থাকে।”
“এতদ্দেশে যদ্যপি স্ত্রীজাতির বিদ্যাশিক্ষার প্রথা প্রচলিত থাকিত, তবে অস্মদেশীয় বালক-বালিকারা মাতৃসন্নিধান হইতেও সদুপদেশ পাইয়া অল্প বয়সেই কৃতবিদ্য হইতে পারিত।”
“বিধবা নারী অজ্ঞানবশতঃ কখন কখন সতীত্ব ধর্মকেও বিস্মৃত হইয়া বিপথগামিনী হইতে পারে, এবং লোকাপবাদভয়ে ভ্রূণহত্যা প্রভৃতি অতি বিগর্হিত পাপকার্য সম্পাদনেও প্রবৃত্ত হইতে পারে। অতএব অল্প বয়সে যে বৈধব্যদশা উপস্থিত হয়, বাল্যবিবাহই তার মুখ্য কারণ। সুতরাং বাল্যকালে বিবাহ দেওয়া অতিশয় নির্দয় ও নৃশংসের কর্ম।”
(বিবাহকেন্দ্রিক নানা কুপ্রথার বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন সংগঠিত করার লক্ষে ১৮৫০ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত হয় সর্ব্বশুভকরী সভা। এই সভার মুখপত্র ‘সর্ব্বশুভকরী’ পত্রিকার প্রথম সংখ্যায় ‘বাল্যবিবাহের দোষ’ প্রবন্ধটি প্রকাশিত হয়। বানান ও যতিচিহ্ন অপরিবর্তিত।)
নিতান্ত প্ররোচিত হয়েই ঈশ্বরের এই লেখাটির অংশবিশেষ প্রকাশ করলাম।
বলা বাহুল্য ধর্মানুরাগী ব্যক্তিরা এবং ধর্মের ধ্বজাধারীরা বক্তব্যের তীব্রতম প্রতিবাদ জানালো।
আমাদের ধর্মপরিব্রাজক বিবেকানন্দ বললেন ”একথাও আমি অস্বীকার করতে পারি না যে বাল্যবিবাহ হিন্দু জাতিকে পবিত্রতায় ভূষিত করেছে”(১৫ই অক্টোবর ১৮৯৬;বাণী ও রচনা, দ্বিতীয় খন্ড;১৩৬৭-৬৮পৃষ্ঠা)
অথবা “প্রণয়বৃত্তি জাগ্রত হওয়ার পূর্বে বাল্যকালে বিবাহ দেওয়া ভালো”( ভারতীয় নারী,উদ্বোধন,পৃষ্ঠা পনেরো, উদ্ধৃতিটি বৃহদাকার, তাই এক্ষেত্রেও অংশবিশেষ দিলাম, কেউ চাইলে সম্পূর্ণ উদ্ধৃতি মূল রচনায় দেখে নিতে পারেন)
“হিন্দু নারীর জীবনের তার প্রধান ভাব তার সতিত্ব;পত্নী যেন বৃত্তের কেন্দ্র-ঐ কেন্দ্রের স্থিরতা নির্ভর করে তার সতিত্বের ওপর।ঐ আদর্শের চরম অবস্থায় নারীরা সহমরণে দগ্ধ হতেন”(বাণী ও রচনা,১ম খন্ড,প্রাচ্য নারী;পৃষ্ঠা৫৭,বানান এবং ভাষা অবিকৃত)
অধিক বলবো না।শুধু হে ধৈর্যশীলা পাঠিকা, আর একটিমাত্র সম্পূর্ণ উদ্ধৃতি “জগতের চোখে সহমরণ এত বড়ো প্রথা কেন-কেননা ওতে ইচ্ছাশক্তির বিকাশ হয় (ভগিনী নিবেদিতা,স্বামীজিকে যেরূপ দেখিয়াছি;পৃষ্ঠা ১৮৩)
সুতরাং তৎকালে ধর্ম এই সকল সংস্কারের বিরুদ্ধে কতো খড়গহস্ত হয়েছিলো, সেটা সহজেই অনুমেয়। প্রাগুক্ত সময়ে জনৈক হরি মাইতির নাবালিকা বধূ ফুলমণি সহবাসজনিত রক্তপাতে প্রাণত্যাগ করে। সমাজ আলোড়িত হয়।ফুলমণি একক নয়, প্রথমও নয়, অন্তিমও নয়। বহু ফুলমণির মৃত্যুতে অবশেষে মহামান্য সরকার বাহাদুর বাধ্য হয়ে বিবাহের নিম্নতম বয়সসম্বলিত একটি আইন প্রণয়ন করেন। ঈশ্বর এবং ইয়াং বেঙ্গলের বহু তদ্বির, আবেদন সত্ত্বেও বিবাহের নিম্নতম বয়স ১৪ বৎসর না ধরে’ দশ বছরকে সীমারেখা ধরে’ ১৮৬০ সনে ইংরাজ সরকার ইন্ডিয়ান পেনাল কোড (এজ অভ কনসেন্ট) চালু করেন।
পাঠিকা শুধুমাত্র কল্পনা করুন ফুলশয্যান্তে প্রভাতে একটি অষ্টমবর্ষীয়া বালিকার মাতৃস্থানীয়া আত্মীয়রা শয্যাপরীক্ষা করে রক্তচিহ্ন দ্বারা দেখছেন, সে তার প্রাপ্তবয়স্ক স্বামীসহবাসে যথেষ্ট ধর্ষিতা হয়েছে কিনা (গৌরীদান অষ্টম বৎসরে হতো এবং মনুসংহিতার বিধানও এটাই); কিম্বা একটি বালিকা প্রথম রজঃস্বলা হচ্ছে একটি অচেনা, অপরিচিত পরিবারে। এই নিষ্ঠুরতম প্রথা কিন্তু সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হয়নি; দরিদ্র, অশিক্ষিত বহু বাঙালির ঘরে আজও এরূপ ঘটে।হয়তো বয়সটা এখন বারো বা চৌদ্দ হয়েছে। নারীশিক্ষার বা সার্বিকভাবে শিক্ষার অভাব এখনও এই সব প্রথা সর্বসমক্ষে বাঁচিয়ে রেখেছে। আমার ঈশ্বর এই ভারতে ব্যর্থ। তৎকালে হিন্দু সমাজকে অসন্তুষ্ট করে বহুবিবাহ নিবারণী কোনও আইন আনা সম্ভব হলো না। কেবলমাত্র ঈশ্বর বা তার সমমনা কেউ কোনও বিবাহানুষ্ঠানে গেলে এক টাকার সরকারি কাগজে দম্পতিকে দিয়ে দস্তখত করিয়ে নিতো যে একজন জীবিত থাকতে অন্যজন বিবাহ করবে না; রীতিমতো চারজনকে সাক্ষী রেখে এই আইনি কার্য সমাধা হতো (কুলীন প্রথার উদাহরণ শ্রীভোলানাথ বন্দ্যোপাধ্যায় বয়স ৫৮, স্ত্রী সংখ্যা ৮০; ভগবান চট্টপাধ্যায় ৬২, স্ত্রী সংখ্যা ৭২; মধুসূদন মুখোপাধ্যায় ৪২,স্ত্রী সংখ্যা ৫৬, কৌলীন্য প্রথার ভয়াবহ উদাহরণ)।
সতীদাহ আইন ছিলো নিবারণমূলক আইন; ভঙ্গ করলে শাস্তি হতো। ভীরু বাঙালি কখনোই আইন ভাঙবার সাহস পায় না। তাই ঐ আইন দ্রুত বলবৎ হয়। ঐ একই ভীরুতা হেতু ইংরাজের বিরুদ্ধে ভারতে কোনও স্বাধীনতা আন্দোলন বৃহত্তর রূপ নিতে পারে নি (সিপাহী বিদ্রোহ ব্যতিরকে, উহাতেও ধর্মীয় উদ্দীপনা অস্বীকার্য নয়)। পদরেণু লেহনে ব্যস্ত বাঙালি সর্বদা আপনার তাৎক্ষণিক, ক্ষুদ্র স্বার্থের বশবর্তী হয়ে কাজ করেছে। বিজ্ঞানচেতনা, আত্মসম্মান এবং ন্যায় অন্যায়বোধ সকলই চিরকাল বাঙালির ব্যক্তিস্বার্থকেন্দ্রিক; “সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলছে”।সেই জন্যই আমার ঈশ্বর একাকী,আমার ঈশ্বর নিঃসঙ্গ, ঈশ্বর পরিত্যক্ত। এতদৃশ আত্মহীন ঈশ্বর, অবিশ্বাসী ঈশ্বর সমাজ পরিত্যক্ত হয়েই একাকী নিঃসঙ্গ অন্তিম জীবন যাপন করে (কর্মাটাঁড়, প্রথম সর্গ)।
সঙ্কুচিতং মম নিবেদনমিতি ঈশ্বরস্য বর্ণনায়ৈ দশমঞ্চ সর্গস্য আবশ্যকতানুভূতম।